– তুই এমন কেনো বলতো? তোর কি এখনো আল্লাহ বিবেক বুদ্ধি দেয়নি? তোর মত নির্বোধ মানে ছ্যাছড়া আর দেখিনি। (আপু)
– আপু তুই এভাবে বলতে পারলি?
– তো কিভাবে বলবো তোকে? তুই কি জানিস না আমাদের বাড়ির অবস্থাটা? দেখিস না তুই বাবার অল্প পেনশনে কিভাবে সংসারটা চলছে? তুই কি বুঝিস না বড় ভাইয়ার ছোট্ট বেতনে আমার তোর পড়ার খরচ কিভাবে চলছে?
– আরে বাবা, মাত্র তো পাঁচশো টাকা চেয়েছি,,পাঁচ হাজার তো চাইনি?
যা দেয়া লাগবে না কারো,,সবাই খালি খোটা দেয়। রাগ করে চলে আসলাম বাড়ির বাইরে.. আজ জান্নাতের বার্থডে কিন্তু দেয়ার মত কিছুই নেই আমার। আবার কদিন ধরেই খেয়াল করছি জান্নাত কেমন যেনো চেন্জ হয়ে যাচ্ছে। আগের মত আর কথাও বলে না।
– হেলো জান্নাত..
– হুম বলো নিলয়।
– কি করছো..?
– এই তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর পার্টিতে আছি।
– তাইলে ব্যস্ত
– বাই এখন..
এদানিং জান্নাত আমাকে আর সময় দেয় না। কেনো দেয় না? আমার কাছে কি টাকা থাকে না বলে? নামিদামী রেস্টুরেন্ট এ খাওয়াতে পারি না বলে? কিন্তু সেতো আগে এমন ছিলো না?
– কোথায় ছিলি নিলয়? (মা)
– এই তো বাইরে…
– তোর বাবার যে চশমাটা ভেঙে গেছে একটু দেখেছিস?
– কেনো? ভাইয়াকে বলো..ভাইতো এনে দেবে।
– সে কতদিকে দেবে তুই বল? তোর পড়ার খরচ তোর আপুর পড়ার খরচ আর কত?
– তা বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে কিনতে পারছে না চশমাটা?
– তাহলে সংসার খরচটা দে তুই। পড়াশোনা শেষের দিকে একটু তো কিছু করতে পারিস?
– ধুরর মা পড়া শেষ করতে ৪ বছরের বেশি লাগবে,,আর রোজ রোজ এমন ভালো লাগে না।
– নিলয়,,এত জোরে কেনো কথা বলিস তুই? (বাবা)
– তা কিভাবে বলবো? সারাজীবন কিছু দিছো তোমরা?
– নিলয় চুপ কর। (আপু)
– তোমরা চুপ করো…তোমরা তো খালি বড়ই হয়েছো। অনেক দায়িত্ব নিতে শিখেছো,,কখনও বলেছো কি লাগবে তোর?
কখনও কিছু সেধে এসে বলেছো নে এটা তোর জন্য? খালি বলেছো সংসার চলতেই শেষ। আরে এতই সমস্যা থাকলে মেরে কেনো ফেলছো না তোমরা?
– নিলয় তুই কিন্তু কোনো লজিক ছাড়াই ফালতু বকছিস।
– হ্যা আমি তো ফালতু বকি?? আর তোরা…
– ঠাসসসসস.. আর একটা কথা বললে তোকে…(বাবা)
প্রচন্ড রাগ নিয়ে চলে আসলাম রুমে। আর ভালো লাগেনা গরীবের মত বাঁচতে। কেনো আল্লাহ আমাকে গরীবের ঘরে দিছিলা? কাদতে কাদতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাত নটা নাগাদ..
– নিলয়.. এই নিলয়?
– আরে ভাইয়া তুমি?
– কি হয়েছে তোর? তুই নাকি রাগারাগি করেছিস?
– না মানে ভাইয়া..
– শোন রে ভাই,,ছেলেদের কাদতে হয় না। শক্ত হয়ে বাচতে হয়।
– আচ্ছা ভাইয়া.. গরীবদের কি কোনো চাওয়া পাওয়া নেই? আর ছোটরা খালি কি নিয়েই যায় সারাজীবন? তারা কি কিছুই দেয় না।
– ওরে পাগল গরীব হয়ে জন্মানোটা কোনো দোষের না,,দোষ হল হাত পা, শক্তি থাকা সত্বেও কিছু না করে গরীব হয়ে মরাটা দোষের।
কি লাগবে তোর বল..আমি দেবো। আমি তো আছিই। আর বাবা মার সামনে উচু গলায় কথা বলতে নেই।
কিছু লাগলে খালি আমাকে বলবি।
ঘরের দক্ষিনের জানালাটা খুলে বসে আছি। আসলেই কি ছোটরা কিছু দেয় না।
পরিবারে কি খালি বড় ছেলেরাই দিতে জানে খালি?
– নিলয়.. এই নে পাঁচশো টাকা। (আপু)
– কি ব্যাপার আপু তুমি টাকা দিচ্ছো কেনো?
– এমনি নে ধর, তুই না ছোট তোর লাগবে রে পাগল, নে ধর
টাকাটা টেবিলে রেখেই আপু চলে গেলো। হায়রে ভালোবাসা। আমি তো জান্নাতকে ভালোবাসি। কিন্তু সেতো বুঝলো না আমাকেই। আসলে ভালোবাসা বলতে অন্য কারো ভালোবাসা বোঝায় না। ভালোবাসা হল পরিবারের ভালোবাসা। যেখানে শত কষ্টের মাঝেও সুখ খোজার যে প্রবনতা বজায় রেখে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করাকে বোঝায়।
হমম আমি তো ছোট, আমি তো কিছুই বুঝি না। বড়রা সবাই দিতেই শিখেছে। কোনোদিন জানতে চাইনি ছোটরাও সেক্রেফাইস করতে পারে।
রাতে না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। সকালে একটা টিউশনি আছে সেটাতে ঠিক সময়ে যেতে হবে। টিউশনি করি এটা বাড়ির কেউ জানে না। একটা নয় তিনটা করি।
বাসায় এসে দেখলাম বাবা পত্রিকা পড়ছে চোখের খুব কাছে ধরে। হয়ত চশমা কেনার টাকাটা দিয়ে বাজার করেছে।
আপুকে দেখলাম জানালার পাশে মুখ গুজে বই পড়ছে। তার ইচ্ছে আছে একটা চাকরি করার।
সবাই পরিবারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে আর আমি কিছুই করিনা। অপদার্থ একটা আমি।
আজ জান্নাত আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। নাহ যায় নি,,আমি দেখলাম একটা ছেলের বাইকের পিছনে বসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব হাসি লাগছিলো নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে। হায়রে ভাগ্য…
– নিলয় তোর ভাইয়াকে ফোন দিয়ে বল। তোর বাবার বুকের ব্যাথার ঔষধটা আনতে।
– ঠিক আছে মা। আমি টাকা ভরে বলছি।
বাড়িতে আসলাম ৮ টার সময়। ভাইয়া এখোনো বাসায় আসেনি। নটার সময় আসবে। পার্ট টাইম কাজ।
– এই নাও বাবা তোমার ঔষধ আর চশমা।
– তুই এনেছিস?
– আরে না,,ভাইয়াকে বলেছিলাম। তো তাই ভাইয়া আমার কাছে এগুলো কিনে দিয়ে গেলো। মাসে রাস্তায় দেখা হয়েছিলো আর কি।
– ওও,,তুই তো আর পারবি না। হয়েছিস তো একটা অপদার্থ।
– হুমমম বাবা আমি তো অপদার্থই (মনে মনে)
চলে আসছিলাম নিজের ঘরে। আপুর ঘরে চোখ পড়তেই দেখলাম মোমবাতি জ্বালিয়ে নামাজ পড়ছে।
নামাজের শেষে আপর কাছে গেলাম।
– আপু…
– নিলয়.. তুই এসেছিস?
– আপু কাদছিলে কেনো?
– শুনতে হবে না।
– বলোনা আপু
– কাউকে বলবি না তো?
– নাহ… বাবার না কিডনিতে সমস্যা হয়েছে।
– কিহহ… কিন্তু বাবার তো বুকে ব্যাথা।
– হুমম আমার কি মনে হয় জানিস? বাবা রিপোর্ট করতে গেছিলো বুকের। কিন্তু কিডনিতেও সমস্যা হয়েছে রে। এই দেখ রিপোর্ট।
– কিন্তু তুমি পেলে কি করে?
– আজ কলেজ যাওয়ার সময় ডাক্তার কাকুর সাথে দেখা হয়েছিলো। উনি এ দিকেই আসছিলো। তাই আমাকে এইটা দিয়ে বলেছিলো যেনো বাবাকে এইটা দিয়ে দিই।
– কাদিস না আপু,,,
– যা তুই ঘরে যা। কাউকে বলিস না যেনো।
ভাগ্য আমাদের নিয়ে খুব খেলা করে। কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে ভয় থাকে বেশিই। ভাগ্যটাকে কি নিজে গড়তে হয়? কিভাবে? যদি নিজে চলার মতই যদি কিছু না থাকে তাহলে কিভাবে ভাগ্য গড়তে হই? হাসি পেলো কথাটি মনে পড়তেই। ফিরে আসার সময় দেখলাম আপুর বোরখার নিচে খানিকটা ছিড়ে গেছে। খুব খারাপ লাগছিলো দেখে। কিন্তু পরের দিন বিকালে..
– আপু এটা তোর জন্য…
– কি আছে রে এটাতে?
– খুলেই দেখ..
– বোরখা….? কোথায় পেয়েছিস?
– আরে আমি কোথায় পাবো? ভাইয়াকে বলেছিলাম কিছু টাকা লাগবে। তাই দিয়ে কিনেছি আরকি।
– ওহহ ভাইয়াই দিছে। তুই তো আর পারবি না। অপদার্থ একটা।
হাসি মুখে চলে আসলাম নিজের রুমে। আসলেই কি আমি অপদার্থ? রাস্তার একপাশে বসে আছি আমি। নিজের শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। দুইদিন ধরে খুব জ্বর জ্বর লাগছে। এমন সময় ভাইয়ার ফোন আসলো..
– কোথায় তুই?
– কেনো ভাইয়া?
– বাবাকে নিয়ে সিটি হসপিটালে যাচ্ছি তুই তাড়াতাড়ি আই।
কিছুই ভালো লাগছে না। চারিদিকটা কেমন যেনো সব শুন্য শুন্য লাগছে। কি হবে আমার বাবার? ভালো লাগছে না কিছুই।
– কি হয়েছে আম্মু আব্বুর?
– নিলয় তোর বাবার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিছে অপারেশন করতে হবে।
– তো করো,
– ডাক্তার বলেছে এক লাখ টাকা লাগবে। (আপু)
– ওহহ আচ্ছা চিনতা করো না দেখি কি করা যায়। ভাইয়া কোথায়?
– ভাইয়া গেছে টাকার ব্যাবস্থা করতে রে।
– আচ্ছা থাকো আমিও দেখি পারি কিনা কোনো ব্যাবস্থা করতে।
বাইরে বের হয়ে চলে আসলাম। একাকি হেটে চলেছি রাস্তায়.. কিছুদুর যেতেই খেয়াল করলাম জান্নাত আজ অন্য একটি ছেলের সাথে ঘুরছে। হায়রে ভালোবাসা। ভালোবাসা বলে কিছুই নেই। টাকায় সব। যার কাছে টাকা আছে তার কাছে ভালোবাসা কেনো। সমস্থ কিছুই তার দখলে থাকবে। হসপিটালে আর আমি ফিরে যায়নি। বাড়িতে এসেই শুয়ে পড়েছি।
– আপু তুমি বাড়িতে? বাবা কেমন আছে?
– সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। বাবার অপারেশনের সব টাকা ভাইয়া যেখানে কাজ করে সেখানকার মালিক এসে দিয়ে গেলো।
– ওহহ
– হুমমম ভাইয়া না থাকলে যে কি হত?
– কি আর হত মরে যেতাম আমরা।
– চুপ অপদার্থ একটা। দুই দিন পর বাবা বাসায় এখন উনি খুব সুস্থ। বাবা এখন টোটালি ফিট।
– নিলয়,,সারাদিন কোথায় থাকিস?
– কেনো বাবা?
– তোর কোনো দায়িত্ব নেই। দেখছিস আমার বড় ছেলে কতটা কষ্ট করে। আর তুই বসে বসে খালি গিলিস। লজ্বা করে না তোর?
– হুমম তোমার বড় ছেলেই তো সব। এর থেকে আর কি আছে? মেরে ফেলোনা বাবা আমাকে?
– ঠাসসসস যখন ঙ্গান ফিরলো তাকিয়ে দেখি আমি হসপিটালে। আরে সবাই আমার দিকে এভাবে কেনো তাকিয়ে আছে?
– তোকে কি করতে মন চাচ্ছে জানিস? (আপু)
– কেনো আমি তো এইবার কোনো অপদার্থমি করিনি। আমি তো ঙ্গান হারিয়েছিলাম বাবার থাপ্পড় খেয়ে।
– ঐ চুপ,,খুব নায়ক হয়ে গেছিস? ( ভাইয়া)
– আরে কি বলছো এসব? তুমিই আছো না? একটু ঘুরে তাকাতেই দেখি বাবার হাতে একটা সাদা কাগজ।
– বেয়াদপ ছেলে কোথাকার।(আম্মু)
– আচ্ছা কি হয়েছে একটু বলবা তো?
– ন্যাকামিটাও শিখে গেছিস। তোর কিডনি কোথায়?
– মানে?? হাসালে আপু কিডনি থাকে তো পেটে।
– আরেকটা কোথায়?
– মানে??
– ঠাসসস..(ভাইয়া)
তোর কিডনি বিক্রির টাকায় বাবার অপারেশন হয়েছে। ন্যাকামী করিস? আমার বস সব কিছু আজ বলেছে। পাঁচদিন আগে তুই কিডনি বিক্রি করেছিস। আর সেই টাকা তুই আমার বসের কাছে দিয়ে এসে বলেছিস বাবার অপারেশনটা যেনো হয়। তাও আবার আমার নামটাও বলে এসেছিস। যাতে কেউ বুঝতে না পারে।
– আর খুব মিথ্যে বলা শিখেছিস। বোনখা কি ভাইয়া দিছে? (আপা)
– তোর বাবার ঔষধ কে কিনো দিছিলো। চশমাটা কে কিনে দিছিলো?
– কিন্তু তোমরা সব জানলে কি করে?
– তুই যে টিউশনি করাস সেখান থেকে কেউ এসে বলেছিলো তুই দুইদিন নাকি পড়াতে যাস না।
শরীর দূর্বল থাকাতে বাবার চড় খেয়ে অঙ্গান হয়ে গেছিলাম। তবে এখন সুস্থ আছি। কিন্তু এ কদিনে বাবা আমার সামনে কেনো আসলো না। আমি আবার কি করলাম। আজ বাবার সাথে দেখা করতেই হবে। বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে বাবা..
– বাবা..
– হুমম
– বাবা….?
– ঠাসসস..
– কেনো মারলে??
– তুই যে একটা আসলেই অপদার্থ সেটা কি জানিস?
– কেনো বাবা কোনো কথা না বলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বাবা কাদছে। আমিও কাদছি।
– ছোট ছেলেও পারে রে।
কেদেই চলেছি…সবাই দরজার কাছে এসে দেখছে আর চোখের পানি ফেলছে। রাত ১০ টা,,,আজো হেটে চলেছি খোলা রাস্তায়। তবে আজ উদ্দেশ্য কোনো অজানাতে না। হেটে চলেছি মনের সুখে। আজ চিৎকার করে বললাম বাবা আমার জমানো টাকা দিয়ে আপুর বোরখা কিনে দিয়েছি। আপুর দেয়া পাচশো টাকাটা আজো পড়ে আছে ছেড়া শার্টের পকেটে। নিরবে বলেই উঠলাম ” ভালোবাসা তো এখানেই, পরিরবারে যতই দুঃখ থাকুক না কেনো। সবাই কখনই আপনার সঙ্গ ছাড়বে না। আকড়ে ধরে রাখবে অপানার ভালোবাসার বন্ধনে।
(সমাপ্ত)