আমার আশালতা

আমার আশালতা

দীর্ঘ চার বছর সম্পর্ক করার পর আমার ও লতার বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়েছে৷ বিয়ে হওয়ার পর কেটে গেছে আটটি বছর ৷ এই আট বছরে আমাদের মাঝে কত যে ভালবাসাবাসি, রাগ, অভিমান, ঝগড়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এক কথায় একটা আদর্শ সম্পর্কের পেছনে যেসব ফ্যাক্টর কাজ করে তার সবগুলোই রয়েছে। কে জানি বলছিল, প্রেম করে বিয়ে করলে নাকি পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা হয়, আগের মত একে অপরের প্রতি কেয়ারিং ও সম্মানটা আর থাকেনা। স্বামী তার স্ত্রীকে আগের মত করে আর সময় দেয়না। কিন্তু আমি মনে করি, প্রেম করে বিয়ে করার পর স্বামী স্ত্রীর মাঝে সম্পর্কের ফাটল কখনই ধরবেনা যদি আমরা প্রেমটা শুরু করি ছেলে বা মেয়েটার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে। কারন শুধুমাত্র ভাল চেহারা দিয়ে হয়তো কারো ভিতর ক্রাশের সৃষ্টি করা যায়, ভালবাসার নয়। আর ভালবাসা ও ক্রাশ সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়।

আমাদের বিয়ের দুই বছর পর মনে হল যে আমাদের বেবি নেওয়া দরকার। তারপর বেবি নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করলাম৷ এভাবেই কেটে গেল আরো দুইটা বছর। কিন্তু কোনভাবেই লতা কনসিভ করতেছে না। বুঝতেছিলাম না বাচ্চা না হওয়ার পেছনে কারনটা কি! একজন ভাল ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম আমরা। আমাদের দুজনকেই বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করতে বললো ডাক্তার।

সেদিনই পরীক্ষার ফলাফল আমরা হাতে পাই। ডাক্তার আমাদের দুজনের সামনে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনা করলো। ডাক্তার বললো সমস্যাটা আমারই। আমার স্পার্ম ডেথ। ডেথ স্পার্ম দিয়ে কোন ভাবেই ফার্টিলাইজেশন সম্ভব নয়। আর এর চিকিৎসা করলেও আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত দুজন জেগে থাকলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই! বাহিরে কোকিলের সুমধুর কন্ঠে গান শোনা যাচ্ছে। হয়তবা আজকের রাতটা আমাদের অনেক রোমান্টিক হতে পারতো। কিন্তু সকল রোমান্টিকতা হারিয়ে গেছে ডাক্তারের ঐ একটা কথা শুনেই। আমি লতাকে বললাম, ‘লতা তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। কখনো তো তোমাকে মা ডাক শোনার সুযোগ করে দিতে পারবনা। নতুন কাউকে বিয়ে করে সুখী হও তুমি। ‘ সে বললো, ‘ লিখন, আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও চলতে পারবনা। তুমি আমার অক্সিজেন। রক্তের হিমোগ্লোিবনের মাধ্যমে তুমি আমার দেহের প্রতিটা কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়েছো। তাই এই কথা বলিও না প্লিজ! ‘

‘তুমি আমাকে এতটা ভালবাসো কেন লতা? ‘
‘তোমায় ভাল না বেসে থাকতে পারিনা তাই।’
‘আচ্ছা লতা ঘুমাও তুমি, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। ‘ প্রায় বিশ মিনিট পর
আমি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসলাম। লতা আমার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না শুরু করে দিল। সে বললো, ‘লিখন, তুমি কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়েছো কেন? ছেলেদের কাঁদতে নেই। চিন্তা করবেনা একটুও । আমি তো আছিই তোমার পাশে। তোমার সাথে আমি বুড়ি হব।লিখন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবনা কখনো। প্লিজ বিলিভ মি…।’

দূরের কোন এক মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে, দুজনই ওজু করে নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার পরিবার আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাহিরে পাঠাতে চাইলো। কিন্তু আমি না করে দিয়েছি এবং এটাও বলে দিয়েছি যে, আমার এই রোগ ভাল হবার নয়। ‘

তারপর কেটে গেছে সাত বছর আট মাস। সংসারটা ঠিক আগের মতই রয়েছে। প্রতিদিন লতা চোখে কাজল দেয় হালকা করে, শাড়ির আঁচলটা কোমরে বেঁধে রান্না করে, আমাকে আদর করে নিজের হাতে ভাত তুলে খাওয়ায়। তবে আমি বুঝতে পারি সন্তান না পাওয়ার আকুতিটা লতার প্রতিটা নিঃশ্বাসেই রয়ে গেছে।

একদিন হঠাৎ লতা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো।তাকে এম্বুলেন্সে করে রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালাম। ডাক্তার এসে পর্যবেক্ষণ করে কয়েকটা টেস্ট করতে বললো। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী টেস্ট গুলো করালাম।

টেস্ট হাতে নিয়ে ডাক্তার গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আমি তার চেহারার দিকে তাকালাম, দেখলাম ডাক্তারের চেহারায় একটা বিপদের ছাপ ফুটে উঠছে। আমি আঁচ করতে পারলাম, অনেক বড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে লতার সাথে। আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম। ডাক্তার আমায় বললো, ‘ লিখন সাহেব, আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিচ্ছি, ভেঙ্গে পড়বেন না। ‘
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে বলেন।’

আপনার ওয়াইফের লিউকেমিয়া হয়েছে। লাস্ট স্টেজ চলছে।এই অসুখ ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও আপনি চাইলে ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে পারেন।

ইন্ডিয়া যাওয়ার সকল প্রক্রিয়া শেষ। আর তিনদিন পরেই ফ্লাইট। লতা তার রিপোর্ট গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর ফাইলে ঢোকাচ্ছে। আলমারির উপরের ড্রয়ারটাতে আমি আমার ব্যক্তিগত কাগজপত্র গুলো রাখি৷ ওটা কখনোই লতা খুলে দেখেনি ওর ভেতর কি আছে। আজকে চাবি পেয়ে ড্রয়ারটা সে খুললো। খুলে যা দেখলো তা লতা কখনো ভাবতেই পারেনি৷ আমাদের বাচ্চা না হওয়ার জন্য লতা দায়ী, এটা সে রিপোর্ট দেখে বুঝতে পারলো। কিন্তু সেদিন আমাকে সে কিছুই বললোনা এ বিষয়ে।

সারাদিনটা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ঘুরে লতার জন্য চিকিৎসার টাকা সংগ্রহ করে রাতে বাসায় ফিরলাম। বাসায় আসতে না আসতেই লতা আমার বুকে ঝড়ের বেগে এসে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে লাগলো। আমি তাকে সান্তনা দিলাম, লতা তোমার কিছু হবেনা, তুমি ভাল হয়ে যাবে। দেখবা আমার আমরা একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো, চাঁদনী রাতে মাদুর বিছিয়ে খুনশুটি করবো। ‘

নাহ সে কিছুতেই থামছেনা। এই মুহুর্তে আমি কি করব কিছুই বুঝতে ছিলাম না। একসময় লতার কান্না থেমে গেল, হয়তবা চোখের পানি গুলো ফুরিয়ে গেছে। এখন হয়ত তার শুধু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, চোখের জল বের হয়না।

আমি, লতা, আমার বড় ভাই ও লতার বাবা, মা, ভাই। আমরা সবাই ভারতের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। প্লেন আকাশে উড়ছে। জানালার দু পাশ দিয়ে সারিসারি মেঘ চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একটু ছুয়ে দেখি।

হঠাৎ দেখতে পেলাম, আকাশে মেঘের মত করে লতা ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি হাত বাড়ায়ে দিয়ে তাকে ধরতে গেলেই সে বহুদূরে উড়ে যায়। প্রায় দু ঘন্টা এমন করে তার কাছে যেতে চাইলাম।কিন্তু ব্যর্থ হলাম।রাত নেমে আসছে।

আকাশের তারা গুলোও মিট মিট করে জ্বলছে। এবার লতাকে দেখলাম আকাশের উজ্বল তারা হয়ে ভেসে বেড়াতে। সে আমার নাগালের বাহিরে, বহু কোটি আলোকবর্ষ দূরে তার অবস্থান। দূর থেকেই তাকে দেখছি আমি নয়ন ভরে। কাছে আর যেতে পারিনা। এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে প্রতিবারই বাঁধা দিচ্ছে।

চারদিকে কিসের জানি শব্দ শুনতেছি। হঠাৎ মনে হল প্লেনটা এইমাত্র এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল৷ লতার মেঘ ও তারা হওয়াটা আমার কাছে ছিল স্বপ্ন।

এ্যাপোলো হসপিটাল। পৃথিবী বিখ্যাত ডাক্তাররা এখানে সেবা দেয়। মনের মধ্যে সাহস নিয়ে আসলাম। আর লতাকে বললাম, আমার মন বলছে তুমি ভাল হবেই। ডাক্তার লতাকে দুইদিন পর্যবেক্ষণে রাখলো, তারপর চিকিৎসা শুরু করলো। প্রথম দুদিন ভালই উন্নতি হতে লাগলো। কিন্তু এরপর থেকে তার অবস্থা খুবই খারাপ হতে লাগলো।ডাক্তার সব আশা ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বললো। যে কোন সময় আমার লতা আকাশের তারা কিংবা মেঘ হয়ে যাবে। লতা আমার সাথে একাকী কথা বলতে চাইলো। আমি ভিতরে গেলাম। সে আমার হাত ধরে বললো, ‘লিখন, আমার সমস্যার কারনে আমাদের বেবি হয়নি, তুমি কেন তোমার সমস্যা বলে প্রকাশ করছো? আর ডক্টরই বা কেন তোমার সমস্যা বলে রিপোর্টের ফলাফল দিয়েছে? ‘

‘লতা আমি তোমায় অনেক ভালবাসি।তোমার সমস্যার কারনে বাচ্চা হচ্ছে না এটা যদি আমার পরিবারও আশেপাশের লোকজন জানতে পারে তাহলে তুমি উঠতে বসতে খোঁচামারা কথা শুনতে৷ এমনকি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য বাধ্যও করতো আমার পরিবার। আর আমি তোমাকে একা ফেলে চলে যেতে চাইনি কখনো। আর ডাক্তারকে আমি আগেই বলছি, রিপোর্ট যা-ই আসুক না কেন, সব সমস্যা আমারই, এই বলে আপনি টেস্টের ফলাফল বলবেন। ‘

‘এতে তোমার যে মানসম্মান চলে গেল লিখন? ‘
‘যাক, সমস্যা নেই। আমার মান সম্মানের চেয়ে তুমি আমার কাছে অনেক বড়। ‘
‘এত ভালবাসো আমায়। কিন্তু আমি তো মনে হয় আর বাঁচতে…..।
আমি তার মুখ চেপে ধরে বললাম,’ প্লিজ একথা বলিও না লতা।তোমার কিছু হবেনা গো। ‘
‘লিখন, আমি জানি আমি বাঁচব কিনা। তবে তোমাকে একটা কথা বলি আমি, মানবে তো?’
‘হুম মানবো, বল। ‘

‘লিখন, তুমি আমার কাজিন নেহাকে বিয়ে করিও৷ আর তোমার যদি মেয়ে হয় তবে তার নাম রাখিও ‘আশালতা’। আমি তার মাধ্যমেই তোমার হৃদয়ে সারাজীবন থাকবো। লিখন তুমি এখন সোজা চলে যাবে। পেছনে ফিরে আর তাকাবে না। আমি তোমার জন্য জান্নাতে অপেক্ষা করব। আর মাকে একটু পাঠিয়ে দাও আমার রুমে।’

আমি দুহাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলাম। লতা ও লতার মা রুমে কথা বলছে।’মা,লিখনের কোন সমস্যা নেই। আমার সমস্যার কারনেই বাচ্চা হয়নি আমাদের। তুমি নেহার সাথে তার বিয়েটা দিয়ে দিও। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে। ‘

রুমের সবাই কাঁদতেছে৷ লতা আর আমাদের মাঝে নেই। আমি কেন জানি কাঁদছিনা একটুও। খুব ইচ্ছে করেও চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না আমার। মানুষ অধিক কষ্ট পেয়ে যখন পাথর হয়ে যায় তখন কাঁদেনা। বড্ড কষ্ট পেয়েছি আমি। তাই হয়ত কান্না নেই। তবে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ
ঠিকই হচ্ছে । কান্নার চেয়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আমার কাছে অনেক কষ্টের প্রতীক৷

বাইরে মৃদু হাওয়া বইছে। ঘরে নেহা রান্না করছে। আমাদের মেয়ে আশালতাকে নেহা সময় দিতে পারছেনা বলে সে কাঁদতেছে। আমি আমার কাজ রেখে আশালতা কে কোলে নিয়ে আকাশ দেখছি, পূর্ণিমা রাতের আকাশ। এই যে আশালতা মা, ‘দেখছো আকাশের তারাটা কত উজ্জ্বল? ‘

‘জ্বি বাবা দেখছি । ‘
‘বলতো ওটা তোমার কি হয়? ‘
‘ওটা আমার মামুনি হয়। ‘

গত তিনবছর ধরেই রাত নামলেই বাপ বেটি তারা দেখতে বসে পড়ি। আশালতাকে শিখিয়ে দিয়েছি, ঐ তারাটা কোন সাধারণ তারা নয়। ওটা তোমার মামুনি, আমার লক্ষ্মী বউ, লতা। আশালতা। বাঁচার আশা হারিয়ে লতা আকাশে গিয়ে তারা হয়ে রয়েছে। তাকে এখনো অনুভব করি। তবে ধরতে পারিনা। কারন সে পৃথিবী থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দুরে। তার কাছে যেতে হলে আমাকে এক অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলা করেই যেতে হবে। আর সেটা হচ্ছে মৃত্যু। জানিনা সেটা কবে হবে। থাক, আপাতত তাকে দুর থেকেই দেখি, খুব গভীর ভাবে অনুভব করি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত