আমি বড় বোনের খেতাব পেয়েছি আমার জন্মের ছয় বছর পর। ঐ আমার ছোট ভাই দুনিয়া আসার পর। ততদিন আমি একাই রাজত্ব করেছি। ও যতোই বড় হচ্ছে আমি ততই অনুভব করতে লাগলাম, ওর আমার বড় ভাই হওয়া উচিত ছিল। আমি ভুলে ওর বড় বোন হয়ে গিয়েছি।
একমাত্র ভাই আমার, তাও কোন কারন ছাড়া আমাদের মধ্যে চরম শত্রুতা। কেউই কাউকে সহ্য করতে পারি না। ছোট খাটো বিষয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা। এমনও হয়েছে আব্বু আম্মু বিরক্ত হয়ে বলেছে, তোরা আর কথা বলবি একজন আরেকজনের সাথে। আব্বু অলওয়েজ আমার সাপোর্টে আর আম্মু তার পুত্রধনের। আমাদের জন্য আম্মু আব্বুর মধ্যেও কথা কাটাকাটি হয়েছে। কারন আব্বু কেন আমাকে সাপোর্ট করে, তার ছেলের দোষ নেই। আর আব্বুর পয়েন্ট দোষ সব তানভীরের। ঐ কথা কাটাকাটি শেষ হতো আম্মু আব্বুর বিরক্তি নিয়ে। দুইজনই বিরক্ত হয়ে বলেছে, আর কথা বলবি না একজন আরেকজনের সাথে।
আমিও আফসোস করে এককালে আব্বু- আম্মুকে প্রায়ই বলতাম আমার আরেকটা হয় ভাই নাহয় বোন চাই। কারন এই শয়তানের সাথে আমার কখনোই একটা ভালো বন্ডিং হয় নি। আব্বু জবাবে স্বান্তনা দিয়ে বলতেন যে,আচ্ছা কিনে আনবো। এমন দিন হয়তো কমই আছে আমরা ঝগড়া করি নি। ঝগড়ার মাঝে আব্বু আম্মু যে ই আসতো এসেই সবসময় প্রথমে তানভীরকে প্রশ্ন ছুড়তো, আই তুই কি করছস ওর সাথে? যা ওর দ্বিতীয় দফায় রাগারাগির কারন।
আমি আমার পড়ালিখার জন্য কখনোই ওকে ঘেটে দেখিনি এর পড়ালিখার ব্যপারে আর আমার সময়ই হতো না। আমি আমার মতোই ছিলাম। ওর জন্য সবসময় বাসায় স্যার। যে স্যারই ঠিক করতো প্রথম শর্ত সকালে পড়াতে আসতে হবে, দ্বিতীয় তার উপর অত্যাচার করতে হবে তাও তানভীরকে মানুষের মতো মানুষ করে দিতে হবে। প্রথম শর্তের কারন ওর ঘুম বেশি। আব্বু সবসময় বলে সকালের পড়া মুখস্ত হয় বেশি। আব্বু আম্মুর এই এক আফসোস তারা কোনদিন পড়তে দেখেনি সকালে তানভীরকে। ওর সকালের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ওয়াসরুম পর্যন্ত দিয়ে আসতে একটা ছোট খাটো ঘূর্ণিঝড় হওয়া নিত্যদিনের ঘটে যাওয়া সকালের ঘটনা। আব্বু এসে পা টেনে বসিয়ে দিল, কিন্তু কয়েক মিনিট পর এসে দেখা যায়, সে আবার ঘুম। আবার হঠাৎ হঠাৎ এমনও হয়েছে, ও ওয়াসরুম থেকে বের হচ্ছে না, ঐখানেই ঘুম।
আর স্যার আসার আগে সে জীবনেও ঘুম থেকে উঠবে না, স্যার আসবে সে ঘুম থেকে উঠবে, ফ্রেস হয়ে পড়তে বসবে। এইসব রোজকার ঘটনা চলতেই থাকে। স্যার আসার আগে ওর ঘুম না ভাঙ্গানোর পিছনে আম্মুর অবদান।
তানভীরের এমন রেকর্ডও আছে যে, ওর জন্য স্যারকে বিদায় করা হয়েছে, স্যার চাকরি ছাড়ে নি। তাও সেই স্যার যে স্যারের কাছে আমিও এক সময় পড়েছি, ভালো রেজাল্ট করেছি। ঐ স্যারকে তাড়ানোর একটাই কারন ওর কোন প্রকার উন্নতি হচ্ছিলো না। স্যারের পারফরম্যান্সে আম্মু আব্বু খুশি না। স্যার বকা দিলেও ওর কোন নড়চড় নেই। কোন কথা গায়ে মাখে নি। ও ওর মতোই আছে।
ঐ স্যার থাকাকালিনই একদিন সকালে আম্মু উকি দিয়ে চেক করছিলো ওদের পড়ার রুমে যে, স্যার তো পড়াচ্ছে আওয়াজ আসছেনা কেন? আম্মু উকি দিয়ে দেখলো, স্যার টেবিলে মাথা রেখে ঘুম। তানভীরও ঘুম। সব বই খাতা খোলা। আম্মু ঐদিন সারাদিন থম মেরে বসে ছিলেন। এই ঘটনাও যুক্ত হলো স্যারকে তাড়ানোর পিছনে।
তানভীরের জে.এস.সি পরীক্ষার সময় হুট করেই ওর সব দায়িত্ব আব্বু আমার উপর দিয়ে দেয়। আব্বু-আম্মুর বড়ই আফসোস, তাদের একমাত্র ছেলের অবস্থা পড়ালিখায় এত শোচনিয়। স্যার আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমিও আব্বু আম্মুর দুঃখ দেখে মনে মনে ঠিক করে নি যে, ওকে সময় দিবো প্রতিদিন পড়ালিখার জন্য। আমার প্রথমদিনই ওকে পড়াতে বসে অনুভূতি এমন যে, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি। নিজের মাথা অল্পতেই গরম, আর পড়াই পড়া কিছুই হয় নি। ওকে প্রথমদিনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাঁধার খেতাব দিয়ে দিলাম। ওর সিম্পল জিনিসে গাঁধার মতো প্রশ্ন। এতোদিন ওকে দেখে বুঝায় যায় নি। ও ভিতরে ফাপা। মনে মনে একটাই প্রশ্ন আসে যে, ওর এত এতো স্যার কিভাবে ওকে সহ্য করেছে। ও কিভাবে ক্লাস এইটে উঠেছে। ও তো জে.এস.সি এক চান্সে পাশ করতে পারবে না। ওর স্যারদের উপর আমার মায়া হচ্ছিলো। স্যাররা এতো এতো মাস ওকে সহ্য করেছে কিভাবে?
আমি রাতে খাবার টেবিলে বলে দিলাম যে, আমি ওকে পড়াতে পারবো না। ওকে ভুলের জন্য মারলেও ও উল্টা আমাকে মারে। ওকে বিচার করলেও উল্টা আমার বিপদ বাড়ে। আমার কথা শুনে আম্মু আকুল ভাবে বললেন, আমাকে সারাদিন ঘরে কোন কাজ করতে হবে না। সারাদিন মোবাইল, টিভি নিয়ে বসে থাকলেও কিছু বলবে না। তাও ওকে এক বেলা পড়ালেই হবে। আব্বু হুট করে ঘোষনা দিলো যে, ও যদি জে.এস.সি তে এ প্লাস পাই ওকে নতুন সাইকেল কিনে দেওয়া হবে। আর আমাকে সাইকেলের মূল্যের সমপরিমান অর্থ কিংবা আমি যা চাই। হাতে আকাশের চাঁদ।
পুরষ্কার শুনে আমি শেষ। এই পুরষ্কারে ঘোষনা থেকে মন সরানো মুসকিল। আমার নতুন মোবাইল চাই।
আমি পুরো দমে ধৈর্য ধরে ওকে পড়ানো শুরু করলাম। আর আমি রেগে গেলে আব্বু এসে বকে, আমাকে স্বান্তনা দেয়। এক সময় নিজে নিজেই ভাবলাম, লাগবেনা গিফ্ট, তাও পড়াবো না। আম্মু ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে দেয়। সব দোষ আমার জান-প্রান অর্থাৎ মোবাইলের উপর দোষ দেয়। অামি নাকি মোবাইল চাপার জন্য ওকে পড়াচ্ছি না। আমি আমার পক্ষ জোড়ালে করতে বলি যে, কি এমন ভাই আমার আজ পর্যন্ত আমাকে আপু ডাকে নি। অন্যদের সামনে আপু ডাকলেও আমাকে সবসময় এই এই বলে সম্বোধন। আমার এত জোড়াল পয়েন্টও আম্মুর ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলের উপর হার মানে। আমার আর কি করা?
আমি অসহায় বালিকা রেগুলার ধৈর্য নিয়ে ওকে পড়াই। এবার এমন হলো যে, সারাদিন ও আমার সামনে হিংস্র বাঘ থাকলেও সন্ধ্যের পর আমার সামনে বিড়াল। হুট করেই আব্বু এমন নিয়ম দিলো যে, ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সারাদিন সে বাসায় পড়বে, আমি যেভাবে বলবো সে ঐরকম করবে। সব ঠিক আছে, কিন্তু ওর উপর হাত উঠলেই আমার বিপদ বাড়ে। ওর উপর হাত উঠালেই আবার যে লাউ সেই কধু। অবস্থা আগের মতোই। বিপদ আমার বাড়ছে। আমিও নিজের মানসম্মান বেঁচে কাঙ্খিত পুরষ্কারের জন্য দাঁত মুখ চেপে ওর পিছনে পড়ে আছি। তবে কারন আরেকটা ছিল, আমার ভাই হয়ে ফেইল করবে, তা কেমন যেন বেমানান। আমি নিজেই এতোদিনে বুঝে গিয়েছি, সে কোনমতে পাশ করলেও এ প্লাস সে পাবে না।
জে.এস.সি’র প্রথম পরীক্ষা ছিল বাংলা। পরীক্ষার দুইদিন আগে থেকে ওকে বাংলা পড়তে বললাম। সে বাংলা পরীক্ষার আগের দিন আমাকে সেই লেভেলে শক দিলো। আমার কাছে এসে হাতে পায়ে ধরে আবদার করল, তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে কেমনে পড়বে, কি পড়বে, কিভাবে পড়বে। আমিও পরিস্থিতির স্বিকার। আগেরদিন রাতেও তার যতোক্ষণ না পড়ালিখা শেষ হলো আমি তার সাথে রাত জেগে বসে ছিলাম তার পাশে। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম তখন যখন সে পরীক্ষার দিন ভোরে পাঁচটায় ঘুম থেকে তুলে দেয়। ডাকার উদ্দেশ্যে ও পড়বে, আমি ওর পাশে থাকবো, ওকে বলে দিবো কি পড়বে। পরীক্ষার দিন, পরীক্ষার আগেরদিনও এইসব দেখে আমি রিতিমতো অবাক। কি আর করা।
ও বাংলা পরীক্ষা দিয়ে আসার পর আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ওর দিকে চেয়ে ছিলাম। ও যতোক্ষন পরীক্ষার হলে ছিল, আম্মু ততক্ষন জায়নামাজে কাটিয়েছে। আম্মু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, কত আন্সার করেছে? কেমন হলো?
ও একটা দুই পাটি দাঁত দেখিয়ে হেসে হাসি বলল,
– ভাই আমার পরীক্ষা খারাপ হলে তোমার দোষ, হ্যাঁ?