মেয়েটির সাথে আমার পরিচয়টা খুব অদ্ভুত ভাবে
হয়েছিলো, সে এখন বধূ সাজে আমার সামনে বসে আছে ।
.
একটা ফলের দোকানে আমি আম কিনছিলাম সেটা অবশ্য
শীতকাল ছিল । শীতকালে সচারচর আম পাওয়া যায়না
কিন্তু আম গুলো দেখে আমার খুব লোভ হয়েছিল, যদিও বা
মাত্র পাঁচ ছয়টা আম দোকানীর খাঁচায় শোভা পাচ্ছিল ।
যখন দোকানী কে জিজ্ঞেস করলাম
.
— আমের কেজি কত ?
.
দেখি দোকানী আকাশ চুম্বি দাম বলছে তবুও বললাম
.
— আচ্ছা ঠিক আছে যা আছে সব গুলো মাপেন এইটু কম
রাখবেন।
কিন্তু হঠাৎ করে একটি মেয়ে দোকানের সামনে এসে
হাজির এবং দোকানী কে বলতে লাগলো
.
— প্লীজ আম গুলো আমাকে দিন । আম গুলো আমার খুব
প্রয়োজন । যত টাকা লাগে আমি দিব ।
.
মেয়েটার কথা শুনে দোকানী আমার দিকে তাকিয়ে
আছে আর আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটির দিকে । হালকা
পাতলা গড়ন । আট দশটা স্বাভাবিক মেয়ের মতই তবে
চোখ গুলো অসম্ভব সুন্দর । কিন্তু এই মুহূর্তে চোখ দুটোর
মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে ।
.
— কিন্তু আপা আম গুলো যে ভাইজান নিয়ে নিয়েছেন
.
দোকানীর কথা শুনে মেয়েটি আমার দিকে সরাসরি
তাকিয়েছে । সেই তাকানোর মাঝে ছিল অনুরোধ এবং
প্রার্থনা । হঠাৎ করেই হাত দুটো এক করে ক্ষমা চাওয়ার
ভঙ্গি করে মেয়েটি আমার উদ্দেশ্য বলতে লাগলো ।
.
— প্লিজ আম গুলো আমাকে দিন ।আশেপাশের সব গুলো
দোকান খোঁজ করেছি কিন্তু পায়নি । আম গুলো যে আমার
খুব বেশি প্রয়োজন ।
.
আমি ভেবে পেলাম না আম গুলো তার কি এতো প্রয়োজন
হতে পারে যার জন্য সে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন । তার
কারণটা জিজ্ঞেস করেও করা হলো না ।
.
— ঠিক আছে, ঠিক আছে আপনিই নিয়ে যান সমস্যা নেই ।
.
আমার সম্মতি পেয়ে মেয়েটি মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচলো
। আম গুলো মেপে দিতেই টাকা পরিশোধ করে হাওয়ার
গতিতে কোথায় যেন ছুটলো মেয়েটি কিন্তু আমার
কৌতূহল আমার মাঝেই স্থির হয়ে রইলো
।
.
অনেকটা সময় কেটে গেছে । সময়ের যাতা কলে কৌতূহল
ডালের মতো বেসন হয়ে গেছে কিন্তু মেয়েটিকে যে
আবার দেখতে পাব ভাবতেই পারিনি । চিনতে মোটেই
ভুল হয়নি । তবে শরীরটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে,
চেহারায় সেই আগের লাবণ্য নেই । বাসে বসা ছিলাম
পাশের সিট খালি ছিল । যদিও বা নাম্বার কাটা সিট
যায় যারটা নির্দিষ্ট । যখনই মেয়েটি বললো
.
— এটা মনে হয় আমার সিট, বসতে পারি ?
.
মেয়েলি কন্ঠ শুনে, মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি
কে চিনতে আমার কোন ভুল হলো না । সব কিছু ভোলা
গেলেও তার চোখ দুটো ভোলার নয় ।
.
— আরে আপনি যে বসুন বসুন ।
.
এবার মনে হয় মেয়েটিও আমাকে চিনতে পেরেছে ।
মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে আমার পাশের সিটে
বসে পড়লো মেয়েটি । মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি ।
জ্যোৎস্নার আলো যেন আমার উঠনো এসে হাজির ।
.
— কোথায় যাবেন আপনি, আর একা কেন ?
.
— হ্যা আমি একাই, আমি আমার পৃথিবীকে হারিয়ে
ফেলেছি ।
.
মেয়েটির কথাটা ঠিক বুঝলাম না তাই জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ ।
.
— জানেন সখ করে আমার বাবা আমাকে ঢাকা শহরে
বিয়ে দিয়েছিল কিন্তু তার পরের বছরই আমাদের ছেড়ে
সে পরপারে চলে গেছেন । তার কিছুদিন পরেই
অনাকাঙ্খিত এক ঘটনার আমার স্বামীর ফাঁসি হয়ে
গিয়েছে যদিও বা সে ঘটনার শিকার আর তাই তো
আমাকে একাই বাড়িতে বৃদ্ধা মায়ের কাছে ফিরে
যেতে হচ্ছে ।
.
কিছুটা আশা ভঙ্গ, তার সাথে অনেকখানি কৌতূহল মনের
মাঝে উঁকি দিচ্ছে । খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কি এমন
হয়েছিলো যার কারণে মেয়েটির স্বামীর ফাঁসি
হয়েছিলো ?
.
— কিছু মনে না করলে বলবেন কি, কী কারণে আপনার
স্বামীর ফাঁসি হয়ে ছিল ।
.
— আমি একটি কিন্ডার গার্ডেনে জব করতাম । মহল্লার
রাস্তা দিয়ে আমাকে আসা যাওয়া করতে হতো কিন্তু
মহল্লার কিছু বাজে ছেলে আমাকে টিজ করতো । খারাপ
ইঙ্গিত দিত, যেটা আমার অসহ্য লাগতো । আমি আর
নিতে পারছিলাম না তাই আমি আমার স্বামী কে
ব্যাপারটা জানাই । সে একটু রাগী প্রকৃতির ছিল ।
রিয়েকশনটা তার মাঝে খুব বাজে ভাবে দেখতে পেলাম
। মুহূর্তের ভেতর তার রাগ সপ্ত আকাশে উঠে গেল । এবং
খুব দ্রুত বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল আর যখন পুনরায়
বাসায় ফিরে আসলো তখন তার হাত রক্তে রঞ্জিত সে
নাকি তাদের একজন কে অনাকাঙ্খিত ভাবে খুন করে
ফেলেছে । প্রথমে আমার ব্যাপারটা নিয়ে তাদের সাথে
তর্কাতর্কি হয় এবং এক পর্যায়ে আমার স্বামীর উপর
ছেলে গুলো আক্রমণ করে বসে, কিভাবে যেন তাদের ছুরি
দিয়েই তাদের একজন খুন হয়ে যায় । আমি তাকে পালিয়ে
যেতে বলেছিলাম কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে
গেছে পুলিশ তাকে ততক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করে । দীর্ঘ
বিচার পক্রিয়ায় আমার স্বামীর ফাঁসি হয়ে যায় । অনেক
চেষ্টা করেও আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি । ঐ যে
সেদিন আমি আপনার কাছ থেকে আম গুলো চেয়ে
নিয়েছিলাম সেটা ও মৃত্যুর আগের দিন খেতে চেয়েছিল
। একজন মৃত্যু পথ যাত্রীর ইচ্ছে তো আর অপূর্ণ রাখা যায়
না ।
.
আমি খেয়াল করলাম কথা গুলো শেষ করে মেয়েটি
কাঁদছে । এখন আমার কি করা উচিত বা বলা উচিত ঠিক
বুঝতে পারছিলাম না । মানুষের জীবন কেন এমন হয়, কেন
প্রচণ্ড ঝড় তুফান অতিবাহিত করে মানুষের জীবন এগিয়ে
যায় । খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটির হাত ধরে তাকে ভরসা
দিতে আর বলতে “তুমি কোন চিন্তা করো না মেয়ে, আছি
তোমার পাশে, যেভাবে তোমার স্বামী তোমাকে আগলে
রেখেছিল ঠিক সেভাবে তোমাকে আগলে রাখবো কিন্তু
না, বলা হয়না কারণ বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন । ক্ষণিকের
দেখায় কারো চোখ ভালো লাগতে পারে, ভালো লাগতে
পারে তার উপস্থিতি তাই বলে একজন বিবাহিতা
মেয়েকে জীবন সঙ্গী করা যায় না । সমাজ বা তার
পরিবার এটা কখনোই মেনে নিবে না ।
.
যেদিনকার মতো মেয়েটিকে খুব মন খারাপ করেই বিদায়
দিতে হয়েছিলাম কিন্তু আজ যে আবার নতুন রূপে
মেয়েটি কে দেখতে পাব ঠিক বুঝতে পারিনি । আমাদের
গ্রামের এক বিপত্নীক পুরুষের বিয়েতে এসে মেয়েটি কে
বধূ রূপে দেখতে পারছি, যে আমার সামনে বসে আছে ।
তবে সে আমার দিকে একবার তাকিয়েছে কিন্তু কোন
কথা বলেনি হয়তো নতুন বউদের কথা বলতে নেই ।
.
মেয়েটি কে বধূ সাজে দেখে আমার কেমন যেন লাগছে
ঠিক বুঝতে পারছি না । সে এক অন্য রকম অনুভূতি । কিছু
কিছু অনুভূতির ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না, তবে মন থেকে
দোয়া থাকবে মেয়েটি সুখী হোক । সমস্ত দুঃখ বেদনা
ভুলে গিয়ে মেয়েটি সত্যি সুখী হোক ।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা