২১ বছরের ভালোবাসার মানুষ গুলোর (বাবা, মা, ভাই) ভালোবাসা কে বিসর্জণ দিয়ে ২ বছরের ভালোবাসার মানুষ আবিরের সাথে পালিয়ে এসেছিলাম তবে মাঝপথেই আটকে যায়। কারণ বাবা আর বড় ভাইয়া কিভাবে যেনো বুঝতে পেরে গিয়েছিলো। তবে বাবা একা ছিলেন না। সরকারি পুলিশ বাহিনীও সাথে ছিলো তার। আমি ভয় পেয়ে আবিরের পেছনে লুকিয়ে পড়ি। বড় ভাইয়া রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমার কাছে এসে বাসায় চল…(বড় ভাইয়া) আমি আবার আবিরের পেছনে মুখ লুকায় বড় ভাইয়া আমার হাত ধরে টানতে লাগলে আবির বাধা দিতে গেলে বড় ভাইয়া আবির কে থাপ্পড় দেয়।
ভাইয়া ছাড় আমায়(আমি) ভাইয়া আমাকেও চড় দেয় এই ২১ বছরের প্রথম, ভাইয়া আমার গায়ে হাত তুললো। রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছিলো। ছোট থেকেই রাগী আর জেদি প্রকৃতির ছিলাম আমি। পুলিশ এসে আমাকে বলে, আপনি আপনার বাবা মায়ের কাছে যান। আমরা দেখছি কি করা যায়…বলে আবির কে এরেষ্ট করে।
আমি পুলিশ কে সরাসরি বলে দেয়, আমার বাবা ভাই নেই বাবা হইতো ওইদিন সব থেকে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিলো। কারণ ভালোবাসার মানুষের দেয়া আঘাত বিষের তৈরী তীরের মতো বুকে বিধে। বড় ভাইয়া আমাকে আবার চড় মারতে এলে বাবা থামিয়ে দেয় আমি বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, বাবার চোখে কোন প্রাণ ছিলো বলে আমার মনে হই না। বাবা আমায় ছেড়ে দাও। ওর এত সাহস ও তোমায় অপমান করে(বড় ভাইয়া)
বাবা মুচকি হেসে, পুলিশের দিকে তাকিয়ে, দারোগা সাহেব, আমারি ভুল হয়েছে, এটা আমার কলিজা না। আমার কলিজা ত এই কথা কোন দিন বলতে পারতো না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, ক্ষমা করবে মেয়ে। আসলে আমার কলিজা ছিলো একটা, যে আজ কলিজা টা ছিদ্র করে কোথাই যেনো চলে গিছে, তোমরা যাও…
বড় ভাইয়া দূরে সড়ে যায় আমি হাজার চেষ্টা করেও বাবাকে ডাকতে পারছিলাম না। চোখ থেকে শুধু জল পড়ছিলো। তখনি বুঝতে পেরেছিলাম আমি কি বড় ভুল করে ফেলেছি বাবা, বড় ভাইয়া, পুলিশ দের নিয়ে চলে যায়। আমি চিৎকার দিয়ে, বাবা বলে কান্না করে রাস্তার উপরে বসে পড়ি। আমায় ক্ষমা করো বাবা, আমায় ক্ষমা করো। আবির পেছন থেকে এসে আমায় ধরে বলেছিলো, চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আবিরের এই সান্ত্বনা টা ওইদিন নিতে পেরেছিলাম না। কারণ আমিতো আমার বাবার মেয়ে বাবার রাগ অভিমাণ সবটা আমার জানা ছিলো।
আমি ঈশিতা। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, তবে আমার বড় একটা ভাই ও আছে। ইদ্রিস ভাইয়া। দুনিয়ার সবার ভালোবাসা পরিমাপ করতে পারলেও এই ২ জনের ভালোবাসা আমি কখনো পরিমাপ করতে পারিনি। বড় ভাইয়া আমায় আদর করে মণি বলে ডাকতো আর বাবা আদর করে কলিজা বলে ডাকতো।আমার বুদ্ধি হউয়ার পর থেকে একদিন ও শুনিনি বাবা আমায় আমার নাম ধরে ডেকেছে। সব সময় শুধু কলিজা বলেই ডাক দিতো। আর আমিও বাবার এই ডাক টা তেই বেশি প্রশান্তি পেতাম। বড় হউয়া অবধি একটা দিন আর একটা ক্ষণ ও বাবা আমায় বকা অবধি দেয় নি মাইর ত দুরের কথা। মা মাঝে মাঝে বলতো, মাইয়াগোরে এত আদর দেয়োন ভালা না বুঝলা ঈশির বাপ। বেশি আদরে কিন্তু পোলাপান খারাপ হইয়া যায়।
বাবা তখন রাগী দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে, আমার আর আমার কলিজার মধ্যে তুমি আইবা না। ও আমার কলিজা। আমার সব ভালোবাসা টুকু ওর জন্যি। আমার পরীটার জন্যি।ওহ, হই। আর পরীটারে যে আনলো সে বুঝি পঁচে গিছে তাই নে??(মা)
আমি আর বাবা হেসে দিয়েছিলাম। তবে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম মা আমায় হিংসা করে, কারণ মাকে বাবা কম ভালোবাসে জন্য। হা হা হা বাবার সাথে এক চপট হাসার পরে ভাইয়া বাসায় এলে, ভাইয়াকেও একই কথা বলে হাসাহাসি করেছিলাম। ভাইয়া আমার কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলো, আমার মণিটার মুখে এই হাসি যেনো সারাজীবন থাকে হুম…??
