মা মারা গেলেন বৃহস্পতিবার রাত একটায় । আজও বৃহস্পতির রাত । বাবার বিয়ে । মাঝ খানে ছয় বছরের গ্যাপ । মায়ের মৃত্যুতে কতটুকু কষ্ট পেয়েছিলাম আজ আর মনে নেই । তবে বাবার বিয়ে খুব কষ্ট দিচ্ছে । মনের আকাশ বিষাদে ছেয়ে গেছে ।
কিছুক্ষন পূর্বে বাবার ফোন,
: আবিদ , কি করো বাবা?
: বাবা , আমি ঠিক আছি। পড়তে বসবো । তুমি কি করো ?
: বাবা , আমি হেরে গিয়েছি।
এরপর কান্না । বাবা আর কোনো কথা বলতে পারছেন না । বাবার ফোন নিয়ে নিলো ছোটন।
: ভাইয়া , তুমি কেমন আছো?
: ভালো ,
: ভাইয়া , তুমি আসলে না কেন ? আমাদের বাসায় কত আনন্দ হচ্ছে ! বড় ফুফু আসছেন, ছোট ফুফু আসছেন । আপুরা আসছেন । ভাইয়া ,তুমি তাড়াতাড়ী আসো । আমরা কাল মাকে আনতে যাবো ।
আমি লাইন কেটে দিলাম । ছোটন তার মাকে আনতে যাক , আমি সারারাত কাঁদবো । আমার মায়ের জন্য কাঁদবো । এত দিন কান্না বাবাই করতেন । আমি খুব কম কেঁদেছি । আজ সবটাই পুষিয়ে নিবো ।
বৃহস্পতি বার সন্ধায় ক্লিনিক থেকে মায়ের সাথে বাসায় ফিরি । কাল ঈদ । রাত আর পেরোই না ।
ঈদের কেনা কাটাও বেশ হয়েছে । তবে মা যে বাজার গুলো করেন , এবার সেগুলো হয়নি । তিনি অসুস্থ । তিনি বলেছেন ,
: বাবা , সুস্থ হয়ে তোমাকে অনেক বাজার করে দিবো ।
আমার কেনাকাটার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই । আমাদের নতুন ভাইয়া হচ্ছে এতেই মহা খুশি । সবার ভাই বোন আছে। আমার নেই । আমার শুধু আমি একাই । ডাক্তার বলে দিয়েছে , আমার ভাই হবে । মা অনেক দিন আগেই বলেছেন। আমার সকল কল্পনার ভূমি ভাইয়া দখল করে নিয়েছে । পিচ্চিটা কেমন জানি হয় !
ঈদের সাত দিন পূর্বে মা ক্লিনিকে ভর্তি হলেন । মা ছিলেন ডাক্তার । মায়ের কলিগের ক্লিনিক । সিজারিয়ান অপারেশনে ছোটনের দুনিয়াতে আগমন । সে দিন কি যেন হয়েছিলো । জটিল কিছু হবে । বাবাও ডাক্তার । তাকেও পেরেশান দেখাচ্ছিলো । আমি ছোটনকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা । ছোট ছোট হাত পা । কি সুন্দর ! তবে গায়ের রং হয়েছে মায়ের মতো । কালো বা শ্যামলা । আমার বাবা ধবধবে ফর্শা । মায়ের রং চাপা । সবাই কালো বললেও বাবা বলতে নারাজ । বাবার সামনে মাকে কেউ কালো বললে তিনি ভীষন রাগ করতেন । বলতেন লিমার ভিতরের রং উপরের সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে ।
মা বলতেন , কালোকে কালো বললে সমস্যা কি ?
: না , কেনো কালো বলবে ?
: তোমার রুচি পঁচা বলে কি সবার রুচিই পঁচা ?
: আমার রুচি পঁচা তো পঁচা মানুষের সাথে থাকছো কেন ?
আমি পেয়েছি বাবার রং , ছোটন মায়ের । বাবা কত যে বলেন ,ছোটন হুবহু লিমার মত । বিশেষ করে রং আর ভ্রু ।
ঈদের আগের দিনেও ডাক্তারগণ মাকে ছুটি দিতে চাননি । অনেকটা রিস্ক নিয়ে বাবা মাকে বাসায় নিয়ে আসেন সন্ধায় । আমার খুব মনে আছে , আমি মায়ের পিঠের দিকে ছোটন মায়ের দুধ খাচ্ছে । মা আমাকে আদর করছেন । আর বলছেন , আবিদ তোমাকে আমি আগের চেয়েও বেশি আদর করবো । তুমি ছোটনকে আদর করবা । আমরা সবাই সবাইকে আদর করবো । কেউ যেন আদর কম না পায় ।
আমি রাতে ঘুমিয়েছিলাম নানুর সাথে । কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে । কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি । অনেকক্ষন পর বুঝতে পেরেছি মা মারা গেছেন । পরে বাবাকে বলতে শুনেছি , মায়ের মায়োকার্ডিয়াক হয়েছিলো । তীব্র ব্যাথার শেষ কথা ছিলো আমার সন্তান ,,
বাবা , মাকে কাঁধে নিয়েই হাসপাতাল ছোটে গিয়েছিলেন । কিন্তু মা ততক্ষনে আমাদের সবাইকে গুড বাই জানিয়ে দিয়েছেন ।
ঈদের দিনের সকাল কেটেছে লোক জনের ভিরে । বিশাল উৎসব । তবে আনন্দের নয় কান্নার । নানু ,মামা , চাচা , ফুফু সবাই কাঁদেন । কান্নার রোল । কাঁদেন না কেবল বাবা আর আমি । আমি বারবার মায়ের মুখে হাত রাখতে চাই । মুরুব্বিরা বাঁধা দেন । বলেন , তোমার মা ঘুমাচ্ছেন । ডিস্টার্ব করবে না । তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে ।
ঈদের জামাত বাবার সাথে আদায় করি । নামাজের পর মায়ের জানাযা হয় । এরপর কে যেনো আমাকে বাসায় নিয়ে আসে । আমি এতো টুকু জানি , মায়ের কি জানি একটি বড় সমস্যা হয়েছে । মা ঘুমিয়ে আছেন । ঘুম ভাঙ্গলে সমস্যা, তাই মাকে নিরব কোনো স্থানে রেখে আসা হয়েছে ।
আমি ধৈর্য সহকারে মায়ের জন্য অপেক্ষা করি । বাবা প্রায়ই কাঁদেন । নানুর কান্না রোগ পেয়ে বসেছে । সময় অসময়ে কাঁদেন । কখনও ছোটন আর আমাকে এক সাথে জড়িয়ে , কখনও একা নিরবে । বাসাটাকে আর বাসা মনে হয় না । কান্নার হাট মনে হয় । বাসার সামনে মায়ের যত্ন করে লাগানো ফুলের বাগানটাকেও দুঃখি মনে হয় । মনে হয় ফুল গুলোও কাঁদছে ।
সাত দিনের ছোটনকে দুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়ে বড় ফুফুর উপর । উনারও এক বাচ্চা ছিলো । ছোটনের চেয়ে অনেক বড় । কদিন যেতে না যেতেই কি জানি হলো , বাবা ছোটনকে ফুফুর দুধ খেতে দিলেন না । বাবা অদ্ভুত একটি কাজ করলেন । চারটি টেবিল ঘরি কিনলেন । রাতে সব কয়টাতে এলার্ম দিয়ে রাখেন । কিছুক্ষন পরপর এলার্ম বেজে উঠে , বাবাও উঠেন । ছোটনকে দুধ বানিয়ে খাওয়ান । আমি ছোট মানুষ । কখনও বাবার পাশে থেকে ঘুম ভাঙ্গে কখনও ঘুমেই চলে বাবার মাতৃত্বের ডিউটি । নানু রাগারাগী করেন । ছোটন আর আমাকে নানুর কাছে রাখতে চান । বাবা একদম রাজি না ।
: কেনো আমার কাছে দিবানা ? নানু বলেন ।
: মা , বাচ্চারা তাহলে আমার থাকবে না । আমি লিমাকে হারিয়েছি , এদেরকে হারাতে দিবো না ।
বাবার কাছে নানু হেরে যান । আমরা বাবার বাসায় বড় হতে থাকি । নানু রুটিন করে প্রতিদিন সকালে আমাদের বাসায় চলে আসেন , বিদায় নেন সন্ধার খানিক আগে ।
ছোটন খুব চঞ্চল হয়েছে । আমার সাথে তার সব খেলা । কখনও মায়ের কথা মনে করে না । কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে , মা বিদেশে চাকরী করছেন , সামনের মাসে চলে আসবেন । অনেক গুলো চকলেট আনবেন ।
বেশ কিছুদিন যাবত ফুফুরা বাবাকে বিয়ের কথা বলেন । বাবার এক কথা , কোনো অবস্থাতেই বিয়ে না ।
সম্ভবত ফুফুরা ছোটনকে ভালো করে বুঝিয়েছে । বাবা বাসায় আসার সাথে সাথে ছোটন শুরু করে , মা কবে আসবে ? মাকে এনে দাও ।
: আসবে বাবা আর কদিন পর ।
: না , কালই এনে দিতে হবে ।
: আচ্ছা , এনে দিবো ।
বিশেষ করে আমার কেডেট কলেজে এডমিশন হওয়ার পর ছোটন বেশি বিরক্ত করছে । অনেক বার আমার ইচ্ছে হয়েছে , ছোটনকে বলি ,মা মারা গেছেন । কেউ মারা গেলে আর আসেন না । বলতে পারি না । একদলা কান্না কন্ঠ রোধ করে দেয় । সব কথা বলতে পারি মা মার গিয়েছেন বলতে পারি না । মনে হয় মা মরার বিষয় না । মা তো আছেন আমাদের দুই ভায়ের রক্ত মাংসে । মায়ের রক্ত মাংস বাদ দিলে আমাদের দেহে আর কি বাকি থাকে ?
কাল ছোটনের মা আসবে । আসুক । আমার কলেজ আমাকে ছুটি দেয়নি । আমিও চাইনি । ছোটন মা পেয়ে মাকে হারাবে । আমি মাকে হারাতে চাই না । আজ সারারাত কাঁদবো । মায়ের মৃত্যুর দিন না বুঝার কারনে যে কান্না কাঁদতে পারিনি , আজ সব টুকু সুদ করবো । কখনও নিরবে । কখনো উচ্চ স্বরে । তবে কাউকে বলে নয় । কারন আমার মা চলে গেছেন কাউকে না বলেই । বলে কয়ে নয় ।
আজ থেকে ছোটন আর আমি বাবাকেও হারালাম । ছোটনের এদুনিয়াতে কেবল থাকলাম আমি । আজকের পর থেকে আমাকে বড় হতে হবে । ছোটন কে বড় করতে হবে । কান্না কেবল আজ রাতের জন্যই । কারন কান্না যে অরুদ্ধ হয় !