অফুরন্ত ভালোবাসা

অফুরন্ত ভালোবাসা

এই তো সেদিন রিক্সা করে কাউতুলি যেতে ছিলাম।রিক্সাটা যখন রেইল গেইটেরকাছে গেল, তখন দুই-তিনটা মেয়ে এক সাথেহেঁটে যাচ্ছিল।আমাকে দেখা মাত্রই একটি মেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, “দেখ দেখ আমাদের খাদিজা এই বোবা ছেলেটার সাথে প্রেম করে।একটা বোবাছেলের সাথে কিসের জন্য প্রেম করে,আরকি দেখে যে বোবা ছেলের প্রেমে পড়েছেখাদিজাই জানে” এই বলে মেয়ে গুলো চলে গেল।আমার ধারণামেয়ে গুলো হয়তো খাদিজার বান্ধবী হবে। তারা মনে করেছে আমি কিছু শুনি নাই। যদিও আমি বোবা তারপরও একটু ভালো শুনতে পারি।কথা বলার ক্ষমতা ওপর ওলানা দিলেও, কথা শুনার ক্ষমতা ঠিকিই দিয়েছে। আমি মেয়ে গুলোর কথা শুনে শুধু একটা মৃদু হাসি দিয়েছিলাম।

হাসিটা এই ভেবে দিয়েছিলাম যে,আসলেই খাদিজা আমার মাঝে কি দেখে প্রেমকরতে আসল।তা আমার আজও অজানা।তাকে আজ আমি জিজ্ঞাসা করব যে,কি দেখে সেআমার প্রেমে পড়েছিল।তাছাড়া আমি তো একটা বোবা ছেলে।কথা বলতে পারি না। নিস্তব্ধ আমি।নিস্তব্ধ আমার চারপাশেরপরিবেশ।প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বড়অসহায় মনে হয়।কেন আমি আজ নিরব।কি অপরাধ ছিল আমার।যার জন্য আমাকে আজ নিরব থাকতে হচ্ছে।শরীলের সব অঙ্গ- প্রতঙ্গ থাকা সত্যেও আমি মনে হয় অনেকনিকৃষ্ট।সব আছে শুধু কথা বলার জন্য আমারইচ্ছাটা নেই।না,আমার ইচ্ছে আছে তবেআমাকে যে বানানো হয়েছে নিরব থাকার জন্য।ওপর ওলা সব দিলেও,বলার জন্য মুখের ভাষাটা দেই নাই।কথা বলতে না পারাটা যে কতো কষ্টের তা লেখে কখনো বুঝানো যাবে না।

বাড়িতে ফেরার সময় খাদিজাকে ছোট একটা বার্তা প্রেরণ করেছি।বার্তাটাত ে লেখা ছিল “আজ বিকেলে তিতাস নদীর প্রান্তে বসাথাকবে।তোমার সাথে আমার কিছু জরুরিকথা ছিল।” এই ছিল বার্তাটা। আর খাদিজা কে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। ওর পুরো নাম খাদিজাতুল কুবরা।পড়ে আমার সাথেই।ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ক্লাস চলাকালীন।ক্লাস চলাকালীন খাদিজা প্রবেশ করল।সারা ক্লাস জুড়ে কোথাও বসার জন্য জায়গা নেই।শুধু আমার পাশে খালি আছে।অবশ্য তার একটা কারণ আছে আমি বোবা কিংবা কারো সাথে কথা বলতে পারি না বলে কেউই আমার বন্ধুত্ব কিংবা আমার সাথে উঠ-বস করতে আগ্রহী না।তাই আমার পাশে সবসময় খালি জায়গা থাকে।

খাদিজা আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,”আমি কি তোমার সাথে বসতে পারি” আমি তখন করুণ দৃষ্টি দিয়ে খাদিজার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বসার জন্য অনুমতি দেয়।বলতে গেলে অনুমতি না। ক্লাসে সবার জন্য সব জায়গায় বসা উন্মুক্ত। তাই এখানে অনুমতি না,বরং তাকে বসার জন্য বললাম।খাদিজা আমাকে দেখে কি ভেবেছিল তা হয়তো সেই কেবল জানে। ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় সে আমাকে ডাক দিয়েছে।আমি বুঝতে পেরেও না বুঝার অভিনয় করে হাঁটতে লাগলাম।আবারও খাদিজা আমাকে ডাক দিল।এইবার আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম, সে আমার কাছে এসে বলতে লাগল,”কি তোমাকে এতক্ষন ধরে ডাকতেছি শুনতে পাও নাই”আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিয়েছিলাম।

এমন সময় কোনো এক আগুন্তক মেয়ে এসে খাদিজা কে নিয়ে চলে গেল।আর বলতে লাগল ছেলেটা বোবা।কথা বলতে পারে না।কেউই এই ছেলের সাথে চলাফেরা করে না।তুইও এই ছেলের সাথে মিশবি না।একনাগাড়ে কথা গুলো বলল খাদিজাকে। আমি বরং দূর থেকে মেয়েটির কথা গুলো শ্রবণ করলাম।আগে তো বলেছি,আমি কথা না বলতে পারলেও শুনতে পারি।এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।খাদিজা মনে মনে কি ভেবেছিল জানার ইচ্ছা নেই আমার।এভাবেই কিছুদিন যাওয়ার পর খাদিজা আমাকে ডাক দিল। সে এক নাগাড়ে  বলতে লাগল। “আসলে তুমি এমন আমি এর আগে জানি নাই।তুমি কথা বলতে পার না, কারো সাথেমিশ না।এগুলো আমার জানা ছিল না।তার জন্য আমি সরি।” আমি তখন আমার ব্যগ থেকে ছোট একটা পেপার বের করে “ইটস ওকে” লিখে খাদিজাকে দেখালাম।

ধীরে ধীরে এভাবেই খাদিজা আমার সাথে মিশতে লাগল।খুব কাছের একজন মানুষ হয়ে গেল খাদিজা।খাদিজাকে আমাকে ভালো লাগত তবে কখনো বলেনি। আমি তোমাকে ভালোবাসি খাদিজা।আর বলবই বা কিভাবে কথা না বলতে পারা তো আমি একজন মানব।খাদিজার সাথে মিশে আমি আমার একাকিত্ব দূর করতে পেরেছিলাম।খাদিজা আমার সাথে কথা বলতো আমার মতোই কাগজ কলম ব্যবহার করে।আমি কাগজ কলম ব্যবহার করে কথা বলার ফলেই খাদিজা ঠিক তেমন করে কথা বলে আমার সাথে।বুঝতেই পারা যায় যে আমরা দুজন নিরব মানুষ।কেউ কখনো বুঝতেপারবে না।আমার মতো খাদিজা কি সত্যই কথা বলতে পারে না।অথচ খাদিজা কথা বলতে পারলেও আমার সাথে একমাত্র কাগজ কলম ব্যবহার করে কথা বলে।

নিজের প্রতি সবসময় একটা নিকৃষ্ট আচরণ থাকত।যে আমি কথা বলতে পারি না।কেউই আমার সাথে মিশে না।কেবল খাদিজাই মিশেছে। কখনো খাদিজা কে বলতে পারব কি না,যে আমি তাকে ভালোবাসি।সে দ্বিধায় কেটে দিন পার করে দিচ্ছি। কিন্তু সকল দ্বিধা দূর করে,কোনো এক পরন্ত বিকেলে,সূর্য ডুবে যাওয়ার আগ মুহুর্তে, চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশে,জনমানবহীন এক রাস্তায় আমার সামনে মুখ ফুটিয়ে খাদিজা বলে ফেলল,”আমি তোমাকে ভালোবাসি জুবায়ের” নিস্তব্ধ আমি,নিস্তব্ধ প্রকৃতি,নিস্তব্ধ আমার চোখের পলক। দৃষ্টি দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে ছিলাম কতক্ষন আমার জানা নেই।খাদিজার ডাকে আমার দৃষ্টি গুজলো তার দিকে।

আমি কিছু বলার আগেই খাদিজা ঝাপিয়ে পড়ল বুকে।আমার চোখের পানি পড়তেই মুখ ফিরিয়ে তাকালো আমার দিকে।করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাদিজা আমার এই না বলা উত্তর শুনার জন্য।সকল বাধা দূর করে হাতে কাগজ কলম নিয়ে লিখে ফেললাম “আই লাভ ইউ টু খাদিজা” এটা দেখার সাথে সাথেই আবারও ঝাপিয়ে পড়ল বুকে।সময় যেন শেষ হয় না,বেলা যেনযায় না,জনমানবহীন এই পথে যেন কোনো কিছুর শব্দ হয় না।হাঁটা শুরু করলাম গন্তব্যে। খাদিজাও আমাকে ভালোবাসে এটাও সবচেয়ে বড় পাওয়া। বোবা, কথা না বলা ছেলের প্রতি ভালোবাসা আছে এটাই যেন অবাস্তব। তবুও যেন নিয়মের তাগিদে কিছু কিছু মানুষ তা করে থাকে সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর জন্য।বোবা,কথা না বলতে পারা লোক গুলোও মানুষ।এদের অবজ্ঞা করতে নেই।কাছে টেনে ভালোবাসে নিতে হয়।

বিকেলে তিতাস নদীর প্রান্তে বসা খাদিজা।পানিতে সূর্যের কিরণ পড়তেই চিকচিক করছে দূর থেকে আসা কোনো একনৌকার ঢেউ।আশপাশ যেন ঝিম ধরে আছে। প্রকৃতি যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।তিতাস নদী শুকিয়ে যেন মৃত্যু শয্যায়।বর্ষাকালে পানি দিয়ে তিতাস নদীর পানি থৈ থৈ করলেও গ্রীষ্মকালে যেন পানি শুকিয়ে হাহাকার।তারপরও যেন পানি নদীর তল দেশে থাকার ফলেই তিতাস নদী এখনো বেঁচে আছে তিতাস পাড়ের লোকদের,এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জনগণের মাঝে।শেষ বিকেলে সূর্য বিদায় লগ্নে আমার আগমন তিতাস নদীর পাড়ে খাদিজার কাছে।এক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে এক ডিঙি নৌকায় মানুষ পারাপারের ব্যস্ত সময়ে।আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই খাদিজা ঘুরে আমার দিকে তাকাল।

কিছু বলার আগেই কাগজ কলম হাতে নিয়ে লিখে ফেললাম “কি দেখে আমার সাথে প্রেম করেছ তুমি” খাদিজা আজ আর অন্য দিনের মতো কাগজ কলমে না লিখে,মুখেই বলতে লাগল,”তুমি বোবা বলে, তুমি কথা বলতে পার না বলে, তুমি নিরব প্রকৃতির মানুষ বলে,এগুলো দেখেতোমার প্রেমে পড়েছি। আমি তো চাই নি তুমি কথা বলতে পার,তুমি যেমন আছ আমার কাছে তেমনই অনেক।অন্যরা কিভাবে দেখল তা আমার দেখার দরকার নেই।”

এর কোনো প্রতুত্তর নেই।খাদিজার এসব কথার কোনো উল্টা না বলে আবারও কাগজ  কলমে লিখলাম “কিসের জন্য আমার সাথে তুমি প্রেম করো” খাদিজা আবারও বলতে লাগল, “তোমাকে পাওয়ার জন্য,তোমার সাথে এক বালিশে মাথা পেতে ঘুমানোর জন্য,শেষ বিকেলে নদীর পার দিয়ে তোমাকে নিয়ে হাঁটার জন্য,তোমার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য,তোমার একাকিত্ব দূরে করে সবসময় তোমার পাশে থাকার জন্য,কোয়াশা ঢাকা সকালে এক চাদরে দুজন মিলে অনেক দূর পথ পারি দেওয়ার জন্য,রেল লাইনের দুই প্রান্তে দুই জন হাতে হাত রেখে মাঝ দুপুরে চলার জন্য,এক প্লেটে ভাগ করে ভাত খাওয়ার জন্য,তোমার লেখা গল্পের নায়িকা হওয়ার জন্য,জ্যোৎস্না রাতে তোমার কাধে মাথা রেখে চাঁদ দেখার জন্য,মাঝ রাতে ঘুম থেকে ওঠে এসে বেলকনিতে দুজনে এক মগে কফি খাওয়ার জন্য,তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে সহস্র রাত পার করার জন্য, সারা জীবন তোমাকে ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য” আমার আর কিছু বলার বা জিজ্ঞাসা করার নেই খাদিজাকে। খাদিজার এসব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি তাকে বুকে ঝড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম।এই কান্না কষ্টের নয়।পরম সুখের কান্না। কিছু মানুষ শুধু ভালোবাসতেই জানে।যেভাবেই হোক। ভালোবাসা যাতে কোনো দিন না ফুরিয়ে যায়।

দীপ্তিময় সূর্যটা যখন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পশ্চিম দিগন্তে লুকিয়ে যাওয়ার খেলাতে ব্যাস্ত। তখন তিতাসের পাড়ে আমি আর খাদিজা পাশাপাশি বসে সময়ের প্রহর গুনছি। কোয়াশা যেন ধীরে ধীরে আগমন হচ্ছে চারপাশে।শীত যেন একটু বেশিই অনুভব করতে পারছি।নৌকার মাঝিরা পারি দিচ্ছে বাড়িতে।ওপারের কৃষকরা লাঙ্গল কাধে ফিরছে নিজ গন্তব্যে। খাদিজা আর আমি যেন খুনশুটি দিয়ে ভরপুর করে দিচ্ছি প্রকৃতির চারপাশ।নিরব আমি তাই যেন নিস্তব্ধ আমার চারপাশ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত