শোন বাবা… কাল থেকে কিন্তু ফাহিমা কে কলেজ থেকে তোকেই আনতে হবে।
– মানে কি? ওই গার্লস কলেজে একগাদা মেয়ের ভেতর থেকে প্রতিদিন ওকে খুজে আনতে হবে?
-ওর জন্য রিজার্ভ করা রিক্সাওয়ালা টা কই?
– আরে উনি থাকলে কি আর তোকে বলতাম নাকি? ওই লোক আজকে গ্রামে চলে গেছে, কবে আসবে ঠিক নেই….
বিকেলটা ই মাটি হয়ে গেলো আমার। আম্মুর কথা না রেখেও পারা যাবে না।
এখন থেকে প্রতিদিন ওর জন্য কলেজ গেটে দাড়োয়ান সেজে বসে থাকতে হবে।
আর হ্যা ফাহিমা কিন্তু আমার একমাত্র ছোটো বোন। আমরা সারাদিন টম এন্ড জেরির মতো একজনের পেছনে আরেকজন লেগে থাকি।
কিন্তু দুজনের মাঝে ভালোবাসাটা ও কিন্তু কম না।
– কিরে ভাইয়া কিছু বলছিস না যে? আনবি তো আমায়?
– এই কথা বলিস না তো! মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ……..আচ্ছা যা আনবো বাট তোকে কলেজে দিয়ে আসবে কে শুনি?
– কেনো বাবা আছে না?
-ও আচ্ছা, তাহলে তো হলোই!
পরদিন বিকেল। আমি দাড়িয়ে আছি কলেজ গেইটের সামনে। দাড়োয়ান ব্যাটা আমার দিকে কেমন কেমন করে জানি তাকাচ্ছে।
গার্লস কলেজের সামনে ফিট-ফাট হয়ে কোনো ছেলে দাড়িয়ে আছে এটা সে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
আমাকে কে কষে দুইখান থাপ্পর মারতে পারলে যেন সে শান্তি পাবে। ফাহিমার কথা ভেবে ভীষন রাগ উঠছে,
এতো বড় মেয়ে অথচ একা যাতায়াত করতে পারে না!
– এই ভাইয়া….এই যে আমি এদিকে!
অবশেষে ফাহিমার পরিচিত কন্ঠ কানে এলো। ঘুরে পেছনে তাকালাম। তাকে কোনো কারনে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে।
সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার সাথে আরো ১০/১২ জন বান্ধবী। মোটামুটি একটা লেডি গ্যাং বলা চলে।
– ভাইয়া…. ভাইয়া জানিস আজকে কি হয়েছে….
– অফ যা তো। বাসায় গিয়ে শুনবো তোর কেচ্চা!
– কি! আমি কেচ্চা বলি? শয়তান, কুত্তা, বিলাই….
– ওই তুই কি তাহলে? পেত্নী কোথাকার!
আমাদের দুজনের ঝগড়া দেখে ওরা হেসে ফেললো। আমার সামনে যে একগাদা মেয়ে দাড়িয়ে আছে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
বেশ লজ্জা পেলাম মনে মনে।
– ভাইয়া আমার বান্ধবীদের সাথে পরিচিত হয়ে নে….ও হচ্ছে পিংকী ও হচ্ছে অর্পিতা…..
ও হচ্ছে অমুক, সে হচ্ছে তমুক অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে ছোট বোনটা! হঠাৎ এক মেয়ে হ্যান্ড শেক করার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো।
ফাহিমা বললো তার নাম নাকি নিরুপমা। নিরুপমা শব্দের অর্থ হচ্ছে যার কোনো তুলনা নেই, কোনো উপমায় ই যাকে সঙ্গায়িত করা যায় না।
নামের সাথে মেয়েটির বেশ মিল আছে, সত্যিই তার তুলনা সে নিজেই। তার রুপের উপমা দিতে গেলে বাংলা ব্যাকরনে কোনো বিশেষন পাওয়া যাবে না।
কোন বিশেষনে বিশেষায়িত করলে তার সৌন্দর্যের সঠিক বিচার করা হবে তাও আমার জানা নেই।
আমার মনে হয় প্যারেড গ্রাউন্ডে তাকে দাড় করিয়ে দিলে কয়েক হাজার মেয়ের মধ্যে তাকেই সর্বপ্রথম নজরে পড়বে।
তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আমি ধরলাম। সাথে সাথে আমার হৃদপিন্ড হাতুড়ি পেটা শুরু করলো।
এর আগে কোনো মেয়ের হাত ধরেছি বলে মনে পড়ছে না, তাই হয়তো এমন হচ্ছে। মেয়েটা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কোনো সুন্দরী মেয়ে আমার দিকে তাকালে ভীষন অস্বস্তি হয় আমার, তার ওপর আমার হাতটা ও ছাড়ছে না সে।
আমি এক সেকেন্ডের জন্য তার চোখে চোখ রাখলাম। বাঙালী ছেলে-মেয়েদের চোখ কালো হওয়ার কথা। কিন্তু ওর চোখ জোড়া অনেকটা নীলচে।
– কিরে তোরা কি হাত ছাড়বি না সারাজীবন এভাবেই দাড়িয়ে থাকবি?
ফাহিমার কথায় দুজনের সংবিৎ ফিরে এলো। লজ্জিত ভঙ্গিতে দুজন দুদিকে সরে পড়লাম। ওদের মজার খোরাক হয়ে গেলাম আমরা দুজন।
কাউকে নিয়ে হাসি-ঠাট্রার সুযোগ পেলে আমরা লুফে নেই এটা আমাদের জাতিগত স্বভাব।
বাসায় এসেও নিরুপমার কথা মাথা থেকে বের করতে পারছি না। ভালো বিপদে পড়া গেলো! আচ্ছা ওর ও কি আমার মতো এমন হচ্ছে?
ধুর! কিসব ভাবছি আমি….
– কিরে ভাইয়া কুচ কুচ হোতা হ্যায়? বুঝেছি বুঝেছি…. কাল ই আমি ওকে সব খুলে বলবো।
কলেজের ঘটনা নিয়ে খোচা দিতেও ছাড়লো না পাজি বোনটা। আমি লাফিয়ে উঠলাম…..
– এই কি বলছিস এসব! উল্টা-পাল্টা যদি কিছু করিস তাহলে কিন্তু….
– কিন্তু কি? কি করবি তুই হুম?
– তোকে আনতে আর কলেজে যাবো না।
– ভাইয়া না ভালো! এমন করিস না, আমি তো মজা করলাম। যা আমি উল্টা-পাল্টা কিছু বলবো না!
– মনে থাকে যেন….
***********
রাত তখন এগারোটা ছুইছুই। বসে বসে ডিস্কভারি তে বেয়ার গ্রিলসের ব্যাঙ খাওয়া দেখছিলাম।
ভদ্রলোকের এইসব খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারগুলো আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে।
কিন্তু আমার মা-বোনের কাছে এটা অত্যান্ত গা ঘিনঘিনে ব্যাপার।
আমি যখন আগ্রহের সাথে এসব দৃশ্য দেখি তখন ওরা দুজন টিভির ত্রি-সীমানায় থাকে না।
হঠাৎ ফাহিমার মোবাইলের শব্দে আমার টিভি দেখায় ব্যাঘাত ঘটলো। ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে,
ফোনের মালকিন সম্ভবত বাথরুমে নিদ্রা গেছে তাই রিসিভ করতে পারছে না। আমি বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরলাম….
– হ্যালো কে বলছেন?
ওপাশ থেকে নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
– হ্যালো কথা না বললে রাখলাম কিন্তু!
– না না, রাখবেন না প্লিজ! আমি নিরুপমা বলছি……
এবার আমি বোবা হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ভেতরে কেমন জানি একটা ভালো লাগা কাজ করছে।
– হ্যালো কথা না বললে রাখলাম কিন্তু!
সর্বনাশ…. মেয়ে ও তো আমার চেয়ে কম যায় না। আমার ডায়লগ আমাকেই শোনাচ্ছে? আমি তড়িঘড়ি করে বললাম…
– রাখবেন না প্লিজ আমি শামীম বলছি। আপনি যাকে ফোন করেছেন উনি ঘন্টাখানেক ধরে বাথরুমে অবস্থান করছেন।
ফায়ার সার্ভিস এনে উদ্ধার করতে হবে মনে হচ্ছে….
নিরুপমা শব্দ করে হাসলো। হাসিটা যেন ছবি হয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
আচ্ছা সুন্দরী মেয়েদের সবকিছুই কি সুন্দর? তাদের কথা-বার্তা, চলন-বলন,
হাসি এমন কি কান্না ও?
– আচ্ছা রাখছি তাহলে। ফাহিমা এলে ওকে বলবো ফোন দিতে….
– এই যে শোনেন ভাইয়া, এতো তাড়া কিসের আপনার হুম? একটু কথাও কি বলা যাবে না?
– কথা বলবেন যখন একটু বলে লাভ কি? শুরু করেন, বাকি রাতটা তো পড়েই আছে। আর ফোনটা তো আপনিই দিয়েছেন।
টাকা কাটলে আপনারই কাটবে। হাহাহা…..
– আমাকে তুমি করে বলতে পারেন ভাইয়া। আমি আপনার ছোটো।
– ওকে!
– তা কি করছেন ভাইয়া?
– এইতো তোমার সাথে কথা বলছি….
– তা তো বুঝলাম কিন্তু এর আগে কি করছিলেন?
– তেমন কিছু না, মনোযোগ দিয়ে ব্যাঙ খাওয়া দেখছিলাম, তুমি দেখবে? তাহলে এখনি ডিস্কভারি অন করো।
এতক্ষনে হয়তো ব্যাংক খাওয়া শেষ করে সাপ খাওয়া শুরু করে দিয়েছে…..
– ইয়াক! আমি এসব বাজে জিনিস দেখি না…
– তাহলে নিশ্চই জি বাংলা কিংবা স্টার জলসার সিরিয়াল দেখো?
– হুম দেখি তো মাঝে মাঝে।
– ওহ…ব্যাঙ বাজে জিনিস আর জি বাংলার সিরিয়াল খুব উৎকৃষ্ট বস্তু? জানো ব্যাঙের মাংসে কি পরিমান পুষ্টিগুণ আছে……?
ব্যাঙের পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান আর জাহির করতে পারলাম না, পেত্নীটা এসে পড়লো…..
– এই নাও নাও, তোমার বান্ধবী এসেছে কথা বলো….
-কিরে ফাহিমা এতক্ষন কোথায় ছিলি?
– বারান্দায় ছিলাম, কে ফোন করেছে?
– নে ধর, নিরুপমা…..
আমি আবার এসে টিভির সামনে বসে পড়লাম। আমার কথা সত্যি প্রমান করে বাবাজি এবার শাপ খেতে শুরু করলো।
শাপের অর্ধেকটা তার মুখের ভেতরে বাকি অর্ধেক বাইরে। লেজটা নাড়াচাড়া করছে।
এতই মনোযোগ দিয়ে দৃশ্যটা দেখছিলাম ফাহিমা কখন যে সামনে এসে দাড়ালো টেরই পেলাম না।
আমি তাকিয়ে দেখি ও কোমড়ে হাত দিয়ে আমার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি খোচা দিয়ে বললাম…..
– এই দাড়া দাড়া….একদম নড়িস না! তোকে না একদম মডেলদের মতো লাগছে, কয়েকটা ছবি তুলে নেই আগে….
– তুই কি ভালো হবি না ভাইয়া? সারা জীবন কি এই ভাড়ামি ই করে যাবি?
– যাক বাবা! আমি আবার কি করলাম…..
– তুই নাকি নিরু কে ব্যাঙ খাওয়া দেখতে বলেছিস?
বলেই ফিক করে হাসি দিয়ে দিলো। কৃত্রিম রাগ টা আর ধরে রাখতে পারলো না।
– হ্যা বলেছিই তো, তাতে কি হয়েছে? জানিস ব্যাঙের মাংস কতো পুষ্টিকর? এতে উচ্চ মানের প্রোটিন…..
– ব্যাস ব্যাস হয়েছে আর বলতে হবে না, আমি গেলাম……
************
আজকের আবহাওয়াটা চমৎকার, বেশ একটা রোমান্টিক ভাব আছে। আকাশ মেঘলা আর ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
এতো সুন্দর একটা পরিবেশ অথচ দাড়োয়ান সাহেব মুখ গোমড়া করে কলেজ গেটে বসে আছে।
আচ্ছা ওনার মুখটা ই এমন নয়তো? কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের চোখে পানি সবসময় ছলছল করে,
দেখলে মনে হবে এখনই বুঝি কেঁদে দেবে, অথচ তার চোখটাই কিন্তু এমন।
আবার কিছু কিছু মানুষ আছে দেখলে মনে হবে সারাক্ষন হাসি দিয়ে রয়েছে, আসলে ব্যাপার টা কিন্তু তা না।
তার মুখটাই এমন! দাড়োয়ানের ক্ষেত্রে ও কি এই কথাটা প্রযোজ্য? কথা বলে দেখতে হবে। আমি তার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম….
– মামা কেমন আছেন?
সে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার পর্যবেক্ষন করলো। চেহারার দিকে তাকিয়ে খানিকটা থমকে গেলেন তিনি।
আমি তার মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট মনের কথা পড়তে পারছি।
“আরে! এই সালা ই তো গতকাল এখানে স্টাইল মাইরা দাড়ায়ে ছিলো না? এখন আবার কোন মতলবে আমার সাথে খাতির জমাইতে আইছে?”
আমি মৃদু হাসলাম। তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললাম…
– দেখেন মামা আপনি আমাকে অযথাই আমাকে সন্দেহ করছেন!
– সন্দেহ করমু না তাইলে কি করমু? তুমার মতো চ্যাংড়া পোলাপাইনগুলারে আমার ঠিকই চিনা আছে, মেয়ে পটাইতে আইছো তাই না?
উনি কথা খানিকটা দ্রুত বলেন। কেমন যেন একটা তাড়াহুড়া ভাব আছে। কথা শুনলে মনে হবে জরুরী কোনো কাজ ফেলে এসে আমার সাথে কথা বলতে হচ্ছে তাকে!
– দেখেন মামা, আমার মেয়ে পটানো লাগে না। এমনিতেই পটে যায় বুঝলেন? আর আমি ওইসব ধান্দায় আসি নাই। আমার ছোট বোন কে নিতে এসেছি।
এবার তাকে কিছুটা আশ্বস্ত মনে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে আমার সাথে আলাপ করতে কিছুটা আগ্রহী তিনি।
– কথার টান শুনে মনে হচ্ছে আপনার বাড়ি নোয়াখালি, ঠিক ধরেছি না?
– হ হ ঠিকই ধরছো, তোমার বাড়িও কি নোয়াখালি?
আমার বাড়ি নোয়াখালি না। কিন্তু আমি জানি এখন যদি বলি ‘হ্যা নোয়াখালি’ তাহলে ওনার মুখে একটা হাসি দেখার চান্স আছে।
আমার খুব ইচ্ছে করছে ওনার গোমড়া মুখে একটুকরো হাসি দেখতে।
– হ্যা মামা আমরা একই এলাকার লোক, আমার বাড়িও নোয়াখালি। আসেন কোলাকুলি করি!
আমার ধারনাই ঠিক। মামার মুখে হাসি ফুটলো। অতি চমৎকার এক হাসি। এই ঢাকা শহরে কোটি মানুষের ভিড়ে নিজের এলাকার লোক কে দেখতে কার না ভালো লাগে?
কলেজ ছুটি হয়ে গেলো। ফাহিমা এগিয়ে আসছে, যথারীতি তার সাথে তার দলবল।
– ভাইয়া চল রেস্টুরেন্টে!
– দেখ রে বোন, আমার কাছে ঝাল-মুড়ি কেনার টাকা টা ও নাই আর তুই রেস্টুরেন্টের কথা বলছিস? সাহস হয় কি করে তোর?
– আরে তোর খাওয়াতে হবে না তো, নিরু খাওয়াবে…..