মিলির সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমার একজন ভালোবাসার মানুষ ছিল। আর এই ব্যাপারটা মিলি জানে। কিন্তু তারপরও কেন আমাকে বিয়ে করলো এ বিষয়টা আমি বুঝি না। আমাকে ফোন করে ও চুপ করে থাকলো কিছুক্ষন। আমি বললাম “কিছু বলবেন?” সে আরও একটু সময় নিয়ে বললো “আমার মন খুব খারাপ। মনে হয় এখনি কেঁদে দিব। আপনি কি আমায় বকা দিবেন?” আমি ওর হঠাৎ এমন কথা শুনে বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে। সাধারণত ও এমন করে কথা বলে না। কিছু একটা হলেই এমন করে বলে। আমি বললাম “আপনাকে আমি কেন বকা দিব?” সে একটু ইতস্তত হয়ে বললো “আমি না একটা ভুল করেছি। বিশ্বাস করেন আমি ভুলটা ইচ্ছা করে করিনি। আপনি আমায় বকবেন নাতো?” আমি মোবাইলটা কানে রেখে পিসির দিকে তাকাই। আজকে একদম আমার কাজ করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু চাকরি বলে কথা।
আমার ইচ্ছার উপর কোন কিছুই নির্ভর করে না। আমি বললাম “কি ভুল করেছেন?” সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “আমি আজ তরকারিতে লবন দিয়ে ফেলছি বেশি। আমি তো এমন ভুল করিনা। আজ কি হলো কিছুই বুঝতে পারছি না। রান্না কেমন হয়েছে একটু মুখে দিয়ে যখন দেখলাম তখনি বুঝতে পেরেছি। একদম মুখে দেওয়া যায় না। আর কিছুক্ষন পর তো আপনি বাসায় আসবেন। আপনাকে আমি কি খেতে দিব?” আমি চুপ করে ভাবি ওকে এখন আমার কি বলা উচিৎ? মেয়েটা একদম সহজ সরল। আজকে অফিসে আসার আগে বলেছিলাম দুপুরে বাসায় একেবারেই চলে আসবো। এসেই আপনার সাথে খাবো ঠিকাছে?” ও কিছু বলেনি। আমি শুধু ওর চেহারাটা ছোট বাচ্চাদের মত হয়ে যেতে দেখলাম। কি ফুটফুটে একটা হাসি দিয়েছিল। ও খুব ভালো রান্না করে। মুলত ওর রান্না করা খাবার খেয়েই আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম ওকে বিয়ে করতে। কিন্তু ও আমাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল এটা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
এই বিয়ে করা গল্পটা না হয় পরে বলছি। কিন্তু মাঝে মাঝে আমি রেগে যাই। যদিও আমি কখনো বকা দেই না। আমি ওকে বললাম “কোন সমস্যা নেই। আমি এখন রাখি হ্যাঁ?” ও শুধু বললো “আচ্ছা। সাবধানে আসবেন।” আামি ফোনটা রেখে কিছুক্ষন চুপ করে থাকি। এই রকম ছোট খাটো ভুল ও প্রায় করে। কিন্তু আমি এগুলাকে ভুল মনে করি না। যখনি কোন ভুল কিছু করে ফেলে আমি ওকে অনেক অনুতপ্ত হতে দেখি। এই অনুতপ্ত হওয়াটা আমার ভালো লাগে না। একদম নিষ্পাপ বাচ্চাদের মত মায়ামায়া ভঙিতে এই ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। আমি সচরাচর তেমন একটা রাগিও না। কিন্তু যখন রেগে যাই তখন নিজেও বুঝতে পারি না আমি কেন এমনটা করলাম। ছোট বেলায় মা যখন শয়তানির জন্য বা পড়ার জন্য মারতো আমি একটুও রাগতাম না এমনকি কাঁদতাম না। বুবু আমার কাছে এসে বলতো তুই এমন কেনরে জাহেদ?” আমি হাসতাম আর বলতাম তোমার ভাই যে তাই।
ছোট বেলায় বুবুই ছিল আমার সব। মানুষের মনের ভিতর অনেক রকমের রং এর ছায়া দেখা যায়। কিন্তু আমি মনে করতাম মানুষের মনের ভিতর সাত রঙ্গা রং ধনুর মত সাতটা রং থাকে। বুবু আমাকে এই সাতটা রং চিনায়। আমাকে বলে তোর কোনটা পছন্দ?” আমি চুপ করে থাকি।কোন রং মানুষকে কেমন ভাবে আচ্ছন্ন করে এটা বুঝার বয়স ছিল না আমার। বুবু বলতো “সব সময় সাদা রংটাকে বেছে নিবি।এটাতে কখনো দাগ লাগতে দিবি না।এটাতে একটু দাগ পড়লেই নোংরা হয়ে যায়। সাদা রংটাকে যতদিন নিজের কাছে যত্ন করে রাখতে পারবি ততদিন তোর চারপাশটা ভালো থাকবে।” আমি সেদিন থেকেই মনে মনে আমার বুবুকে একটা সাদা রং ভাবি।একদিন আমার এই সাদা রংটার কি যেন হলো। আমি দেখতাম বুবু সারাদিন বাসায় চুপ করে বসে থাকতো। আমার সাথে আগের মত কথা বলতো না।
