আমাকে শুধু মা’র জন্যই শক্ত হতে হবে অনেক শক্ত হতে হবে। নিজের কথা ভুলে উনার জন্য কিছুতো একটা করতেই হবে আমায় যতক্ষণ আমার নিঃশ্বাস আছে অন্তত ততক্ষণ চেষ্টা করে যেতে হবে।যখন আমি শারিরিক, মানসিক, পারিবারিক আর সামাজিক সব যন্ত্রণায় প্রায় আধমরা হতে বসেছিলাম তখন একমাত্র আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দেবার জন্য শুধু তিনিই ছিলেন।যখন আমি মুখ গুঁজে দিন-রাত,ঘড়ি-ঘন্
টা কোন কিছু না ভেবে কাঁদতাম তখন আমাকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আমার সাথে সাথে নীরবে কেঁদে যেতেন।যে দিনগুলোতে আমি পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম আমায় একটু একটু করে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো আমার মা।
হ্যাঁ আমার একমাত্র মা না হলেও মায়ের সম্পূর্ণ মর্যাদা আমি উনাকে দিয়েছি আর উনিও আমায় দিয়েছে একজন সন্তানের প্রাপ্য জায়গা।আমি বলবো না উনি আমাকে মেয়ে কিংবা ছেলের নজর অনুযায়ী অধিকার দিয়েছেন।একজন মানুষ আর উনার সন্তান হিসেবেই উনি আমায় মানুষ করেছেন।যখন নিজের মা না না ভুল বললাম হয়তো। কারণ মা’রা কখনো এমন হয়না।যখন উনি আমায় কোন এক ময়লার স্তূপের( ডাস্টবিনের) পাশে মরার জন্য ফেলে রেখে গিয়েছিলো তখন মা হুম আমার মা আমায় তুলে নিয়েছিলো পরম মমতায় তার কোলে।সেই থেকে শুরু আমার জীবনের নতুন অধ্যায় আর হয়তো মায়েরও।
আমাকে কোলে তুলে নেয়ায় মায়ের অনেক কথা শুনতে হয়েছিলো। চাইলেই উনি আমায় মরার জন্য ছেড়ে যেতে পারতেন কিংবা খুব হলে কোন অনাথাশ্রম বা এতিমখানায় দিয়ে দায় সারতে পারতেন।কিন্তু হয়তো উনি একটু বেশিই দয়ালু ছিলেন অথবা আমার প্রতি প্রথম দেখায় উনার মায়াটা বড্ড বেশি পড়ে হয়েছিলো। তাই উনি নিজের স্বামীর,শ্বশুরবাড়ির,এমনকি ভাইদেরও হাজারো নিষেধ আর কথা শুনেও আমায় জড়িয়ে নিয়েছিলেন বুকে সারাজীবনের মতন।তার দু’বছরের ছেলের চেয়েও হয়তো আমাকেই বেশি সময় আগলে রাখতেন কোলে।
সময় গড়াতে থাকলো বুঝতে শিখলাম আমিও।আমাকে চারপাশ থেকে প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয়া হতো এটা আমার বাড়ি নয়।এটা আমার মা নয়।এখানে আমার অধিকার নেই।এ বাড়ি আমার না।কিন্তু পরম স্নেহে আমায় বুঝিয়ে দিতেন তিনি এসবে কান না দিতে।উনি সবসময় আছেন আমার পাশে।আসলেই উনি ছিলেন সব সময়েই আমার খুব কাছে।উনাকে মা তো বলেছিলাম কিন্তু উনার স্বামী কে কখনো বাবা ভাবতে পারিনি।হয়তো উনিও আমায় মেয়ে ভাবেননি শুধু স্ত্রী কথায় আশ্রয় দিয়েছেন মাত্র।এমন অনেক দিন গিয়েছে আমায় নিয়ে ঝগড়া বেধেছে আর মা’র গায়ে হাত তোলা হয়েছে।শোনানো হয়েছে অকথ্য ভাষায় শত কথা।আস্তে আস্তে যখন বড় হতে শিখলাম মায়ের কষ্টটা বুঝতে শিখলাম। মুখ লুকিয়ে আড়ালে নিজেও কাঁদতে লাগলাম।
কোন রকন পড়াশোনা শেখানো হলো আমায় তাও মায়ের জোরে।এখন নাকি বিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতন আপদ বিদেয় করতে পারলেই বেঁচে যায় সবাই।মা’র ছেলেকে আমি ভাই মেনেছিলাম মন থেকে কিন্তু হয়তো বাবা আর পরিবারে অন্যদের মতন সে আমাকে কখনো বোন ভাবতে পারেনি।তার ফলই ভোগ করেছিলাম আমি সে রাতে।সেদিন মা বাড়ি ছিলোনা।উনার স্বামীর কোন আত্মীয়ের মৃত্যুতে অন্য গ্রামে গিয়েছিলেন।সেদিনই সুযোগ বুঝে আমার মায়ের ছেলে যাকে কিনা আমি ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিলাম সে খুব যত্ন করে আমার জীবন শেষ করে দিলো এক রাতেই।বোনের ইজ্জত লুটে নিলো এক ভাই।ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিয়ে মুখ চেপে ধরে শক্তি খাটিয়ে ভোগ করে নিলো আমার শরীর।পাশবিক সে নির্যাতনে এক রকম বাকশূন্যই হয়ে গেলাম আমি।নিজের চোখের পানি সেদিন আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যহীন লেগেছিলো।দানবটা আমায় শাসিয়ে গিয়েছিলো যেন এ কথা কাউকে না বলি বিশেষ করে মা’কে।কিন্তু মা পরের দিন আমার মুখ দেখেই বুঝেছিলো কিছু একটা ঘটেছে।
কিন্তু আমি বলতে চাইনি।কারণ আমি চাইনি তিনি জানুক তার দেয়া শিক্ষা ভুলে তার ছেলে কতটা জানোয়ার হয়ে গিয়েছে।এ কথা শুনে মা হয়তো ঠিক থাকতে পারতোনা।উনাকে শুনতে হতো আরো অনেক কথা হয়তো মার ও খেতে হতো।কিন্তু যখন দেখলাম জানোয়ারটা আবারো সুযোগ খুঁজছে আর মা অনবরত আমায় জিজ্ঞেস করেই চলছে তখন বাধ্য হলাম মুখ খুলতে। জানোয়ারটা নাকি আরো কিছু মেয়ের সাথেও এমন করেছে।আমি চাইনি আর কোন মেয়ের জীবনে এমন কালো অধ্যায় নেমে আসুক।মা শোনার পর যেন আমার চেয়েও বেশি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।কিন্তু তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে বাড়ির সবার সামনে নিয়ে নিজের ছেলেকে চড় মারলেন।বিলাপ করতে লাগলেন কেঁদে কেঁদে। মাকে ওমন অবস্থায় দেখে আমি নিজেও কাঁদতে লাগলাম।অন্যরা সবাই জানোয়ারটার মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে উল্টো আমাকে চরিত্রহীনা বলে গেলো।মা জানোয়ারটাকে জেলে দেয়ার সাহস পর্যন্ত দেখিয়ে ফেললেন। উনার স্বামী সে রাতে মাকে মেরে নাক মুখ দিয়ে রক্ত উঠিয়ে দিলেন।উনি আমার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
পুলিশের কাছে সবটা জানালো। কিন্তু আমি আর উনি দুজনেই জানি কোন লাভ হবেনা।এমন গ্রামীণ পরিবেশে ক্ষমতাবানরাই জিতে যায়।এখানে সত্যের আড়ালে টাকা নিয়ে মিথ্যা কেনা হয়।ঠিক গ্রাম নয় অনেকটা ছোটখাটো মফস্বল বলা চলে জায়গাটাকে।কিন্তু এখনকার জীবনধারা এখনো আদিম গ্রামীণ সমাজের।মা নিজের জেদে অটল রইলো আমি বেশ কয়েকবার বললাম বাড়ি ফিরে যেতে। অবাক চোখে প্রশ্ন করলো তোকে ফেলে আমি বাড়ি ফিরবো বলে তোর মনে হয়?
আমি নিরুত্তর রয়ে গেলাম।কারণ আমি জানি মা আমায় ছাড়া যাবেন না আর আমাকে ও বাড়িতে কেউ উঠতে দিবেনা।অগত্যা বাধ্য হয়ে মা ভাবনা শুরু করলেন কোথায় যাওয়া যায়।মার এক খালাতো বোন শহরে থাকেন। শুনেছি তিনি বিধবা আর সন্তানহারাও।মাকে খুব আদর করতেন নাকি ছোটোবেলায়। একমাত্র সেখানে যাওয়া ছাড়া আর কোন যাওয়ার রাস্তা নেই আমাদের কাছে।ভাগ্য ভাল বিধায় পুরোনো সেই বাড়তেই তার দেখা মিললো। দু বোন গলা ধরে অনেক কান্নাকাটিও করলো। মা আমার কথা সব খুলে বললো সাথে এখানে আসার কারণও বলে দিলো।খালা আমাদের আশ্বাস দিলো।মাথা গুঁজার ঠাঁই দিলো।মা নিজে কুটির শিল্পের কাজ পারতো খালা কে বলে কোন ব্যবস্থা করে দিতে বললেন।খালা কপট রাগ দেখালো তিনি কি পর নাকি আর একলা সংসারে দু’জন মানুষকে খাওয়ানো পরানোর সামর্থ্য তার এখনো আছে বলতে লাগলেন।মা বললেন, অনেক তো হলো আপা এবার নিজে কিছু করতে চাই।মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই।তোমার ঘাড়ে মেয়েকে নিয়ে বোঝা হতে চাইনা।মা আমাকে আবার পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।আর সেখানেই হয়তো তখন থেকে শুরু হলো আমাদের জীবনের নতুন আরেক অধ্যায়।
নতুন করে শুরু করলাম আমরা।কারণ তিনি চাননা তার মেয়ে তার মত বন্দী পুতুলের মতন জীবন বেছে নিক।যে পুতুল চাইলেই কথা বলতে পারেনা।শুধু অন্যের হাতের খেলনা হয়ে রয়ে যায়।মা চান তার মেয়ে নিজের যোগ্যতায় ঘুনে ধরা সমাজে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে মর্যাদার সাথে বাঁচতে শিখুক।যেখানটায় তার জীবনের অধিকার শুধুই তার থাকবে অন্য কেউ জোর করতে পারবেনা। যেমনটা মায়ের সাথে হতো।এতটা বছর একরাশ অবহেলা আর অবজ্ঞাতেই কাটাতে হলো তবুও একটুখানি সন্মান মিললো না।হ্যাঁ অনেকটা গল্পের মত শোনালেও আমার মা পেরেছিলো সেইই গল্পটা বাস্তবে রূপান্তর করতে।
মা ঘুমুচ্ছে আরামে।কতদিন এমন ঘুম হয়নি কে জানে!ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখখানা দেখে বীণার চোখে জল এসে গেলো।এই মানুষটি তার জন্য কি কি না করলো এমনকি নিজের জীবনটাই শেষ করে দিলো।পরিবার স্বামী সন্তান সব ত্যাগ করলো শুধুমাত্র সত্যের পথে চলবে বলে।জানিনা মা কতটা কষ্ট পায় ভিতরে ভিতরে তার অতীত জীবন নিয়ে। কিন্তু আমি ওয়াদা করেছি নিজের কাছে এবার মার মুখে হাসি ফোঁটানোর দায়িত্ব আমার শুধুই আমার।চোখ মুছে বীণা মার পাশে গিয়ে মার গলা জড়িয়ে ধরলো। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বে।একটু পরেই সকাল হবে আর সেই সকালের আলোটার মতই ঝলমলে করতে চায় বীণা ওর মার জীবন। একটুকরো সুখের পরশে।বীণাকে পারতেই হবে।শুধুমাত্র মা’র জন্য সব দুঃখ জয় করতেই হবে।যেমনটা মা করেছিলো এখনো করছে এবার শুধু বীণার পালা।মা’র কষ্টের বোঝাটা হালকা করা। মা’র মুখে প্রাণবন্ত মিষ্টি একটা চিরস্থায়ী হাসির সন্ধান করা।এইতো জীবনের অটুট উদ্দেশ্য।এতেই বীণার মনের প্রশান্তি নিহিত।