এই শহরে তুমি আর আমি

এই শহরে তুমি আর আমি

বিকেলের এই সময়টায় আমি সাধারনত ঘুমাই না। আজ ঘুমিয়েছিলাম। আমার ছোট বোন নীতু জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে লাইট টা জ্বালালো। চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে বিছানায় বসল,

– শরীর খারাপ?
– উহু। নিতু তারপরও পাশে বসে রইল আমার পাশে।
– কিছু বলবি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
– না। উত্তরটা দিয়ে নিতু চুপ করে রয়। আমি বিছানা থেকে উঠে চোখমুখে পানি দিয়ে নিতুর আনা চায়ের কাপে চুমুক দেই।
– মা পুরি ভাজছে। দিবো?
– না।
নিতু উঠে চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকায়।
– দাদা, তোর কিছু লাগবে?
– না তো! বেশ অবাক হয়েই উত্তরটা দিই আমি।

কিছুক্ষন কি যেন ভেবে নীতু বলে, মীরাপা ফিরে এসেছে। কথাগুলো দম বন্ধ করে বলে উঠে আমার দিকে তাকাল নিতু। তারপর হুড়মুড় করে চলে গেল রুম হতে!

অনেকদিন পর আড়মোড়া ভেঙ্গে থমকে যাওয়ার মত মীরা শব্দটি আমার কানে বাজছিল। চায়ের কাপ নিয়ে আমি বারান্দায় আসি।মীরার বারান্দার দিকে তাকাই। ওর বাসাটা মুখোমুখি হলেও আমার রুম হতে কেবল মাত্র মীরার বারান্দাটা দেখা যায়। ছোট ছিপছিপে বারান্দাটা ছেয়ে আছে রং বেরং এর বেলী আর গোলাপফুলে। এ গলির আর সব বারান্দা হতে একটু আলাদা বৈকি! তবু অনেক দিন আমার চোখে পড়ে নি সে বারান্দার বিশেষত্ব।
আমাদের বাসাটা ছিল আনকোড়া শহরটার এক প্রান্তে।তখন ঢাকায় পড়ি- ফাইনাল সামনে। তাও মাসে মাসে এখানটাতে ছুটে আসতাম। বন্ধু আমার কোনকালেই তেমনটা হয়ে উঠেনি। দুপুর বেলাটা যখন নিস্তব্দতার চাদর মুড়িয়ে বিশ্রাম নিত, তখন অলস দুপুরেবইয়ের ঢালি খুলে বারান্দায় পড়তে বসতাম আমি। শীর্ষেন্দুর গল্প আর সুনীলের কবিতা। ভুল করেও মনে আসেনিকোন অষ্টাদশির কৌতুহলের খোরাকহতেপারি এই আমি!
একদিন আমার রুমে নীতু এসে বলল,

– দাদা, তুই এসব কি ছাইপাশ পড়িস?
কিছুটা রেগেইনিতুর দিকে তাকালাম। নিজেকে রক্ষা করতে নিতু বলে উঠল ,
– আরেহ! আমি না ।এটা মীরাপার কথা। তোর এই বই গুলো দেখে আমায় জিজ্ঞেস করেছিল।
– মীরা কে?
– চিনো না? সত্যি? আহা!! মীরাপা কথাটা শুনলেই কি যে কষ্ট পাবে!!

নিতুর কাছ হতে তেমন কিছুই জানা হয় নি সেদিন। কিন্তু প্রথমবারের মত আমি মীরার দোতলার বারান্দায় তাকাতে ভুল করি নি। খেয়াল করলাম, কোন এক কিশোরীর সুনিপুণ যত্নে আগাছার মত ভেবে নেওয়া গাছগুলি কেমন সুন্দর করে বেড়ে উঠছে!

তখনও মীরার সাথে দেখাহয় নি আমার। আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটা একটু নাটকীয় ছিল বৈকি!! সেবার রেল স্টেশন হতে বাজার পর্যন্ত আসার কোন ফাঁকে যে আমার মানিব্যাগটা হারিয়ে ফেলেছি টের পাইনি । সিএনজি চালক এর হাতে মানসম্মান খোয়ানোটা যখন অবধারিত তখনই ত্রাতার ভূমিকা মীরার আগমন। ব্যাগ হতে টাকাটা দিতেই আমি চেচিয়ে উঠেছিলাম,

– আরে! আপনি কেন দিচ্ছেন?
– তাহলে কি আপনি গনপিটুনী খেতে চাচ্ছেন ? মীরা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
কথাটা শুনে আমি চুপসে গেলাম।
মীরা টাকাটা দিয়ে আমার দিকে ফিরল,

– কি ব্যাপার? অমন মুখ কালো করে রাখছেন কেন? মার খাননি বলে খুব আফসোস হচ্ছে?
– আপনার টাকাটা?
– মাত্র আশি ।ন্যায্য ভাড়া যদিও ষাট।যাইহোক, আমি ওই আশি টাকার শোকে মরছি না- নিশ্চিন্ত থাকুন।
– কিন্তু তারপরও. . . .
– তারপরও কি? মীরা আমার দিকে তাকাল। আচ্ছা, সমঝোতার ভঙ্গিতে মীরা বলে উঠল, ধরুন আমি যে প্রায় আপনার গল্পের বইগুলো ধার নিতাম সেই ধারটা শোধ করলাম।
– আমার বই ধার নিতেন আপনি? কে আপনি? আমি হতভম্বের মতো মীরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি।
-আমি? আমার চেয়ে দ্বিগুন হতভম্ব হয় মীরা আমার প্রশ্নটা শুনে।তারপর ঠোটদুটো চেপে ধরে আহত সুরে বলে উঠল,
– নীতু আসলে ঠিকই বলেছিল!আপনি মানুষটা একটা বড় ধরনের আহাম্মক!!

আমার হাতে রিকশা ভাড়াটা গুজে দিয়ে মীরা চলে গেল!
সেই পরিচয়ের পর হতে খেয়াল করলাম মেয়েটার প্রায় এ বাড়িতে আনাগোনা। আর সেই সুবাদে সে দিনের ত্রানকর্ত্রীর নামটা আর আমার অজানা রইল না। আমাদের প্রথম দেখাটা যতটা ছিল আদ্ভূত তার চেয়েও আকস্মিক। তাই হয়তো অষ্টাদশীকে সেদিন ওভাবে খেয়াল করা হয়ে উঠেনি।
কাধ ছড়িয়ে ঢেউ খেলানো চুলের চেয়েও সুন্দর ছিল মীরার ঘন পল্লবঘেরা চোখ – দীঘির কালো জলের মত গভীর সেই চোখ জোড়া আমায় যতটা আকর্ষন করেছিল ঠিক ততটা তীব্র বিরক্তিতে মীরা আমায় প্রতিবার পাশ কাটাতো যতবার আমাদের দেখা হয়ে যেত। অষ্টাদশীর পরিচয় না জানাটা অপরাধ ছিলঅবশ্যই কিন্তু সে অপরাধের শাস্তির স্থায়িত্বটা ছিল আমার কাছে অসহ্য রকমের দীর্ঘ!

তারপর এক বর্ষার বিকেলে মীরা আমার মুখোমুখি হল। এক হাতে আমার দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল ,
– একবার বই পড়ে ফেললে বুঝি দ্বিতীয়বার আর ছুঁয়ে দেখতে মানা?
– আমাকে বলছেন? টের পেলাম গলা শুকিয়ে গেছে।
মীরা চোখমুখে বিরক্তি। সেই বিরক্তি মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।মেয়েটা চোখমুখে রাগ ফুটিয়ে কথা বললে বেশি ভাল লাগে- এ কারনেই এত রাগ দেখায়!
ঠান্ডা গলায় মীরা বলল,

-আপনি ছাড়া এ রুমে আর কেবলমাত্র একটা প্রাণী আছে- দেয়ালের ঐটিকটিকিটা। যদি জানতাম টিকটিকিটা শিক্ষিত তাহলে আপনাকে আর প্রশ্নটা করতাম না! আমাকে আবারও বোকা বানিয়ে মীরা হনহন করে বাসা হতে বেড়িয়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যায় রগচটা কন্যার ফেরত দেওয়া বইটা খুলতে গিয়ে চিরকুটটা পেলাম।”আপনি এতটা গাধা কেন?” আমার মনে হচ্ছিল বুকের মধ্যে মনের সুখে কেউ ধুমধাম হাতুড়ি বাজাচ্ছে। কয়েকবার চিরকুটটা পড়লাম। কাঁপা হাতে মীরার ফেরত দেওয়া আগের বইগুলো খুলতেই বেরিয়ে আসল আরো কয়েকটা চিরকুট,

” শুনুন দাত মাজতে মাজতে আর কোনদিন বারান্দায় আসবেন না। বিশ্রি লাগে”
” ঘিয়ে রংএর শার্টটা সুন্দর”
” পরেরবার বিভূতির বই নিয়ে আসবেন ঢাকা হতে”
” অভ্যাসটা ছাড়ুন, না হলে খালাম্মাকে বলে দিবো- তার ছেলে রোজ বারান্দায় লুকিয়ে সিগারেট খায়!”

গাড়িটা মোড়ের গলির মুখে অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বারান্দায় দাড়িয়েছিলাম। মীরার বারান্দার দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করছি ।আর কোন দিন কেউ ও বারান্দা হতে আড়চোখে এদিকটায় তাকাবে না! আমার মনে হচ্ছে অনুভূতিগুলো শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে! অথচ এই অনুভূতির রংটা ফ্যাকাসে হয়েছিল আরওবছর চারেক আগে এক সকালে। নীতু আমায় ঘুম হতে উঠিয়ে থমথমে মুখে এক নিঃশ্বাসে যখন বলেছিল,
-দাদা, কাল রাতে মীরাপার বিয়ে হয়ে গেছে!! ছেলেপক্ষ দেখতে এসে বিয়ে পড়িয়ে গেছে।

শূন্যতায় ডুব দেওয়া আমি বাস্তবে ফিরে এসে আবার মোড়ের দিকে তাকালাম। মীরার ফিরে আসার পর আমার সাথে আর দেখা হয়নি । রোজ বারান্দায় দাড়িয়ে আমি অপেক্ষা করেছি, নীতুর মারফত বই পাঠিয়েছি চিরকুটের আশায়- মীরা দেখা করেনি। মীরার ডিভোর্সের খবরটা পাওয়ার পর সারারাত বারান্দায় বসে অন্ধকারে সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে দিয়েছিলাম কারো একটুখানি খেয়ালের আশায়। হতাশ হয়েছি।

রুমের এসে সাইড টেবিলে নীতুর রেখে দেওয়া চিরকুটটা পেলাম,” অনেকগুলো দিন পেরিয়ে যখন আবিষ্কার করলাম আপনার প্রতি অদ্ভূত এক ভাল লাগা কাজ করছে-সে অনুভূতিটাকে সযতনে লুকিয়ে রাখা ছাড়া তখন আর কিছু করার ছিল না আমার। আপনি মানুষটা বেশ বোকা ধরনের- তাই মুগ্ধতাটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। বুদ্ধিশুদ্ধি যদি আরেকটু থাকতো তবে টের পেতেন নিজের সাথে যুদ্ধ করে রাগের ভান করতে আমার আপ্রান চেষ্টাটা। আমি ভাল করেই জানতাম আমি অসম্পূর্ণ-ভাগ্যের রসিকতায় আমার মা হবার সম্ভাবনা কম।তাই কোনদিন বলা হয় নি- ভাললাগে!! হাজার হোক- কোনদিন আবার ভেবে না বসেন ঠকিয়েছি!

বাসাটা বদলে ফেললাম- যে চোখে মুগ্ধতা দেখেছিলাম একদিন তার যায়গায় করুণা দেখার সাহস নেই বলে।তবু শহরটা বদলাচ্ছি না- কোন এক মন খারাপ করা বিকেলে চোখ বন্ধ করে যাতে বাতাসে নাক ডুবাতে পারি-যে বাতাসটায় ভাগ বসাচ্ছেন আপনিও। ভাল থাকবেন। মীরা ” চিঠিটা দিয়ে মীরা “ধরা গেলে ছোঁয়া যায়না” দূরত্বে চলে গেল।আমি থমকে যাওয়ার মত থমথমে মুখে কতক্ষন বিছানায় পরে রইলাম। চিঠিটা পাওয়ার পর হতে আমার মনে হল চাইলেই মীরাকে আমি ছুতে পারতাম। আসলেই পারতাম!!

শো শো শব্দে আকাশ কাল করে কালবৈশাখির বৃষ্টি নামে এই শহরে। অফিসের জানালার সামনে দাড়িয়ে সেই বৃষ্টির ছাটগুলো আমায় ভিজিয়ে দেয়। আমার মনে হয় এই শহরের কোন এক খানে বৃষ্টিটা মীরাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছে।কিংবা ফাগুনের ঝিরঝিরে বাতাসটা যখন আমার শরীরটা জুড়িয়ে দেয় আমি অনুভব করি শহরময় মীরার অস্তিত্ব।
অফিস হতে বদলী আর প্রমোশনের খবর আসে। আমি প্রমোশনটা আটকিয়ে জোঁকের মত এই শহরে পরে থাকি। আমার ভয় হয় আমি চলে গেলে কোনদিন মীরা আর বাতাসে নাক ডুবিয়ে আমায় খুঁজে পাবে না। মাঝে মাঝে আমি শহরময় হন্য হয়ে ঘুরি।মিত্রের ঘাট, রেল ষ্টেশন, ইকবালের বাস স্টেশন- এক সমুদ্র মানুষের ভিড়েও আমার একলা লাগে।কখনো কখনো ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে আমার।চোখ বন্ধ করলে আমি মীরাকে দেখতে পাই। উদ্দেশ্যহীন হাটাহাটির ঘোরে আমি মীরাকেই খুঁজি!আমি ভেবেছিলাম আমাদের শহরটা বড্ড ছোট।অথচ শহরটা ছিল বেশ বড় -অন্তত মীরাকে খুঁজে না পাওয়ার মত বিশাল।

কেমন দ্রুতভাবেই না কতগুলো মাস পেরিয়ে যায়। আমি মীরারে খুঁজেও পাই না।তারপরও আশায় থাকি। হয়তো কোন এক দিন মীরার সাথে আমার দেখা হবে। কাচাবাজারে আলু পটল কিনতে গিয়ে একদিন চোখে পড়ে যাবে মীরাকে। নিজেকে আড়াল করতে না পেরে ধরা পড়ে যাওয়া হাসি দিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করবে,”কেমন আছেন?”
বুকপকেটে তাই আমি চিঠিটা নিয়ে রাস্তায় হাটি,যে কথাগুলো বলা প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই ।

“মীরা, বাম হাটুর নিচে হতে পা টা নেই। বছর দশেক আগে একসিডেন্টে হারিয়েছিলাম।তোমাকে যতটা বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম ততটা তুমি নও। না হলে বুঝতে পারতে আমার চোখে মুগ্ধতা আর অসহায়ত্বের সহাবস্থানটা। এক অষ্টাদশীকে নিজের পঙ্গু জীবনের সাথে জড়িয়ে না নেওয়ার অসহায়ত্ব!! একটা প্রশ্নের উত্তর জানার খুব ইচ্ছে- বলতে পারো, এই ঠকতে না দেওয়ার প্রতিযোগীতায় আমরা কে জিততে পারলাম?

ইতি
আবির”

আকাশ উথাল পাতাল করে জ্যোৎস্নার আলো উপচে পড়ে আমার শহরটায়। জোনাকিরা মনের আনন্দে সেই আলোয় খেলা করে। বিশাল জানালার পাশে দাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক নিসঙ্গ বৃদ্ধ। ঠিক তার উপরের ছাদে দাড়িয়ে জ্যোৎস্না বিলাস করে এক জোড়া সদ্য বিবাহিত স্বামী- স্ত্রী। আমার চারপাশ শূণ্য লাগে। চোখ বন্ধ করে আমি মীরাকে ডাকি। ভরা জ্যোৎস্নার শূন্যতার সাথে এক অদ্ভূত হাহাকার ভেসে রয় বাতাসে।সেই হাহাকার দুজন মানুষের- যারা একে অন্যকে না ঠকানোর প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত দুজনেই ঠকেছিল! কেউ জানলো না , শহরটার দুই প্রান্তে বাস করা অসম্পূর্ণ মানুষ দুটিও সম্পূর্ণ হতে পারতো!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত