সকাল ৮টায় ঘুম ভাঙিয়ে মিমি যখন বলল,
“তারাতারি উঠ শুভ্র৷ কাজ আছে”
খুব একটা বড় ঝামেলা না হলে এই মেয়েকে ছুটির দিনে ১০টার আগে ঘুম থেকে তোলা অসম্ভব৷ যেদিন ক্লাস থাকে, সেদিনও আমার ২০-২৫খানেক কল দিয়ে তাকে ডেকে তোলা লাগে৷
এমনও অনেক দিন গিয়েছে,
আমি নিজ হাতে নুডলস খাইয়ে দিচ্ছি আর মেয়েটা খরগোশ আঁচড়ানো নিয়ে ব্যস্ত৷
ফোন পেয়ে ঘন্টাখানেক পর মিমির বাসায় গিয়ে যখন পৌঁছালাম৷ মেয়েটা তখন চিন্তিত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷
আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই মুখটা কালো করে বলল,
-আমার “ছোটন” এর ঠান্ডা লেগেছে৷”
-আমাকে তোর পশুর ডাক্তার মনে হয়? ছুটির দিনের ঘুমটা নষ্ট করে, ঐ খোরগোশ ব্যাটার ঠান্ডা লেগেছে সেটা শুনবো আমি!”
-তুই এমন ভাবে কথা বললি কেন আমার সাথে? কেঁদে দিবো একদম৷ তারপর যে নাকের পানিগুলো বেরোবে৷ সেগুলো তোর এই টি-শার্টে মুছবো৷ আমার রান্না করা বিরিয়ানীগুলোতেও মিশিয়ে দিবো৷ নোনতা স্বাদ হবে৷ দারুণ হবে না বল?”
আমি আর কিছু বললাম না৷ আমি যতবারই মেয়েটার উদ্ভট সব কাজে রেগে যাই৷ ততবারই ন্যাকামো মাখিয়ে হুমকি দিবে আমাকে৷
গোলগাল চেহারার তুলতুলে গালের মেয়েটার উপর আমি রাগ ধরে রাখতে পারিনা কখনো৷ঠিকই আমার রাগটা গায়েব করে দিবে স্বভাব সূলভ ন্যাকামো দিয়ে৷”
মিনিট খানেক পরই একহাতে খরগোশ আর আরেকহাতে আমার হাত ধরে বেরিয়ে পরে৷ খরগোশের জন্য গেণ্জি কিনবে৷ আমি যেতে চাচ্ছি লাম না৷
বিরিয়ানীর লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ আমি যখনই তার কোনো কাজে না করেছি৷
তখনই তার নিজের হাতে বানানো বিরিয়ানীর লোভ দেখিয়ে কাজটা হাসিল করিয়ে নিয়েছে৷ হাজারটা ন্যাকামো করলেও বিরিয়ানী ভালো রাঁধতে পারে৷
মায়া মায়া চেহারার মেয়েটার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল কলেজ মাঠের আমলকী গাছের নিচটাতে৷
এমন অদ্ভূত অভ্যাসওয়ালা মানুষ আমি কখনোই দেখিনি৷ যেখানে অষ্টাদশী একটা মেয়ের সাজগোজ, পড়ালেখা আর সাংসারিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা৷ সেখানে এই মেয়েটা কিনা খরগোশ ছানা নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকে৷
কাঁধে কলেজ ব্যাগ আর হাতে খরগোশ ছানা নিয়ে ক্লাসে আসতো মেয়েটা৷ আমার সাথে চোখাচোখি হতো মাঝেমাঝে৷
আমি চোখ মুখ কুঁচকে তাকাতাম ওর দিকে৷
সেদিনও আমি কলেজ গেইট দিয়ে ঢুকতেই এই অদ্ভূত অভ্যাসের মেয়েটার অদ্ভূত কান্ডটা চোখে লেগে গিয়েছিল৷ গাছ থেকে ঝড়ে পরা আমলকীগুলো থেঁতলে খাওয়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল মেয়েটা৷ কিন্তু খরগোশ ব্যাটা কিছুতেই খাবে না৷
অদ্ভূত কর্মকান্ডখানা দেখতে দেখতে একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি৷
আমাকে দেখামাত্রই ম্মিত হেসে বলেছিল,
-দেখলেন তো আমার ছোটন কিছুতে খেতে চাচ্ছেনা৷ ভিটামিনের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে দিনদিন৷”
আমি আর হাসিটি চেপে রাখতে পারিনি৷ হো হো করে হেসে ফেলেছিলাম৷
আমার হাসিতে মেয়েটা রেগে গিয়েছিল৷ হাতে থেতলানো আমলকিটা আমার সাদা শার্টে ঘষে হনহন করে প্রস্থান নিয়েছিল৷
ঠিক তারপরের দিনই লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে আমার সামনে এসে বলেছিল,
“আসলে আমার না খুব রাগ হয়েছে৷ তাই আপনার শার্টটা নষ্ট করে দিয়েছি৷”
কথার প্রতুত্তরে আমি কিছু বলিনি৷ মিমির হাতের খরগোশটার মাথায় হাত বুলিয়ে যখন বললাম,
-খরগোশটা সুন্দর৷”
মেয়েটা হেসে বলল,
-খরগোশ বলবেন না৷ ওর নাম ছোটন৷ আপনিও ছোটন বলে ডাকবেন৷ ঠিক আছে?”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিই৷
এরপর থেকেই শুরু৷ যখনই যেখানে গিয়েছি সবখানেই সেই ছোটন সাথে৷ ফুচকার প্লেট থেকেও ছোটন কে ফুচকা খাওয়ানোর অসাধ্য সাধন করার চেষ্টাও করবে৷
চটপটি খেলে ওটাতেও ছোটনকে খাওয়ানোর ইচ্ছা তার৷
আইসক্রিমের বেলায় একটু আধটু সফল হয় মাঝেমধ্যে৷ এতেই তার বিশ্বজয়৷
মিমির হাতের রান্না করা বিরিয়ানী খাওয়ার সময় এই ছোটনকে নিয়ে আমার সামনে বসে থাকতো৷ খাওয়া শেষে আমি যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম৷ মিমি তখন নাক মুখ ফুলিয়ে বলতো,
-তুই এমন ক্যান? এই যে বিরিয়ানীটা গিলে ফেললি৷ আমি তোর সামনে বসে আছি৷ আমাকে এক লোকমা নাইবা দিলি৷ আমার ছোটন কে তো দিতে পারতিস৷”
আমি যখন বলতাম,
-খরগোশরা এসব খায় না মেয়ে৷”
মেয়েটা তখন দ্বিগুণ রেগে বলতো,
-তোকে বলেছিনা “খরগোশ” বলে না ডাকতে৷ তুই এখনই ধুর হ বাসা থেকে৷”
ঘোর বর্ষার এক সকালে উদাস হয়ে আমাকে বলেছিল,
-শুভ্র আমার পায়ে নুপুর পরিয়ে দিবি তুই? ঝুম বৃষ্টি হবে৷ আর সেই বৃষ্টিতে আমি তোর দেয়া নূপূর পরে ভিজবো৷”
এই খরগোশ পাগলি মেয়েটার কথায় আমি অবাক না হয়ে পারিনি৷ মিনিট খানেক তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে৷ আমার উত্তর না পেয়ে আবার বলেছিল,
-দিবিতো?
-হু দিবো৷”
পায়ে নূপুর পরে আমার হাত ধরে বৃষ্টিবিলাস করেছিল ঠিকই৷ কিন্তু তারপরের সর্দিতে নাক মুখ লাল করে ফেলেছিল৷
আমার রুমালটা দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলেছিল,
-শুভ্র আমি কি ভাবছি জানিস?
-হ্যা জানি৷
-বলতো?
-ছোটনের কথা ভাবছিস তুই৷”
আমার উত্তর শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল,
-ছোটনকে হিংসে করিস তাই না তুই?
-কেন হিংসে করবো শুনি?
-এই যে তোর ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে৷”
-কে বলেছে এই কথা?”
মেয়েটা আবারো হাসে৷ রহস্যময়ী হাসি৷
আমার কানের কাছে মুখটা নিয়ে বলেছিল,
-সেদিন কফি বানাতে আমি যখন নিচে নেমেছিলাম৷ তুই ছোটন গলা টিপে ধরে কি বলেছিলি আমি শুনেছি কিন্তু হু৷”
ধরা খেয়ে আমি আর কিছু বলতে পারিনি৷
এই খরগোশ ব্যাটার গলা টিপে আমি সেদিন বলেছিলাম “তুই ব্যাটা আমার মিমিকে আমার হতে দেস না”
খরগোশ না বুঝলেও তার মালকিন ঠিকই শুনে ফেলেছে৷
এরপর থেকে আজ পর্যন্ত জ্বালানোর মাত্রা বেড়ে চলেছে দিনদিন৷
খরগোশ ব্যাটার জন্য টি-শার্ট কিনতেই ঘন্টা তিনেক শেষ করে ফেলেছে৷ আদৌ এই খরগোশকে সেটা পরাতে পারবে বলে আমার মনে হচ্ছে না৷ যদিও চেষ্টার কমতি রাখবেনা৷
ফুচকা থেকে চটপটি, আইসক্রিম থেকে পায়েস৷ কিছু এই মেয়ে বাদ রাখেনি৷
আসার সময় যখন বলেছিলাম,
“এসো হে বৈশাখ” এর একটা গেন্জি কিনে ফেল৷ ছোটনকে মানাবে বেশ৷
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলেছিল,
শালা বদ! আমার ছোটনকে ব্রান্ডের টি-শার্ট পরাবো৷ দরকারে তোকে আমি “এসো হে বৈশাখ”পরাবো৷ তোর খুব শখ হয়েছে৷”
আমি আর কিছু বলিনি৷ বলতে গেলে ঠিকই সেই বৈশাখের গেন্জি পরাবে আমাকে৷
আমি পরতে চাইবোনা৷ কিন্তু সে নাকের পানির ভয় নয়তো বিরিয়ানী লোভ দেখিয়ে আমাকে পরিয়ে নিবে৷
খরগোশের কাপড় কিনে মেয়েটা বেশ খুশি৷ আমি কিছু না বলে তার পাশে হাঁটছি৷ সে এদিক সেদিক দেখছে৷ হাঁটার জোরটা একটু বাড়িয়ে দিলাম৷
আরৈকটু থাকলে হয়তো বলবে,
“এই শোন! ছোটন এর জন্য একটা প্যান্ট কিনি৷গেন্জি যেহেতু কিনেছি৷”
আমার মনে কুহু ডেকে উঠলো৷ এবার সোজা কোলে নিয়ে হাঁটা ধরেছি৷
শপিংয়ের বাইরে গেলেই নামিয়ে দিবো৷ তাও এই শপিংয়ে আর একমিনিটও নয়৷ এই মেয়ে সব করতে পারে ঐ খরগোশ ব্যাটার জন্য৷