বাবার সাথে দুপুরের খাবার খেতে বসেছি।বাবা তার মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– দেখতো,মোবাইলে কোনো মেসেজ এসেছে কি না!
বাবা সাধারনত মোবাইলের মেসেজ টেসেজ খুব একটা খেয়াল করেন না।ফোন আসলে উত্তর দেন,প্রয়োজনে ফোন করেন।এই দুটো কাজ ছাড়া তার ধারনা মোবাইলে আর কোনো কাজ নেই।বাদ বাকি সব অকাজ।আজ কালকের ছেলে-মেয়েদের এই অবস্থার জন্য এই অকাজ কু’কাজই দায়ী।এ নিয়ে বাবা আমাকে প্রায় হাজার খানেক গল্প শুনিয়েছেন।যেই মূহুর্তে শোনানোর প্রয়োজন হয়েছে,সে সময়ের বাহিরেও শুনিয়েছেন।আমার হাতে মোবাইল দেখলেই বাবার নতুন একটা গল্প মনে পরে যায়।ধীর গলায় ঢোকর তুলে বলেন,
– বুঝলি বাবা?এই মোবাইল জীবনে কিচ্ছু দেবেনা।শোন,অমুক গাঁয়ের তমুকের ছেলে এরকম সারাক্ষন মোবাইলে নিয়া পরে থাকতো।কি করলো শেষ পর্যন্ত?ওইতো,বসে আছে বাড়িতে।
আমি মেসেজ দেখে বললাম,
– আব্বা,তোমার বেতনের মেসেজ এসেছে।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।ছোট্ট করে জবাব দেয়,
– ওহ,আচ্ছা।
কোনো কথা শুরু করার আগে বাবা ঢোকর তোলেন।ব্যতিক্রম খুব একটা দেখিনি।খাবার খেতে খেতে বাবা একবার ঢোকর তুললেন।আমি বুঝলাম বাবা কিছু একটা বলবেন।পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-আব্বা,পানি খাও।
পানি খেতে খেতে বাবা বললেন,
– বুঝলিরে আব্বা?তোর মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনতে হবে।কতদিন হলো তোর মাকে কিছু দেওয়া হয়না!এবার বাড়ি যাওয়ার সময় একটা ভালো শাড়ি কিনতে হবে।
আমি বললাম,
-হুমম।ফ্রি আছো কবে?চলো যাই।
বাবা কিছুক্ষন ধরে খেয়াল করলাম খাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছেন।চুপচাপ।কিছু একটা ভাবছেন।আনমনে।খুব যত্ম করে ভাবছেন।ভাবনাকেও যত্ম করতে হয়।ভালোবাসতে হয়।এই ধারনা আমি বাবার কাছেই শিখেছি।বাবা যখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন,আমি বুঝি বাবা যত্ম করে ভাবছেন।
একটু থেমে বাবা বললেন,
– সনমের একটা ব্যাগ কেনা লাগবে।পুরোনোটা ছিঁড়ে গিয়েছে।সেদিন রাতে ফোনে বলেছে এবারের ছুটিতে যাওয়ার সময় ওর জন্য ব্যাগ নিয়ে যেতেই হবে।
বাবা আবার খাওয়া বন্ধ করে কি যেনো ভাবছেন।চুপচাপ।আনমনে ভাবছেন।খুব যত্ম করে ভাবছেন।একটু থেমে বাবা আবার বললেন,
– কিরে?কিছু বলিস না কেনো?তোর এই পোষাক তো দেখি পুরোনো হয়ে গিয়েছে।আজকালকার ছেলেরা এক পোষাক এতোদিন পরে?
আমি বাবার দিকে তাকালাম।ভালোবাসায় সিক্ত চোখ।শাসন-ভালোবাসা আর নির্ভরতার চাহনী বাবার চোখে।আমি খেয়াল করেছি।বাবার চোখের দিকে চোখ পরলে মানুষ একনাগারে তাকিয়ে থাকতে পারে না।চোখে পানি এসে যায়।এই রহস্যের গল্প আমি এখনো জানিনা।আমার ধারনা জগতের সব কিছুর মাঝে একটু আধটু এমন রহস্য থাকা উচিৎ।
বাবার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,
– আব্বা,তোমার গাঁয়ের এই পানজাবিটা কবে কেনা?
-আচ্ছা আব্বা,জুতোটা তো সেই কবে দেখেছি ছিঁড়ে গিয়েছে,নতুন একটা বদলে আনোনি কেনো?
-আব্বা,তুমিও তো এক পোষাকে চলাফেরা করো।আমি এক পোষাকে চললে ক্ষতি কি?
বাবা কিছু বলে না।নিজেকে সামলে নিয়ে এক ঢোকে গ্লাসের পানি শেষ করে।বাবা মুচকি হাসে।এই হাসিতে শত প্রশ্নের উত্তর লুকোনো থাকে।শত সমীকরনের সমাধান থাকে।হাসতে হাসতে বাবা বলেন,
– আরে পাগল।আমার কথা বাদ দে।এটা তোর মায়ের দেওয়া পাঞ্জাবি।তাই সব সময় এটাই পরে থাকি,বুঝলি?আর জুতোটা বদলানোর কি প্রয়োজন।সেলাই করালেই দেখবি তোর জুতোকেও পেছনে ফেলবে।
বাবা অনেক্ষন হলো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি বাবার চোখে তাকাতে না পারলেও লক্ষ্য করেছি বাবা অনেকবার চোখ মুছেছেন।আঁড়াল করার আপ্রান চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে বাবার।
হাত ধুতে ধুতে বাবা বললেন,
– বাজান!তুই না কলেজে উঠে নতুন মোবাইল কিনতে চেয়েছিলি?জানিস?সেদিন মার্কেটে একটা মোবাইল দেখেছি তোর জন্য।পছন্দ করে রেখেছি।এবার তোর পছন্দ হলেই মোবাইলটা নিয়ে নিবো তোর জন্য।এই মুখ অমন গোমরা করে আছিস কেনো রে?একটু হাসি দে তো দেখি!
আমি কিছু বলিনা।বলতে পারিনা।মানুষ সব সময় কথা বলতে পারে না।গলা ধরে আসে।আমিও কথা বলতে পারিনা।কথা আটকে যায়।
বাবা,বসন্ত এসেছে।বসন্ত আসে ভালোবাসার প্রতীক হয়ে।বসন্ত আসে বাবা-মা এর ভালোবাসার স্নিগ্ধতা হয়ে।ভাই-বোনের ভালোবাসার আলপনা হয়ে।বন্ধুদের হাজার রকমের কল্পকথা হয়ে- বসন্ত আসে।
বসন্ত তোমাদের জন্যই এসেছে।সত্যি বলছি,তোমাদের গল্পতেই বসন্ত সাজে।নতুনরূপে- নতুনভাবে।প্রতিবছর।আবার বসন্ত আসবে- তোমাদের জন্যই আসবে।তোমাদের এই হাসিমুখের গল্প শুনতেই ওরা আসে।