আমি বাবার সাথে তেমন ফ্রি ছিলাম না। বাবাকে ভয় লাগতো। মাকে গিয়ে বলি “বুবুর কি যেন হয়েছে।” মা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো “কিছু হয় নাই। মানুষ বড় হলে এমোনি চুপ হয়ে যায়।” কিন্তু আমার মন কেন যেন বলতো বুবুর কিছু একটা হয়েছে। আমি বুবুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বুবু আমাকে দেখে বলে “কিছু বলবি?” আমি বললাম “তুমি আমার সাথে কথা বলো না কেন ঠিক করে?” বুবু আমার হাত ধরে কাছে বসায়। বুবু কাঁদে। আমার মনের সাতটা রং এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় রংটা কাঁদে।আমি বুবুর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম “আমার ভালো লাগে না তুমি কাঁদলে। কেন কাঁদছো?” বুবু আমাকে বলতে চায় না।আমি তখন নিজেই কেঁদে দিয়ে বললাম “দোয়াই তোমার বলো।” বুবু আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল “স্কুলের আরাফাত স্যার আমার দিকে সব সময় কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। আমার ভালো লাগে না। সেদিন ছুটির সময় আমার হাতটাও ধরেছিল।খুব বাজে একটা কথা বলেছিল।” বুবুর কথা শুনে আমার ভিতরটা কেপে উঠেছিল। আমি কি করবো বুঝতে পারিনি।
সেদিন আমি রান্না ঘর থেকে বটি নিয়ে শুয়রের বাচ্চাটাকে পুরো স্কুলে দৌড়িয়ে ছিলাম। আমি নিজেকে তখন কেমন ভাবছিলাম জানি না। বাবা আমাকে খুব মারলো আর বললো “আমি কি মরে গেছিরে? তুই কেন এমন করলি?” আমি তখন একটুও কাঁদিনি।কিন্তু এর একটু পর বুবু যখন আমার সামনে এসে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে একটা থাপ্পড় মেরেছিল আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। বুবু বলেছিল “অনেক শেয়ানা হয়ে গেছিস তাই না? তোর বয়স কত? সবে মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়িস।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম “আমার সাতটা রং এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় রংটার মধ্যে আমি দাগ লাগতে দিব না। শুয়রের বাচ্চা আমার সাদা রংটার সাথে কেন এমন করলো?” বুবু আমায় কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে নিয়েছিল।
আমি বাসে উঠে বাসার দিকে যাওয়ার জন্য রওনা দেই। আমি জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকি।চারপাশ যেন দ্রুত ছুটতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়ে জীবনটা এইভাবেই ছুটে যায় তার নিয়মে।এই নিয়মের বাহিরে চাইলেই কেউ আমরা বের হতে পারি না। মিলি হচ্ছে বুবুর ননদ। আমি ঢাকায় চাকরির জন্য একা থাকি। বুবুও ঢাকায় থাকে তবে সেখানে থাকতাম না। মাঝে মাঝে বুবুর বাসায় গিয়ে দেখে আসতাম।আমি যখন ওদের বাসায় যেতাম তখন মিলি আমার সামনে আসতো না।আমিও ওর সামনে যেতাম না। একদিন ঠিকি আমার সামনে এসে ইতস্তত হয়ে বললো “একটা কথা বলবো?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। সে বলে “আপনি কি ছোট বেলা থেকেই এমন চুপচাপ? কারো সাথে কথা বলেন না। আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করেন নি আমি কেমন আছি?” কথা সত্য আমি ওকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি।
আমি বললাম “আপনিও তো কখনো জিজ্ঞেস করেননি। আসলে আমি নিজেকে অনেক চুপচাপ করে ফেলেছি। বিশ্বাস করেন আমি এমন না। মানুষটাকে যেদিন হারিয়ে ফেললাম, আমার বিশ্বাষের সব পথ বন্ধ করে দিল আমি তারপর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছি। এখন কারো সাথে তেমন কথা বলতে ভালো লাগে না। যখন মন ভালো থাকে না তখন বুবুকে একবার দেখে যাই আর না হলে মায়ের সাথে কথা বলি।মা কেমন করে যেন বুঝে ফেলে জানেন।বুবুও বুঝতো।কিন্তু কিছু বলতো না।” মিলি আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম “এই দেখুন না আপনাকে কি না কি বলে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না কেমন?” মিলি একটু সময় নিয়ে বললো “আমাকে কি বলা যায় তার কথা?” আমি বলেছিলাম অন্য একদনি বলবো। আজ আসি। বুবুকে বলবেন আমি চলে গেছি।”
গ্রীষ্মের মৌসুমে ইভার সাথে আমার সম্পর্ক শুরু হয়েছিল।ভালোবাসা কি এর গভীরতা কতটুকু এতকিছু মাথায় ছিল না। তখন সবে মাত্র আমি কলেজে পড়তাম। কাঠফাটা রোদ্র যখন মাথার উপর বয়ে যেত আমি তখন একটা ছায়া হয়ে ইভার পাশে দাঁড়াতাম।ওর হাতটা ধরে বসে থাকতাম। বলতাম “তোমাকে সুন্দর লাগে এই রোদ্দুর মাঝেও।” ও হাসতো। আমার নাকটা ধরতো।কতবার ও আমার নাক ছুয়ে দিয়েছে। আমি ওকে বলতাম “নাক ছুয়ে দাও কেন মেয়ে?” ও হেসে বলতো “এই নাক, চোখ আামার, আমি হাজার বার ছুয়ে দিব ছেলে।” আমি যখনি ভালোবাসার কথা বলতাম ও লজ্জা পেয়ে মুখটা এত্তোটুকু ছোট করে ফেলতো। আমি ওর চোখে তাকিয়ে কতবার আমাকে দেখেছি আমাদের ভালোবাসা দেখেছি তার হিসেব নেই। রাতের জোনাক পোকারা তাদের আলো দিয়ে যখন গ্রামের শহরটাকে সবুজময় করে দেয় তখন আমি এই জোনাক পোকা ধরে নিয়ে ওর কাছে নিয়ে যেতাম আর বলতাম “তুমি ঠিক এমন করে আমার ভিতরে বিচরন করো জানো?” ভালোবাসা বলতে আমি শুধু বুঝতাম দুটো মানুষ যে স্বপ্নটা দেখে তা পূরণ করা।
এটা ছাড়া আমি কিছুই বুঝতাম না।কিন্তু এই স্বপ্ন পূরণের সুরটা কি আমার কাছে ছিল? কলেজ পাস করার পর আমি চট্টগ্রাম ভার্সিটি আর ও জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। কিন্তু আমাদের কথা হতো। দুটো মানুষ দু প্রান্তে থাকলেও আমাদের ভালোবাসাগুলো আদান প্রদান হতো।কিন্তু একটা বছর পর বুঝতে পারলাম ও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।আমার সাথে যেমন করে কথা বলতো, ভালোবাসার কথা বলতো তা যেন ঘুমের মত হয়ে গেলো। বালি যেমন মুঠোয় বন্ধি করলে ঝরঝর করে পরে যায় ঠিক তেমন।যখনি আমার সাথে কথা হতো বলতো “মনটা ভালো নেই জানো। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না।মন কেন ভালো থাকে না বলতো পারো?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।গাধার মত চুপ করে ছিলাম। ওকে যে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বলে মন ভালো করে দিব এই জিনিসটা আমার মাঝে ছিল না। আমি বলেছিলাম “ঘুমিয়ে পড়ো মেয়ে। সকালে কথা হবে।” আমি চিন্তা করলাম ওর সাথে না হয় একবার দেখা করি।আমাকে দেখে না হয় নিশ্চয় ওর মন ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ওকে কিছুই জানাইনি।
এর একদিন পর ওর সাথে দেখা করার জন্য ওর ভার্সিটিতে যাই। ওর ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করাতে বলে দেয় ও কোথায় এখন। ওকে খুঁজি। আমি ওকে দেখতে পাই।যখন দেখলাম আমার কি যেন হয়েছিল।মনে হচ্ছিল আমার মাথাটা ফেটে যাচ্ছে।আমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।ও একটা ছেলের হাত ধরে কাধে মাথা রেখে বসে ছিল।আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিৎ।বুঝতে পারলাম ও কেন আমার সাথে এমন করে কথা বলে। আমি নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখে ওদের সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বললাম “আইন অনুষদটা কোনদিকে বলতে পারেন?” ও আমাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল।থতমত খেয়ে সোজা হয়ে বসে। আমাকে ওখানে যে দেখবে আশা করেনি।ছেলেটা আমাকে দেখিয়ে দেয় কোন দিকে যেতে হবে।আমি ছোট্ট একটা ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসি।এরপর ওর সাথে আমি একটাবারের জন্যও যোগাযোগ রাখলাম না।সিম ভেঙ্গে ফেলে দিলাম। এর একমাস পর ও আমায় ফোন করে। আমার নতুন সিম নাম্বার কোথায় পেয়েছিল আমি জানি না।
সে বলে “প্লিজ কথাটা শুনো। ফোন কেটো না।” আমি চুপ করে থাকি।সে বলতে থাকে “ফাহাদ খুব ভালো বন্ধু আমার।আমার যখন মন খারাপ থাকতো ছেলেটা কেমন করে যেন বুঝে ফেলতো। আমাকে হাসাতে চেষ্টা করতো। তার দুষ্টামি গুলো দেখে হাসতাম। আমার মন ভালো হয়ে যেত। একদিন সে আমাকে তার ভালো লাগার কথা জানায়।আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একবার বলতে চেয়েছিলাম আমার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে।কিন্তু কি থেকে কি হলো আমি কিছুই জানি না।কেন এমন হলো।” আমি তাকে বললাম “আশা করি আপনি আমাকে আর ফোন না দিলে খুশি হবো।আমি এসব মনে করতে চাইনা।হয়তো আমার জন্য কষ্ট হবে। আপনার থেকে আমি এমনটা আশা করিনি একদম করিনি।আপনাকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না।” সে আমার কাছে ক্ষমা চায়।
আমি একটু রেগে বলেছিলাম “বিশ্বাস করেন আমি কি করবো জানি না।খোদার কসম আপনি যদি আর একবার যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন আমি খুব খারাপ করে ফেলবো। আপনার ফাহাদের সামনে আপনাকে ইচ্ছামত পিটোবো। আমার তখন কি অবস্থা হবে বা আমাকে আস্ত রাখবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে পিটাবো। শান্ত আছি, শান্ত থাকতে দেন।” এটা বলেই ওকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দেই। আামর চোখে পানি আসে। আমি চুপ করে কাঁদি। আমি ভাবতাম এই মেয়েটা ছাড়া আমার সব কিছুই অসমাপ্ত। আমার সব কিছুতে ওর ছায়াটা লেগে থাকে। কিন্তু এমন করে হারিয়ে যাবে আমি ভাবতে পারি না। এই ভালোবাসা বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে আমার এখন কষ্ট হয়।আমি জানি পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুত সুন্দর ভালোবাসা আছে। এটা পেতে ভাগ্য লাগে ভাগ্য।
মিলিকে চাইলেও আমি ভালোবাসতে পারি না। যেদিন ওর সাথে কথা বলার পর বাসা থেকে চলে এসে ছিলাম তার ঠিক সাতদিন পর ও আামাকে ফোন দিয়ে বলে “আপনার কষ্ট গুলো কি আমার মাঝে একটু শেয়ার করবেন?” আমি অনেকক্ষন চুপ করে ছিলাম। এককবার ভেবেছিলাম বলে কি হবে? কিন্তু তারপরও আমার বিষাদময় ভালোবাসার কথা তাকে জানালাম। জানালাম আমার ভিতরের কথা। যে কথা গুলো আমার মনের ভিতর একটা ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করেছিলাম। কিন্তু এই ভালোবাসাটা আমার জন্য ছিল না। মিলি একটু সময় নিয়ে বললো “কাল আমার জন্মদিন। আপনি কি একবার বাসায় আসবেন। ভাবীর কাছ থেকে শুনেছি আপনার কাচ্চি বিরিয়ানী অনেক পছন্দ। আমি অতটা ভালো রাধতে পারি না। তারপরো আমি রাঁধবো। আসবেন কেমন?”
মিলিদের বাসায় যখন যাই তখন সন্ধ্যা ছুই ছুই। ওকে একটা হাতঘড়ি দিয়েছিলাম। ওর বান্ধুবীরাও ছিল। আমি আমার ছোট্ট মামাটাকে নিয়ে খেলতে থাকি। বুবু আমায় বলে “তুই গ্রামে যাস না কেন?” আমি কিছু বলি না। গ্রামে যেতে ভালো লাগে না। গ্রামে গেলেই ইভার কথা মনে পড়ে। গ্রামের সমস্থ জায়গা জুড়ে ইভার সাথে আমার ভালো ভালো কাটানো সময় গুলো ছিল। গ্রামে গেলেই ওর চুলের গন্ধটা কেন যেন আমি অনুভব করতে পারতাম। আমার ভালো লাগতো না। কিচ্ছু ভালো লাগতো না।
আমি বুবুকে ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “আমার মামাটাকে স্কুলে ভর্তি করাবা না?” বুবু আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিল। তারপর বলেছিল “তোর জন্য যে মা রাতে কাঁদে তুই বুঝিস না?” আমি কিছু বলিনি। সেদিন আমি খুব পেট ভরে খেয়েছিলাম। কিন্তু এই খাবার খেয়ে ওকে কিছু বলা হয়নি। বাসায় ফিরে আসার পর ও নিজেই ফোন করে বলেছিল “আমার রান্না কি খুব খারাপ হয়েছে? এভাবে কিছু না বলে চলে গেলেন কেন?” আমি একটু সময় নিয়ে বলেছিলাম “আসলে তেমন কিছুই না। আপনি একটু ব্যস্ত ছিলেন আপনার ফ্রেন্ডদের সাথে পরে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয়নি।” এর একমাস পর দুপুর বেলা আমি নিজেই মিলিকে ফোন করে বললাম “আমার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে।”
এই কথাটা আমি মিলিকে কেন বলেছিলাম জানি না। আমি চাইলে দোকানে গিয়ে খেতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল ওর হাতের রান্না থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। মিলি আমাকে একটা হাসি দিয়ে বলেছিল “আমি এখন ভার্সিটিতে। এমন হঠাৎ ইচ্ছে হলো কেন আপনার?” আমি চুপ করে থাকি কিছু বলতে পারি না। আমার চুপ থাকা দেখে ও বললো “অন্যদিন খাওয়াবো কেমন?” আমি ফোনটা রেখে দেই। আমার নিজেকে খারাপ লাগছিল। কেন আমি ছোট হতে গেলাম ওর কাছে? আমি নিজেকে নিজে চিনতে পারি না। আমি কেমন? আমার চারপাশটা এমন কেন? এর দুদিন পর মিলি নিজেই ফোন করে বললো ”আপনি কি একবার আমার সাথে দেখা করবেন?” আমি বলেছিলাম “আচ্ছা” ও আমাকে ওর রান্না করা বিরিয়ানি খাওয়ায়। আমি চুপ করে খেতে থাকি। আর ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ভাবে ও প্রায় রান্না করে এনে আমাকে খাওয়াতো। আর আমার খাওয়া দেখতো।
এই দেখার মাঝে ওর চেহারায় একটা ভালো লাগার আভা পেতাম। ওর যখন ভার্সিটির ফাইনাল শেষ হলো বুবু একদিন ওর কথা আমাকে বললো। জানালো ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করবে এটাই ফাইনাল। আমি অনেকটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বুবুকে জানালাম এটা সম্ভব না। বুবু আমাকে ধমক দিয়ে বলে “তোর মাথা আমি ফাটিয়ে ফেলবো। এদিক ওদিক করে অনেক সময় নষ্ট করছিস।” সেদিন রাতে আমি মিলিকে ফোন দিয়ে বললাম “বুবু আপনাকে কিছু বলেছে?” মিলি চুপ করে থাকে। আমি আবার বললাম “এটা তো কখনো সম্ভব না তাই না?” ও একটু সময় নিয়ে ইতস্তত করে বললো “আমি বাসায় বুঝাবো আপনি চিন্তা করবেন না।” আমি বললাম “আপনি আবার ভাববেন না আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি বলে আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি না।” সে হাসতে লাগলো। আমি চুপ করে থাকি।
সে এই কথার প্রসঙ্গ বদলে বললো “একটা কথা বলি। আপনি কখনো বলেননি আমার রান্না কেমন হয়েছে। আমি প্রতিবার আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আপনি আমায় কিছু একটা বলবেন।” আমি বললাম “আসলে আমি দুঃখিত। আমি চুপ করে খেতাম আর আপনি প্রতিবার তাকিয়ে থাকতেন। আমার মনে হলো আপনাকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কারন আপনি আমার চেহারা আর খাওয়া দেখেই বুঝতে পারতেন। আমি আপনার রান্নার সাধটা সারাজীবন মনে রাখবো মিলি।” এই কথাটা বলার পরই মিলি লাইনটা কেটে দেয়। আমার বুকটা ধক করে উঠে। মেয়েটাকে কি আমি খুব একটা আহত করলাম? ওকে আহত করার এই অধিকার কি আমার আছে? আমার কেমন যেন লাগতে শুরু করলো। সারাটা রাত আমি ঘুমাইনি। শুধু ওকে নিয়ে ভেবেছি। পরের দিন সকালে “বুবুকে ফোন করে বললাম “মিলিকে একবার জিজ্ঞেস করে নিও ও রাজি কিনা।”
তিনদিন পর ও আমার সাথে দেখা করলো তার রান্না করা বিরিয়ানি নিয়ে। আমি আগের মতই একটু চুপ করে থেকে বললাম “এই যে এতো ঘন ঘন বিরিয়ানি রান্না করেন কেউ কিছু বলে না?” ও আমার দিকে তাকিয়েই গভীর ভাবে বললো “ভাবী অনেকবার বলেছে। আর এই জন্যই কিনা কি বুঝে আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা বলছে। কিন্তু আপনাকে আমি বিয়ে করবো না। আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিবেন অনেক।” আমি খেতে খেতে বলি “কথা সত্য। আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। একজনকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমাকে বিয়ে না করাই ভালো।
যদি ভালোবাসি তাহলে আপনার এই বিরিয়ানিকেই ভালোবাসতে পারি।” মিলি আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর চোখে জল দেখি। সে জল ও লুকানোর চেষ্টা করে। তারপর বলে “আপনি কি জানেন আপনার খাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে। আমার খুব মায়া হয়।” আমি হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বললাম “এটা অনেক আগেই বুঝেছি। আপনি একটা ভালো মেয়ে।” তার কয়েক মাস পরেই মিলির সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। তেমন কোন অনুষ্ঠান হয়নি।আমাদের বিয়ে হয়েছে পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসে মেয়েটাকে আমি একটাবারের জন্যও ছুয়ে দেখিনি। মাঝে মাঝে মিলিকে আমার খুব অসহায় মনে হয়। মনে হয় ওর সাথে এমন অবজ্ঞা না করলেই তো হয়। একটা মানুষের জন্য আরেকটা মানুষ কেন দুঃখ পাবে?
মোহাম্মদ পুর বাসটা এসে যখন থামলো আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বাস থেকে নামার পরই দুপুর বেলার রোদ্রটা আমার কাছে ভালো লাগলো না। মিলি নিশ্চয় অপেক্ষা করছে কখন ওর সাথে বসে খাবো। মেয়েটাও কেমন যেন আমার এতো অবহেলা সহ্য করে যাচ্ছে। হাটতে হাটতে বাসায় গিয়ে দরজার কলিং বেল বাজাতেই ও দরজাটা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। দরজার ভিতরে ঢুকেই আমি বললাম “বাবা ফোন করেছিল।আপনি কি আমার সাথে গ্রামে যাবেন?” ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো “আপনি না চাইলে যাবো না।”
আমি সোফার একপাশে ব্যাগটা রেখে বসে জুতো খুলতে খুলতে বললাম “আপনার সাথে এমন করে চলি এই জন্য আপনার খারাপ লাগে না?” সে শাড়ির কুচি ধরে মাথা নিচের দিকে করে কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বললো “ফ্রেশ হয়ে নিন।তরকারি গুলা খাওয়ার মত না। তারাতারি করে ডিম ভাজি, আলু ভর্তা আর ডাল করেছি।” আমি একটু ইতস্তত হয়ে বললাম “দুঃখিত আমি অফিসে খেয়ে আসছি। আসলে খাওয়ার কথা ছিল না।মিঠু ভাই যখন বললো নিষেধ করতে পারিনি।আপনি খেয়ে নিন।” আমি ওর মুখটা ছোট হয়ে যেতে দেখলাম ঠিক এতোটুকু। তার চোখে জল আসে। মিলি এই জল লুকানোর চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন আমি ওকে বিয়ে করলাম। বিয়ে করার কি দরকারই বা ছিল।আর আমি বুঝতে পারি না এই ময়ুরাক্ষী মেয়েটা কেন আমার অবহেলা গুলো সহ্য করছে।সে ভিতরের দিকে চলে যায়। আমি জানি এই মেয়েটা এখন চুপ করে কিছুক্ষন চোখের পানি ঝড়াবে।ওর সাথে দুপুরের খাবারটা খাওয়া কি আমার উচিৎ ছিল না?
বহু বছর পর আমার প্রিয় গ্রামের গন্ধ আমি গভীর ভাবে নিতে থাকলাম। এই সবুজ ধান ক্ষেত, পুকুর, মাঠ সব কিছুর মাঝে আমার ছোয়া লেগে আছে। আমি মনে মনে বললাম “প্রিয় গ্রাম আমি অনেক দুঃখিত তোমাকে দেখতে না আসাতে। তোমার বুকেই আমি বড় হয়েছি। আমাকে আবার বরন করে নাও এবং তোমার ছোয়া দাও।” বাবা মা, আমাদের দুজনকে দেখে সামনে আসতেই আমরা দুজনে সালাম করার পর মা মিলিকে জড়িয়ে ধরে। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন লাগলো। কোথায় আমাকে একটু জড়িয়ে নিবে। মিলিকে জড়িয়ে নিয়েই বললো “অনেক দিন বাইচা থাকো মা।” বাবা বললো “এই হারামজাদাটাকে তুমি কেন বিয়ে করলা? ও একটা নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। ওর জন্য ওর মা কাঁদে ও কোন গুরুত্বই দেয় না।” আমি কিছু বললাম না। মিলি শুধু একবার আমার দিকে তাকালো।
এরপর দিনই আমি মিলিকে আমার গ্রামটা ঘুরে দেখাই। আমি মিলিকে বলি “আমাদের গ্রামটা চমৎকার বুঝলেন। একদম আপনার বিরিয়ানির মত।” মিলি আমার কথা শুনে হাসে। ও যখন হাসলো আমার কেন যেন একটু ভালো লাগলো। এই প্রথম একদম কাছ থেকে মিলিকে হাসতে দেখেছি। কি অপূর্ব ওর হাসিটা। ঘুরতে ঘুরতে একটা বিলের সাকোর বাশ ধরে ধরে আমি পার হচ্ছি তখন পিছনে তাকিয়ে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে মুখটা গোমড়া করে। আমি বললাম “অভ্যাস নেই?” সে মাথা নেড়ে না সূচক ইশারা দেয়। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম “আপনার আপত্তি না থাকলে আমার হাত ধরতে পারেন।” ও আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। আমার মনে হলো আমি আসলে একটা বোকা। ছাগল মার্কা ছেলে। নিজের বউ এর হাত ধরতে আবার আপত্তি কিসের? মিলি আমার হাতটা ধরে সাকো পার হতে থাকে। যখন আমার হাত ধরে সাকো পার হতে থাকলো আমার ভিতরের বাসি অনুভূতিগুলোকে কেমন করে যেন আচ্ছন্ন করলো। আমার অনুভূতিগুলোকে আবার সজাগ করে তুললো। একটা নতুন অনুভূতি।
তিনদিন পর সন্ধ্যা হওয়ার কিছুক্ষন আগে স্কুলের মাঠের দিকে ইভার সাথে আমার দেখা হলো। ওকে দেখার পর জাস্ট বোবার মত দাঁড়িয়ে ছিলাম। দুজন দুজানার দিকে কতক্ষন তাকিয়ে থাকলাম জানি না। আমি বললাম “ভালো আছো।?” ও শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তারপর বললো “ভালো থাকার জন্য অভ্যাস করছি। একদিন অভ্যাসটা অর্জন করে ফেলবো। তোমার কি খবর? শুনলাম বউ নিয়ে বেড়াতে আসছো?” আমি শুধু হুম শব্দ করলাম। তারপর দুজনে কিছুক্ষন হাটলাম।
ইভাই নিরবতা ভেঙ্গে বললো “একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। সেদিন তুমি চাইলে আমাকে আর একটা বার সুযোগ দিতে পারতে না?” আমি এই কথার ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “ফাহাদকেই বিয়ে করেছো তাই না?” সে হাটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “ভালোবাসাটা সেদিনিই মরে গেছে। আমি নিজেকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছি। বুঝতে পারলাম তোমাকে ছাড়া আমার ভিতরে আর কেউ নেই। আমি খুব খারাপ করেছি। আমার এই ভুলের জন্যই তোমাকে হারালাম। অবশ্য তোমার কোন দোষ নেই। তোমার জায়গায় আমি থাকলে আমিও এমনটা করতাম।যেদিন তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে তারপর থেকেই আমি আর কাউকে চাইনি বিশ্বাস করো। বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করলাম। মেয়ে আছে একটা আমার। একটু একটু কথা বলতে পারে। ওর বাবার সাথে ঝগড়া করে কিছু দিনের জন্য আসছি।
মানুষটাকে কোনদিনও আমি নিজের থেকে ভালোবাসা দিতে পারিনি। তারপরও আমাকে কত্ত ভালোবাসে। আজকে কথা হয়েছে। কাল এসে নিয়ে যাবে।” এটা বলে ও একটু থামে। আর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। আমরা দুজন আবার হাটতে থাকি। ইভা আবার বলতে থাকলো “কি আশ্চর্য তোমার সাথে দেখা হয়ে গেলো। একটা কথা কি জানো আমি কোনদিনও ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি। ভাবতাম যে মানুষটা আমাকে এতো এতো ভালোবাসলো সেই আমাকে এতো এতো ঘৃনা করে। সত্যিই কি আমাকে আর একটা বার সুয়োগ দেওয়া যেত না?” আমি ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম “তুমি জানোই আমি ছোট বেলা থেকে এমন। তোমাদের দুজনকে যদি ঐ অবস্তায় না দেখতাম তোমাদের সম্পর্ক আরও গভীরে যেত এটা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছো। ভালোবাসা ব্যাপারটা অনেক ভয়াবহ।
এই ভালোবাসায় একবার যদি, সন্দেহটা চলে আসে বা বিশ্বাসটা উঠে যায় কিংবা ভরসা করা যায় এই আশ্বাসটা চলে যায় সেটার মাঝে আর ভালোবাসা থাকে না। তোমার মেয়ের নাম কি রেখেছো?” সে বললো “আমীরাতুন নিসা। ডাক নাম জুঁই।” আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠলো। চারপাশটা যেন ঝিম মেরে গেলো। ও আমায় প্রায় বলতো “আল্লাহ যেন আমাদের একটা মেয়ে দেয় ঠিকাছে? মেয়ে হলে কি নাম রাখবা?” আমি নাম খুঁজে পাই না। দু মাস পর ভেবে বলেছিলাম আমীরাতুন নিসা রাখবো। যার অর্থ নারী জাতির নেত্রী। তবে আমি ডাকবো জুঁই বলে। তুমি আমায় জুঁই এর বাবা বলে ডাকবা।” ও খুব হাসতো। আমি চুপ করে ওর পাশে হাটতে থাকি। যখন বিদায় নেওয়া সময় হলো আমি বললাম “আজ থেকে শান্তিতে ঘুমাবা। তোমার স্বামীকে কষ্ট দিও না। ভালো থেকো।” সে কিছুক্ষন আামার দিকে তাকিয়ে চলে যায়।
বিছানায় বসে আমি মিলির দিকে তাকিয়ে থাকি। ও আমার শার্ট প্যান্ট গুলো গুছাচ্ছে। আগামীকাল আবার চলে যাবো। আমার তাকানো দেখে ও বললো “আপনি কি আামায় কিছু বলবেন?” আমি বললাম “বাবার কথা সত্য। আমি অনেক নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছি।” মিলি বললো “এমনটা কখনো ভাববেন না।” আমি বললাম “আপনি কেন আমার দেওয়া কষ্ট গুলো সহ্য করেন বলেন তো?” ও একটু ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বললো “কে বললো আপনি আমাকে কষ্ট দেন? আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ি আপনি প্রতিবার আমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আপনার নিশ্বাসের শব্দে আমি বুঝতে পারি।
আমি আপনার মতl এতো বোকা না। এটা বুঝি আমি। ভালোবাসা তৈরি হতে তো সময় লাগে। আমি আপনাকে সময়টা দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে একদিন খুব ভালোবাসতে শুরু করবেন। জানেন সেদিন সাকো পার হওয়ার সময় যখন হাতটা ধরলেন আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সাকোটা যেন শেষ না হয়। সাকোটা একটু বড় হলে ক্ষতি হতো? যারা সাকোটা তৈরি করেছে তাদেরকে যাওয়ার সময় বলে যাবেন এটা ভেঙ্গে গেলে বড় করে বানাতে। পরের বার এলে আপনার হাতটা যেন অনেকক্ষন ছুয়ে থাকতে পারি।” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না।
আমার চোখে পানি আসে। আমি একটা কান্নার গোঙ্গরানি দিতেই মিলি আমার কাছে এসে পাশে বসে থেকে এই প্রথম সাহস করে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো “আমার বিরিয়ানি পাগল স্বামীটা কেন কাঁদছে? কাঁদলে বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবো না বলে দিলাম।” আমি কাঁদতে কাঁদতেই হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে বসে থাকলাম। মিলিও চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো। আমি জানি না আমাদের বাকি দিন গুলো কেমন কাটবে।তবে আগামীকাল থেকে আমি আবার নতুন করে সকাল দেখতে শুরু করবো। একটা নতুন ভালোবাসার সকাল। যে সকালটার মাঝে একটা স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকবে…