ভালোবাসার পরিপূর্ণতা

ভালোবাসার পরিপূর্ণতা

“এই যে নীল শার্ট পরা ছেলে এদিকে শোনেন তো।”
বেশ জোর গলাতেই কথাটি শোনা গেলো। শুভ নামের ছেলেটি একবার নিজের দিকে তাকায় একবার আশেপাশে তাকায়। বুঝতে পারে এখানে নীল শার্ট পরা ছেলে কেবল শুভই আছে। কিন্তু এই ব্যস্ত রিকশা স্ট্যান্ডে তাকে কে ডাকল তা জানতেই ঘাড়টা ঘুরিয়ে যাকে দেখলো তাতে বেশ অবাক হয়েছে। শুভকে ডেকেছে রিমি নামের মেয়েটি। আড়চোখে শুভ রিমির দিকে একবার তাকায়। রিমি আবারো ডাক দেয়। দুই পকেটে হাত গুজে রিমি নামের মেয়েটির সামনে যায়। চোখ তুলে একবার তাকাতেই রিমি ঝটপট বলে..
– এই যে মি. রোজ আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেনো? আমি যখনি দেখি তখনি আপনাকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু কেনো?
শুভ মুচকি হাসতে লাগল। রিমি বোকার মত চেয়ে আছে। কারন রিমির এমন কথায় শুভ যে হাসবে তা সে ভাবতেই পারিনি। রিমি আবার বলে..
– আপনি হাসছেন কেনো?
– আপনিও যে আমাকে দেখেন সেটা ভেবে।
– না মানে…কিছু না। আপনি এখন উত্তর দেন।
শুভ চুপ হয়ে যায়। আড়চোখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিমির দিকে বারবার তাকায় সে। রিমিও মাঝে মাঝে শুভর দিকে তাকাতে থাকে। শুভ বলে উঠল..
– আপনি দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর।
শুভর মুখে এমন কথা শুনে রিমি কেমন চুপ হয়ে যায়। রিমি ভেবেই নিয়েছিল সব ছেলেদের মত এসে এই ছেলেটাও বলবে “আপনি দেখতে অনেক সুন্দর। আপানার হাসি সুন্দর, আপনার দাঁত সুন্দর ব্লা ব্লা। কিন্তু শুভ এভাবে যে রিমির প্রসংশা করবে বুঝতেই পারিনি। রিমি শুভর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তারপর বলে..
– মানে কি?
– তা জানিনা। তবে আপনার মাঝে একধরনের ব্যাকুলতা আছে। আপনার ঠিক গোলাপি না, লাল,গোলাপির মিশ্রনে দুটি ঠোঁট আমাকে বিমহিত করে। আপনার হরিণী চোখের দিকে তাকালে একধরণের নেশায় পড়ে যাই। আপনার ঐ অবাধ্য চুলগুলা দেখলে মনের মধ্যে একটা ঢেউ খেলে যায়।এবং আপনার ঐ চিকন সাদা দাঁতের হাসি আমাকে কেমন উদভাসিত করে। তাই চেয়ে থাকি। খুব কি অপরাধ করেছি তাতে?

রিমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকে। ভার্সিটিতে যাবে বলে রিমি রিকশা স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। আর শুভ আসে তার অফিসে যাওয়ার জন্য। একের পর এক রিক্মা তাদের দুজনকে উঠতে বলছে আর চলে যাচ্ছে। সে দিকে এই দুজন মানুষের কোনো খেয়ালই নেই। তারা ব্যস্ত দুজনকে আড়চোখে দেখাতে। তারা দুজনেই নিরবে তাদের মনের অবাধ্য কিছু কথা সাজিয়ে চলেছে। রিমি কেমন যেন কথা শুন্য হয়ে পড়ে। কি মনে করে রিমি বলে..
– হুমম অনেক বড় অপরাধ করেছেন।
– কি রকম?
– জানিনা। তবে আমার দিকে আর তাকাবেন না।
– তাহলে তো আরো বেশি করে তাকাতে হবে।
– কেনো?
– আপনাকে দেখতে আমার ভীষন ভালো লাগে।
– কিন্তু আমি ছাড়া কি আর কোনো মেয়ে নেই?
– হুম আছে তো। তবে আপনার মত মাদকতায় পরিপূর্ণ না তারা। আপনার বিচলিত হওয়ার প্রয়াসও আমাকে আকর্ষিত করে।
দুজনেই আবার চুপ হয়ে যায়। রিমি সম্মাহিত হয়ে শুভর মনোমুগ্ধকর কথাগুলো শুনতে থাকে। যা এর আগে কোনোদিনও এমন হয়নি। রিমি দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী হওয়ায় অনেক ছেলেই তাকে নানা ভাবে এসে প্রপোজ করেছে। অনেক ছেলেই রিমিকে বিভিন্নভাবে তাদের মনের কথা জানিয়েছে।

কিন্তু সেসবে রিমি কখনই ইন্টারেষ্ট দেখায়নি। তবে ছেলেদের প্রপোজগুলো সে বেশ ভালোভাবেই ইনজয় করেছে। সুন্দরী মেয়ে হলে যা হয় আরকি। তারা ভাবে আজ এ ছেলে প্রপোজ করছে কাল অন্য একজন করবে। তাই এক্সেপ্ট না করে তা ইনজয় করতে থাকে। সেক্ষেত্রে রিমিকে ছেলেরা কতই না রোমান্টিকভাবে প্রপোজ করেছে তবে রিমি একান দিয়ে শুনে ওকান দিয়ে বের করে দিয়েছে। কিন্তু কেনো জানিনা এই ছেলেটার কথাগুলান তার শুনতে অনেক ভালো লাগছে। নিরবে এসব কথা ভাবতে থাকে রিমি। রিমি হকচকিয়ে সামনে তাকায়। দেখে ছেলেটি রিক্সায় বসে তাকে ওঠার জন্য ডাকছে।
– এই যে অনুভূতি মাখা অতসী আপনার ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে এরপর না গেলে। পাশে যথেষ্ট জায়গা আছে চাইলে বসতে পারেন।

রিমি কি একটা ভেবে যেন জোরে হেঁটে শুভর পাশে যেয়ে বসে। বসতে যেয়ে দুজনের প্রথমবার বাহুডোরে ছোঁয়া লেগে যায়। দুজনেই হালকা ভাবে শিহরিত হয়। মুখে কিছুই বলে না। রিমি নিজেই অবাক হয় তার ব্যবহারে। আজই প্রথম তাদের কথা হওয়া,আর অবাকের বিষয় হল পরিচয়পর্বের প্রথমদিনি দুজনেই প্রথমবার একসাথে রিক্সাতে করে যাচ্ছে।
– আচ্ছা আপনি আমার বাড়ির সামনের যে টং দোকান আছে সেখানে কেনো আসেন? (রিমি)
– কেনো আসে আবার মানুষ দোকানে? কেনাকাটা করতে।
– একদমই মিথ্যে বলবেন না। আপনি মোটেও কোনো কিছু কিনতে আসেন না।
– মিথ্যে কেনো হবে?
– কারন আপনি দিনে ৮-১০ বার ঐ দোকানে আসেন।
– বাব্বাহ…আপনি এত্ত খেয়াল করেন তাহলে?
– জ্বি না,চোখ চলে যায় সে দিকে বারবার।
– হি হি হি..
শুভ ফিক করে হেসে ওঠে। রিমি বিরক্তি মাখা চাহনি নিয়ে শুভর দিকে তাকায়। শুভর আকাবাকা সাদ দাঁতগুলো হালকা বের হয়ে থাকে মুচকি হাসির কারনে। রিমি পলকহীন ভাবে তা একদৃষ্টিতে দেখে। এ দিকে শুভ ভাবছে সে রিমিকে একাই দেখে। রিমি তার দিকে তাকায় না। কিন্তু না, রিমিও তাকায় শুভর দিকে। তবে তা আড়চোখে। কপট রাগ মাখা মুখে রিমি বলে..
– কেনো দেখেন আমাকে বারবার? কেনো খোজেন আমাকে ছাদে আর ব্যালকনির বারান্দায়?
– মনে আছে?
– কী মনে থাকবে?
– সেদিন আপনি একটা আলপোনা আঁকা সাদা শাড়ি পরেছিলেন?
– কোন দিন?
– সেদিন আপনি সাদা শাড়ি পরে কয়েকজন বান্ধবি মিলে আমাদের বাড়ির পাশের খেলার মাঠে এসেছিলেন। অবশ্য সেই মাঠে খেলাধুলা হয়ই না। মাঠটা এমনিতেই ফেলানো থাকে।
– ওহ সেদিন? আসলে সেই দিন খুব কাঁশফুল দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই বান্ধবিরা মিলে সাদা শাড়ি পরে ফটোশ্যুট করতে সেখানে যায়। আপনার বাসা যে ওখানে তা জানতাম না।
– হুমমম..সেদিন আপনাকে আলপোনা দেয়া সাদা শাড়িতে অসাধারন লাগছিল। যেন মনে হচ্ছিল সাদা কাশফুলের মাঝে শরৎ এর সৌন্দর্যের দেবী দুহাত মিলে প্রকৃতির নতুন ছন্দে মাদল বাজাচ্ছে।
– ওহ, বুঝছি। সেদিন থেকেই আমাকে দেখা শুরু তাই না?
– হুমম।
– তাহলে তো আপনি একটা চোর।(রিমি)
– কেনো? (শুভ)
– চুরি করে বারবার দেখেন আমাকে।
– আপনি তো তাহলে চোরনি। আপনিও তো দেখেন আমাকে, তা না হলে কিভাবে জানলেন আমি আপনাকে দেখি?

রিমি চুপ হয়ে যায়। পাশে বসে থাকা অফিস নিয়ে ছেলেটির কথা একমনে ভেবেই চলেছে। আসলে ভাবনাটা গত একমাস ধরেই হচ্ছে রিমির। মাসখানিক আগে ি শুভ রিমিদের বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে রোজ আসে। কারন শুভ সেদিনিই রিমির পিছু নিয়ে বাড়ির ঠিকানা জানতে পারে। দুজনের বাসা পাশাপাশি এলাকাতে। এরপর শুভ কারন ছাড়ায় রিমিদের বাড়ির সামনের দোকানে রিমিকে দেখার জন্য প্রতিদিন বেশ কয়েকবার করে আসতে থাকে। আর রিমি সেটা আস্তে আস্তে খেয়াল করতে থাকে। প্রথম প্রথম এ ব্যাপারে বিরক্তি থাকলেও আস্তে আস্তে তারও ভালো লেগে যায়।
– আমার কথা সবসময় ভাববেন না মিস রিমি। (শুভ)
চমকে যায় রিমি শুভর থেকে এমন কথা শুনে। রিমি ঠিক কি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না। রিমি যে ছেলেটার কথা ভাবে তা কি করে বুঝতে পারছে কে জানে? রিমি আস্তে গলায় বললো..
– কী বললেন?
– কিছু বলিনি।
– ওহ। আচ্ছা আমরা কি বোকা কেউ কারো নাম এখনো জানিই না।
– হি হি হি..
– হাসেন কেনো? (রিমি)
– নাম না জেনেই আমার কথা ভাবেন এত? তাহলে নাম বললে তো আরো বেশি ভাববেন। তবে আমি আপনার নামটা জানি। আপনার বন্ধুরা আপনাকে রিমি বলেই ডাকছিল তাই শুনেছিলাম।

রিমি লজ্জাতে লাল হয়ে যায়। শুভ সত্যিই বলছে। নাম না জানা এই ছেলেটির কথা রিমি প্রতিদিন ঘুমানোর আগে,দুপুরে, বিকেলে,সকালে ভেবেই চলেছে। কি এক বাজে কান্ড ভাবা যায়? আচ্ছা ছেলেটাকি আমাকে ভালোবাসে? জিজ্ঞাসা করবো? ভালো না বাসলে কি রোজ বাড়ির সামনে আসতো নাকি? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রিমি বলেই ফেলে..
– আচ্ছা,আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?
হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে শুভ চুপ হয়ে যায়। রিমির ভার্সিটির সামনে তখন রিক্সাটা এসে থামে। দুজনেই চুপ হয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিমি আবার বলে..
– আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?
– নাহ।
– কিহ..না?
– হুমম।
শুভর মুখে না শুনে রিমি কেমন যেন হতে লাগল। রাগ আর কেমন কান্না আসতে লাগল। অনেক কষ্টে সে কান্নাটাকে আটকিয়ে চলে যেতে থাকে। তখনি শুভ সাহসের অতিমাত্রা ছাড়িয়ে রিমির বা হাতটা ধরে। রিমি আবারো শুভর মোলায়েম হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে। ঘুরে তাকায় পিছনের দিকে। ি শুভ রিমির চোখের দিকে তাকায়। রিমি লজ্জায় লাল হয়ে মাথাটা নিচু করে নেয়। শুভ বলে..
– আপনার ঐ চিকন ভ্রু যখন আমি দেখি তখন আমার মাঝে এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। ইচ্ছে করে সবসময় দেখি। আপনার মোহনীয় নাকটা যখন দেখি তখন আমার মাঝে আপনার প্রতি উদাসিনতার সৃষ্টি হয়। ইচ্ছে করে তখন তোমার নাকটা টেনে দিয়ে বলি, এই মেয়ে তোমার নাকটা এত ভালো লাগায় পরিপূর্ণ কেনো? জানিনা এসবকে ভালোবাসা বলে কিনা। তাই উত্তরটা ছিল না।

রিমি হা হয়ে তাকিয়ে থাকে নাম না জানা ছেলেটির দিকে। আদৌও কি এটা কখনো হয়েছে এমন নাম না জানা ছেলের প্রতি কোনো মেয়ে প্রেমে পড়েছে। তবে রিমি মুচকি হাসে। কারন রিমির এক প্রকার ভালোই লাগছে এমন নাম না জানা ছেলেকে ভালোবাসতে। ভালোবাসার মাঝেই যদি ভালো লাগা না থাকে তবে তা জমে নাকি?

রিমি কিছুই বললো না। ব্যাগ থেকে লাল একটি কলম বের করল। তারপর শুভর ডান হাতটি উঁচু করে নেয়। ডান হাতের ঠিক মধ্যমা আংগুলের উপর রিমির মোবাইলের ১১টি নাম্বারের ডিজিট সুন্দর করে লিখে দেয়।

লেখা শেষে রিমি দৌড়ে ভার্সিটির ভিতরে চলে যায়। শুভ মুচকি হাসতে থাকে। খানিকবাদে ভাইব্রেট করে রিমির ফোনটি কেঁপে ওঠে। সেখানে ছোট্ট একটি মেসেজ লেখা.. “নাম না জানা ছেলেটির নাম শুভ”। রিমির ফিরতি মেসেজ..
“নাম না জানলেও ক্ষতি হতো না কিছুই।”
“কেনো?”
“জানিনা।”
“আপনি কিন্তু বলেন নি আমাকে ভালোবাসেন কিনা”
“আপনার নামের মত সেটাও না হয় অজানা থাক”
“ওকে,তবে ক্লাসের সময় আমার কথা একদমই ভাববেন না।”
“কে বলেছে যে আমি আপনার কথা ভাববো?”
“আমার মন”
আর কেউ কোনো মেসেজ দেয়নি। রিমি কল্পনাতে হারিয়ে গেছে। রিমির কল্পনার ব্যাকগ্রাউন্ড এ বাজছে…
“তুমি আর তো কারো নও,
শুধু আমার..
যত দূরে সরে যাও,
রবে আমার..।
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার”

আজ ওদের ভালোবাসার পরিপূর্ণতা পেল। ভালো থাকুক ওরা ওদের নতুন পথ পরিক্রমায়। ভালোবাসা হচ্ছে একটা বন্ধন, মায়ার বন্ধন, চিরজীবণ কাছে থাকার বন্ধন। একটা গভীর এবং সুন্দর ভালবাসা ঠিক তখনি ক্ষুন্ন বা নিঃশেষ হয়ে যায় যখন ‘ইগো’ নামক শব্দটি ভালবাসায় প্রবেশ করে। সুতরাং ভালবাসায় কখনো ইগো নামক কোনো শব্দের স্থান দেবেন না। যথেষ্ট বিশ্বাস এবং ভরসা রাখবেন ভালবাসার মানুষটির উপর। তাহলেই আপনারা ভালবাসার আসল সৌন্দর্য এবং রসবোধটা উপলব্দি করতে পারবেন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত