—এ, এই কি করছেন আপনি??
–ব্রিজটার এতটা কাছাকাছি গিয়েছিলো রাসেল যে কারোর কথাতে হঠাত করে ভয় পেয়ে যায়। এবং তাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে লাগছিলো। আরে, পরে গেলেই কি। ও ত মরতেই আসছে(রাসেল)
–কি করছিলেন এটা ভাই?? (তপু)
—বুকের ভেতরের ধুকপুকানি টা এখনও যায় নি রাসেলের। অদ্ভুত ত, এমন হচ্ছে কেনো ওর?? নাকি ভয় পাচ্ছে ও??
–ও মিয়া ভাই, কথা কন না কেন??(তপু)
—বিরক্তবোধ হয়ে চুপ থাকুন ত…. (রাসেল)
–তপু কিছুটা সময় চুপ থাকলেও রাসেলের কথাতেই আবার কথা বলার অনুমতি পেলো।
–রাসেলের কেমন যেনো লাগছিলো, শুধু শুধু ছেলেটাকে এমন বললাম কেন?/
–ভাই, ও ভাই( তপু)
–এমন করে কেউ ডাকতে পারে কাউকে?? এতটা ভালোবাসা এই ডাকের মধ্যে কেনো?? (রাসেল)
–ভাই আপনি কি করতে যাচ্ছিলেন এটা, মরতে??(তপুর মুখে বেদনার ছাপ)
–হুম…স্ট্রেইট উত্তর(রাসেলের)
—জীবন টা আপনার কাছে এতটা অমুল্যয়ায়ীত হয়ে গিছে??(তপু)
–চুপ করে আছে রাসেল।
–ভাই কি কারনে এটা করতে চাইছিলেন?? প্রেমিকা রাগ করছে??(তপু)
—রাসেল হেসে দিলো,
— ভাই, হাসেন যে। ভুল কিছু বলছি??(তপু)
—প্রেমিকা যার প্রতিটা দিন চেঞ্জ হই সে নাকি সেই দুঃখে সুইসাইড করতে আসবে, বলেইআবার হো হো করে হেসে দিলো।
–তপু চুপ করে ছিলো। আর ওদিকে রাসেল হেসেই যাচ্ছে।
—বাবা বলে দিয়েছে উনি নাকি আমাকে আর কোন ফাইন্যান্সিং সাহায্য করবে না। উনি আমাকে একটা টাকাও আর দিবে না। বাবার কথার পালটা জবাব দিতে গিয়ে উনি আমাকে থাপ্পড় দিয়েছেন জীবনের ১ম। জীবনের ১ম, জীবনের ১ম বলতেই থাকলো, (রাসেল)
—ব্যাস এইটুকুই??(তপু)
— এত বড় কিছু আর বলে ব্যাস এইটুকু। রাসেলের রাগ হয়ে যায়। তপুর জামাটা টেনে ধরে, এটা তোমার এইটুকু মনে হই??
–তপু হাসি মুখ নিয়ে, ভাই আপনি ত বড়লোক মানুষ, আমার গায়ে হাত দিলেন যে, নোংরা লেগে যাবে না??(তপু)
—ছেড়ে দিলো তপুকে
—শোনেন ভাই…..(তপু)
–তপু কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু ওকে থামিয়ে, রাসেল
—চুপ থাকো। এখন তোমার ভাষন আমি শুনতে চাই না। অনেক বড় বড় কথা বলতে সবাই পারে কিন্তু যে যেখানে থাকে সেই শুধু বুঝতে পারে তার অবস্থা
—ভাই, আমিতো আপনাকে কিছু বলবো না। শুধু একটা কথাই বলবো সেটা হলো, এখন ত ২ই টাবাজে, এখন থেকে বিকেল ৫ টা অবধি সময় টুকু আপনি আমার সাথে যাবেন/থাকবেন??(তপু)
—আমি কেনো তোমার সাথে যাবো??
–চলেন না ভাই, খারাপ লাগবে না।(তপু)
–এতক্ষণে রাসেল এটুকু বুজছে যে তপু রাসেলের আর যাই হোক ক্ষতি করতে পারবে না। আরকরলেই বা কি,, ওর কাছে ত টাকা পয়সা কিছুই নাই শুধু ও ছাড়া।
—মিয়াভাই কিছু ভাবেন??(তপু)
–, ইমম, নাহ, চলো(রাসেল)
–সত্যি যাবেন ভাই(তপু)
–এই এতক্ষণে রাসেলের মুচকি হাসিমাখা মুখ তপু দেখতে পেলো।
–হুম যাবো।
–চলেন ভাই, তপু ত মহাখুশি। ভাই আপনার হাত ধরতে পারি??(তপু)
–রাসেল চুপ করে আছে।
–নিরবতা যে সব সময় সম্মতির লক্ষন হয় না তা রাসেলের এই ব্যাবহারে বুঝে গিছে তপু।
—আরে চলেন ত ভাই, হাসিমুখ নিয়ে তপু আগে আগে, আর রাসেল তাকে অনুসরণ করছে। কি সব নোংরা জায়গা, উফফফ।
–রাসেলের মুখ থেকে কথাটা বেরোয়ে এলো, না চাইতেও।
–তপু একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে,আবারহাসি দিয়ে, আসেন ভাই
–রাসেলের কিছুটা খারাপ লাগলো,ছেলেটা হইতো মন খারাপ করলো। ধুর কি যেবলি আমি।
–একটা কারখানার ভেতরে, একপাশে খাতা কলম নিয়ে বসে আছে একজন, আর অন্যপাশে সবাইকাজ করছে। জুতা তৈরীর কারখানা মনে হচ্ছে। কি গন্ধ, গন্ধে রাসেলের বমি চলে আসছিলো। তপু বুঝতে পেরে রাসেল কে বাহিরে রেখে,আবার ভেতরে গেলো।
–ছি, এখানে কোন মানুষ থাকে?/ থাকতে পারে??(রাসেল)
—কি বললাম এটা?? ওই ছেলেটাও ত মানুষ।
–আমি পারবো না এখানে থাকতে বলেই পা বাড়াচ্ছিলো চলে যাওয়ার জন্য, তপু এসে, মিয়া ভাই চলেন। কিছুটা অপরাধবোধ করে, এ, এবার কোথায়??( রাসেল) আরে চলেন না। আইজকা ৫০০ টাহার কাম করছিলাম। ম্যানেজার রে কইয়া আরো ৩০০ টাহা বেশি নিছি।
–বেশি কেনো নিছো??(রাসেল)
–ও ভাই কি কন?? আপনি আমার মেহমান না?? আপনারে আইজকা ঘুরতে নিয়া যামু সেই সব জায়গায় যেখানে আপনি আগে হইতো যাননি। আর গেলেও সেইভাবে না যেভাবে আজ আপনাকে নিয়ে যাবো।
–আচ্ছা, একটা প্রশ্ন ছিলো?/(রাসেল)
–হ ভাই, কন(তপু)
–তুমি মাঝে মাঝে গ্রাম্য আবার মাঝে মাঝে শহরের শিক্ষিতদের মতো কথা বলছো, এটা কিভাবে??(রাসেল)
–তপু রহস্যময় হাসি দিলো, তারপর সামনের দিকে পা বাড়িয়ে, চলেন ভাই
—রাসেল কিছু বুঝলো না। চুপ করে শুধু তপুর কথা শুনলো। ১মে ওরা একটা হাসপাতালে আসলো,
–এখানে কেনো নিয়ে আসলা আমাকে??
( রাসেল কিছুটা রেগে তপুকে বললো কথাটা)
–ভাই, আপনার সমস্যা হচ্ছে??(কিছুটা ভরকে গিয়ে)
—রাসেলের রাগ টা বেড়ে গেলো যখন ওর পাশে একটা মহিলা ফ্লোরে বসে পড়ে কান্না করতে লাগলো, হইতো মহিলার কেউ মারা গিছে।
—তপু বুঝতে পারলো রাসেলের এগুলো ভালো লাগে না। ও বিরক্তবোধ করছে তাই ওখানথেকে তাড়াতাড়ি করে রাসেল কে অন্যদিকে নিয়ে নিলো।
—রাসেলের রাগ এখনো কমেনি। আর পুরো রাগ ঝারছে তপুর উপর দিয়ে। তপু চুপ করে আছে ত আবার মুচকি মুচকি হাসছে।
–এক পর্যায়ে, ভাই আপনার আম্মা মারা গেলে আপনি কি করতেন?? কান্না করতেন না??
—রাসেল ওর মাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে তাই আম্মিকে নিয়ে তপুর এই কথা বলাটাতে আগের চেয়ে বেশি রাগ হয়ে গেলো। আবার আগের মতো গেঞ্জি টা ধরে, আমার আম্মির মৃত্যু কামনা করিস তুই??( সরাসরি তুই বলে দিলো রাসেল)
— ভাই সেটা আমি কখনো বলিনি। আর কামনাও করিনা। আর একদিন না একদিন সবাইকেই ত মরতে হবে। হোক আজ বা কাল। তখন আপনি কি করবেন?/
—এবার কিছুটা শান্ত হয়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে, পাগল হয়ে যাবো আমি। আমার মা, ই আমার সব।
—তপু এবার হালকা হেসে, ওই মহিলাটারো হইতো ভালোবাসার এমন একটা মানুষ মরছে যার জন্য নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। ধরুন কাল আপনি যেই প্রিয় মানুষটার সাথে কথা বললেন তাকে যদি আজকে কবরে রেখে আসেন ত তখন কি আপনার কষ্ট হবে না?? যে আগামী দিনগুলো তে আর সেই মানুষ টা আর আপনাদের মাঝে থাকছে না।
—রাসেলের কিছুই বলার নেই তপুর এই কথাগুলোর পরে, গেঞ্জি টা ছেড়ে দিছে।
–তপু আবার মুচকি হাসি দিয়ে সামনের কেবিন টাতে ঢুকে পড়লো, তপুর দেখাদেখি রাসেল নিজেও ঢুকলো। রাসেল কেবিন টাতে ঢুকেই দেখলো, এক বয়ষ্ক পুরুষ লোক বেডের উপর শুয়ে আছে। রাসেলের মন টাতে কেমন যেনো লাগলো। কই, এই অনুভূতি ত আগে হইনি কখনো।
—দাদু, দেখেন কাকে নিয়ে এসেছি।(তপু)
—বয়ষ্ক মানুষটির উঠার শক্তিটুকু নেই, তবে চাইছেন উঠতে,
–রাসেল মানুষটার কাছে গিয়ে, দাদু পড়ে যাবেন ত। উঠতে হবে না।
–তপু কে এইটা?.তুমি কে দাদুভাই??
–দাদু তোমার নাতি গো, আমার বন্ধু(তপু)
—রাসেল অবাক হয়ে তাকালো তপুর দিকে।
—কিছুসময় পরে, কেবিনের বাহিরে এসে,
—আজ ৭ মাস যাবত পড়ে আছেন উনি।(তপু)
— রাসেল তাকালো তপুর দিকে
— সম্পর্কে উনি আমার কেউ না। কিন্তু বাড়িয়ালার বাবা উনি। সেই হিসেবেই দাদু বলতাম। অনেক ভালোবাসে আমায়। প্রতিদিন আমার জন্য খাবার রেখে দিতেন। এর জন্য বুড়ো মানুষ টা বউমার মুখে কম কথা শুনেন নি। তবুও রাখতেন। একদিন রাগ করেই বলেছিলাম, আমি আর আসবো না। আর আমি এখানে থাকবো না, রুম বদলাতে চেয়েছিলাম।
–দাদু আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো, আর বলেছিলো, নাতিরে, আমার আপন নাতিগুলোর ত সময়ি নেই আমার সাথে কথা বলার। তোর ও কি সময় নাইরে??
–এরপর কিছু বলার ছিলো না। দাদুকে আমি অনেক ভালোবাসি। যখন শুনতে পারি, ওনার কিডনিতে প্রব্লেম হইছে বড়জোর ৮, ৯ মাস আছেন, খুব খারাপ লাগছিলো। ডাক্তার বলেছিলো যদি একটা কিডনি ট্রান্সফার করা যায় ত কয়েক বছর বাঁচতে পারবেন। নিজের মেয়ে, ছেলে, নাতি সবাইকে বলেছে, অনুনয় করে, আমায় একটা কিডনি দাও তোমরা। আমি আর কয়েকটা বছর বাঁচতে চাই। আমি এখনি যেতে চাই না। একটা কিডনি দাও আমায়।
–কেউ দেয় নি জানেন ভাই। একজন ও না। ইভেন ওনার চিকিৎসার খরচটাও বহন করতে অপারগ প্রকাশ করে।
–রাসেল তপুর কথায় ওর দিকে শুধু চেয়ে আছে,
— আমি দিতে চেয়েছিলাম। একটা কিডনি (তপু)
—রাসেল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ চেনা যানা নেই কাউকে কিডনি দিবে??
–ভালোবাসতে চিনতে জানতে হই না ভাই। (তপু)
–তারপর কি করলা??(রাসেল)
–ভাগ্যে আমার মন্দ ছিলো ভাই। কিছু একটা ভুলে গেছিলাম আমি, তাই হলো না।(তপু)
–মানে?? কি????(রাসেল)
–কিছুটা কেশে, রাসেলের দিকে তাকিয়ে, চলেন ভাই। (তপু)
–রাসেল তপুর ব্যাবহারে শুধু অবাক ই হচ্ছে।
–বাহিরে এসে ২ জন একটা খাবার হোটেলে ঢুকলো,
–এইখানের বিরানীর যা টেস্ট ভাই। আপনি একবার খেলে কোনদিনও এর স্বাদ ভুলতে পারবেন না।
–রাসেল চুপ করে আছে,হউতো কিছু ভাবছে।
–হোটেল টা থেকে বেরোয়ে একটা সড়ু গলি ধরে হাটতে লাগলো,তপুর কথাটা একদম ঠিক।
বিরানী টা এতটা ভালো ছিলো যে রাসেলের আরো কয়েক প্লেট খাইতে মন চাইছিলো কিন্তু তপু হইতো কিছু মনে করতে পারে, আর তাছাড়া ওর হাতে ত টাকাও সেভাবে নেই। তাই আর বলা হইনি। একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলো ওরা।
–এটাই আমার জান্নাত (তপু মুচকি হেসে)
— এইটুকু ঘর, এটাও ওর কাছে জান্নাত মনে হচ্ছে৷ পাগল হয়েছে।(রাসেল)
–ঘরেতে বেশিকিছু নেই, একটা চৌকি, পাশে একটা বসার জন্য চেয়ার, চেয়ার টার ৪ পায়ার ১ পায়া ভাঙ্গা। একটা ৪০ পাওয়ারের ভাল্ব মিটমিট করে জ্বলছে।
–চৌকিটা দেখায়ে, এইখানে বসেন ভাই। আমি আসছি,
–রাসেল বসে পড়লো।
ঘরটা এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আর বিছানাটাও যে না চাইতেও রাসেল শুয়ে পড়লো। ৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে, উঠে বসলো। পুরো রুম টা আবার চোখ মেলে নিলো, হঠাত একটা টাংকি জাতীয় কিছুতে চোখ পড়লো রাসেলের। কাছে গিয়ে৷ টাংকি টা খুলে, দেখলো ওর মাঝে অনেক কিছু। তারমধ্যে একটা এলব্যাম। এযুগেও এলবাম আছে দেখে রাসেলের মন এলবামের ছবি গুলো দেখার প্রতি ইচ্ছাপোষন করলো। চৌকির উপর বসে পড়লো। এলবাম টার ১ম পাতা টা উল্টাতেই, একটা পরিবারের ছবি দেখা গেলো। বাবা মা, আর মাঝখানে হইতো তাদের ছেলে। ৩ জনের মুখেই হাসি। তারপরের ছবিগুলাতে, ছেলেটার ছবিই বেশি। তার মায়ের সাথে দুষ্টমি করার সময়ের পিক গুলা দেখে রাসেল নিজেই হেসে দিলো। ছবিগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পরিবারটা ধনীপরিবার গুলোর মধ্যে একটা। বাড়িটা পুরো রাজমহল এর মতো লাগছে।
–ভাই…..(তপু)
–পেছনে তাকিয়ে, তপুকে দেখে লজ্যা পেয়ে সরি বলে এলবাম টা পাশে রেখে দিলো….
—তপু হালকা হেসে, এলবাম টা নিয়ে, রাসেলের কাছে গিয়ে,
—এই যে এইটা দেখছেন এই ছবিটা ওঠার সময় ছেলেটা অনেক কেঁদেছিলো। বাবা বকা দিছিলো জন্য। সব সময় হাসিখুশি থাকতো ছেলেটা যার জন্য বাবা ইচ্ছা করে কাঁদিয়ে ছিলো ছেলেটাকে যাতে এই কান্নার ছবিটা ওনারা রাখতে পারে সারাজীবন।
–এতকিছু তুমি জানলা কেমনে??(রাসেল)
–আমিই সেই ছেলে।(তপু)
— রাসেলের বিস্ময় যেনো কাটছে না। মুখ থেকে বেরোয়ে আসলো, মানে??
–তপু চায়ের কাপ টা আগাই দিয়ে, জি, এটা আমার পরিবার। বাবা, মা আর আমি। দাদুর থেকে পাওয়া এই রাজমহলেই থাকতাম আমরা। দাদুর দাদা অর্থাৎ আমার বাবার পরদাদা ছিলেন জমিদার তাই তার পরবর্তী পুত্র নাতী গুলোর চালচলনেও ছিলো জমিদারিত্বের ছাপ। বাবাও তেমনি ছিলেন। মায়ের সাথে ওনার পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও বেশিরভাগ সময়ই উনি বাহিরে আড্ডা দিতে দিতে কাটাতেন। দাদুর সম্পত্তি এত ছিলো যে, সারাজীবন বসে খেলেও ফুরার মতো না। দাদুদের মতো জলসা ঘর বাবার আমলে না থাকলেও পতিতা পল্লী ভালোই ছিলো। প্রতিদিন সেখানে যাওয়া আসা ছিলো তার রুটিনপূর্ণ কাজ। আম্মা এগুলোর কিছুই জানতো না। কারন, উনি সারাদিন ঘরেতেই থাকতো। আর বাহিরে না বেরোনোর জন্য এগুলোর কিছুই উনি জানতেন না।
সময় যতই যায়, বাবা ততই দুর্বল হতে থাকে, সাথে মা নিজেও। আমার বয়স তখন ১১,। ওনাদের ২ জন কেই আমি নিজে একটা হাসপাতালে নিয়ে আসলাম, ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলো বাবার কাছে। বাবার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানি পড়লো। আব্বু আম্মুর ২ জনের রিপোর্ট ই এক রকম ছিলো। তাই মা তখন ডাক্তারকে আমাকেও পরীক্ষা করতে বলেন। অদ্ভুত লেগেছিলো আমার ব্যাপার টা। ওনারা অসুস্থ, কিন্তু আমাকে চেকাপ করছে কেন?/ রিপোর্ট টা দেখে আম্নু আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলো। আমি কিছুই বুঝেছিলাম না। বাসায় এসে আম্মু আব্বুকে ওনেক কথা শুনিয়েছিলো যা আমি লুকিয়ে শুনছিলাম। কথাগুলোর মধ্যে একটা কথা ছিলো এই, তোমার পাপের শাস্তি আজ আমাকে আর আমার সন্তানকে পেতে হচ্ছে। ছোট্ট মন টাতে শুধু এটুকুই গিয়েছিলো বাবা হইতো খারাপ কিছু করেছে আম্মুর সাথে।
–ছোট থেকে পড়াশোনা তে অনেক ভালো ছিলাম। ১১ বছরের আগের সময়টুকু আমি স্কুলেতেই সবার সাথেই পড়েছি। কিন্তু ওইদিনের পর থেকে আমাকে বাসার বাইর হতে দিতো না আমার বাবা। আম্মু চাইলেও বাবা বের হতে দিতো না। আর যেহেতু আমার পড়াশোনার প্রতি ছিলো অদম্য ইচ্ছাশক্তি, এই জন্য বাবা, ঘরেতেই টিচার এনে দিয়েছিলো। আমি ঘরেতেই ততদিন পড়তে থাকলাম যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার সময় আমায় কিছু বলে গিয়েছিলেন, কথাগুলো এমন ছিলো,
–তপু, সম্পদের বড়াই কখনো করো না। যেই সম্পদ তোমাকে সুস্থতা দিতে পারে না তার বড়াই কোনদিনও করবা না। আর তোমার বাবা যেই ভুলটা করেছে তুমি ওই ভুল টা করো না। আম্মু তখন বলেছিলো, ভুলটা করলেই কি আর না করলেই কি, শাস্তি ত পেয়েই যাচ্ছে। হ্যা, আমি শাস্তি পাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। শরীর টা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যেতো। মাথাতে প্রচন্ড ব্যাথায় কান্না করতাম একা, অন্ধকার রুমেতে। বাবা চলে যাওয়ার কয়েক বছর পরে মা, নিজেও চলে গেলো। আম্নু যাওয়ার আগে বলেছিলো, বাবা৷ তুই এই অভিশপ্ত সম্পদের মধ্যে থাকিস না। পারলে জুতার কাজ করলে করবি কিন্তু তবুও এই নোংরার চিহ্ন লেগে থাকা সম্পদের মাঝে থাকবি না। মাকে কথা দিয়েছিলাম, থাকবো না। আম্নুআমার কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলো, আমায় ক্ষমা করিস বাবা। আম্নুর চোখের পানিতে ভালোবাসা আর অপরাধ বোধ ছিলো যা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
হ্যা, আম্নুকে দেয়া কথাটা আমি রেখেছি। ততদিনে আমাদের সম্পত্তির পরিমানো ফুরিয়ে আসছিলো কারন বাবা সারাজীবন কোন কাজ ই করেনি। শুধু চাকর বাকর দিয়ে কাজ করিয়ে নিছেন। আর ওদিকে চাকর বাকর ওনার সম্পত্তির বেশিরভাগি বিক্রি করে কেটেপড়েছিলো। যেটুকু আমি পেয়েছিলাম, ওটুকু পাশের মসজিদ, মাদ্রাসাতে দিয়ে দেয়। আর নগদ টাকাগুলো একটা এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছিলাম। বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম ৫০% ছাড়ে। গায়ে থাকা একটা জামা আর প্যান্ট ছাড়া আমি আর কিছুই আমার সাথে নিয়ে এসেছিলাম না। ওইদিনেই আমি ১ম ওই রিপোর্ট গুলো হাতে নেই। আমার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় রিপোর্ট টা দেখে। যেখানে আমাদের ৩ জনের শরীরেই এইসআইভি ভাইরাস ছিলো। বিজ্ঞান বইতে এই রোগের ব্যাপারে আমি অনেকটাই জেনেছিলাম। তাই পুরো জীবন টা আমার থমকে গিয়েছিলো।
১৯ বছর বয়স থেকে আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। যার প্রতিটা মুহুর্তে মনে হতো এই বুঝি আমার সময় শেষ। প্রতিদিন কাজ করার ৫০০ টাকা হতে কিছু টাকা জমায়ে রাখতাম, আর ৭ দিন পর পর চেকাপ করতাম আর শুনতে চাইতাম এই যদি ডাক্তার বলতো আমি ঠিক হয়ে যাবো। বা তোমার আগের সব রিপোর্ট গুলোই ভুল। ডাক্তারের থেকে এই একটা কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম, কিন্তু নাহ। প্রতিবারি রিপোর্ট আমার সাথে খেলা করতো। হা হা হা, তপু জোরে হেসে দিলো। কি আজব দুনিয়া, একদিকের মানুষ সামান্য কষ্টেই সুইসাইডের পথ নেয় আর অন্য একজন মৃত্যুপথযাত্রী বাঁচার জন্য আকুল আবেদন জানায়। এইতো বয়স, ২০ গিয়ে ২১ পড়লো, ডাক্তার সময় দিয়েছিলো, ৩, ৫, অথবা ১০ বছরের। ৩ বছরে মরিনি, ৫ বছরেও না। হা হা হা, ১০ বছর পরে গিছে, তাই প্রহর গুনতে শুরু করেছি। রাসেলের চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। জানেন ভাই, প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে শুধু এইটুকু ভাবি কালকের সকাল টা আমি দেখতে পাবো ত??
এই একটা কারনে, আমি আমার দাদুকে কিডনিটা দিতে পারিনি। খুব কষ্ট হই জানেন ভাইয়া, যখন দাদু বাঁচার জন্য আমাকে বলে, নাতিরে, তুই ও আমায় একটা কিডনি দিলি না??অপরাধবোধ কাজ করে আমার মধ্যে। তপুর চোখে পানি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাসেল তপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। তপুর কান্নার কোন শব্দ হই না। রাসেলের কান্নার আওয়াজ কিছুটা হচ্ছে। ভাই, আমার কলার ধরবেন না??(তপু) রাসেলের কান্নার বেগ আরো বেড়ে চলে, ভাই একটা কথা বলি, শোনেন জীবনটা আমাদের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। এটাকে নিয়ে কোন খেলা বা অবহেলা করবেন না। যদি অবহেলা করেন ত একদিন বুঝতে পারবেন এর মুল্য টা কি ব্রিজ টার পাশ দিয়ে হেটে চলেছে রাসেল। তবে কিছুসময় আগের মানুষ আর এখনকার মানুষ টার মধ্যে অনেক পার্থক্য খুজে পাওয়া যাচ্ছে।
অনেকটা সাইড দিয়ে হাটছে, তপু আসতে চেয়েছিলো রাসেলের সাথে কিন্তু রাসেল আসতে দেয়নি। তপুর শরীর রাসেলের কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। হইতো ভালোবাসা থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো তাই তপুকে বলেছিলো, আজকেত রাতটা থেকে যায় আমি??(রাসেল) তপু হালকা হেসে, ভয় লাগছে ভাই?? আরে মরবো না এত তাড়াতাড়িই মরবো কেনো, আপনার মতো একটা ভাইয়ের সাথে আর কিছুটা দিন থেকে যেতে চাই ভাই(তপু) হাটতে হাটতেই রাসেল বুঝতে পারলো ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। যেই মানুষ টা একমাত্র মা ছাড়া এই ২১ বছরে কারোর জন্যকাঁদেনি আজ সেই মানুষ টাই কি একটা মানুষের জন্য কাঁদছে যাকে কয়েক ঘন্টা আগেই চিনতে পেরেছে। সারারাত রাসেলের এপাশ ওপাশ করতে করতেই গেলো। শুধু ভাবছিলো কখন সকাল হবে আর কখন আমি তপুকে এক নজর দেখতে পাবো। ভালো আছেতো ও?? মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় কাজ করছিলো রাসেলের।তাই ভোর হতে না হতেই বেড়িয়ে পড়ে তপুর ছোট্ট কুটিরের দিকে। ঘরে ঢুকতেই আটকে যায় রাসেল। ভেতর থেকে ঘরটা সিটকিনি দেউয়া।
তপু কি এখনও ঘুমায় নাকি?? রাসেল মনে মনে ভাবে। ডাকতে গিয়েও ডাকে না যদি ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফিরে আসছিলো রাসেল। পরে আসবে মনে করলো। কিন্তু পরক্ষনেই কি যেনো ভেবে দরজার উপর আঘাত করতে লাগলো, তপু, এ, এই তপু। দরজা খোল। এতটা জোরে রাসেল তপুকে ডাকছে যে পাশের বাড়ির সবাই বেরোয়ে আসছে কিন্তু তবুও তপু দরজা খুলছে না। রাসেলের ভয় টা আরো বেড়ে যায়। দরজা একপ্রকারে ভাঙ্গার চেষ্টা করলে বাড়িয়ালা এসে রাসেল কে থামতে বলে, কি করছো তুমি?? আমার ঘরটা ভেঙ্গে ফেলবে নাকি?? রাসেলের রাগ হয়ে যায়, বাড়িয়ালার গেঞ্জি টা টেনে ধরে, তোরে একশোটা দরজা আমি বানাই দিবো, এখন একটা কথাও বলবি না।
রাসেলের চোখ দেখে বাড়িয়ালা ভয় পেয়ে যায়, রাসেলের দরজা গুটানো দেখে তাড়াতাড়ি ঘড়ে গিয়ে এক্সট্রা চাবি এনে রাসেল কে দেয় এ, এই নাও। এটা দিয়ে খুলো। রাসেল চাবিটা পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। আর ভেতরে ঢুকেই ও স্তব্ধ হয়ে যায়। পাশে থাকা বাড়িয়ালা জোরেই বলে উঠে, ইন্নালিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাসেল কিছু সময় ধুম ধরে ছিলো তারপর, একপ্রকার ছুটে, তপুকে জড়িয়ে ধরে, ভাই, তপু, ভাই আমার দেখ দেখ আমি আসছি। ভাই তুই কোন দিকে তাকাই আছোস?? আমার দিকে দেখ, ভাই দেখনা আমার দিকে। চোখ ২ টো খোলা রেখেই শেষ নিশ্বাস টা নিয়েছে তপু।
রাসেলের আহাজারীতে পুরো কলনী স্তব্ধ হয়ে গিছে। কেউ কেউ বলছে, এটা কে হই তপুর?? আগে ত দেখিনি। কেউ কেউ বলছে কাল দেখলাম ২ জন কে আসতে। বিকেলে তপুকে কবর দিয়ে বাসায় ফিরলো রাসেল।মা একবার জিজ্ঞেস করেছে ওকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?? কি হয়েছে ওর?? রাসেল কোন উত্তর দেয়নি। চুপ করে ঘরে চলে আসে। দরজা লক করেই ফ্লোরে বসে পড়ে, চোখ থেকে পানি ঝড়ছে, ভেতরটাতে কষ্ট হচ্ছে খুব। ৩ ঘন্টার জন্য কেনো তুই আমার জীবনে আসলি ভাই?? কেন, আমায় এতটা ভালোবাসলি। কেনো তোকে ভালোবাসার সুযোগ দিলি না আমায়। পরের দিন, তপুর ঘরেতে বসে আছে রাসেল। গতদিনের তপুর বলা কথাগুলো শুধু ভাবছে। অনিচ্ছা স্বত্তেও চোখ থেকে পানি ঝড়ছে, চৌকির পাশে একটা পেজ দেখা যাচ্ছে, পেজ টা টেনে বের করলো রাসেল। ভাই রাসেল, হইতো এটাই তোমায় বলা আমার শেষ কথা।
সন্ধ্যা থেকেই খুব খারাপ লাগছিলো, বুঝতে পারছিলাম আজ হইতো সেই সময় টা আসছে যেইটার ভয়ে আমি প্রতিটা দিন থাকতাম। ভাই রাসেল, আমার আর সকালের আলোটা দেখা হলো না ভাই। তোমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে। তুমি অনেক ভালো জানো। আমার জামা টেনে ধরা, তোমার রাগি চোখের মাঝেও আমি আরো একটা জিনিস দেখেছিলাম সেটা হলো ভালোবাসা যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না ভাই। ভাই জীবন টাকে আর কখনো হেলায় ভেসে দিয়ো না। জানো, আমার খুব করে ইচ্ছা করছে বাঁচতে। কিন্তু আর কিছু লেখা নেই পেজ টাতে।রাসেল পাশে থাকা কলম টা নিয়ে পেজটাতেই লিখে দিলো, তুই সারাজীবন আমার ভিতরে বেঁচে থাকবি ভাই। আমার কলিজার টুকরা ভাই হয়ে। কাগজটার উপরে বিন্দু পরিমান জল গড়িয়ে পড়লো।