-রোগীর নাম?
-আমার বউ।
বৃদ্ধের সলাজ হাসি দেখে আমার চোখকপালে উঠল।
-বউতো বুঝলাম,নাম বলেন।
-আমার নাম কলিমউদ্দিন। রোগী আমার বউ।
-আরে চাচা বুঝলামতো! আপনার নাম কলিমউদ্দিন, রোগী আপনার বউ, রোগীর নামটা বলেন।
মনে মনে ভাবলাম,কী আপদ!
তখন বেলা সাড়ে এগারটা। সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগ। রোগী দেখছি। একজন বিশেষজ্ঞ স্যার ছুটিতে আছেন। হাসপাতালের অন্তর্বিভাগের রোগী দেখা শেষ করে মাত্রই এসে বসেছি স্যারের সুনির্দিষ্ট চেয়ারে, আমি নাদান মেডিকেল অফিসার। বাইরে আরো শ দুই রোগী লাইনে দাঁড়ানো।
সামনে পিঠ কুজো করে বসে থাকা নোংরা, মলিন শার্ট পরিহিত প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ তার গালের ঝুলে পড়া চামড়ায় একটু হাত বুলিয়ে ইতস্তত হয়ে হাসলেন। নাকের উপর মোটা কাঁচের চশমাটা ঠিক করলেন। ভাঙা কন্ঠস্বর।
-বউয়ের নাম স্মরন করতি পারছুইন্না মা। বিয়ে হয়েছে আজকা ষাইট বৎসরের মত। হ্যায় ছিল এতিম, হের বয়স ছিল নয়, আমার সতের। আমি তহন থেইকা ডাকি বউ,আর বাকীরা সব ডাকত কলিমউদ্দিনের বউ। আমার ছাওয়ালরা ডাকত আম্মা, হেগো নাতিরা ডাকে দাদী। হ্যার নাম হের নিজেরো স্মরনে নাই। হিহি।
আমুদে রোমান্টিক বুড়ো দেখি!
ঢোক গিললাম একটা।
কী মুশকিল। প্রেসক্রিপশনে রোগীর নামতো আর কলিমউদ্দিনের বউ,অমুকের আম্মা,তমুকের দাদী লেখা যায়না। আমি তাই ভাঙাচোরা হস্তাক্ষরে গটগট করে লিখলাম, রোগীর নাম, মিসেস কলিমউদ্দীন।
-বয়স কত দিব চাচা?
-হের বয়স আর কত অইব। আমারতো এহনো আঠার বছর মনে অয়। সাজলে মনে অয় লায়িকা শাবনূর।
এবার আমি হেসে ফেললাম। ঘোলাটে চশমার আড়াল হতে বৃদ্ধ যেভাবে প্রেমময় দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে কথাটি বললেন না হেসে পারা গেল না। বৃদ্ধাকে দেখলাম স্বামীর চোখে চোখ রেখে ইশারা করছেন। মৃদু শাসন বোধহয়। মুখে হাসি। সামনের সারির একটা দাঁত বোধহয় কোথাও ঘুরতে গেছে। পান খেয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁট।
-কী সমস্যা আপনার চাচী?
চাচী উত্তর দেওয়ার আগেই চাচার ত্বরিতগতিতে জবাব,
– রাইতে নাক ডাকে। আমি ঘুম যাতি পারিনা।
এবার চাচীর বাঁজখাই গলা শোনা গেল
-মিছা কথা বলবেননা আব্বাসের বাপ। আমি নাক ডাকিনা। আপনে কানে বেশি শোনেন। কতবার বললাম আপনেরে কানের ডাক্তর দেখান।
চাচা মিনমিন করে বললেন,
-আল্লার কিরা।
-কিরা কাটি মিছা কথা বলবেন না। আমি নাক ডাকিনা। নাক ডাকলে আমার ক্যান ঘুম ভাঙে না?
প্রমাদ গুনলাম,বৃদ্ধ দম্পতির ঝগড়া দেখে। বাইরে রোগীর শোরগোল বাড়ছে। এরই মাঝে আমার মুঠোফোনে একটা বার্তা এসেছে।
মুঠোফোন হাতে নিলাম। বার্তাটা পাঠ না করেই রেখে দিলাম।
তারপর প্রেসক্রিপশনে রেফারড টু ইএনটি লেখার আগে শেষবারের মত প্রশ্ন করলাম।
-আর কোন সমস্যা আছে চাচী?
-আপনে এট্টু বাইরে যান। আমি আপার লগে এট্টু কথা বলব।
-আমার সামনে বলো।
-যান না বাহিরে।
চাচা মুখ বেজার করে বের হয়ে গেলেন।
আমি মনযোগ দিয়ে চাচীর বাদবাকী সমস্যা শুনলাম। শোনা শেষে বললাম,
-আপনারতো গাইনির ডাক্তার দেখাতে হবে। চাচাকে নিয়ে দুইশ দশ নাম্বার রুমে চলে যান।
বৃদ্ধা খুশিমনে প্রেসক্রিপশন হাতে বেরিয়ে গেলেন।
আমি হাঁক ছাড়লাম পরবর্তী রোগী পাঠানোর জন্য। আরো ঘন্টাখানিক বসে বসে হাতের ব্যায়াম করো থুড়ি প্রেসক্রিপশন লিখো।
লিখতে লিখতে ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই। খিদেটা চাগিয়ে উঠেছে,
রোগী দেখায় ইস্তফা দিয়ে ক্যান্টিনে যাচ্ছি হালকা কিছু খেয়ে নিতে।
হাসপাতালের সামনে একটা গোল চত্বর আছে। এপ্রনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চত্বরের কাছাকাছি এসে দেখি সেই বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। হাপুস নয়নে কাঁদছেন।
আমি কৌতূহলবশত কাছে গেলাম।
-কী হয়েছে চাচী?
-আপনের চাচাকে খুঁজি পাতিসিনা।
-সে কী! সাথে আর কেউ আসেনি?
– ছাওয়ালরাতো আমরার লগে থাকেনা। খোঁজও নেয়না।
-মোবাইল আছে সাথে?
-আমরার আবার মোবাইল!
-তাহলেতো সমস্যা।
আমি সমবেদনা জানালাম।
-বসে থাকেন চাচা হয়ত আশেপাশে বাথরুমে গেছে। চলে আসবে।
আমার সান্ত্বনাসূচক বাক্যেও বৃদ্ধার কান্না থামলনা।
-ও আববাসের বাপ,আপনে কই…
বলতে বলতে বোরখার খুটে বারবার চোখ মুছতে লাগলেন।
বৃদ্ধার বিলাপকে পেছনে রেখে অস্বস্তি নিয়ে পা বাড়ালাম।
ক্যান্টিনে ঢুকেই একটা সমুচা,আর এক কাপ চা। চিনিটা এত বেশি হয়ে গেছে। চা শেষ করতে সময় লাগল। বিল দিতে যেয়ে খেয়াল হলো পার্সখানা বহির্বিভাগের চেম্বারে ফেলে এসেছি। ক্যান্টিনের ম্যানেজারকে ডেকে বললাম বিষয়টা।
চিরাচরিত হাসিটা হেসে ম্যানেজার কাশেম মিঞা বলল,আপা কেনো সমস্যা নাই। আপনে যাওয়ার সময় টেকা দিয়ে গেলেই হবে।
ক্যান্টিন হতে বের হয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ফের হাসপাতালে ঢুকব দেখি সেই গোল চত্বরে বৃদ্ধার পাশে এখন বৃদ্ধ বসে আছেন, এক হাতে দুটো সবুজ রংয়ের সস্তা আইসক্রিম।
আরেকটু সামনে যেয়ে দেখি বৃদ্ধা তখনো কাঁদছেন, আর কলিমউদ্দীন সাহেব অন্য হাতে বউয়ের ভেজা গাল মুছে দিচ্ছেন।
দ্বিপ্রহরের কড়া রোদ তখন মাথার উপর। ঈশানকোণে এক টুকরো মেঘ জমেছে যদিও। রোদের তীব্রতা তাতে কমেনি। পশ্চিম দিকে মর্গের পাশে থাকা আকাশমনি গাছটা হতে একটা বেনে বউ পাখি ডাকল কি ডাকল না,আমি মুগ্ধ চোখে বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখতে থাকি।
কাছে গিয়ে বললাম,
-কী চাচা কই হারায়ে গিয়েছিলেন?
-একটু পলায়ে ছিলাম। দেখতাছিলাম আমারে না পালি আপনার চাচী কী করে। কেমন কানতাসিল। হিহি।
-কথা বলবেন না আমার লগে।
বৃদ্ধার কন্ঠ শুনে বোঝা গেল বাড়ি গেলে চাচার আজকে দফারফা হয়ে যাবে।
-আইসকিরিম খাও বউ। ও বউ।
আমি মৃদু হাসলাম।
কে বলবে এনারা নববিবাহিত দম্পতি নয়। ছেলেমানুষের মত ঝগড়া করছেন,মান অভিমান করছেন।
-তুমি আমারে তহন বাহির করে দিলা ক্যান?
-শরমের কথা আপনের সামনে বলা যায়? আস্তাকফিরুল্লাহ।
-আচ্ছা আইসকিরিম খাও।
আমি হাসলাম। জীবন সায়াহ্নে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষ, একটা জীবন এক সাথে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দেওয়া দুজন মানুষ, সবুজ রংয়ের সস্তা আইসক্রিম খেতে খেতে ফোঁকলা মুখে হাসছেন। বার্ধক্যে জরাজীর্ণ একের হাতের উপর অন্যের হাত রাখা, দুর্বল হাতে সেই হাতখানা শক্ত করে ধরে রাখা। মৃত্যু ছাড়া সে বাঁধন ছিন্ন করবে সাধ্যি আছে কার?
দৃশ্যটা পেছনে ফেলে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকি। অন্যমনস্ক হয়েই ব্যাগ হতে মুঠোফোন বের করলাম। সকাল সাড়ে এগারটায় বার্তা এসেছে,
-ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি।
ফোনের ইনবক্সে অন্তত শ খানেক বার্তা এসেছিল এর আগে, যার সারাংশ ছিল ” আরেকবার ভেবে দেখবে,প্লিজ?”
থমকে গেলাম খানিক। আকাশের রং বদলাল কী ভীষন দ্রুত। ছায়াময় হয়ে উঠেছে আমার চারপাশ। এখন একটু হাহাকার নিয়ে হাত বাড়ালেই প্রকৃতি সে হাত ভরিয়ে দেবে বিরামহীন বর্ষণে।
একসময়কার প্রিয় নাম্বারটায় ফোন দিলাম আমি। গলা কাঁপছে। রিং বাজতেই অন্য পাশ হতে আসাদ ফোন ধরবে। ওকে আজ বলতে হবে অনেকদিন এক সাথে আইসক্রিম খাইনি।