ভালোবাসা

ভালোবাসা

খুব দ্রুত আমার চোখের সামনে দিয়ে ফ্লাশব্যাকে সময় সরে যেতে লাগলো।আমি ভাবতে থাকলাম,আমার সমস্ত শিক্ষা, সংস্কারকে এক নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিলো অমরের একটা কথা “বাবু,আমি যে রূপাকে ভালোবেসেছি “।
আমার কেবলই মনে হতে লাগলো,অমর আমাকে অবলীলায় হারিয়ে দিলো।আমি সময়ের সরণী বেয়ে চলে গেলাম আজ থেকে দু’বছর আগে।

আমার নাম,প্রনবেশ হাজরা।কিছুদিন আগে রুশার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে।রুশা সরকারি হাসপাতালের নার্স। ওর এই চাকরি নিয়ে আমার প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল।’মহিলা’ হয়ে রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে নাইট ডিউটি

করবে,এমন চাকরি আমার পছন্দ ছিলো না।আমি নিজে একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে ম্যানেজেরিয়াল পোষ্টে আছি।যথেষ্ট উপার্জন করি,কি প্রয়োজন রুশার চাকরী করার?

বিয়ের আগে ওকে এটা অনেকবার বুঝিয়েছি, কিন্তু ওর এক গোঁ পড়াশুনা করে,নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে,এটা নাকি ও ছাড়বে না।

রুশাকে আমি খুব ভালোবাসতাম,যে কোনোও মূল্যে ওকে পেতে চাইতাম আমি।বাড়ি থেকেও তাড়া ছিলো বিয়ে করার,তাই রুশার চাকরি নিয়ে আমি আর বেশি কিছু ভাবিনি।

বিয়ের পরে সবকিছু ভীষণ রঙিন ছিলো,সুন্দর ছিলো।রুশা আর আমি,কত একান্ত মূহুর্ত আমাদের কেটেছে আমার এই ঘরে,এই বিছানায়।

রুশা আমাকে ভালোবেসে প্রাণ বলতো।ওর গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট থেকে আমার এই আদরের নাম শুনতাম আমি।অদ্ভুত একটা শিহরণ জাগতো আমার।

আমি চাইতাম না,রুশার সৌন্দর্য আর কেউ দেখুক।রুশা হসপিটাল থেকে ফিরে আমার কাছে ওর বিভিন্ন ডাক্তারদের গল্প করতো।আমার অসহ্য লাগতো।এরপর,যত দিন যেতে লাগলো আমার শুধুই মনে হতে লাগলো,রুশা বুঝি ওর কোনও ডাক্তার কোলিগের সাথে প্রেম করছে,এত উচ্ছল হয়ে কথা বলা,এত সুন্দর করে সাজগোজ কিসের জন্য?

আমার সবকিছুতেই খুব রাগ হতো,ওর স্বকীয়তা আমি নিতে পারতাম না।আমি কোনো কোনোও দিন রাগ করে ওর সাথে কথা বলতাম না।

ধীরে ধীরে অশান্তি হতে লাগলো।রুশা পেছনে আমি রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছিলাম।ও কাঁদতো, আমার কি জানি কেন তখন ভীষণ ভালো লাগতো।ওকে কষ্টের মধ্যে দেখে আমার একরকম পৈশাচিক আনন্দ হতো।

এরপর একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলাম রুশা ফেরেনি,ওকে ফোন করে জানতে পারলাম,আমার সাথে ও আর থাকবে না।আমার বাড়িতে সবাই ওকে অনেক করে বুঝিয়েছিল।আমি ওকে কতখানি ভলোবাসি তা অনেক বার অনেকভাবে বুঝিয়েছি।নিজের কাছে বার বার জিজ্ঞাসা করেছি যে, কি এমন করেছি? ওর যাতে ভাল হয় সেটাই তো করতে চেয়েছি,কিন্তু ও আমাকে কেন বুঝছে না সেটা ভেবে কষ্ট পেতাম।

এরমধ্যে একদিন অমরের সঙ্গে আলাপ।আমার অফিসের গাড়ীর ড্রাইভার। প্রথম দিন থেকেই স্বল্পবাক্ অমরকে আমার ভালো লাগতো।ড্রাইভার শ্রেণীর মানুষদের অযথা কৌতূহল আমি একদমই পছন্দ করি না।

অমর একটু হলেও অন্যরকম ছিল।ওই সময় থেকে আমি খুব অন্যমনস্ক থাকতাম,চিন্তার জাল কেটে মাঝে মাঝে অমরের টুকটাক কথা কানে আসতো। একদিন শুনলাম,ও ফোনে কারোর কাছে কাকুতি মিনতি করছে “প্লিজ, একটু আমার কথা শোনো,এমন কোরো না”।

শীতের বিকেল থেকে সময় গড়িয়ে যেমন রাত নামতে থাকে সাথে নিয়ে আসে একবুক বিষন্নতা, ঠিক তেমন করে আমারও সমস্ত মন ধীরে ধীরে রুশার স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল।

রুশার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল যেদিন,সেদিন ও আমাকে বলেছিল,আমি নাকি ওকে বুঝতেই পারিনি,এইকথাটা শুনে আমি ভাবছিলাম,ওকে না বোঝার কি আছে? অফিসের মেল কলিগদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করবে আর আমাকে সবটা মানতে হবে?আমিও তো অফিসে একটু আধটু কাজের ফাঁকে রনিতার সাথে আড্ডা দিই,আমার ভালোই লাগে।কিন্তু রনিতার ওপর আমার মাঝে মাঝে রাগ হয়,অফিসে আমার সাথে গল্প করছে মানে সকলের সাথেই ও এরকম আজে বাজে করে বেড়ায়।

এরই মধ্যে একদিন অমর আমাকে ফোনে জানালো ও কিছুদিন ডিউটিতে আসতে পারবে না।
আগেই বলেছি ড্রাইভার শ্রেণীর মানুষদের অতিরিক্ত কৌতূহল আমি পছন্দ করি না,আবার আমি নিজেও ওদেরকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করি না।

আমার নিজের মনও খুব ভালো ছিলো না।রুশার সঙ্গে আমার মিউচুয়াল ডিভোর্স হতে চলেছিল।আসলে সম্পর্কগুলো অনেকটা বরফের মতো হয়,জল জমে বরফ হলে তা আয়তনে বাড়ে,সম্পর্কও তেমন সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।অনেক সময়েই দেখা যায়,অচেনা দিয়ে পরিচয়ের পর খুব চেনা সম্পর্কে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার উল্টোটাও সমান ভাবে সত্যি।

এখন ভাবি,রুশাকে বুঝি আমি কোনও এমন কিছু দিয়ে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম যা কখনও আমার ছিলই না।
কিছুদিন পর অমর আবার কাজে যোগ দিলো।ওর চেহারা খুব বিদ্ধস্ত, দেখেই মনে হচ্ছিল কিছু একটার সাথে মনে মনে তীব্র লড়াই করছে।

সেদিনটার কথা আমার মনে আছে এখনও,কোর্ট থেকে আমি আমাদের ডিভোর্সের অ্যাপিল করে ফিরছিলাম,মিউচুয়াল কেসে ছয়মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়।কি অদ্ভুদ,মানুষের সম্পর্ক যত জটিল হয়েছে আইন ততই সহজ হয়েছে।

গাড়ীর পেছনের সীটে বসেও ভালো বুঝতে পারছিলাম,আমি বা অমর আমরা কেউই ভাল নেই।হঠাৎ অমর বলল,”বাবু কিছুদিন ধরেই আমার মন খুব খারাপ,আমার বৌ আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”
আমার নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল “কোথায় গেছে”?

অমর কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলো,”ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম,দু’বছর পর বললো,আমাকে আর পছন্দ নয়,অন্য কারোকে ভালোবাসে,আমি আর কিছু জানতে চাইনি।”

তারপর আমি অমরকে হুড়মুড় করে অনেকগুলো কথা বলেছিলাম সব কথা এখন আমার মনেও নেই,কিন্তু উত্তরে অমর শুধু একটু ম্লান হেসেছিল।

এরপর,অমরের সাথে আমার একটা আলগা সখ্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। একবার ওর মোবাইলে এর স্ক্রিনসেভারে ওর স্ত্রী রূপার ছবি দেখেছিলাম,ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও কেন অমর রূপার ছবি রেখেছে বুঝলাম না। আমিও নিজেকে মনে মনে জিজ্ঞাসা করছিলাম,আমিও কি পেরেছি রুশাকে পুরোপুরি ভুলতে?

এরপর প্রায় বছর দু’এক পরের কথা,একদিন সকালে অমর আমাকে ফোন করে বললো,”বাবু,কিছুদিনের ছুটি চাই”।ফোনে ওর গলার স্বরে যেন আনন্দ ঝরে পড়ছিল।

প্রায় একসপ্তাহ পরে অমর গাড়ি চালাতে এলো, গাড়িতে বসেই বললো “বাবু, আমার রূপা ফিরে এসেছে”।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম,দুবছর ধরে যার সাথে কোনও যোগাযোগ নেই,যে নিজের বিয়ে করা স্বামীকে অবলীলায় ফেলে অন্য পুরুষের সাথে ঘর বাঁধতে পারে,তাকে অমর কি করে আবার স্বীকার করছে?

এইকথা গুলো ওকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম তখন ও বলল ” বাবু,আমি তো রূপাকে ভালোবেসেছি “।
একজন প্রায় অশিক্ষিত মানুষ, কিসের জোরে এতটা ভালোবাসতে পারে? নিজের নারীকে কোনও পুরুষ এইভাবে আবার আপন করে নিতে পারে? যে নারীকে অন্য একজন পুরুষ ভোগ করেছে তাকে আবারও নিজের ভাবতে অমরের একটুও বাধলো না?

এত উচ্চশিক্ষিত একজন কালচার্ড মানুষ হয়ে আমি তো পারিনি রুশাকে নিজের করে নিতে।রুশা তো শুধুমাত্র নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিল,আমি কখনই রুশাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের স্বীকৃতি দিই নি।
আমি সব সময় ভেবেছি বাইরের মানুষের চোখের চাউনির স্পর্শে বুঝি রুশা অপবিত্র হয়ে গেল।
অমর কিভাবে পারল রূপাকে আবারও নিজের করে নিতে?

আমি শুধু বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, কতটা গভীর প্রেম হলে মানুষ সবকিছুকে উপেক্ষা করতে পারে,সমস্ত জীবন ধরে শুধু একটু ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে সন্ধ্যা নেমে আসছিল,রাস্তায় যত আলো জ্বলতে লাগলো আমার মনের মধ্যে ততই বুঝি অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।পাখীরা ঘরে ফিরছিল,মনে পড়লো হ্যাঁ, মানুষও তো একদিন ঘরে ফেরে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত