ছেলেদের জন্য বিয়ের আদর্শ বয়স হচ্ছে ২৬! আমার এখন সাতাশ চলে! অথচ অবাক করার মত বিষয় হলো, দিনের পর দিন এতবড় একটা ব্যাপার কিভাবে জানি বাড়ীর কর্তা আর কর্ত্রীর নজর এড়িয়ে যাচ্ছে! ব্যাচমেট থেকে শুরু করে অনেক জুনিয়রের পর্যন্ত বিয়ের ছবিতে ফেসবুকে আমার টাইমলাইন সয়লাব, অথচ বিয়ের বাজারে একজন উপযুক্ত আর আদর্শ পাত্র হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে এখনো বিয়ের ফুল ফুটেনি আমার!
বাড়ীতে বাবা আর মাকে দেখলে মনেই হয়না আমার বিয়ে নিয়ে উনাদের কোনরকমের মাথাব্যথা আছে। উনাদের কানে বিষয়টা উঠিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে উনারা নিজ থেকে আগাবেন সে সম্ভবনাও ক্ষীণ! কিন্তু নিজের বিয়ের কথা নিজ মুখে কিভাবে বলি? লজ্জাশরম বলতে একটা বিষয় আছে! আবার এদিকে না বললেও সমস্যা, বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে! এ যেন উভয়সংকট! বাসায় এমন কোন তৃতীয় পক্ষও নাই যে, যাকে দিয়ে বাবা মার কানে আমার বিয়ের ব্যাপারটা উঠিয়ে দিতে পারি! তাই শেষপর্যন্ত ভাবলাম লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে নিজেই ইনিয়ে বিনিয়ে উনাদেরকে এই বিষয়টা ইঙ্গিত করার চেষ্টা করবো!
সেদিন উদাস গলায় মাকে বললাম, “মা, বাসাটা কেমন জানি খালি খালি লাগছে! কেমন যেন মানুষজন কম কম মনে হচ্ছে তাইনা? বাসায় নতুন কোন মেহমান এলে ভালোই হতো!” মা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, “আজব তো! মানুষজন কমবেশী মনে হবে কেন? গত সাতাশটা বছর ধরে এই বাড়ীতে তুই আমি আর তোর বাবা মিলে তিনটা মানুষ বাস করছি, এখনো তো তাই আছি!” আরে তাইতো! এই বিষয়টা তো খেয়ালই করিনি আমি! তবে যে বিষয়টা খেয়াল করলাম সেটা হচ্ছে ছেলের বয়স যে সাতাশ সেটা মায়ের মনে আছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ের কথাটা মনে নাই! সেবারের মতো মাকে আমার কথার মাহাত্ম্য বুঝাতে ব্যর্থ হলেও আমি দমে যাইনি! দিনকয়েক পর আরেকদিন গিয়ে মাকে বললাম, “মা, বুয়ার রান্নাটা ইদানীং কেমন যেন হয়ে গেছে, খেয়ে স্বাদ নাই! নতুন রাঁধুনি আনা দরকার!”
মা আহত গলায় বললেন, “বাসায় বুয়া আসলেও কি আমি কখনো তাকে রান্না করতে দিই? তোর জন্মের আগের তিন বছর আর জন্মের পরের সাতাশ বছর, মোট তিরিশটা বছর ধরে রান্না করে চলেছি আমি, আর আজ এতবছর পর এসে তুই বলছিস রান্নায় স্বাদ পাস না? ঠিক আছে এখন থেকে রান্নায় লবণ কম দেওয়া হবে আর মরিচ বেশী দেওয়া হবে, তারপর ভিন্ন স্বাদের খাবার খাস!”মায়ের রান্না এমনিতে যথেষ্ট ভাল, এখন মনে হচ্ছে রান্নার দোহাই দেয়াতে মা সত্যি সত্যি রান্নার স্টাইল বদলাবেন, শেষে আবার খেয়ে শান্তি পাব না! তবে যে জিনিসটা ভেবে শান্তি পেলাম সেটা হচ্ছে, আমার বয়স যে সাতাশ হয়েছে সেটা মায়ের মনে আছে! পরক্ষণেই দুঃখ পেলাম এই ভেবে যে, সাতাশ বছরের ছেলেটার বিয়ের ব্যাপারে উনার কোন আগ্রহ নাই!
আমি দমে যাওয়ার পাত্র না। কিছুদিন পর নতুন আইডিয়া নিয়ে মায়ের সামনে হাজির হলাম আবার। বললাম, “মা, ইদানীং রিফাতের (রিফাত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড) সাথে ঘুরতে যেয়ে আনন্দ পাইনা। ছেলেটা কেমন যেন উদাস উদাস টাইপের হয়ে গেছে। সপ্তাহে অল্প একটু সময় পাই ঘুরার জন্য, আর সেই সময় যদি নিরানন্দ কাটে কেমনে হয় বলো? আমার মনে হয় নতুন ঘুরার সঙ্গী দরকার!” মা রাগী গলায় বললেন, “আমি তোকে আগেই বলছিলাম রিফাত নামের ছেলেটা একটা এক নাম্বারের বদমাইশ। দেখ নেশাটেশা করে উদাস হয়ে পড়ে থাকে কিনা! সাতাশ বছর বয়সে সাতাশটা না হোক একটা ভাল বন্ধু জুটাইতে পারলিনা, জুটাইছোস একটা নেশাখোর বন্ধু!” এ যাত্রায়ও মা আমার কথার গূঢ়ার্থ বুঝতে ব্যর্থ হলেন। তবে আমি এটা খুব করে বুঝেছি যে, আমার বয়স যে সাতাশ এইটা মা কখনো ভুলেন না আর ছেলের বিয়ের ব্যাপারটাও উনি কখনো মাথায় আনেন না!
মাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে শেষে ভাবলাম বাবাকে একটু নাড়া দিলে মন্দ হয়না! সেদিন বিকেলে বাবা ছাদে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। মা চা দিয়ে গেছেন একটু আগে। বাবার পাশে গিয়ে বেশ আধ্যাত্মিক ভাব নিয়ে বললাম, “আচ্ছা বাবা তোমার কি মনে হয়না এই বুড়ো বয়সে এসে তোমার একটু বেশী বেশী যত্ন দরকার? এদিকে মায়েরও বয়স হয়েছে, উনি তোমার যত্ন নিবেন কি, উনারই বরং কারো যত্ন দরকার! বাড়ীতে নতুন এমন কাউকে আনলে হয়না যে তোমাদের দুজনেরই খুব ভালোভাবে যত্ন নিবে? এই যেমন ধরো তুমি এরকম বিকেলে পত্রিকা পড়ার সময় তোমার মাথার চুল টেনে দিবে, পা টিপে দিবে, চা শেষ হয়ে গেলে আরেক কাপ এনে দিবে, প্রয়োজনে চায়ের কেটলি হাতে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে!” বাবা পত্রিকা থেকে চোখ তুলে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন!
শক্ত গলায় বললেন, “বিয়ের পর ত্রিশটা বছর হয়ে গেল! এই ত্রিশটা বছরে ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যও তোর মা আমার অযত্ন হতে দেয়নি। তোর জন্মের আগের তিন বছরে যেমন যত্ন পেয়েছি, তোর জন্মের পরের সাতাশটা বছরেও ঠিক একই রকম যত্ন পেয়ে এসেছি। আমার আলাদা কোন যত্নের দরকার নাই, আর বয়সও এমন কিছু বেশী হয়নাই আমার!” বাবার কথায় আমি বেশ আশাহত হলাম। তবে যেটা শুনে আশাবাদী হলাম সেটা হচ্ছে, ছেলের বয়স যে সাতাশ সেটা বাবার মাথায় আছে! কিন্তু পরক্ষণেই এটা মনে হতে আশা ভাঙল যে, সাতাশ বছর বয়সী ছেলেরও যে আলাদা যত্নের দরকার সেটা বাবা বেমালুম ভুলে বসে আছেন!
আমি বিয়ের ব্যাপারে বাবা মাকে বুঝানোর আশা একপ্রকার ছেড়ে দিলাম। এমন কোন আইডিয়াও আর মাথায় আসছিলো না যেটা দিয়ে বাবা মাকে বুঝানোর চেষ্টা করা যায়। সেদিন সকালবেলা অফিস যাওয়ার জন্য বেরুনোর সময় অনেক করে খুঁজেও জুতার মোজা জোড়া খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর এতেই মোজা খুঁজে না পেলেও মাকে বিয়ের ব্যাপারে বুঝানোর জন্য আমি একটা নতুন আইডিয়া খুঁজে পেলাম! বিকেলে অফিস থেকে ফিরে সোজা গেলাম মায়ের কাছে! “মা, ইদানীং একটা সমস্যা ফেইস করছি খুব!” “তোর আবার কিসের সমস্যা?”
” মা, ইদানীং না নিজের জিনিসপত্র গুলো কই রাখি কই রাখিনা খুঁজে পাইনা! এই যেমন ধরো, আজ সকালে অফিস যাওয়ার জন্য বেরুনোর সময় দেখি মোজা জোড়া নাই, গায়েব হয়ে গেছে। মোজা খুঁজতে গিয়ে অফিসে একঘণ্টা লেইট। নতুন চাকরী, প্রতিদিন মোজা খুঁজতে গিয়ে যদি একঘণ্টা করে দেরী করি তাহলে তো চাকরীই থাকবেনা! মা যদি এমন কেউ থাকতো, যে আমার জিনিসগুলো সবসময় গুছিয়ে রাখবে, অফিস যাওয়ার সময় আমার জুতো মোজা কোট টাই ঘড়ি ওয়ালেট সব এক জায়গায় করে আমাকে অফিস যাওয়ার জন্য রেড়ি করে দিবে তাহলে আমার চাকরীটা যাওয়ার আর কোন ভয় থাকেনা!”
“আগে তোর মোজার গন্ধ দূর কর হারমজাদা, না হলে চাকরীই তোকে দূর করে দিবে! মোজার গন্ধে তোর ঘরে ঢোকা দায় হয়ে পড়ছিল, তাই কাল রাতে আমিই তোর মোজা নিয়ে ধুইতে দিছিলাম। এরপর থেকে মোজা না পেলে বারান্দার জানালায় খুঁজবি। সাতাশ বছরের বুড়ো হয়েছিস অথচ এখনো নিজের কাজ নিজে করতে পারিস না, নিজের জিনিসের নিজে খেয়াল রাখতে পারিস না!”
এরপর আর কোন কথা থাকেনা! থাকা উচিতও নয়! আমি ভাল করে বুঝতে পারলাম আমার বউয়ের দরকার থাক বা না থাক, এই বাড়ীর বউয়ের দরকার নাই! আমার বিয়ের শখ এই জন্মের মত মিটে গেল! মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে, বিয়ে না হওয়াতে বরং ভালোই হয়েছে, কারণ বিয়ের পর নাকি পুরুষ মানুষ মরে যায়!
আমি বেঁচে থাকার আনন্দে গুনগুনিয়ে গান ধরলাম!