আমি ভাইয়াকে জরায় ধরে, থাকবে যদি আমার পাওনাটা এখন পায় তবে ভাইয়া সাথে সাথে আমার সামনে, এক গাদা আইসক্রিম, আর ক্যাডবেরি তুলে ধরলো। এত্তত্তত্তত্তত্তত??(আমিতো খুশিতে গদগদ হয়ে যায়) ভাইয়ারে এই হাসি কোনদিন ও ফুরোবে না…. (আমি) পাগলী বোন আমার….(ভাইয়া মাথায় হাত বুলায়ে) যতক্ষণ অবধি বাসায় পৌছাইতাম না। বাবা তেমাথার মোড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। আর বাসায় মাকে খাবার বেড়ে রেডি থাকতে বলতো।
আমি কলেজ থেকে ফিরলে বাবা ভাইয়া, মা তবেই খাবার খেতো। সবসময় নিজেকে রাজকন্যা মনে হতো। এটাও মনে হতো, আগেকার রাজকন্যারা যদি এখন বেঁচে থাকতো তবে হইতো তারাও আমাকে দেখে হিংসে করতো….
আবিরের সাথে পরিচয় টা হই কলেজেই। প্রথমে ফ্রেন্ডশিপ তারপর বেষ্ট ফ্রেন্ড আর তারপরেই ভালোবাসার মানুষ।কি নেশায় পড়েছিলাম জানি না। যার জন্য বাবা মা, আর ভাইয়ের ভালোবাসা টাও আবিরের ভালোবাসার কাছে ফিকে আর তুচ্ছ মনে হতো।
আবিরের সাথে আমার রিলেশন চলাকালীন সময়েই ভাইয়া কিভাবে যেনো বুঝতে পেরে যায় আর তার ফলেই আজ আমাদের পালানোর মতো এত বড় খারাপ কাজ টা করতে হলো। কারণ ভাইয়া আমার জন্য বিয়ের সমন্ধের কথা বলাবলি করছিলো। আর আবির কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না।
আবিরের বাসাতে ঢুকেই প্রথম যেই আঘাত টা পায় আমার শাশুড়ি আর ননদের থেকে সেটা হলো, তারা মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলো, মেয়ে দেখলি ঠিক আছে, বিয়ে করলি ঠিক আছে, ত দেশে কি লম্বা মেয়ের অভাব ছিলো?? এই বাটুল মেয়ে তোর চোখে পড়েছিলো কেমনে রে??
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে ছিলাম। শুনেছিলাম আবির ওর মায়ের বাধ্য ছেলে কিন্তু মা পাগল ছেলে এটা জানতাম না। বাধ্য আর পাগলের মধ্যে পার্থক্য আছে। পাগল হচ্ছে ঠিক ভুল বিচার না করেই একপক্ষ নিয়ে কথা বলা। আর বাধ্য হলো ঠিক ভুল বিচার করে সঠিক টাকে সাপোর্ট দেয়া। আমার ভুল হলেও আবির আমাকেই বকতো আবার যদি ভুল আমার নাও হতো তবুও ওর মায়ের পক্ষই নিতো। আবিরের প্রতি যেই ভালোবাসা টা ছিলো বিয়ের আগে সেটা কমতে থাকে বিয়ের পরের আবিরের কাজ গুলো দেখে। আমি চাইতাম আবির ঠিক ভুল বিচার করে পক্ষ নিয়ে কথা বলুক। আমার ভুল হলে আমায় বকবে বা শুধরে নেউয়ার সুযোগ দিবে আর মায়ের ভুল হলেও সেটা মাকে বলবে, কিন্তু নাহ। সব সময় শুধু আমার উপর দিয়েই দোষ চাপায়ে দিতো।
রাত্রে বাবা মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়তো। আর কান্না করতাম মুখ বুজে। বিয়ের ২ বছরের এক দিন ও আমার বাবা আমার খোঁজ নেয় নি। তার কলিজা টা কেমন আছে সেই খোঁজ টাও নেয়নি, আর নিবেই বা কেনো? তার কলিজা যে তাদের ভালোবাসাকে অপমান করে নিজের কপালে নিজে কুড়াল মেরে এই দোযখে এসে পড়েছে।
৩ বছরের মাথায় আমার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। একদম পরীর মতো। কিন্তু মেয়েটাকে ১০ মাস পেটে রেখে বুঝেছিলাম আমার মা ও ত আমায় এত কষ্ট করেই তার গর্ভে ধারণ করেছিলো। আমার মেয়ে যেমন আমার নাড়ি ছিড়ে দুনিয়াতে জন্ম নিয়েছিলো, ঠিক একইভাবে আমিও ত আমার মায়ের নাড়ি ছিড়েই দুনিয়াতে এসেছিলাম। এতটা কষ্ট করে যেই মা আমায় দুনিয়াতে নিয়ে এলো তার ভালোবাসা টা আমি কেমনে ভুলে গেলাম??? আমার চোখের পানি আমার মেয়ের মুখের উপর পড়লো…
আমার মেয়ে নিশিও ঠিক আমার মতোই। একগুয়ে, জেদি, রাগী, সব গুন পেয়েছিলো। তবে আমার চেয়ে ওর বাবাকেই ভালোবাসতো বেশি। মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম, আচ্ছা সব মেয়ের প্রথম ভালোবাসার মানুষ টাই কি তার বাবা হই?? কেনো হই? মায়ের চাইতেও কেন তারা বাবাকে বেশি ভালোবাসে??
এক, এক করে পার হয়ে প্রায় ১৯ টা বছর একদিন নিশি এসে বললো ও নাকি এক ছেলেকে ভালোবাসে, প্রথমে আমি কিছু বলিনি। ছেলে কি করে জানতে চাই নিশির থেকে…নিশি বলে ওরা একই কলেজে পড়ে। তখনি চড় টা দেয় নিশির গালে। তোর লজ্জা করে না, সেম বয়সি ছেলের সাথে প্রেম করিস।(আমি) তোমার লজ্জা যেমন করেছিলো না আমারো তেমন করে না,বুঝলে। আর আমি ওকেই বিয়ে করবো…বলেই নিশি কান্না করতে করতে ঘরে চলে গেলো।
আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলাম, চোখ থেকে শুধু জল পড়ছিলো। আর ভাবছিলাম, আমার মেয়ে আমায় এ কথা বলতে পারলো?? আর পারবেই বা না কেন?? আমার কর্মের ফল ত আমাকে পেতেই হবে। কিছুদিন পরে গ্রামের এক চাচাকে দেখতে পায় আমাদের এলাকাতে। চাচাকে সালাম দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, বাবা কেমন আছে চাচা??(আমি) চাচা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কি বলো মা। তুমি জানো না?? আমি অবাক হয়ে, কি জানবো চাচা??(তোমার বাবা ত ৬ মাস আগেই মারা গেছে…(চাচা)
বুকেতে কিছু একটা বিধে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছে আমি মাটির উপরে না, শূন্যে ভাসছি…দৌড়ে বাসায় এসে রুম লক করে বেডের উপরে পড়ে যায়…জোরে জোরে কান্না করতে থাকি। আমায় ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ টাও দিলে না বাবা?? আমিতো তোমারি মেয়ে বাবা?? এত রাগ এত অভিমান করে চলে গেলে বাবা?? আমায় ক্ষমা চাওয়ারো সুযোগ দিলে না….আমার একটা ভুলের সাঁজা আমায় সারাজীবনের জন্য দিয়ে গেলে বাবা।
বিয়ের পর থেকে অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম বাবার সাথে কথা বলার, দেখা করার কিন্তু ফোনের অপাশ থেকে বাবা বলতো, আপনি ভুল জায়গায় কল দিয়েছেন এখানে সেই মানে কেউ থাকে না।
আমি শুধু চুপ করে বাবার কন্ঠটা শুনতাম। সেই কন্ঠটা শোনার জন্য সবসময় উদ্বেগ হয়ে থাকতাম কিন্তু গত ৬ মাসে এক বারো ফোন দিতে বা কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। কারণ আগে আবিরের ফোন থেকে কল দিতে দিলেও পরে আবির আর কল দিতে দিতো না। বলতো তোমার বাবার এত দেমাক কিসের??
ঈশিতার চোখ থেকে জল ঝড়ছে, অঝোর ধারায়, এই জলধারা কি কখনো থামবে?? হউতো সময়ের সাথে সাথে থেমেও যেতে পারে….সময় যেমন মানুষ কে সহজ করতে পারে ঠিক তেমনি কঠিন করতেও তার জুড়ি নেয়…