ভাইজান কইটা টেকা দিবেন? সেই সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি…
– এই কি হলো দাঁড়ালে কেন?
– কত্ত ছোট মেয়েটা। কিভাবে হাত পেতেছে। না দিয়ে কিভাবে যাই।
– আরে ধুর এরা সব নেশাখোর। তুমি টাকা দিবা আর এই টাকা নিয়ে নেশা করবে।
-উফ… বাজে কথা বন্ধ করোত।
মানিব্যাগ বের করে ৫০ টাকার একটা নোট নিলো বিজয়। ছোট মেয়েটা টাকা টা হাতে নিয়ে কর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বিজয়ের দিকে। বিজয়ের পাশে ওর গার্লফ্রেন্ড নীলা ঝাঝালো কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো
– কি রে টাকা পেয়েছিস। এখন হা করে কি দেখিস? যেন টাকা টা দেওয়াতে নীলার সমস্ত শরীর জ্বলছে। ছোট মেয়েটা ভয়ভয় কণ্ঠে বললো
-ভাইজান আমার কেছে তো ভেঙা টেকা নেই। বিজয় একটু অবাক হলো। সামান্য ভ্রুকুঞ্চন করে বললো
– কেন? খুচরা টাকা কেন লাগবে তোমার?
– ভেঙা টেকা না থাকলে আপনারে চল্লিশ টেকা ফিরায়ে দেবো কি করে।
বিজয়ের মুখে একটা শান্তির হাসি দেখাদিলো। মানুষ হয়তো ওকে সর্বচ্চ দশটাকার বেশি দেয় না। মেয়েটার প্রতি রাহাতের এই হাসি দেখে নীলার জ্বলন্ত শরীরে অগ্নুৎপাত হলো। তার লাভা ছিটিয়ে দিয়ে নীলা বলে উঠলো
– এতটুকু মেয়ে দেখো আবার টাকার হিসাব ও জানে। বিজয় বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো
– কেন? ওর মত বয়সে তুমি মনেহয় টাকার হিসাব জানতে না।
– দেখো বিজয়। এই সব রাস্তার মেয়ের সামনে আমাকে অপমান করবানা খবরদার।
– তো কি বড়লোকের মেয়ের সামনে তোমায় অপমান করা উচিৎ বা তুমি খুশি হতে।
– বিজয় তোমার এই স্বভাবের কারণেই তোমাকে এত অসহ্য লাগে। তুমি মানুষ কে সম্মান দিতে জানো না বুঝলে?
– হ্যা জানি না। অবুঝ বড়লোকেদের আমি সম্মান দিতে জানি না।
– তুমি সামান্য এই রাস্তার মেয়ের জন্য এভাবে অপমান করলে বিজয়? দুটাকার সস্তা মেয়ে তোমার কাছে এত বড় হয়ে গেলো। সাথে সাথে বিজয়ের মাথা ঝাইঝাই করে উঠলো। রাগে চোখমুখ লালচে হয়ে গেলো।
– চুপ। আর একটা ছোটলোকি কথা বলবে না তুমি। এতটুকু মেয়ে ভিক্ষা করছে দেখে তোমার মেয়া লাগে না?
– না লাগে না। যত্তসব
এই বলে নীলা রাহাত কে ছেড়ে হনফন করে চলেগেলো। কিন্তু বিজয় তাকে একবার ও আটকালো না। শুধু একটানা নীলার দিকে তাকিয়ে ওর চলেযাওয়া দেখলো। বিজয়কে দেখে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে।
– ভাইজান ভাবীজান রাগ করেছে। এই লন টেকা লাগবো না।
– আরে কেন কেন? টাকা টা তোমাকেই দিয়েছি। তোমার ভাবী একটু এমন। বাদ দাও। সত্যি কি আজ সকালে খাওনি?
– না ভাইজান। মা কইছে পার্কে গিয়ে যে টেকা হবে সেইটা দিয়ে খাইতে।
– আর কেউ টাকা না দিলে?
– টেকা না হলে খাওয়া হয়না।
– কি? খাওয়া হয় না? এত টুকু মেয়ে না খেয়ে থাকতে পারো কিভাবে?
হয়ত মেয়েটা কি বলবে বুঝেউঠতে না পেরে চুপ করে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার চকচকে ক্ষুধার্ত চোখ পড়েফেলতে বিজয়ের খুব দেরী হলো না। আজ বিজয় আর নীলার ক্যাফেতে গিয়ে খাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নীলা তো তেজ দেখিয়ে চলে গেলো। পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করে দেখে এক হাজার টাকার দুইটা নোট এক কোনে পড়ে আছে। দেখে বিজয়ের মমতা মাখা চোখ খুশিতে আরো উজ্জ্বল হয়ে গেলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বিজয় জিজ্ঞেস করলো
-তোমার নাম কি
– আমার নাম লতা..ভাইজান।
– হুম… তো চলেন আমার মিষ্টি পিচ্চি গার্লফ্রেন্ড।
-কোথায় যাবো ভাইজান?
– চলেন দুইজন মিলে খাওয়াদাওয়া করবো।
আমি ও আপনার মতো কিছু খাইনি। শুনেই লতার মুখে খুশির একটা আভা দেখা দিলো। কিন্তু একটু পরেই লতা নিজের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো।
– কি হলো? আবার মন খারাপ হলো কেন?? কি? যাবে না আমার সাথে?
– যাবো ভাইজান। তা আমারে ঢুকতে দেবে না ওরা। আমার ছেঁড়া জামা পরা দেখে ওরা আমারে বের করে দেবে। বিজয় লতার কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো। হাসি থামিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-আরে কেউ কিচ্ছু বলবে না ডার্লিং। আমি আছি তো সাথে। চলো আজ পেট ভরে ভালো ভালো খাবার খাবো আমরা।
লতার ছোট্ট হাতটা আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলেছে পার্কের রাস্তা ধরে দুজন। পার্কের আশেপাশের মানুষ গুলোর তাকানোর ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে। তারা অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখছে যা আগে কখনো দেখেনি।
একটু চিন্তিত হয়ে গেলো বিজয়। আজ ভালোপরিবারে জন্ম নেওয়া লতার বয়সী কোন মেয়ের কত্ত রকমের বায়না। বিছানা জুড়ে বড় বড় দুইটা টেডি বেয়ার লাগবে। গান গাইতে গাইতে নাচবে এমন এক পুতুল লাগবে। একটা আই প্যাড লাগবে সেখানে ভালো ভালো গেইম আছে। প্রত্যেক সপ্তাহে নতুন নতুন ড্রেজ। খাবার নিয়ে কত রকমের বায়না। এই খাবো না সেই খাবো। এখন ভাত খাবো না নুডলস খাবো। তো নুডলস হাজির। আর.. এই শিশুটার বায়না কেবল পেট পুরে খাবার?? লতা হয়তো রাতে অর্ধেক প্লেট ভাত পোড়া মরিচ কচলিয়ে পিয়াজ দিয়ে পেট পুরে খেয়ে মা এর বুকের ভেতর ঘুমিয়ে গিয়েছে। আর মা হয়তো ভুখাপেটে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আজ আমি হয়তো পেট পুরে কিছু ভালো খাবার খেতে দিবো। কিন্তু কাল??? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লতার দিকে করুণা মাখা দৃষ্টিতে তাকালো বিজয়। একটু আগেই এই হাত নীলার হাতের সাথে ছিলো। যার চাওয়া কিনা আকাশ ছোঁয়া। আর এখন? এখন যে হাতের সাথে হাত আছে তার চাওয়া কেবল মাত্র দুমুঠো খাবার?? পৃথিবী টা কত নিষ্ঠুর এই লতাদের জন্য এর মধ্যে লতা হাত টেনে বললো
-ভাইজান ভাইজান বিজয় লতার দিকে তাকালো। বিজয়ের চোখ দুটো ছলছল করছে। বললো
– কি হয়েছে লতা? লতা একটা ক্যাফের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো
– ভাইজান ওইখানে খেতে নিয়ে যাবা??
– আচ্ছা চলো…
ফ্রাইড রাইস উইথ চিকেন। সাথে স্যালাট। অর্ডার করলো বিজয়। খাবার এলো। বিজয় চামচ হাতে নিয়ে বসেরইল লতার দিকে ফিরে।
-লতা বসে আছো কেন? খাও?
– ভাইজান আমি হাত দিয়ে খাবো? চামচ দিয়ে খেতে পারিনা।
-তোমার যেভাবে খুশি খাও
এর পর লাচ্চি, আইসক্রিম, কোক সবই খাওয়া হলো। বিল মিটিয়ে দেখলো এখনো এক হাজার টাকা আছে। বিজয় এবার লতাকে নিয়ে একটা লোকাল শপিং দোকানে গিয়ে লতাকে সুন্দর একটা জামা কিনে দিয়ে বললো
– কই দেখি আমার ডার্লিং এর কেমন লাগে। বাহ একদম রাজকন্যার মত লাগছে। বলে মুখে আলতো করে চুমু দিলো বিজয়। লতা জামাটা পেয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলো। লতার খুশি দেখে বিজয়ের বুক একরাশ খুশিতে ভরে গেলো । লতা খুশিতে বিজয়কে কে জড়িয়ে ধরলো। বিজয় হাত বুলিয়ে দিলো লতার মাথায়। লতাকে না পেলে হয়ত নীলাকে নিয়ে ক্যাফেতে থাকত বিজয়। ধুয়াশার মত উড়ে যেত টাকা গুলা। বিনিময়ে হয়তো পেতো নীলার কৃত্রিম হাসি। তার বিনিময়ে নাহয় লতার প্রাণউজাড় করা খুশি পেলো। যতদিন জামাটা পরবে এই খুশি ওর মুখে এঁকে থাকবে। হয়ত একদিন মা এর সাথে ঘুরতে বের হবে কোন একদিন। আর মা-র আঁচল ধরে টেনে বলবে
– মা..মা…. এই জামা টা এক ভাইয়া দিয়েছিলো না? সেই দিন অনেক ভালো ভালো খাবার খেতে দিয়েছিলো মা। যা জীবনে কোন দিন খাইনি। হয়ত সেই ভাইয়ার নাম টা মনে থাকবে না। তাতে কি যায়-আসে। লতার মুখভরা হাসি আর হৃদয় ভরা তৃপ্ততা তো রয়ে যাবে অনেক দিন। এ এক অদ্ভুত ভালোলাগা!
সমাপ্ত