নিশিকে কি বলে ডাক দেবো বুঝতে পারছিনা। বউ বলবো! নাকি জানপাখি! বউ বললে অবশ্য নিশি বেশি খুশি হয়। আমি বুঝতে পারি মেয়েটা তখন মনেমনে হাসে। কেমন একটা চাহনীতে যেন তাকায় আমার দিকে। ওর এই চাহনীটা আমার অসম্ভব ভালো লাগে। আমি অবশ্য ওর এই চাহনীটা দেখার জন্য বউ বলেই বেশি ডাকি।
দরজার সামনে আরো একটু এগিয়ে গেলাম আমি। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা অসম্ভব রেগে আছে। নক করার আগে চেক করে নিলাম লক করেছেকিনা। চেক করতে যেয়েই খুলে গেলো। বাহ! বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে তো। দরজা লক না করে এমনিই লাগিয়েছে। যাক বাবা। আমার কষ্টটা কমিয়ে দিলো। আল্লাহ! এবার ওর রাগটাও কমিয়ে দাও নিশি অবশ্য আমার ওপর রাগ করে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারেনা। ওর নাকি দম আটকে আসে আমার সাথে রাগ করে থাকলে। অন্য সময় চুপচাপ থাকলেও সমস্যা নাই, কিন্তু রাগ করে কথা না বলে একদমই থাকতে পারেনা আমার বউটা। এখন যদি আমি ওর রাগ না ভাঙিয়ে নিজের মতই থাকি একটু পরই নিশি এসে আমায় একগাদা কথা শোনাবে। কেন ওর রাগ ভাঙালাম না আমি! কেন এমনটা করলাম! আমি কি জানিনা ও আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারেনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
একবার হলো কি ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবার কথা ছিল। নিশিই বলেছিল ওকে একটু ঘুরতে নিয়ে যেতে। চেষ্টা করলাম কিন্তু ছুটি হলোনা। তাই বলেছিলাম রেডি হয়ে ৫টায় অফিসের সামনে আসতে। এর মধ্যেই আমি বের হতে পারবো। ও যখন আমার অফিসের সামনে এসে আমায় ফোন দিল, আমি বের হবো ঠিক সে মুহুর্তেই বস আমায় ডেকে বলল একটা কাজে ইমার্জেন্সি গাজীপুর যাওয়া লাগবে আমার। নিশিকে জানালাম আজ হচ্ছেনা।বাসায় চলে যাও। রাতে যখন বাসায় ফিরলাম তখন দেখি নিশি মুখ ভার করে বসে আছে। আমি অনেকটা ক্লান্ত ছিলাম। তাই খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মত সব কাজ সেরে ঘুমাতে গেলাম। তার ঠিক তিন মিনিটের মাথায় খেলাম সেই এক ধাক্কা। তারপর একগাদা অভিযোগ।
আমি কি বুঝতে পারছি না আমার কাজের জন্য কেউ রেগে আছে। কেন রাগ না ভাঙিয়ে ঘুমাচ্ছি। বলতে বলতেই নিশি কেঁদে দিল। ওর কান্না দেখে আমার খুব খারাপলাগছিল। নিশি আমার বউ হলেও আমার প্রতি ওর কোনো আবদার ছিল না। বিয়ের পর আজ পর্যন্ত নিশি মুখ ফুটে আমার কাছে কিছুই চায়নি। সবসময় আমি যা বলেছি তাই শুনেছে, আমি যা দিয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছে। কিন্তু আজ একটা আবদার করলো তাও রাখতে পারলাম না। মেয়েটারও তো একটা মন আছে, ইচ্ছা আছে। যদি বলতাম অন্যদিন নিয়ে যাবো তবু হত, কিন্তু অফিসের সামনে নিয়ে যেয়ে আবার ব্যাক পাঠানোটা আসলেই বেমানান। আমার কাছে তো কিছুই চায়নি কখনো। কোনোকিছু নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগও করেনি।
সেদিনই ভেবেছিলাম এই মেয়েটাকে আর একটুও কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। মেয়েটা এমনিতেই অনেক চাপা। সবকিছু নিজের মধ্যেই চেপে রাখে। তারওপর ওকে নিজ থেকে কষ্ট দেয়াটা ঠিক হবেনা। তারপর থেকে সবসময়ই আমি ওর রাগ ভাঙাই। আমার অবশ্য ওর রাগ ভাঙাতে ভালোলাগে খুব। তাই মাঝেমাঝে ইচ্ছা করেই এমনসব কাজ করি যাতে ও রেগে যায়। আজকের কাজটাও ইচ্ছা করেই করা। আমি জানি এটা করলে নিশি রেগেযাবে। একটু নয় অনেকটা রেগে যাবে। তবুও আমি কাজটা করলাম এবং সেই হলো। নিশি অনেক রাগ করে চলে আসলো। এবার আমি ওর রাগ ভাঙাবো। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম আমি। দেখলাম বউ আমার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
আমি জানি নিশি আমায় অসম্ভব বেশি ভালোবাসে। তাই ওর এই খুনসুটি পাগলামি গুলো সবসময়ই মেনে নেই আমি। এই খুনসুটি পাগলামিগুলোর মধ্যেই যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। আরেকবারের কথা, আমার সিগারেটের নেশা ছিল। কিন্তু আমার এই অভ্যাসটা নিশির একদমই পছন্দ না। তাই বিয়ের সপ্তাহ দুই না যেতেই নিশি আমার সিগারেট খাওয়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা দেয়। আমার ধারণা এতদিন নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের সাথে সবকিছু মানিয়ে নেয়া ব্যাপার ছিল। তাই সপ্তাহ দুই দেরীতে এসেছে। আমি ভাবলাম নতুন বউ। তাই একটু আধটু করবেই। পরে ঠিক হয়ে যাবে। তাই তার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নিজের অভ্যাসমত কাজ চালিয়ে যেতে থাকলাম।
পরদিনই যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম তখন নিশি দেখে ফেলে। আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দেয়। তারপর বলে, “সিগারেট খাচ্ছ কেন? তোমার ঠোটের ভাগ আমি আর কাউকে দিতে পারবো না”। বলেই রাগান্বিতভাবে তাকায়। ওর কথা শুনে আমি হেসে উঠি। আমার হাসি দেখে ও আরো রেগে যায়। আমাকে টান দিয়ে ধরে চুমু খায় ও। তারপর বলে, রাগ করে চলে গেলে তো থাকতে পারবোনা। সেই এখনই আবার এসে কথা বলবো। তাই প্রমাণ দিয়ে গেলাম যে কোনোকিছুর ভাগই আমি দিতে পারবোনা। এরপর থেকে যেন আর সিগারেট না খাওয়া হয়। এই কথাটা মনে হলে আমার এখনও হাসি পায়। সেদিনের পর থেকে আমি সত্যিই সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দেই। একমাত্র বউয়ের জন্য সিগারেটের মত নেশা ছেড়ে দিলাম। ভাবা যায়!!?
– এই যে বউ আমার! এত রাগ করলে হবে?
– তোমার ওপর যে রাগ করে থাকতে পারিনা তা তো তুমি জানোই
– ওমা সেকি!! তুমি কাঁদছ!!?
– আচ্ছা অন্যের বউ দেখতে খুব ভালো লাগে না? আমি তো পুরনো হয়ে গেছি! ঠিক আছে আমি চলে যাবো। তখন যত ইচ্ছা অন্যের বউ দেখো। বলেই নিশি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
আসলে হয়েছে কি, ফুপির বাসায় গেছিলাম দুজনে। সেখান থেকে বাসার সামনে এসে যখন রিক্সা থেকে নামলাম তখন দেখি নিশি বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? বলল দেখছোনা? পাশে বউ আছে তবুও অন্যের বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখলাম আসলেই তাই। পাশে নিজের বউ থাকা সত্ত্বেও একজন নিশির দিকে তাকিয়ে আছে। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে আমি বললাম, তবে রে আজ! আমার ভাব দেখে নিশি বলল, ঝামেলার দরকার নাই। চলো বাসায় চলো। আমি নিশিকে বললাম দেখোই না কি করি! একটু পর নিশি বলে উঠলো, তুমি তো দেখি ওর বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছো। এবার আমি নিশির দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে বললাম, ও আমার বউয়ের দিকে তাকিয়েছে, আমিও ওর বউয়ের দিকে তাকিয়েছি। যেমন কর্ম তেমন ফল।
আমার কথা শুনে নিশি অত্যধিক রেগে বলল, তবে তুমি অন্যের বউ দেখেই থাকো। একদম আমার কাছে আসবানা। বলেই হনহন করে হেটে চলে আসলো। আমি জানি ও অনেক রাগ করেছে। কিন্তু ওর রাগ ভাঙাতে আমার খুব বেশি সময় লাগবেনা। মেয়েটা একটু অভিমানী বটে। তবে আমাদের বোঝাপড়াটাও একদম বন্ধুর মত। আমি ওকে যতটা বুঝি, ও আমায় তারচেয়েও বেশি বোঝে। তাই বন্ধুর মত এমন খুনসুটি ঝগড়া করতে বেশ ভালোই লাগে আমার। এখন ওর কান্না দেখে আমারই খারাপ লাগছে। মেয়েটা দেখি সিরিয়াস হয়ে গেছে অনেক। আমি ওকে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি। তারপর বলি, এই পাগলি তুমি বোঝো না আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি? তুমি কি বোঝোনা আমার তোমায় ছাড়া থাকা সম্ভব না?
এবার নিশি বলল, হ্যা হয়েছে। অন্যের বউ দেখার সময় তো ভালোই দেখো। ওর কথা শুনে আমি হেসে দিলাম। বললাম, ওর বর ও তো তোমায় দেখেছে। আমায় দেখেছে তো কি? আমি কি দেখেছি? আমি বললাম, না দেখলে কিভাবে বুঝলে ও তোমায় দেখছে? আমার কথা শুনে নিশি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রেখে বলল, তুমি অন্য মেয়ের দিকে তাকালে আমার ফাটে। ওর কথা শুনে আমি বললাম, আমারও ফাটে। ওই বেটা যেমন কর্ম করেছে, তেমন ফল পেয়েছে। আর তুমি যেমন ওই বেটাকে একবার হলেও দেখেছ, আমিও ওর বউকে দেখেছি। সমান সমান। আর এক ঢিলে দুই পাখি।
এবার নিশি আমায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, এতকিছু বুঝি না। বলেছি না তোমার কোনোকিছুই আমি কারো সাথে শেয়ার করতে পারবোনা। তুমি শুধু আমায় দেখবে। শুধুই আমায়। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমায় দেখবো। শুধুই তোমায়। আমার বউটা তো আর কম সুন্দরী নয়!