বাস্তব জীবনের ভালবাসা আর সাহিত্যের পাতায় ফুটে
ওঠা ভালবাসা কখনো এক হয়না। প্রেমের উপন্যাস এবং
কোন মর্মস্পর্শী গাথা কাহিনীতে দুর্দান্ত প্রেমের
পরিণতি স্নিগ্ধ পারিবারিক জীবনে শেষ হয়ে যায়না।
জীবনের শেষ রেখায় এর রেশ থেকে যায়। প্রেম যদিও
কখনো তৃণের মত নরম,তীক্ষ্ণমুখ কাঁটার মত বেদনাদায়ক
এবং ব্যথার নির্যাসেই প্রেমের বিশালতা অনুভূত।
প্রেমের উপন্যাসে ডিডো-এনিয়েস আর এ্যাণ্টানী-
কিলোপেট্রার মত ব্যর্থ প্রেমে সাকসেসফুল মনে
করাটা;নিছক সুখের সমুদ্রে নিজেকে নীল করে দেওয়াটা
হতো বন্ধ্যা মেধার পরিচায়ক। মৃত ফুলকে বুকে নিয়ে কিছু
মানুষ করে প্রেম,ক্রোধ হাহাশ্বাস।
কিছু মানুষের প্রেমের শুরু হয়,দেব-দেবীদের মতনই
করুণ,বেদনাদায়ক এবং সংঘাতময়। সে ভালবাসা এক সময়
ফুলে ফলে সমৃদ্ধ অধরায় হয়ে উঠে দারুণ পচনশীল। মানুষ
সরল ভালবাসা,হাবাগোবা ভালবাসা গ্রহণ করতে
নারাজ,নিছক বাছুরে প্রেম তথা মিলনে সার্থকতার
চেয়ে বিষাদপূর্ণ ব্যর্থ প্রেমের কাহিনীই মানুষের মনকে
অনেক বেশী নাড়া দেয়।
একজন নবীন প্রেমিক সব সময় প্রার্থনা করবে
উৎপাদনশীল এই পৃথিবীতে যাতে তার প্রেমে কোন
বিপর্যয়ের ছোঁয়া না লাগে। প্রেমে পরিক্রমান্তে সে
যেন নির্বিঘ্নে তার প্রেমিকাকে বধূরুপে লাভ করে এবং
তাদের পারিবারিক জীবনেও যাতে কোন দৃশ্য বা অদৃশ্য
তঞ্চকের আবির্ভাব না ঘটে। কিন্তু নবীন এই প্রেমিক
সাহিত্যের পাতায় তার প্রেমিকাকে খুঁজে ভিন্নরুপে
ভিন্ন চরিত্রে। এবং সে দেখবে ভাগ্যের ছলনা,ললনার
ছলনা,ভুল বোঝাবুঝি,হতাশা,সন্দেহ বিচ্ছিন্নতা এবং
মৃত্যু। বাস্তব জীবনে মানুষ যে প্রেমের ছবি আঁকে,যে
বাস্তব পরিণতি ও সার্থকতা কামনা করে,সাহিত্যের
পাতায় সেটা অকাম্য বিষয়। এই অকাম্য বিষয়ে
নাটকীয়তা থাকেনা বলেই সাহিত্যের উপাদান
হিসেবেও মনোগ্রাহী হয় কদাচিৎ।
মানুষ কখনো পরিপূর্ণ ত্রুটিহীনতাকে আকর্ষণীয় বলে মনে
করেনা। নিজস্ব কোন ব্যর্থ স্মৃতি বুকে আগলে রেখে
লালন করতে না চাইলেও পৃথিবিটা কোন ফুলের বাগান
নয় যে,সেখানে সুখের আর প্রাপ্তিস্থান হবে। পৃথিবীটা
একটা যুদ্ধ সংগ্রামের স্থান। এখানে কেউ নিজেকে
নিয়ে ব্যস্ত,কেউ প্রেমের মানুষকে নিয়ে ব্যস্ত আর কেউ
সাহিত্যে নিজের প্রেমকে বেদনাদায়ক করে তুলতে
ব্যস্ত।
একটি সহজ বিবাহ,কিছু সরল চরিত্রের ভালবাসা,ঝুঁকিহীন
পথে তর-তরিয়ে ছুটে চলা,পারস্পরিক মিষ্টি আলাপন
এসবে হারিয়ে যেতে ভালবাসে। হারিয়ে যেতে
ভালবাসে,উত্তেজনায় থর-থর করে কেঁপে ওঠার মতন
ঘটনায় নিবিষ্ট ত্নমরতায়,যে উত্তেজনায় এক জোড়া
নিখুঁত চরিত্র প্রেমিক-প্রেমিকার সংঘাতহীন প্রেম-
পরিক্রমায় খুঁজে পাওয়া যায়না। নিদ্রা জাগরণে
সুখস্বপ্নে বিভোর থাকা যতখানি আনন্দদায়ক,সেই সুখের
চিত্র আঁকা,সাহিত্যে সে প্রেম ফুটিয়ে তোলা ও পাঠ
করা ততখানি বিরক্তিকর। এই সুখ,ভালবাসা বা ইটোপিয়া
যখন প্রেমের গল্পকে ছুঁয়ে যায়,তখন গল্পের জাতটাই
মারা পড়ে।
রবার্ট ব্রাউনিং এর নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তার
লেখা “The Ring and the book” হয়তো কেউ পড়েছেন বা
কেউ পড়েননি। ব্রাউনিং তরুণ বয়সে একজন সফল প্রেমিক
ছিলেন। তার প্রেম জীবন ছিল সুখ শান্তিতে পরিপূর্ণ।
পারিবারিক জীবনেও তিনি খুব সুখে ছিলেন।প্রেমের
গায়ে বেদনার নীল রঙ ছিলনা,সবটুকুই ছিল রঙিন। কিন্তু
তিনি যখন প্রেমিকের প্রেমকে পুঁজি করে প্রেমের
উপন্যাস রচনা করতে যান,তার লেখায় প্রেমের নিছক সুন
মোহান্ধতা অবিলতা সৃষ্টি করেনা। তাদের প্রেম
পার্থিব জীবনে সফল হলেও প্রেমের উপন্যাসে নায়ক-
নায়িকাদের প্রেমের রিক্ততা,শূন্যতা নিঃস্ব হয়ে
গিয়েও মিলনের দ্বারে পৌঁছাতে পারেনি গভীর
বিষণ্ণাতা এবং জীবনের অবডালে দীর্ঘ হাহাকার ও
দীর্ঘশ্বাসের কারণে। তার নির্মম হাতে রচিত
যে,পাঠকের চোখ লবণাক্ত।
সাংবাদিকতায় যেমন সাধারণ মানুষের বৈচিত্রহীন
জীবন-যাত্রার বর্ণনা দিতে দিতেই নিজের শক্তি ক্ষয়
করেনা,বরং খুঁজে বের করে মানুষের সংঘটিত নানা
বিচিত্র ঘটনা,চিত্রিত করে দাবাদেহ দগ্ধ অর্থব পৃথিবীর
নানা অনাচার,ভূমিকম্প,বন্যা,ডাকাতি,ধর্ষণ,সাহিত্যও
তেমনি সরলতাকে পছন্দ না করেই জটিলতাপূর্ণ বিষয়
অনুধাবন করে। সাহিত্যের বিষয় বস্ত মন,যা কখনো
আঙ্কিক ও যান্ত্রিক নিয়মে নিছক নির্মল হয়না,জটিলতা
যার স্বাভাবিক ধর্ম।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা