বাবা মা’কে না জানিয়ে বাবার পছন্দ করা পাত্র কে কল দিয়ে যখন বললাম, কাল দুপুরের দিকে পি.জি হসপিটালে দেখা করতে, ভদ্রলোক বেশ উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন,
– ওখানে কেন? আমি শুধু বলেছিলাম,
– আসলেই জানতে পারবেন, রাখছি।
পাত্র হচ্ছে বাবার অফিস কলিগের ভাতিজা। নাম আশিকুর রহমান শ্রাবণ। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে জব করছে। নম্র,ভদ্র,চরিত্রবান ছেলে, বাবা অন্তত তাই বলেছেন। দেখতে কেমন তা বলতে পারবো না। কারণ পাত্র কে আমি এখনো দেখি নি। বাবার নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে ছেলে কে। আর বাবার পছন্দের উপর ছোটবেলা থেকেই আমার যথেষ্ট ভরসা থাকে সবসময়। ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার পরও প্রতি ঈদের কেনাকাটা টা আমি বাবা কে সাথে নিয়ে করি।
ছোটবেলার অভ্যাস, বদলাতে পারি নি এখনো। তাই পাত্র কে না দেখেই “হ্যাঁ” বলে দিয়েছি। তাছাড়া আমার কোনো পিছুটানও নেই। একটা ছিল কিন্তু রিলেশন হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিলো। তাও অনেক আগের কথা। তবে একজন কে অবশ্য খুব করে মনে ধরেছিলো, কিন্তু….যাক গে সেসব কথা। তারপর আর সে পথে পা বাড়াতে মন সায় দেয় নি। তবে বিয়েতে রাজি হওয়ার আরো একটা কারণ আছে। তা হল, ইদানীং ফেসবুকে ব্রাইডাল ফটোশ্যুটের ছবি দেখে বউ সাজতে ইচ্ছে করে খুব। পরদিন দুপুরবেলা ক্লাস শেষ করে চলে গেলাম পিজি হসপিটালে। ২ নং গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রাবণ কে কল দিলাম,
– আসসালামু আলাইকুম, কোথায় আপনি?
– ওয়ালাইকুম সালাম। আমি তো পৌঁছে গেছি।
– আমিও তো গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
– আমিও তো। আচ্ছা আপনি কত নাম্বার গেটের সামনে আছেন সাবরিনা?
– ২ নং। আপনি?
– আমিও। আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না?
মনে মনে ভাবলাম, দেখতে পেলেও তো চিনতে পারবো না। কিন্তু এ কথাটা উনাকে জানাতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই বললাম,
– না পাচ্ছি না। আপনি আমাকে দেখতে পেলে সামনে আসুন।
– আচ্ছা আসছি। ২ মিনিট পর এক সুদর্শন যুবক হাসি হাসি মুখ করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো,
– আপনি সাবরিনা?
তৎক্ষণাত তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দ্রুত গতিতে চোখ বুলিয়ে নিলাম আমি। আপাদদৃষ্টি তে সুদর্শন হলেও ভদ্রলোক কে আমার একটুও ভাল লাগে নি। ৫’১০” হাইট, ফর্সা ধবধবে গায়ের রঙ, হ্যাংলা পাতলা গড়ন, বিড়ালচোখী, পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট (মেয়েদের মত)। এ ধরনের পুরুষরা প্রেমিক হিসেবে ঠিকঠাক হলেও স্বামী হিসেবে একদমই মানানসই নয়। স্বামীরা হবে চকলেট কালার (কালো), শ্যাম বর্ণের হলেও মানিয়ে নেয়া যায়,একটু সুঠাম দেহের অধিকারী। কিন্তু একে দেখে মনে হচ্ছে ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। আর সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ছিল “ক্লিনসেভ”। ক্লিনসেভওয়ালা ছেলেদের আমার কাছে কেন জানি ছেলে মনে হয় না, আবার মেয়েও মনে হয় না, এদেরকে দেখলেই আমি কনফিউজড হয়ে যাই। যাই হোক ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে উত্তর দিলাম,
– জ্বী।
– আমিই শ্রাবণ। বলুন এবার, এখানে কেন ডেকেছেন?
– ভিতরে চলুন।
আমি ভেতরে ঢুকে সামনে এগিয়ে গেলে শ্রাবণ আমাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। ব্লাড টেস্টের টেবিলের সামনে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– বসুন। আমিও পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। শ্রাবণ আমার পাশে বসে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলেন,
– ব্লাড টেস্ট কেন? খুব স্বাভাবিকভাবে আমি উত্তর দিলাম,
– HIV টেস্ট করাবো তাই। আমার উত্তর শুনে শ্রাবণ ধাম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,
– হোয়াট! মানে কি এসবের? আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে চাপা গলায় অনুরোধ করলাম,
– চুপচাপ বসুন, পরে সব বুঝিয়ে বলবো আপনাকে।
শ্রাবণ শান্ত হয়ে বসলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে ব্লাড নিতে দিলেন। বাইরে এসে আমার পিছু পিছু হাঁটার সময় শ্রাবণ প্রশ্ন করলেন,
– এখন বলুন, এসবের মানে কি? আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম,
– দেখুন, এখনকার যে জেনারেশন! তাই বিয়ের আগে এইসব টেস্ট করানো বুদ্ধিমানের কাজ। সাবধান থাকতে তো আর সমস্যা নেই! আর শুনুন, আপনাকে আমি কল করে এখানে আসতে বলেছি, এই কথাটা যেন আর কেউ না জানে। শ্রাবণ মাথা নাড়িয়ে আমার দিকে আরেক কদম আগালেন,
– বুঝলাম। কিন্তু তাহলে তো আপনারও ব্লাড টেস্ট করানো দরকার ছিল। খানিকক্ষণ কিছু একটা ভেবে আমি বললাম,
– ঠিক আছে, চলুন।
তারপর আমার ব্লাডও দিয়ে আসলাম। কাজ শেষ করে শ্রাবণ তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন। অফিস থেকে বোধ হয় ছুটি নিয়ে এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। আমিও আর সময় নষ্ট করলাম না। বাসায় চলে আসলাম।
আগে থেকেই আমার প্লান ছিল,যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবে তার HIV টেস্ট করিয়ে নিবো। আশেপাশে তো কম ভুক্তভোগী দেখছি না! তাছাড়া এই সময়ে প্রেমিক-প্রেমিকার অবাধ মেলামেশা, শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া,অবৈধ পথে ভালবাসার প্রমাণ দেয়া এগুলো ডালভাত। শ্রাবণের বাড়ি থেকে আমাকে যেদিন দেখতে এসেছিলো,সেদিন চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে শ্রাবণের ভাবী আমার হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে চুপিচুপি বলেছিলেন,
– নাম্বার দিয়ে গেলাম,বাকি কাজ তোমার।
তখন এই সুযোগ টা হাতছাড়া করলাম না। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের সাথে গ্রুপ চ্যাট করছিলাম, এমন সময় মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। শ্রাবণ কল দিয়েছেন। কল রিসিভ করলাম আমি,
– আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছেন সাবরিনা?
– জ্বী ভাল, আপনি?
– ভালো। একটা কথা জানার ছিল।
– বলুন।
– আপনি আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন?
– আপনার ভাবী দিয়েছেন।
– কবে? যেদিন আপনাকে দেখতে গিয়েছিলো সবাই?
– হুম।
– ও, তো কাল রিপোর্ট আনতে যাচ্ছেন কখন?
– কিসের রিপোর্ট?
– ভুলে গেলেন! আজ কোন কাজে আমাকে ডেকেছিলেন…
– ওহ্, ক্লাস শেষ করে তারপর।
– ঠিক আছে, আমিও চলে আসবো।
– আপনার কাল অফিস নেই?
– আছে, ছুটি নিতে পারবো।
– আজও তো ছুটি নিয়েছিলেন।
– নাহ্, আজ আমি ছুটিতেই ছিলাম।
– কেন?
– একটু ব্যক্তিগত।
– ও আচ্ছা।
– ঠিক আছে, কাল আবার দেখা হচ্ছে তাহলে। রাখছি।
– হুম আচ্ছা।
ফোনের লাইন কেটে ল্যাপটপ অফ করে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে মাথাটা ধরেছে খুব। ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে বের হতেই দেখলাম, শ্রাবণ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি এখানে? মুচকি হাসি দিয়ে শ্রাবণ বললেন,
– আপনাকে নিতে চলে আসলাম। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম আমি,
– আমি কি গ্যাঁদা বাচ্চা যে আমাকে নিতে আসতে হবে? তাছাড়া আমি কোন ভার্সিটি তে পড়ি এটা আপনি জানলেন কি করে?
– অবান্তর প্রশ্ন করলেন। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে কোন ভার্সিটি তে পড়াশুনা করছে তা জানবো না! আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না আমার। শ্রাবণ একটা গাড়ির সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
– চলুন, যাওয়া যাক তাহলে? আমিও সামনে আগালাম,
– স্যরি, গাড়িতে আমি কমফোর্ট না। তবে বাইকে চড়তে ভাল লাগে খুব। আপনি গাড়ি দিয়ে আসুন। আমি রিক্সা নিয়ে নিচ্ছি।
আমি চলে আসার পরও শ্রাবণ স্থির হয়ে কিছুক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর যে যার মত করে হসপিটালে পৌঁছে গেলাম। রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে দুজনেরই। হসপিটালের কাজ শেষ করে একরকম জোর করেই শ্রাবণ আমাকে লাঞ্চে নিয়ে গেলেন গুলশান-২ এ। আমি যেতে চাই নি।
এভাবে প্রায়ই দু’তিন দিন পরপর শ্রাবণ আমার ভার্সিটির সামনে চলে আসতেন। ব্যাপারটা একেবারেই ভাল লাগতো না আমার। অফিস ফেলে হুটহাট করে হবু বউয়ের কাছে এরকম করে ছুটে আসা টা নেহায়েত লুতুপুতু ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি আমার কাছে। দিনে দিনে শ্রাবণের প্রতি আমার অনাগ্রহ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগলো। ওর কথাবার্তা, চালচলন, কথা বলার ধরণ সবকিছুতে আমি বাস্তবতার চেয়ে আবেগের ছোঁয়া পেতাম বেশি। অতি আবেগী মানুষ আমি সহ্য করতে পারি না। আর পুরুষ মানুষের আবেগ তো একদমই না। আমার কাছে শ্রাবণ কে কলেজ পড়ুয়া প্রেমিকদের মত মনে হত যে কিনা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা প্রেমিকাকে রূপকথার গাঁজাখুরি গল্প শুনিয়ে মুগ্ধ করায় ব্যস্ত।
একদিন কড়াভাবে নিষেধ করে দিলাম যেন যখন তখন ভার্সিটির সামনে চলে না আসে। তাছাড়া বিয়ের আগে এভাবে নিয়মিত দেখা করা আমার পছন্দ না। আমি শ্রাবণ কে বুঝাতে চেষ্টা করতাম, এভাবে হচ্ছে না, আমি মানিয়ে নিতে পারছি না। কিন্তু সে বুঝতে পারতো না। অবশ্য বুঝতে পারতো না নাকি বুঝতে চাইতো না তা জানি না। অনেকবার ভেবেছি, জল বেশিদূর গড়ানোর আগেই মা’কে সবটা বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারি নি। বাবা বারবার বলেছিলেন, পাকা কথা হওয়ার আগে ছেলের সাথে একবার কথা বলে নিতে। অথচ আমি রাজি হই নি। বাহাদুরি দেখিয়ে বলেছিলাম “তুমি দেখেছো তো বাবা, তাতেই চলবে”। এখন বড্ড আফসোস হয়। তখন যদি শ্রাবণের সাথে পরিচয় হত,আজ তাহলে এই দিন আসতো না আমার। একদিন সন্ধ্যেবেলা শ্রাবণ কল দিয়ে জানালেন,
– আমার এক কাজিন আপনার সাথে দেখা করতে চায়? আপনার কি কাল সময় হবে সাবরিনা?
– আমার সাথে কেন দেখা করতে চায়?
– এমনিই। থাকে না বিয়ের আগে কাজিনরা হবু ভাবীর সাথে পরিচিত হতে চায়? তেমনই আর কি।
– কিন্তু কাল তো আমার সময় হবে না। অন্য কাজ আছে।
– প্লিজ, একটু দেখুন না ম্যানেজ করা যায় কিনা?
এখন যদি আমি “না” করি তাহলে শ্রাবণের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও “হ্যাঁ” বলে দিলাম। পরদিন বিকালে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে শ্রাবণ তার কাজিন কে নিয়ে এলো। আমার পৌঁছাতে লেট হয়ে যাওয়ায় উনাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিলো কিছুক্ষণ। রেস্টুরেন্টে ঢুকে শ্রাবণ কে দেখতে পেলাম প্রথম সারির ডানপাশের এক টেবিলে বসে আছে,মুখোমুখি বসে আছে তার কাজিন। আমি ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে শ্রাবণের পাশে বসলাম। আমার পুরো দুনিয়াটা থমকে গেল শ্রাবণের কাজিন কে দেখে। শ্রাবণ কিছু বলার আগেই তার কাজিন খুব কৌতুহলী হয়ে আমাকে বললো,
– আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মুচকি হেসে স্বাভাবিক হলাম আমি,
– ভর্তি পরীক্ষার জন্য “অপরচুনিটি” তে কোচিং করেছিলাম আমি।
– ও আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে তুমি করেই বলি। তো এখন কোথায় পড়ছো?
– ঢাবি তে ইকোনোকিক্স ডিপার্টমেন্টে।
– বাহ্। খুব ভাল।
পরিচয় পর্ব শেষ করে বাসায় ফেরার তাড়া দেখিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে চলে এলাম আমি। বেশিক্ষণ আশিক স্যারের সামনে স্থির হয়ে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ভর্তি পরীক্ষার কোচিং এ আশিক স্যার আমাদের ইংলিশ ক্লাস নিতেন। গায়ের রঙ কালো হলেও যে একটা মানুষ এতটা সুন্দর হতে পারে তা আশিক স্যার কে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না। আর এমনিতেও কালো ছেলেদের প্রতি আমার এক ধরনের আলাদা দূর্বলতা কাজ করে। বিশেষ করে আশিক স্যারের হাসি টা ছিল রমণীদের ভড়কে দেয়ার মত। যদিও তিনি খুব কম হাসতেন। তার ব্যক্তিত্ব, রাগী চেহারা, কথা বলার ধরণ, একটু আধটু শাসন সবকিছুতেই আমি শুধু মুগ্ধতা খুঁজে পেতাম। অন্যান্য ক্লাসগুলো যেমন তেমনভাবে করলেও ইংলিশ ক্লাস টা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে করতাম। আর যেদিন আশিক স্যারের ক্লাস থাকতো সেদিন যতটা সম্ভব অগোছালো হয়ে কোচিং এ আসতাম।
এই যেমন চুলগুলো কোনোরকম করে আঁচড়ানো, সেই চুলে আবার এলোমেলো হাতখোঁপা, তারপর রংচঙ বিহীন শুষ্ক ঠোঁট, রাত জাগার কারণে চোখের নিচে পড়া হালকা ডার্ক সার্কেল স্পষ্ট, এই আর কি। কারণ কোথায় যেন পড়েছিলাম, অগোছালো সুন্দরী রমণীরা পুরুষদের নজরে পড়ে বেশি। তাছাড়া সবাই বলতো,ফিটফাটের চেয়ে এরকম অগোছালো সাজেই আমাকে বেশি মানায়। মোট কথা সবসময় ই আমার চেষ্টা থাকতো আশিক স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার। কিন্তু মানুষটা একটাবারের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকাতো না। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো না। তিনি তার মত করে ক্লাস নিয়ে চলে যেতেন। অন্য কোনো দিকে নজর দেয়ার সময় তার কখনোই থাকতো না। ধীরে ধীরে এ মুগ্ধতা কখন যে ভালবাসায় রূপ নিলো,তা আমি নিজেও আঁচ করতে পারি নি। লোকে বলে, ভালবাসা নাকি বলে কয়ে আসে না। কাকে কখন এ রোগে আক্রমণ করে তা আগে থেকে জানা যায় না।
আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আরশি মানে আমার খালাতো বোন, ও সবসময় এটাকে মোহ বলতো। কিন্তু আমি কখনোই এ অনুভূতি কে মোহ ভাবতে পারি নি। মোহ হলে তো কবেই আশিক স্যার কে ভুলে যেতাম। ভালবাসি বলেই না মানুষ টা কে আজও বুকের বামপাশে জিইয়ে রাখতে পেরেছি। এত ভালবাসি তবুও কখনো সাহস করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারি নি কথাটা। কারণ ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়ার আশা ছিল না। অনুভূতি টা ছিল একপাক্ষিক। কত রাত যে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়েছি তার হিসেব নেই। মন খারাপের বিকেলগুলো কতটা নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছি, কেউ জানে না। একপাক্ষিক অনুভূতিগুলোর কোনো দরকষাকষি চলে না, নয়তো এই মূল্যহীন যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতিগুলো কে কবেই এক চিলতে অভিমানের চওড়া দামে বেঁচে দিতাম কোনো এক মুসাফিরের কাছে।
বাসায় এসে আরো বেশি অস্থিরতায় পড়ে গেলাম। এতদিন তো শুধু শ্রাবণ কে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। আর আজ জানতে পারলাম আশিক স্যার শ্রাবণের কাজিন। সব মিলিয়ে কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এর মধ্যে মা এসে জানিয়ে গেলেন, শ্রাবণের বাড়ি থেকে বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। তাই আগামী মাসের ২০ তারিখ ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। এবার একেবারেই হতবিহবল হয়ে পড়লাম আমি। যে করেই হোক বিয়ে ভাঙার ভূত মাথায় চেপে বসলো। আর কোনো উপায় না দেখে আরশি কে কল করলাম,
– হ্যালো আরশি।
– হ্যাঁ বল।
– কাল আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে পারবি?
– কোথায়?
– উঁহু, সেসব কথা পরে হবে। তুই সকালে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসিস। ঠিক আছে?
– ওকে।
আরশি আমার দু’বছরের ছোট হলেও ওর সাথে আমি সবকিছু শেয়ার করি। আরশির সাথে কথা শেষ করে শ্রাবণ কে টেক্সট করলাম, “কাল দেখা করতে, খুব দরকার”। সকালে আরশি বাসায় আসার পর ওকে আমি সব বুঝিয়ে বললাম। ও কিছু বললো না, চুপচাপ শুধু শুনে গেল সব। সকাল ১১.৩০ এ আমি,আরশি আর শ্রাবণ রমনার বকুলতলায় বসলাম। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই শ্রাবণ কে বললাম,
– দেখুন শ্রাবণ, আমি এতদিন বলবো বলবো করেও কথাটা বলতে পারি নি। কিন্তু আজ না বলে উপায়ও দেখছি না। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলাম,
– আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। অন্য কাউকে ভালবাসি আমি। এ বিয়েটা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। পরক্ষণেই শ্রাবণ বলে উঠলো,
– ও, ঠিক আছে। আমি শ্রাবণ ভাইয়্যা কে কল করে বলে দিচ্ছি ওকে থামিয়ে দিলাম আমি,
– মানে? শ্রাবণ কে?
– কে আবার? আমার চাচাতো ভাই আর তোমার হবু বর। আরে সেদিন যাকে নিয়ে এসেছিলাম। তুমি হয়তো তোমার হবু বরের পুরো নাম টা খেয়াল করো নি। ওর নাম আশিকুর রহমান শ্রাবণ। দ্বিধান্বিত হয়ে আবারো প্রশ্ন করলাম,
– তাহলে আপনি কে?
– তোমার দেবর “শ্রেয়ান”।
– আমি কিছু বুঝতে পারছি না। শ্রেয়াণের বদলে এবার আরশি উত্তর দিলো,
– স্যরি রে সাবরিনা, ফেসবুকে আশিক ভাইয়্যার সাথে শ্রেয়াণের ছবি দেখে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আশিক ভাইয়্যার সাথে ওর কিসের সম্পর্ক। তারপর যখন জানতে পারলাম, ওরা দুজন কাজিন। তখন তোর কথা বললাম। আশিক ভাইয়্যা কে তুই কতটা ভালবাসিস সেটা বললাম। সব শুনে শ্রেয়ান এই প্লান টা সাজিয়েছিলো। বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়ে আরশি কে জিজ্ঞেস করলাম,
– তুই ওকে আগে থেকেই চিনিস? গলা খাঁকারি দিয়ে শ্রেয়ান উত্তর দিলো,
– উই আর ইন এ রিলেশনশিপ। আরশির দিকে কড়া চোখে তাকালাম আমি,
– এতদিন বলিস নি কেন? বাচ্চাদের মত করে আরশি কৈফিয়ত দিতে শুরু করলো,
– বা রে, তুই কি কখনো জিজ্ঞেস করেছিস, আমি কোনো রিলেশনশিপে আছি কিনা? তাহলে আমি কেন আগ বাড়িয়ে বলতে যাব! কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচু স্বরে শ্রেয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম,
– প্লান টা কি ছিল শুনি?
– তেমন আহামরি কিছু না। আসলে আরশির কাছে আশিক ভাইয়্যার প্রতি তোমার পাগলামির কথাগুলো শুনে খুব ইন্টারেস্টেড হয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে দেখার জন্য। তারপর আরশি তোমার ছবি দেখালো। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, যে করেই হোক তোমাকেই আমার ভাবী বানাবো। খোঁজ নিয়ে আবার জানতে পারলাম, আমার বাবা আর তোমার বাবা একই অফিসে চাকরী করেন। তখন তো কাজ টা আরো সহজ হয়ে গেল আমার জন্য। একদিন কায়দা করে বড় চাচা কে বাবার অফিসে নিয়ে গেলাম, আরশিও সেদিন আমার কথামতো তোমাকে আংকেলের অফিসে নিয়ে এসেছিলো। তারপর দূর থেকে তোমাকে দেখিয়ে চাচা কে বললাম,”চাচ্চু, তুমি না শ্রাবণ ভাইয়্যার জন্য মেয়ে খুঁজছো? ওই দেখো, মাশাল্লাহ্ না?” প্রথম দেখাতেই চাচ্চু তোমাকে দেখে পছন্দ করে নিয়েছিলেন। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিল, তোমার যা চোখ ধাঁধানো রূপ! এইতো, বাকি কাজ চাচ্চু বাবার সাথে কথা বলে সেরে ফেললেন। সব শুনে আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। আরশি বললো,
– কিন্তু শ্রাবণ সেজে মজা করার প্লান টা আমাদের ছিল না। একা শ্রেয়াণের ছিল। শ্রেয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম,
– আমি যদি তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়তাম?
– ধুর, আমি এত কাঁচা খেলোয়াড় নাকি! সব জেনেই মাঠে নেমেছিলাম। আরশির কাছে শুনেছি, তুমি যে ধরণের কোয়ালিটির ছেলে পছন্দ করো। সেই কোয়ালিটির ছিটেফোঁটাও আমার মধ্যে নেই। তাই নিঃসংকোচে আর নির্ভয়ে খেলতে নেমে গিয়েছিলাম বুঝলে?
– কিন্তু ফোন নাম্বার টা?
-উঁহু, ওটা তো আমিই ভাবী কে লিখে দিয়েছিলাম। কিন্তু কার নাম্বার দিয়েছি তা আর যাচাই করে দেখেন নি ভাবী। মুখ গম্ভীর করে বললাম,
– কাজ টা ঠিক হয় নি। কিন্তু শ্রেয়ান জোর গলায় প্রতিবাদ জানালো,
– অবশ্যই ঠিক হয়েছে। দেবর হয়ে ভাবীর সাথে এতটুকু মজা করার অধিকার আমার আছে। তাছাড়া শ্রাবণ ভাইয়্যা সবটাই জানে। চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করলাম,
– উনিও তোমাদের এই ছেলেমানুষি টা কে প্রশ্রয় দিয়েছেন?
– আরে না। প্রথমে তো কিছু জানায় নি। পরে জানিয়েছি। বকাঝকা করেছে অনেক। তারপর আবার ঠিক হয়ে গিয়েছে। আর সেদিন তো তোমার সাথে আলাপ করানোর জন্যই ওকে নিয়ে এসেছিলাম। আরো কিছুক্ষণ থাকলে তুমি নিজেই ব্যাপার টা ধরে ফেলতে পারতে। খেলা সেদিনই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তুমি তো ভয় পেয়ে ভেগে গেলে। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে শ্রেয়ান বললো,
– ও হ্যাঁ,কি যেন বলছিলে, অন্য কাউকে ভালবাসো তাই তো? শ্রাবণ ভাইয়্যা কে কল করে বলি তাহলে এখন? নিজের অজান্তেই আতঙ্কিত হয়ে বলে ফেললাম,
– না। সাথে সাথে শ্রেয়ান আর আরশি একযোগে হেসে উঠলো।
বাইরে থেকে যতই ওদের সাথে রাগ দেখাই না কেন, মনে মনে ঠিকই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলাম ওদের ছেলেমানুষি কে। ছেলেমানুষি থেকে যদি মনের মানুষ টা কে আপন করে পাওয়া যায়, তাহলে সেই ছেলেমানুষি ই ভাল।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিয়েটা হয়ে গেল। বাসর রাতে শ্রাবণ ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তখন ড্রেসিংটেবিলের সামনে গয়না খুলতে ব্যস্ত ছিলাম। শ্রাবণের স্পর্শ পেয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমার কাঁধে থুতনি রেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলেন,
– তোমার মনের কথা আমাকে জানাও নি কেন?
– আপনিই বা বুঝেন নি কেন?
শ্রাবণ আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে দুই হাত দিতে আমার মুখটা আঁজলা ভরে ধরলেন। বুকে বুক লাগিয়ে পাঁজর গুড়িয়ে দিলেও কারো হৃদয় কম্পিত হয় না, আবার বুকের উপর শুধু বুকের ছায়া ফেলেও নাকি অন্তর কাঁপিয়ে দেয়া যায়। আমার অন্তর টা যেন কেঁপে উঠলো। তারপর নাকে নাক ঘষে উত্তর দিলেন,
– আগুন সুন্দরীদের কখনো অনুবাদ করতে যেতে নেই, অনুভব করতে হয় শুধু। লজ্জা পেয়ে তার বুকে মুখ লুকাতে নিলে, আমাকে থামিয়ে দিয়ে একটা খাম আমার দিকে এগিয়ে দিলেন শ্রাবণ,
– এক মিনিট, এক মিনিট। আগে এটা ধরো।
– কি এটা? আমার ঠোঁটে আলতো করে ভালবাসার ছোঁয়া দিয়ে শ্রাবণ ফিসফিস করে বললেন,
– HIV টেস্টের রিপোর্ট। নেগেটিভ এসেছে কিন্তু।