বউয়ের ভালোবাসা

বউয়ের ভালোবাসা

সুমনার বিয়ে হয়েছে একসপ্তাহও হয়নি। কিন্তু সে বর শাহেদকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। যেন জন্ম জন্মান্তর থেকে তাদের পরিচয়। অথচ তিন সপ্তাহ আগেও তাদের দেখা হয়নি। দুই সপ্তাহ আগেই আকদ হলো। তার পাঁচদিন আগে, মেয়ে দেখতে এসে শাহেদ আর তার বোন আংটি পরিয়ে গেছে। তারপর তাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি, সুমনার বাবা বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে এসব মিলামিশা খুবই অপছন্দ করেন, তাই। উনার মতে, বিয়ের অনুষ্ঠানের পর তোমার বউ তোমার ঘরে রাখবে, নাকি বাইরে গাছতলায় থাকবে, নাকি বউ নিয়ে রঙ ঢঙ করবে সেটা তোমরা দেখো, তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। কিন্তু আমার ঘর থেকে আমার মেয়ে এক পাও কোথাও যাবেনা বা জামাই এসে সঙ সেজে বসে থাকবে, দরজা বন্ধ করে হাহা হিহি করবে তা হবেনা।

সে কারণে ফোনেও কথা বলেনি সুমনা। আর তাই হয়তো কল্পনায় আঁকা, বলা, সব কথায় গরগর করে বিয়ের দিন বিকেলে একসাথে পাশাপাশি বসে কার করে যাবার সময়ই উগলে দেয় সুমনা। সারা পথ তারা কথা বলতে বলতে এসেছে। অপরিচিত এই দুই জনের পেটে এতো কথা যে কবে জমা হয়েছিলো! তাদের মনে হলো, একঘণ্টার পথ দশমিনিটে শেষ হয়ে গেলো যেন হঠাৎ করেই। গাড়ি থেকে নামতেই ইচ্ছে করছিলো না সুমনা বা শাহেদ এর। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলে এমনই কি হয়! চোখের ভাষায় জিজ্ঞেস করে দু’জন দু’জনকে। কারো উত্তর জানা নেই। গাড়ি থেকে নামার আগে সারাদিন রাতের ঝামেলা আর ক্লান্তিতে সুমনা কেমন অসুস্থ বোধ করে হঠাৎ করে। বুঝতে পেরে শাহেদ অস্থির হয় আর ওর ভাবীরা মুখ টিপে হাসে। “বউ তো এখনো ঘরেই ঢুকলো না!” সবাই আড়ালে নয়, সামনেই বলে উঠেন । লজ্জা পেয়ে যায় শাহেদ।

-না না, আমি ভাবলাম বেঁহুশ হয়ে যায় কিনা তাই।
-নাগো তোমার বউকে বেহুশ হতেই দিবো না আমরা। গাড়ি থেকে নামাতে নামাতে ভাবিরা বলেন।
-আর হবে মনে হলে রসুন নাকে শুকতে দিবো।
-না না রসুন লাগবেনা, বিশ্রী গন্ধ.. সুমনা বলে উঠে।
-হায় আল্লাহ, নতুন বউ দেখি কথা কয়। ওগো কথা বলতে নেই। আশেপাশের জা’য়েরা বলে উঠেন।
-কেনো!
-আবার বলে?

সবাই হেসে উঠেন। বাসায় ঢুকানোর পর মেহমানের পর মেহমান, প্রতিবেশী, আত্মীয়, সবাই এক এক করে বউ দেখে যায়। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত সুমনার চোখে মুখে নকল হাসি, সে শুধু মনেমনে শাহেদকেই খুঁজে। কিন্তু শাহেদ উধাও। খুব রাগ হয় সুমনার। ভাবে, একটু আশে পাশে থাকলে কি হয়! সবার সামনে কি সে আর কথা বলতো! অতো বোকা নয় সুমনা। একটু চোখাচোখি হতো, চোখে চোখে কথা বলতো। ঐ বেয়াদপটা তাকে একা ফেলে কই গেলো? মনে মনে বকা দেয় সুমনা। সব ঝামেলা শেষ হলে, রাতের খাবার খেয়ে একা রুমে তাকে বসিয়ে দিলেন ভাবীরা, তখন প্রায় রাত বারোটা। এরমধ্যে শাহেদের সাথে একপলক দেখা হয়েছিলো শুধু। সে তাকাইওনি সুমনার দিকে, মুখ নীচু করে খেতে গেলো তার সামনে দিয়ে। খুব অভিমান হয়েছিলো সুমনার। ঠিক আছে, আসুক রুমে কথায় বলবেনা সে। সুমনা প্রায় দশমিনিট একা ছিলো, তারপর শাহেদ ঢুকে।

-এসেছেন লাটসাহেব! মনে মনে বলে সে।
-কি খুব টায়ার্ড? শাহেদ জানতে চায়। সুমনা চুপ।
-কি হলো, খারাপ লাগছে? ভাবীদের ডাকবো।
-হ্যাঁ, ভাবীদের ডাকো, আজ ওদের সাথে ঘুমাবো।
-রাগ? কেনো!!
-সারাদিন কই ছিলে? আমাকে একা ফেলে…
-কি করবো, সবাই লজ্জা দিবে যে।
-দিলে দিতো।
-তাই?
-হুম।
-মিস করেছো?
-অনেক।
-আমিও।
-হুম, প্রমাণ পেয়েছি
-কি করলাম আবার!
-খেতে গেলে একবার ফিরেও তাকাওনি।
– সবার চোখ যে আমাদের দুইজনের দিকে,তাই। তাইতো সারাক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকেছি।
-তারপরও…
-ঠিক আছে, আজ সারারাত তাকিয়ে থেকে পুষিয়ে দেবো, হবে?
-না। শাহেদ পাশে যায়।

-দ্বিতীয় বারের মতো হাতটা ধরতে পারি?
-মাত্র দ্বিতীয় বার! আর ধরবেনা?
-স্যরি, ভুল হয়েছে, গাড়িতে প্রথম বার ধরা তো, তাই বলা। তা সারাজীবনের জন্য ধরতে পারি?
-হুম।শুধু হাত ধরবে! আদর করবেনা?
-আদরও করতে হবে?
-যাও করতে হবেনা।
-আবার অভিমান হয়েছে? আদর করবো তো।
-হুম, আজ সারারাত জেগে থাকতে হবে কিন্তু, গল্প করবো।
-তুমি টায়ার্ড নাহ?
-তো কি, আমি গল্প করতে চাই।
-ঠিক আছে।
– আমার বর, সারারাত আমার হাত ধরে গল্প করবে, আমি সবসময় এমন কল্পনা করেছি।
-তাই! ঠিক আছে। হাত তো ধরেই আছি। আধঘণ্টা গল্পও হয়না, সুমনার গলা ভারি হয়ে আসে, চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
-তুমি শুয়ে পড়ো সুমনা, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
-হুম।

সুমনা আর কথা বলতেও পারেনা, শাহেদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে, মুহূর্তেই ঘুমের রাজ্যে। শাহেদও কম টায়ার্ড না, শুয়ে পড়ে সেও। পরদিন আবার মেহমান, সুমনার বাড়ি থেকেও অনেকে আসে দেখতে। সুমনার এসব ভালো লাগেনা, ও চায় শুধু শাহেদের সান্নিধ্য পেতে, গল্প করতে। আর ভাবী স্থানীয়রা তো আছেন, সুযোগ পেলেই জিজ্ঞেস করছেন।

-তারপর বলো, কাল রাতে কি হলো? সব ঠিক তো?
-জ্বি, সব ঠিক আছে।
-কি ঠিক আছে! হাসতে হাসতে সবাই আবার জানতে চান।
-কিছু হয়নি কাল? কতক্ষণ জেগে ছিলে?
-জানিনা, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
-কি বলে ঘুমিয়েছে!

বিয়ের রাতে কি কেউ ঘুমায়! এমনতর মজা করতেই থাকেন তারা। ভাবীদের জন্মই যেন, এসব কথা বার্তা বলার জন্য। সুমনা আবার ভাবতে বসে, সে ভাবী হলেও কি তাই করবে? ছিঃ না, কিভাবে সে এমন ইংগিত দিয়ে কথা জানতে চাইবে! রাতের আগে ঐ মানুষটার দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে ভেতরে সুমনা অস্থির হয়ে পড়ে। তা বুঝতে পেরেই যেন শাহেদ দুপুরে একবার সুযোগ বুঝে রুমে এসেছিলো। শাহেদেরও যে একই অবস্থা, মিস করছে প্রচণ্ড রকম!

দুই একবার যে আসেনি, তা নয়। কিন্তু কেউ না কেউ থাকে সাথে, কথা হয়না, একটু ছুঁয়ে দেখাও হয়না। দুপুরের ঐ সময়, শাহেদ এসেই দরজা আটকিয়ে দেয়, খুব করে জড়িয়ে ধরে সুমনাকে। আকষ্মাৎ এমনভাবে জড়িয়ে ধরবে, সুমনা ভাবতেই পারেনি। কিন্তু এতো ভালো লাগছিলো। ইচ্ছে হয়েছিলো, আর যেন সে না ছাড়ে, এভাবেই থাকে সারাজীবন। কিন্তু দরজার ওপাশে চেঁচামেচিতে শাহেদ ওকে একা রেখেই বের হয়ে যায়। এ যেন দুই বিবাহিতা দম্পতি’র লুকোচুরি প্রেম! খুব ভালো লাগে সুমনার। কিন্তু এতো মিস করে কেনো তাকে? বুকে কেমন কষ্ট হতে থাকে মানুষটার জন্য, অথচ সে হয়তো আশেপাশেই আছে। চারদিন পার হয়, ভালোবাসা বাড়তেই থাকে দু’জনের মধ্যে। একমুহূর্তের জন্যও কেউ কাউকে আড়াল করতে চায় না। পঞ্চমদিন, সুমনাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে তিনদিনের জন্য। এটাই নিয়ম, যেতেই হবে। সুমনার খুব কান্না পায়। অনেক কাঁদে সে, আগের রাতে শাহেদকে জড়িয়ে ধরে।

-আমি যাবো না।
-কিন্তু যেতে তো হবে, মানুষ কি ভাব্বে বলো?
-ভাবুক, আমি তোমাকে ছাড়া যাবো না, তাহলে তুমিও চলো।
-হায় আল্লাহ, আমি কিভাবে যাবো!
-কেনো, যেতে হবে আমার সাথে।
-যাও, কাল তুমি যাও, পরশু দেখতে যাবো।
-পরশু!
-কাল সারাদিন রাত কিভাবে থাকবো? শাহেদ হাসে, পাগলি মেয়েটির কথা শুনে।
-শুধু কাল নয়, তিনদিন থাকতে হবে
-থাকবো না আমি। বিয়ে দিয়েছে কেনো? আমি শ্বশুরবাড়িতেই থাকবো।
-ঠিক আছে, এবার যাও, আর যেতে দিবো না, ঠিক আছে?
-হুম, ঠিক নেই।

পরদিন, বাবা এসে সুমনাকে নিয়ে যায়। সুমনার মন টিকে না, সে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে বাড়িতে।

-কিরে কি হলো, চুপচাপ কেনো! শ্বশুরবাড়ি পছন্দ হয়নি! বড়বোন জানতে চায়।
-আমার আর বাপের বাড়ি পছন্দ হচ্ছেনা, আমাকে আনলে কেনো?
-মা, দেখো, তোমার মেয়ে কি বলে! তার নাকি এখানে আর ভালো লাগছেনা।

মা শুনে আর মনে মনে খুশিই হোন, মেয়ের মন বসে গেছে। বিয়ের পর প্রথম ক’দিন স্বামী স্ত্রী যেন দুইজন দুইজনের মধ্যে সাত রাজার ধন পায়। বড় মেয়েকে মনে করিয়ে লজ্জা দেননা আর মা। ইতিমধ্যে সুমনা অনেকবার ফোনে কথা বলে ফেলেছে শাহেদের সাথে।

-কাল কিন্তু ভোরে ভোরে চলে আসবে।
-আচ্ছা
-ঘুম থেকে উঠেই চলে আসবে, নাস্তা এখানে করবে।
-আচ্ছা।
-আচ্ছা আচ্ছা করছো কেনো?
-এতো ভোরে কেউ আসে! পাগল বলবে তো।
-বলুক, পাগলের সাথে তো আমি থাকবো, ওরা না।
-হুম।
-কখন আসবে বলো?
-খুব ভোরে।
-হুম।

পরদিন শাহেদ বন্ধুকে নিয়ে এগারোটার দিকে যায়। এদিকে সুমনা ব্যাগে কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখে। শাহেদ আসে, ওকে তার রুমে নিয়ে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে, যেন কতো বছর পর দেখা!

-চলো এবার চলে যাই
-কি বলছো! আমি বাসায় বলে আসিনি। কাল ভাইয়া আসবে তোমাকে নিতে।
-না, আমি আজই যাবো।
-কি লজ্জা, আমি কিভাবে নেবো! সবাই কি বলবে!
-না, আমি যাবো, দেখো, সব গুছিয়ে রেখেছি।
-তো আমি কি বলে নিয়ে যাবো?
-তুমি এখন গিয়ে বলবে, মায়ের শরীর খারাপ, আমাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছে।
-মিথ্যে বলতাম!
-ভালোবাসায় মিথ্যে বলা যায়…
-তাই!
-হুম।

শাহেদ আমতাআমতা করে সুমনার শিখিয়ে দেয়া কথায় বলেন। নিয়ে যায় সুমনাকে সাথে করে। বন্ধু তার মোটর সাইকেলে একা চলে যান, আর সুমনা আর শাহেদ ট্যাক্সি করে, একজন অপরের হাত ধরে। শাহেদের মনটা ভরে যায় পাগলি বউয়ের এতো ভালোবাসায়!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত