দুদিন ধরে রাত্রি আমার ভদ্রতা এবং ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। সত্যি কথা বলতে ভেতরে ভেতরে রাগে আমার গা জ্বলছে কিন্তু আমি হাসি মুখে এমন ভাব করছি যেন কিছুই হয়নি। যেমন সে তার মামার বাড়ি এসেই তার মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে ব্লাড প্রেসার মাপতে শিখেছে। তারপর থেকে প্রেসার মাপা যন্ত্র সাথে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরঘুর করছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকে ধরেই প্রেসার মাপছে। দুদিনে সে আমার প্রেসার আট বার চেক করেছে।
প্রেসার একটু লো হলেই ধরে দুটো সেদ্ধ হাসের ডিম খাইয়ে দিচ্ছে। ডিম খেয়ে শুয়ে আছি তার একটু পরে এসে আবারো প্রেসার মাপছে। ডিম খেয়ে প্রেসার একটু বাড়লেই ধরে দুই গ্লাস তেঁতুলের শরবত খাওয়াচ্ছে। শুধু তেঁতুলের শরবত খাইয়ে শান্ত হচ্ছেনা। জোর করে মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করছে। দুই দিনে চারবার মাথায় বরফ পানি ঢালার কারনে সর্দি লেগে গেছে। বাসার প্রায় সবার সর্দি লেগে গেছে তবুও রাত্রির অত্যাচার বন্ধ হচ্ছেনা। সবাই মিলে সেই শালাবাবুকে বকাবকি করছে যে রাত্রিকে প্রেসার মাপতে শিখিয়েছে। অথচ সেই বেচারার সবচেয়ে বেশি সর্দি লেগেছে।
আমি রাত্রির মামিকে ডেকে বললাম “মামি আপনি তো রাত্রিকে কিছু বলেন”। মামি রাত্রিকে ডেকে বললেন “অনেক ঢং করেছিস। আর না। এবার এসব বন্ধ কর।” রাত্রি তার মামার সামনে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো “মামা আমি চলে যাচ্ছি। মামি আমাকে গালি দিয়েছে।”
ব্যাস মামা মামিকে ডেকে ইচ্ছা মতো বকাবকি করলেন। তারপর থেকে রাত্রিকে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা। রাত্রির মামা হলেন এ বাড়ির হিটলার। তার উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। গতকাল তিনি তার এক ছেলেকে ধরে নিজ হাতে ন্যাড়া করে দিয়েছেন। তার অপরাধ তিনি সিগারেট খেয়েছেন। অথচ তার রুমে বসে আমি সিগারেট খেয়েছি। ভাগ্য ভালো মামা শশুড় বুঝতে পারেননি লোকটা আমি ছিলাম। নাহলে আমাকে ধরে ন্যাড়া করে দিতেন। রাত্রির মামা রিটায়েট আর্মি অফিসার। সবাই তাকে বাঘের মতো ভয় পায়।
সবাই ভয় পেলেও রাত্রির সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। বেচারা মামার খুব ইচ্ছে ছিলো তার একটা কন্যা সন্তান হবে। এক এক করে সাতটা ছেলে হবার পরে তিনি নিশ্চিত ছিলেন এবার তিনি কন্যা সন্তানের পিতা হবেন। তিনি ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিলেন তার মেয়ের নাম রাখবেন চম্পা। বড় সাত ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন চম্পা। কিন্তু সেবারেও মামির ছেলে হলো। কন্যা সন্তানের জন্য জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা পেলো রাত্রি। ভাগ্নিকে তিনি মেয়ের মতো ভালোবাসেন। সেজন্যই এ বাসায় রাত্রির এতো ক্ষমতা। রাত্রি খুব আনন্দের সাথে সবাইকে সেদ্ধ ডিম আর তেঁতুলের শরবত খাইয়ে বেড়াচ্ছে। মুহি হয়েছে রাত্রির এসিসট্যান্ট। পুরো বাড়ি খুঁজে রাত্রির ভয়ে লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোর খোঁজ দেয়া তার কাজ।
আমি দুদিন ধরে নিজের রাগ কমানোর জন্য নতুন উপায় বের করেছি। রাত্রির সবচেয়ে ছোট মামাতো ভাই কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করে। প্রতিদিন কাস্টমার কেয়ারে ফোন করছি। যতোক্ষন পর্যন্ত রাত্রির মামাতো ভাই ফোন ধরছেনা ততোক্ষন ফোন করছি। যখন ফোনের ওপাশে রাত্রির মামাতো ভাই বলছে “হ্যালো স্যার আমি জাহিদুল হাসান বলছি। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
আমি মুচকি হেসে বলছি “কে চম্পা বলছেন? আচ্ছা চম্পা আমি আপনাকে একটা গান শোনাতে চাই। সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগো। সাত ভাই চম্পা আহা আহা, চম্পা চম্পা আহারে আহা। ওরে চম্পা আহারে চম্পা।”
শালাবাবু ফোনের ওপাশে একটা কথাই রিপিট করে “হ্যালো স্যার কে বলছেন।” শালাবাবু মনে হয় কনফিউজড কে তাকে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে চম্পা ডাকে। তার বাবা তার জন্মের আগে চম্পা রাখতে চেয়েছিলো এটা তো সবার জানার কথা না।
আজ সকালে চম্পা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় এসে উপস্থিত। বিনোদন নেয়া বন্ধ আমার।
দুপুরে গোসল শেষ করে ঘরে এসে দেখি আমার কমলা রঙের লুঙ্গিটা নেই। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এতো দামি লুঙ্গি কোথায় গেলো। আমার এক বন্ধু থাইল্যান্ড থেকে দুটো লুঙ্গি এনেছে আমার জন্য। একটা কমলা রঙের অন্যটা সবুজ রঙের। বন্ধু লুঙ্গিগুলো দেয়ার সময় বলেছিলো দোস্ত বহুত দামি লুঙ্গি। এই লুঙ্গি কেনার জন্য দোকানে ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছিলো। কতো লোকের উষ্টা গুঁতো খেয়ে যে দোকান থেকে লুঙ্গি দুটা কিনেছি তোর জন্য। বন্ধুর ভালোবাসা দেখে আমার বুক ভরে এসেছিলো। কিন্তু সেই লুঙ্গি কই। গোসলে যাবার আগেই তো বিছানায় রেখে গেলাম।
আমি ঘরের সবকিছু ওলট পালট করে আমার লুঙ্গি খুঁজছি। দুটো লুঙ্গিই গায়েব। রাত্রি হাসি হাসি মুখে রুমে ঢুকলো। রাত্রির হাসি দেখেই বুঝতে পারছি সামথিং ইজ রং, ভেরি ভেরি রং। রাত্রিকে বললামঃ
-আমার লুঙ্গি কোথায়?
–এই যে নাও।
রাত্রি আমার দিকে লুঙ্গি ছুঁড়ে দিয়ে দৌঁড়ে পালালো। যেটা ভেবেছিলাম রাত্রি আমার লুঙ্গি দুটোর সাথে তার চেয়েও খারাপ করেছে। কমলা লুঙ্গি কেটেকুটে সবুজ লুঙ্গির উপর বড় বড় দুটো পকেট বানিয়ে দিয়েছে। শুধু সেটা করে ক্ষান্ত হয়নি সে। লুঙ্গির একদিকে মোটা ফিতা লাগিয়ে দিয়েছে। লুঙ্গির কষ্টে কান্না আসছিলো। আমার থাইল্যান্ডের লুঙ্গি। লুঙ্গির প্রতি ভালোবাসা কাটাতে না পেরে কোমরে লুঙ্গির ফিতা গিট্টু দিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। আমাকে যেই দেখছে সেই হাসছে। হাসুক তাতে আমার কি। পকেট থাকায় মোবাইল রাখতে অবশ্য সুবিধা হয়েছে। আমার মামা শশুড় পর্যন্ত আমার অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করলেন। আমাকে ডেকে বললেন “জামাই আসো আসো। বসো একটু গল্প করি।”
রাত্রি দু কাপ চা এনে টেবিলের উপর রাখলো। চায়ে চুমুক দিয়েই বললাম “চা এতো ঠান্ডা কেন?”
রাত্রি চায়ের কাপ নিয়ে আমার লুঙ্গির উপর ঢেলে দিলো। লাফ দিয়ে সোফার উপর বসলাম। রাত্রিকে ধমক দিয়ে বললামঃ
-বদ মহিলা। মাথা কি পুরোপুরি গেছে তোমার।
–কেন চা তো ঠান্ডা। লাফ দিয়ে উঠলে কেন?
-তাই বলে গায়ের উপর চা ঢেলে দিবি। পা পুড়ে গেছে তো।
–পুড়ুক। খুব ভালো হয়েছে। খুশি হয়েছি।
চেঁচামেচি শুনে সাত নম্বর শালাবাবু এসে বললোঃ
–দুলাভাই নাকি থাইল্যান্ডের লুঙ্গি পড়ে বেড়াচ্ছেন শুনলাম। বাহ্ থাইল্যান্ডের লুঙ্গিতে পকেট থাকে জানতাম না তো। লুঙ্গিতে দেখি বাংলায় থাইল্যান্ডের লুঙ্গি লেখা।
শালাবাবুর কথা শুনে লক্ষ্য করে দেখলাম লুঙ্গিতে সত্যি সত্যি বাংলায় লেখা থাইল্যান্ডের লুঙ্গি। তারমানে বন্ধু মিথ্যা বলেছে। হারামি। লেখাটা এতোদিনে আমার চোখে পড়লোনা। আশ্চর্য। শালাবাবু বললোঃ
–দুলাভাই আমার সাথে একটু আসেন। কাজ আছে।
শালাবাবু আমাকে মেইন সুইচের কাছে দাঁড়া করিয়ে বললো “দুলাভাই এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যখন সুইচ অন করতে বলবো তখন অন করবেন। যখন অফ করতে বলবো অফ করবেন।”
এমনিতে মেজাজ খারাপ তার উপর বিরক্তিকর কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ঠিক বুঝিনা এই শালাকে চাকরি কে দিবে। শালা নাকি ইলেকট্রিকাল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তিনটা সুইচ বদলাবে চল্লিশ মিনিট ধরে আমাকে মেইন সুইচের সামনে দাঁড়িয়ে রেখেছে। একটু পরপর বলছে ভাই অন করেন। ভাই অফ করেন। বিরক্তি দমিয়ে রাখতে না পেরে কাজ করার সময় হুট করে সুইচ অন করে দিলাম। শালাবাবু শক খেয়ে টুলের উপর থেকে লাফ দিয়ে দৌঁড়ে বাইরে চলে গেলো। বাইরে গিয়ে চিল্লাচ্ছে “শক খাইছিরে। ওরে বাপরে। কঠিন শক খাইছি। কান গরম হয়ে গেছে। আরেকটু হইলে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে যেতো।” আমি ভাবছি এই শালা যদি ভুলেও কোন অফিস বা কারখানায় চাকরি পায় এ তো পুরো অফিস উঠিয়ে দিবে।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এ বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যাটা উপভোগ করার মাঝে একটা আনন্দ আছে। গাছপালায় ঘেরা বাসাটায় এক ধরনের নিরবতা নেমে আসে। এই সময় ছাদে দাঁড়াতে আরও বেশি ভালো লাগে। আমি আসলে মনে মনে রাত্রিকে খুঁজছি। দুপুরের পরে তাকে আর দেখিনি। দুপুরে এসেছিলো প্রেসার মাপতে। সাথে তেঁতুল পানি নিয়ে এসেছিলো আমি রেগে গিয়ে তার মাথায় তেঁতুল পানি ঢেলে দিয়েছি। তারপর থেকে তার দেখা পাচ্ছিনা। আমার ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হলো। রাত্রি ছাদেই দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রিকে বললামঃ
-তুমি এখানে? তাহলে বাসার সবাইকে কে অত্যাচার করছে?
রাত্রি আমার কথার জবাব দিলোনা। কাছে গিয়ে দেখলাম সে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বললামঃ
-কি হলো মন খারাপ কেন?
–কিছু হয়নি।
-কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে। সেই কিছু একটা কি শুনি?
–আমি খুব অত্যাচার করেছি তাইনা? সরি।
-মাথায় একবার তেঁতুল জল ঢেলেছি তাতেই মন খারাপ? তুমি যে এ বাসায় আসার পর থেকে ধরে ধরে ডিম খাওয়াচ্ছো, তেঁতুলের শরবত খাওয়াচ্ছো, মাথায় বরফ পানি ঢালছো। এসব কি?
–এসবের জন্যই তো সরি বলছি। আর হবেনা।
-হঠাৎ এতো ভদ্র হয়ে গেলে ঘটনা কি?
–আমি এসব করছিলাম কারন আমি তোমার উপর রেগে ছিলাম। তুমি আমার জন্মদিন ভুলে গেছিলা। ভেবেছি আমার রাগ দেখে তোমার মনে পড়বে। কিন্তু তোমার তো সব ন্যাকামি আর অত্যাচার মনে হচ্ছে। সরি আর করবোনা।
-গুড। আর যেন এসব না হয়। আর তুমি কি ছোট বাচ্চা যে তোমার জন্মদিন মনে রাখতে হবে। এক বাচ্চার মায়ের আর জন্মদিন। যাও নিচে যাও মামা খুঁজছেন তোমাকে।
রাত্রি নিচে যাওয়ার আগে একবার আমার মুখের দিকে তাকালো। আমার কথা শুনে যে রাত্রির মন খারাপের পরিমান বেড়ে গেছে সেটা তার চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। আমি আরেকটু কড়া কন্ঠে বললাম “কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন। যাও নিচে যাও।” রাতের খাওয়ার পরে রাত্রি কোন কথা না বলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাতে রাত্রিকে ডেকে বললামঃ
-খুব গরম পড়েছে। চলো একটু ছাদে যাই।
রাত্রি ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বললোঃ
–আমি যাবোনা তুমি যাও।
-যাবেনা মানে। মুখে মুখে তর্ক করা তো খুব ভালোই শিখেছো।
রাত্রি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বিছানা থেকে নামলো। আমার পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে ছাদে আসলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাদে আসতেই আলো জ্বলে উঠলো। পুরো ছাদ বেলুন দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। মাঝখানের টেবিলে একটা কেক রাখা হয়েছে। রাত্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
-সরি ভুলে যাওয়ার জন্য। সত্যি বলতে কাজের চাপে স্মরন ছিলোনা।
সমস্যা হলো কেক কাটতে গিয়ে। কেকের উপর লেখা “হ্যাপি বার্থডে বদমহিলা।”
রাত্রি কেক না কেটে কেক আমার মুখে ছুঁড়ে মারলো।
–হারামি, বুইড়া খাটাস। কাকে বদমহিলা বলিস। আমি বদমহিলা? তুই কি তুই।
আমি মুখ থেকে কেক তুলে তুলে খাচ্ছি। মুহি আর চম্পা ভাই দুজনে মিলে বেলুন গুলো ফাটাচ্ছে। হঠাৎ লাইট অফ হয়ে গেলো। আমার সাত নম্বর শালাবাবু আবারো চিৎকার দিলেন “আরেকবার শক খাইছি রে। ও মারে। কান গরম হইয়া গেছেগা।” শালাবাবুর সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নামার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। রাত্রি আমাকে বকাবকি থামিয়ে হাসতে শুরু করলো। হুট করে মনে পড়লো আমি তো গিফ্ট কিনতে ভুলে গেছি। না জানি এটার জন্য আমার কি অবস্থা হবে।