বুড়ি

বুড়ি

….কিরে বুড়ি, কি করিস? (মেঘার পাশে বসতে বসতে বললাম)
….> দেখ নীল,একদম আমায় বুড়ি বলে ডাকবি না(মেঘা)
…> কেন?
….> আমি মোটেই বুড়ি নই ….

> বুড়িই তো! দেখনা বাঁ পাশের গালটায় কেমন বসে গেছে ৷ এবড়ো থেবড়ো, হি হি হি> ইসসস, ওটা মোটেই বসে যায়নি বুড়ো ৷ ওটা টোল!জানিস ছেলেরা টোল পড়া মেয়েদের বেশি পছন্দ করে?

….> জানিনা, তবে তোর বুড়োর বেশ পছন্দের!
….> আবার শুরু করছে! চুপ থাক ফোন নিয়ে গেম খেলা শুরু করলো ৷ আমি ওর আরও একটু কাছে গিয়ে বললাম,
….> মেঘা
….> হুম
…..> শোননা
…..> বল, শুনছি..আমি মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে বললাম,
….> ভালবাসি
…> মাইর খাবি
…..> সত্যিই
….> এদিকে আয়, একটা সেল্ফি তুলি ..সেল্ফি তুলে ছবিটা আমার সামনে ধরে বলল
….> দেখনা, একদম বেমানান, চলবে না
….> আবার ফাজলামি শুরু করছিস?
….> তো কি করবো?
….> আমি সত্যিই বলছি
….> তুই থাক তোর সত্যি নিয়ে,

গেলাম আমি মেঘা উঠে হনহন করে চলে গেল ৷ কিছুক্ষণ বসে বসে পুকুরে ঢিল ছুড়লাম ৷ ভাবছিলাম মেঘা আবার ফিরে আসবে, কিন্তু আসলো না ৷ ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকগুলো “ভালবাসি” লিখে ওকে পাঠিয়ে দিয়ে উঠে বাড়ির পথে হাটা শুরু করলাম ৷ মেয়েটা এমন কেন? যতবারই ভালবাসার কথা বলতে যাই ফাজলামি করে এড়িয়ে যায় ৷ কিন্তু মনের মধ্যে ভালবাসাটা পুষে রাখাও অনেক কষ্টকর ৷ গৃহহীন পথিকের মত পাক খেতে থাকে ৷ নিজেও দু- দন্ড শান্ত হয়ে বসেনা, আমায়ও বসতে দেয়না ৷

দিন শেষের নীড়হারা পাখিটার মত ছটফট করতে থাকে, নীড়েই তার শান্তি ৷ সে নীড় যে মেঘা, সেটাই তাকে বোঝাতে পারিনি হয়তো ৷ কিন্তু যত দিন যায় আকুলতা বাড়তেই থাকে ৷ গভীর সাগরে ডুবতে থাকা মানুষটাও বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাইতো দু- হাতে জলের সাথে সংগ্রাম করে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ৷ আমিও একবার শেষ চেষ্টা করতে চাই ৷মেঘাকে ফোন দিয়ে পার্কে দেখা করতে বললাম… ৩০ মিনিট ধরে পার্কের বেঞ্চটায় বসে আছি ৷ মেঘার আসার নামই নাই ৷ বিরক্তি লাগছে, রাগও হচ্ছে ৷ মেঘা অনেকটা বদলে গেছে বুঝতে পারছি, আমার গুরুত্বটা কমে এসেছে ৷ ওর কথা আর কাজেই সেটা বুঝতে পারি একটু একটু ৷ আরও ১০ মিনিট পরে আসলো ৷

…> কিরে, হটাৎ জরুরি তলব? (মেঘা)
,..> কিছু কথা বলতে চাই ৷ জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা
….আর দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চাই।কোন ফাজলামি করতে পারবি না ৷
….> সিরিয়াস কিছু? কি হয়েছে?
….> জানিনা কি হয়েছে, কিভাবে হয়েছে ৷ শুধু জানি

আজীবনের জন্য কিছু শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যেটা তোকে ছাড়া পূরণ করা সম্ভব না ৷ তুই আর আমার অবসরে নেই রে, অভ্যাসে পরিণত হয়েছিস ৷ সেই অভ্যাস, যা কোনদিন ত্যাগ করা সম্ভব না ৷ তুই আমার অনুভবে নেই, অস্তিত্বে মিশে গেছিস ৷

একটাই চাওয়া, এই অস্তিত্বের সমাপ্তি যেন কোনদিন না হয় ৷ তোকে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছি, অনেক বেশিই ভালবেসে ফেলেছি বলে মেঘার হাতটা ধরলাম ৷ মেঘা আলতো করে ছাড়িয়ে নিলো ৷ ওর মুখের দিকে তাকালাম ৷ চোখদুটো ছলছল করছে, পলক পড়লেই কেঁদে দেবে ৷ মেঘা মুখটা ঘুরিয়ে চোখ মুছে নিলো ৷ আমি আবার ওর হাতটা ধরলাম, এবারও মেঘা ছাড়িয়ে নিল ৷ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ৷ মেঘা না সুচক মাথা নাড়লো ৷ আমি বললাম,

….> কারন?
….> (নিরব)
> তুইকি কাউকে ভালবাসিস?(মেঘা চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে একটুকঠিনভাবেই বলল,)
…> হ্যাঁ তাই
…> কাকে?
…> রাহাত, আমার কাজিন
…> ওহ, বলিসনিতো কখনো
…> প্রয়োজন মনে করিনি তাই ৷ যাই হোক, আমি আসি, কাজ আছে, বাই মেঘা উঠে দাড়াতেই আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
….> তুই মিথ্যা বলছিস
…> হাত ছাড় নীল।

আমার মাথায় যেন ভুত চাপলো ৷ এক ঝটকায় মেঘাকে বুকে টেনে নিলাম ৷ মেঘাও যেন কিছুক্ষণের জন্য পাথরের মত নিশ্চল হয়ে গেল ৷ তারপর এক ধাক্কায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সাথে সাথে আমার গালে সজোরে একটা চড় দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল ৷ ক্ষনিকের জন্য আমিও যেন স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম ৷ সম্বিত ফিরে পেয়ে মেঘার যাওয়ার পথের দিকে তাকালাম ৷ কেমন যেন ঝাপসা লাগছে, চোখটা যেন কেমন জালা করছে ৷ না, ছেলেদের কাঁন্না শোভা পায়না ৷ প্রাণপনে চেষ্টা করছি চোখের জল আটকানোর এতদিন ভাবতাম মেঘাও হয়তো আমায় ভালবাসে ৷ কিন্তু কয়েক মুহুর্তেই সব এলোমেলো হয়ে গেল, সব ধারণা মুহুর্তেই যেন শতশত যুক্তিতে ভুল প্রমাণিত হলো ৷ জানি মেঘার সাথে সম্পর্কটা আর আগের মত থাকবে না ৷ মধ্যে অজানা কোন দেয়াল হটাৎ মাথা তুলে দাড়িয়ে যাবে ৷ তাই নিজেকেই ওর জীবন থেকে সরিয়ে নেওয়াই ভাল হবে ৷ হয়তো কিছুদিন মিস করবে, কিন্তু সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে ৷

এখন আমি এখানে থাকলে ওর ভালবাসার বাধা হয়ে থাকবো, যা আমি কখনই চাই না ৷ তাই সেদিন রাতেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম ৷ এক মাসের বেশি হতে চলল গ্রামের বাড়িতে আসছি ৷ এর মধ্যে একবারও কথা হয়নি মেঘার সাথে ৷ যোগাযোগ করার সব মাধ্যমও নষ্ট করে দিয়েছি ৷ তবু মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছা হয় ওর হাসিমুখটা দেখতে ৷ হাসলে টোল পড়ে মেয়েটার ৷ অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে ওর টোলটার দিকে ৷ কিন্তু সে অধিকার হারিয়েছি ৷ না, হারিয়েছি বললে ভুল হয় ৷ যা পাইনি কখনো, তা হারাবো কি করে? বাড়িতে থাকতে ভাল লাগেনা ৷ মা বারবার জিগ্গেস করতে থাকে কি হয়েছে আমার, এমন মনমরা হয়ে থাকি কেন? সেদিন সন্ধ্যায় তো কেঁদেই দিয়েছিল ৷ আমারও ইচ্ছা করে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে, মনের মধ্যে জমা কষ্টগুলো বলতে ৷ কিন্তু ছেলে যে, কাঁন্না আমার শোভা পায়না ৷ কষ্টগুলো বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখি, নাহলে ওরা যে আমায় কাপুরুষ বলবে ৷ আমার জীবনের গল্পটা এভাবে শেষ না হলেও পারতো ৷ নিজেকে অনেকটা সামলেও নিয়েছি ৷

কিন্তু আবার সবকিছু এলোমেলো করে দিল মেঘার একটা চিঠি ৷ সেদিন নদীর পাড়ে বসেছিলাম, ছোট ভাই এসে বলল, > শহর থেকে তোর চিঠি এসেছে বলে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে চলে গেল ৷ ততক্ষণে সন্ধ্যা নামার উপক্রম ৷ পাখিরা সব নীড়ে ফিরছে ৷ আশেপাশের বাড়িগুলোতে সন্ধ্যা প্রদিপ জ্বালানো শুরু হয়েছে ৷ আবছা আলোয় চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম “কেমন আছিস নীল? সেদিন তোর খুব লেগেছিল নারে? কি করবো বল, আমার যে আর কিছু করার ছিল না ৷ ক্ষনিকের ভালবাসায় জড়িয়ে তোকে কষ্ট দিতে চাইনি ৷ চিঠিটা যখন পাবি তখন হয়তো আমি আর এই পৃথিবীতে নেই, আকাশের তারা হয়ে গেছি ৷ আচ্ছা, এই হাজার তারার ভিতর খুজবি আমায়? কত স্বপ্ন বুনেছিলাম তোকে নিয়ে ৷ তুই, আমি আর আমাদের ছোট্ট একটা সংসার, দুষ্টুমি আর ভালবাসায় ভরা ৷ কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেল, যেদিন ডাক্তার আমার ছয় মাসের জীবনসীমা বেঁধে দিল ৷

তুই যেদিন আমায় প্রথম ভালবাসি বলেছিলি, তার তিনদিন আগেই জানতে পারি সেটা ৷ সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম ৷ দুদিন তোর সামনেও যাইনি ৷ তুই জানিস, তুই আমাকে ২৫৩বার “ভালবাসি” বলেছিস, আর মেসেজে “ভালবাসি” বলেছিস ৬০৯৯বার ৷ কেউ হয়তো সারাজীবনেও একবার শুনতে পারে না এই শব্দটা ৷তোর হাতটা ধরতে ইচ্ছা করছে খুব ৷ লিখতেও কষ্ট হচ্ছে অনেক ৷ হাতটায় খুব ব্যথা ৷ তোকে আঘাত করার শাস্তি দিয়েছি ৷ কিন্তু তা না করলে যে তুই আমায় ছাড়া চলতে শিখতিস না ৷ পারলে ক্ষমা করে দিস, আর একটু ভালবাসা রাখিস আমার জন্য ৷ দেখিস, পরের জন্মে অনেক সময় নিয়ে আসবো তোকে ভালবাসার জন্য ৷ কাঁদবিনা একদম, আমি কিন্তু দেখবো আকাশ থেকে ৷ ভাল থাকিস…

……ইতি ….
..তোর বুড়ি….

শেষের লাইনগুলো পড়তে পড়তে বুঝলাম আমি কাঁদছি ৷ আজ আর চোখের জল আটকাতে ইচ্ছা হচ্ছে না, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে ৷ ঝাপসা দৃষ্টিতে হাটা শুরু করলাম নদীর পাড় ধরে ৷ চারপাশের অন্ধকারটাও ক্রমশ গভীর হয়ে আসছে ৷ সেই অন্ধকারের বুক চিরে মেঠো পথটা ধরে হাটছি আমি ৷ জানিনা এ পথের শেষ কোথায় ৷ হয়তো এই পথের শেষে দাড়িয়ে আছে মেঘা, আমার বুড়ি ৷ দাড়িয়ে আছে তার ভালবাসা নিয়ে, অধীর অপেক্ষায়…

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত