বাবাই, ও বাবাই!!” ডাক দিয়ে দৌড়ে বেলকনিতে চলে যায় মেহের। গভীর রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে চোখ খুলে বাবাইকেই খুঁজে মেহের। সবসময় যা দেখে বাবাই চায়ের মগ হাতে নিয়ে বেলকনিতে বসে থাকে। দুষ্টু মেয়ে মেহেরও তখন সুযোগ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে কোলে চড়ে বসে আর চা খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। যেমন চা পাগল বাবাই তেমন চা পাগল তার মেয়ে। বাবাই মেহেরকে কাধেঁ উঠিয়ে কিচেনে চলে যায়।কিচেনে “ফাইজান’স কিচেন” এরকম একটা বোর্ড টাঙানো। মেহের তার বাবাইকে বলে এনে লাগিয়েছে। মেহেরের মতে তার বাবা পৃথিবীর সেরাশেফ অার এটা একটা রেস্টুরেন্ট যেখানে প্রায়ই তারবাবাইর বন্ধুরা এসে খেয়ে যায়। অার বিল হিসেবে মেহেরের জন্য অসংখ্য চকলেট অার চিপস নিয়ে অাসে।
মেহেরের বাবাই চকলেট তেমন পছন্দ করেনা, এইব্যাপারে মেহের তার মায়ের মত হয়েছে। একদম নাকে মুখে লাগিয়ে চকলেট খেত বাচ্চাদের মত। দেখতেও ঠিক শায়লার মতই হয়েছে মেহের। একদম শান্ত অার ম্যাচিউর।অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে পাঁচ বছরের বাচ্চাকে কখনোইম্যাচিউর সার্টিফিকেট দেয়া যায়না। তবে মেহেরের বাপারটাই অালাদা। জগতেরই হয়তো নিয়ম মা মরামেয়েগুলো জন্মের পরই বুঝতে শিখে যায় যে অামি শিশু নই, অামার বাবাও এখন অামার সন্তান। কথা ছিল তিনজন মিলে সারা দেশ ঘুরতে বের হবে। কিন্তু শায়লা কথা রাখেনি। স্বার্থপরের মত চলে গিয়েছে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারেই। পাঁচ বছর হতেচলল। মেহের একদম জ্বালায়না ফাইজানকে। উল্টোমনে হয় যেন মেহেরই তাকে দেখাশোনা করে।চা বানানো শেষ ফাইজানের। বেলকনিতে অনেক ঠান্ডা তাই মেয়েকে নিয়ে রুমেই চলে গেল। টিভিতে রাত তিনটার খবর চলছে। উচ্চস্বরে চিৎকার করলো মেহের,
“বাবাই!!”
: সরি মা।
– অাবার তুমি চা বলে হরলিকস দিয়েছো।
: কালকে চা ই দিব, প্রমিস মা।
– নাহ অামি এক্ষুণি চা খাব।
: রাতে চা খেতে নেই।
– তুমি খাচ্ছো, সো অামিও খাব।
: অামি তো বড়।
– অামিও তোমার মত হবো।
: অাচ্ছা তুমি হরলিকস শেষ করো, চা অানছি।
ফাইজান অার তর্কে যায়না। মেহের বরাবরই মায়ের মতই জেদি হয়েছে। এখন চা বানিয়ে না দিলে সে সোফায়ইবসে থাকবে সারারাত অার ঘুমাবে না। শায়লার সাথেওকখনো তর্কে পারেনি এখন মেহেরের সাথেও পারেনা।অগত্যা হার মেনে চা বানাতে চলে যায় ফাইজান।হরলিকস খেতে খেতে টিভিতে খবর দেখছে মেহের।ফাইজান চা নিয়ে রুমে ডুকলে মেহের দৌড়ে গিয়েমগটা হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। অাগে পরীক্ষা করে নেয়বাবাই এবারও তো ঠকায়নি। নাহ চা দিয়েছে বাবাই, ইয়েয়েয়েয়ে।
: থ্যাংক ইউউউ বাবাই।
– ইউ অার ওয়েলকাম সুইটহার্ট।
: বাবা জানো খবরে বলেছে অামেরিকায় দাবানলেঅনেক মানুষ মারা গিয়েছে।
– হ্যা মা দেখেছি অামি।
: ওরাও কি মায়ের কাছে চলে যাবে বাবাই?
– চা শেষ করো।মেহের বুঝে মায়ের কথা বললে বাবাই কষ্ট পায় তাই সেঅার কথা বাড়ায় না।চায়ের কাপটা বাবাইর দিকে বাড়িয়ে দেয়,
: বাবাই।
– খাবেনা?
: শেষ তো।
– তাহলে?
: তোমার কাপ থেকে অারেকটু দাও।
– কিহ?
এবার চোখ লাল করে তাকায় ফাইজান। মেহের চুপচাপ উঠে তার কাপটা নিয়ে গিয়ে কিচেনে রেখে অাসে।এসেই অাবার বাবাইর কোলে চড়ে বসে মেহের। ফাইজান খুব মনোযোগ দিয়ে নিউজ দেখছে। তারচাচাতো বোরও অামেরিকায় থাকে। ফাইজানকেঅনেক অাদর করতো। তবে অনেকবছর যাবত যোগাযোগ নেই। কে জানি কেমন অাছে অাপুটা। “বাবাই, ও বাবাই, উঠো।” অতটুকু শরীর দিয়ে যতটুকু পারছে ধাক্কা দিচ্ছে মেহের। কিন্তু ফাইজানের কোন হুশই নেই । ঘুমালে একদম মরার মত ঘুমায়। অবশেষে উপায় না পেয়ে অন্য সোফার কুশন এনে মেঝেতে জমা করলো মেহে্র। তারপর শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বাবাইকে সোফা থেকে ফ্লোরে কুশনের উপর ফেলে দিল। ” ও মাাাা!!”
: এতক্ষণ ধরে ডাকছি, শুননা?
– এভাবে ফেলে দিলা, যদি কোমর ভেঙ্গে যেত?
: ভাঙ্গবে নাহ, নিচে নরম কুশন দেয়া অাছে।
– অাহারে অামার শার্লক হোমস রে।
: ওই কালো প্রজাপতির মলাটওয়ালা বইয়ের শার্লক হোমস?
– হ্যা সেটাই।
: অামাকে পড়ে শুনাবে?
– ডিটেক্টিভ বই তোমার মাথায় ডুকবে নাহ।
: আচ্ছা, টেবিলে নাস্তা দিয়েছি তাড়াতাড়ি অাসো!
– টেবিলে নাস্তা দিয়েছো মানে?
: দেখো অামার বয়স পাঁচ বছর অামি এখন সব পারি।
ফাইজান অবাক হয়ে বসে থাকে পুচকে মেয়ের কথা শুনে। তারপর দৌড়ে টেবিলের কাছে চলে যায়।টেবিলে একটা প্লেট রাখা। প্লেটে দু’পিস ব্রেড যার মধ্যখানে চিজ স্লাইস করে রাখা। ফাইজান সেটা দেখে হাসতে হাসতে চেয়ারে বসে পড়ে।
: এটা কি বানিয়েছো মেহের?
– এটা মেক্সিকান সেন্ডউইচ।
: হাহা মেক্সিকোতে বুঝি টমেটো ফলেনা?
– তুমি তো চাকু ধরতে নিষেধ করেছো অামি কিভাবে টমেটো দেই।
: খুব ভাল করেছো, চাকুতে হাত দিবানা কখনো।
– অাচ্ছা।
: সময় হলে অামি নিজেই শিখিয়ে দিব।
মেহের মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে চলে যায়। কেমন করে যে মেয়েটা প্রতিদিন ওর অাগে উঠে যায়। উঠে নিজের কাপড় চেঞ্জ করে, ঘরের সব পর্দা সরিয়ে দেয়। ফাইজান ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে ওমলেট বানায় করে অার দুধ গরম করে। দুজনে একসাথে টেবিলে বসে নাস্তা করছে,
: উমম ম্যাক্সিকান সেন্ডউইচটা দারুণ হয়েছে।
– বুঝতে হবে তো কে বানিয়েছে।
: কোথা থেকে শিখলে এটা?
– কেকা ফেরদোসির রেসিপি। ফাইজান অাৎকে উঠলো। ব্রেডটা দুবার হাতে নিয়ে দেখলো। নাহ ঠিকই অাছে এটা ব্রেডই, নুডুলস নাহ।
: এবার তাহলে কিচেনের নাম পাল্টাতে হচ্ছে!
– কি নাম দিবা বাবাই?
: মেহের’স কিচেন।
– নাহ তোমার রান্না বেশি ভাল তোমার নামই থাক।
: হাহাহা তাই?
– হুমম।
এই চলছে বাবা মেয়ের সংসার। মেহেরের মা মারা যাওয়ার পর অাত্মীয়স্বজন অনেক জোরাজুরি করেছিল ২য় বিয়ের জন্য কিন্তু ফাইজান রাজি হয়নি। কারণ সে জানে প্রথম প্রথম সৎমা মেহেরকে মেনে নিলেও পরে ঠিকই তার অাসল রৃপ দেখাবে। যা ৯৯ ভাগ ঘটনায় দেখেছে সে।
দুই ফ্ল্যাটের বাসা। এক ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অন্য ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। পাশাপাশি টুকটাক ব্যবসা করে। অনেক ভাল ভাল চাকরীর অফার পাওয়া সত্বেও নেয়নি কারণ সে মনে করে চাকরী মানে টাইম টু টাইম কারো গোলাম হয়ে যাওয়া। তার একটা মেয়ে অাছে যে অনেক ছোট। তাকে সময় দেয়া জরুরী। ফাইজান মনে করে অাজকালকার সমাজের ছেলেপেলেরা উচ্ছন্নেযাবার প্রধান কারণ হচ্ছে বাবা-মায়ের ব্যস্ততা, অবহেলা। ফাইজান সে বিষয়ে খুব সতর্ক। সবসময় চোখেচোখে রাখে তার কলিজার টুকরাকে। বাহিরে গেলে পাশের বাসার পিচ্চিটা এসে খেলা করে মেহেরের সাথে। মেহেরের বেস্ট ফ্রেন্ড তুলি। তুলি ক্লাস টু পড়ে।
পাড়াপ্রতিবেশিরা মেহেরকেও স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য বলে। কিন্তু ফাইজান একবাক্য না করে দেয়। এটুকু মেয়ের উপর গাদাগাদা বই চাপিয়ে দিতে চায় না সে। আগে বড় হোক, জীবনটা বুঝতে শিখুক। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার যা নমুনা। মেহের বাসায় বসেই অমন বাংলা-ইংলিশ ছড়া-কবিতা বলতে পারে। শরৎচন্দ্রের রচনাবলির কঠিন কঠিন শব্দ সে নির্ধিধায় বলতে পারে। ফাইজান একসময় প্রচুর বই পড়তো, গল্প-কবিতা লিখালিখি করতো। হয়তো বাবার সেই গুনটা মেহেরও পেয়েছে। ফাইজান সবসময় বাসায় ফেরার সময় খাবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে অাসে। তাও দুজনের জন্য। কারণ এই সময় তুলিও থাকে বাসায়। সে তুলিকেও নিজের মেয়ের মতই অাদর করে। ফাইজান বাসায় ঢুকার সাথে সাথে মেহের দৌড়ে গিয়ে প্যাকেটা হাত থেকে কেড়ে নেয়।
: অাজ কি এনেছো বাবাই?
– উটপাখির ডিমের কাটলেট।
: ওয়াও বিফ বার্গার, ঠ্যাংকু বাবাই।
মেহের কিচেন থেকে দুটো প্লেট অানে অার ফ্রিজ থেকে সসের বোতলটা নিয়ে ফ্লোরেই বসে পড়ে। অাগে তুলিকে দেয় তারপর নিজে নেয়। কারণ তারবাবাই বলেছে কিছু খেতে অাগে অাশেপাশের মানুষকে খাওয়াতে হয় তারপর নিজে খেতে হয়। দুজনেই খেতে শুরু করে। হঠাৎ কি মনে করে থেমে যায় মেহের। দৌড়ে রুমে চলে যায়,
: বাবা্, ওয়ান বাইট।
– নাহ মা অামার খিদে নেই।
: ওয়ান বাইট প্লিজ।
– অামি সিংগারা খেয়ে এসেছি।
: তুমি রোজ সিংগারা খাও অামার জন্য কোনদিন অাননা কেন।
– কারণ সিংগারা স্বাস্থ্যকর না।
: তুমি খাও সো অামিও খাব কারণ. . .
– কারণ তুমি অামার মত হতে চাও, তাইতো?
: হুহ, কাল অামার অার তুলির জন্য চারটা সিংগারা অানবা।
– অাচ্ছা অানবো।
: না ছয়টা অানবা ।
– ছয়টা কেন?
: কাল তুলির কাজিনও অাসবে।
– অাচ্ছা যাও অানবো।
ফাইজান শুয়ে থাকে অলস ভঙিতে। শায়লার না থাকাটা অনেক কষ্ট দেয়। বাপ মেয়ে ভালই অাছে কিন্তু শায়লার কি না গেলে হতনা? হয়তো অারেকটু ভাল থাকতাম অামরা। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ফাইজান। ঘুম থেকে উঠে দেখে বিকেল চারটা। নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছে করে। নিজের খিদে নেই বলে কি মাসুম বাচ্চাটারও খিদে নেই। সামনের রুমে গিয়ে দেখলো মেহের নেই। হয়তো পাশের বাসায় গিয়েছে, তার গলারঅাওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফাইজান তড়িঘড়ি ভাত তরকারি রান্না করে মেহেরকে অানতে যায়। দরজায় টোকা দিতেই ভাবি দরজা খুলে দিলেন,
: ভাবি, মেহের কোথায়?
– তুলির রুমে শুয়ে পড়েছে।
: ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ওকে খাওয়াতে মনে নেই।
– মেহেরকে তো তুলির সাথে খাইয়ে দিয়েছি।
: ভাবি শুধু শুধু অাপনাদের কষ্ট হলো।
– কি যে বলেন ভাই, অাপনার মেয়ে অার অামার মেয়ে অালাদা কি।
: ভাবি অামি ওকে নিয়ে যাই।
– অাচ্ছা।
ফাইজান মেহেরকে কোলে করে নিয়ে নিজেদের রুমে শুইয়ে দিল। টিভি ছাড়া সামনে, বলিউডের “শোলে” মুভিটা চলছে। অনেক পছন্দের একটা মুভি। তবে তার মুভি দেখায় মন নেই। শায়লার কথাই ঘুরে ফিরে মনে পড়ে,
: বাবাই তুমি কাদঁছো।
– তোমাকে না মাত্র বিছানায় রেখে অাসলাম?
: বিকালে ঘুমাতে ভাল লাগেনা।
– তাহলে ঘুমালে কেন?
– অান্টি জোর করে ঘুমাতে বললেন।
: কিছু খাবা?
– মেক্সিকান সেন্ডউইচ বানাই?
: কেকা ফেরদোসির রেসিপি? হাহা।
– টমেটো কেটে দাও।
মেয়ে একদম পাকা রাধুনির মত সেন্ডউইচ বানাচ্ছে।ফাইজান সেটা আড়চোখে দেখছে অার হাসছে। মেহের অাজ খুব খুশি কেননা তাদের বাসায় অাজ মেহমান অাসবে। মেহমান বলতে রাতে ডিনারে কবির ও তার স্ত্রী তানিয়াকে দাওয়াত করেছে ফাইজান। সেজন্য সকাল থেকে বিভিন্ন রকমের নাস্তা, রান্নাবান্না করে রেখেছে ফাইজান। মুরগীর মাংস, ডিম ভূনা, ডাল, চায়নিজ সবজি, অার সাদা পোলাও রান্না করেছে রাতের জন্য। অার নাস্তার জন্য অনেক রকমের খাবার। ফাইজান মেহেরকে হাল্কা নাস্তা করার জন্য বললে মেহেরও জানায় সে মেহমান আসলেই খাবে। সন্ধ্যায় টিভি দেখছে বাবা মেয়ে মিলে। কলিংবেলের অাওয়াজ, “অামি খুলবো, অামি খুলবো” বলেই ছুটে গেল মেহের।কবির অার তানিয়া এসেছে। মেহের তো তানিয়ারকোলেই চড়ে বসেছে। ওরা ভিতরে ঢুকে বসলো।
: অান্টি অামার জন্য কি এনেছো?
– তোমার প্রিয় চকলেট অার চিপস অনেকগুলা।
মেহের সেখানেই বসে খেতে শুরু করলো। তারপর তারা পরস্পর কুশল বিনিময় করলো। ফাইজান একে একে নাস্তার প্লেট এনে দিচ্ছে। মেহেরসেই যে তানিয়ার কোলে চড়ে বসেছে আর নামার নাম নেই। অাসলে মাতৃস্নেহ না পাওয়ার অভাব হয়তো সে এভাবেই পুষিয়ে নেয়। যা তিনি ছাড়া অার কেউ বুঝেননাহ। এত এত নাস্তা দেখে কবির ও তানিয়া দুজনেরই চোখ ছানাবড়া।
: শুধু শুধু এত কষ্ট করলে ফাইজান।
– কি বলো তানিয়া, কতদিন পর অাসলে তোমরা।
: তোমার ঝাল মাংসের তরকারির সুগন্ধটা পাগল করে দিচ্ছে।
– সবুরে মেওয়া ফলে।সবাই নাস্তা খেয়ে নিলো। মেহের তানিয়াকে নিয়েভিতরের রুমে চলে গেল তার পুতুল দেখাবে বলে। কবিরঅার ফাইজান বসে কথা বলছে,
: অার কতদিন এভাবে একা একা থাকবি?
– শায়লার স্মৃতি কখনোই অামাকে একা থাকতেদেয়না।
: তোকে বলে লাভ নেই শালা তুই ঘাউরা মজিদ।
– হাহা তাহলে বারবার এক কথা বলিস কেন।
দুই বন্ধু মিলে অনেকক্ষন আড্ডা দিলো। তারপর মেহের অার তানিয়া দুজনের প্রবেশ, “বাবাই অান্টি অামাকে এই ঘড়িটা উপহার দিয়েছেন,অামি কি রাখতে পারি?” বাবাইর অনুমতি লাগবেনা তুমি ওটা রাখতে পারো,তোমার ওপর অতটুকু অধিকার অামাদের অাছে’একথা বলে ফাইজানের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো তানিয়া। অনেক কথা বার্তা হলো। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা হতে চললো। তানিয়া উঠে খাবার বাড়তে চলে গেল। টেবিলে সবকিছু অানা হচ্ছে। মেহের তার ক্ষুদ্র দুটি হাতে সাহায্য করছে। সবাই একসাথে খেতে বসলো।
কবির ও তানিয়া খাওয়া শুরু করলো। তারা দুজনে লক্ষ্য করলো ফাইজান ও মেহের কিছুটা চুপ। সেটা দেখে তানিয়া জিজ্ঞেশ করলো, কি হয়েছে মেহের? মেহের উত্তর দিলো, বাবাই বলেছেন খাওয়া শুরু করার অাগে অামরা যা খেতে পারছি তার জন্য অাল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে হয়, সেটাই করলাম। এতটুকু মেয়ের এই অসীম বোধশক্তি অাশ্চর্য করে তাদেরকে। তানিয়া নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে মেহেরকে। কোথায় কে যেন নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই বসে অারাম করছে। চা বানানোর জন্য উঠে গেল তানিয়া। ফাইজান তানিয়াকে ঈশারা দিয়ে মেহেরকে চা দিতে বারণ করলো। মেহের চুপিচুপি তানিয়ার পিছুপিছু কিচেনে চলে গেল,
: অান্টি।
– কি মতলব?
: তুমিও কি বাবাইর মত চা বলে অামাকে হরলিকস দিবা?
– নাহ অামি হরলিকস বলেই হরলিকস দিব, হিহিহি।
: তোমার সাথে কথা বলবো না অার।
– ওমা এতো রাগ তোমার?
: হুহ।
– অাচ্ছা চা দিব, তবে বাবাইকে বলবা হরলিকস দিয়েছি।
: হেহেহে, অাচ্ছা বলবো।
চা খাচ্ছে সবাই মিলে। মেহেরও খাচ্ছে, বলতে গেলে সবার অাগেই খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। এইটুকুন মেয়ে এত গরম চা কিভাবে শরবতের মতো এতো তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলেছে সেটাই ভাবতে থাকে তানিয়া। ফাইজান কটমট চোখে তানিয়ার দিকে তাকায়, যেন বুঝাতে চায় “ওকে চা দিতে মানা করেছিলাম অামি” তানিয়া হঠাৎ বলে উঠে, মেহেরকে দিয়ে দাও অামার কাছে। ফাইজান উত্তর দেয়, মেহের যেতে চাইলে নিয়ে যাও, অামার অাপত্তি নেই। সবাই মেহেরের দিকে ঘুরে তাকালো। সে অনবরত ডান বাঁমে মাথা নাড়াচ্ছে ‘সে যাবে না’
: তুমি এখানে থেকে যাও অান্টি।
কবির অারও যোগ করে বললো, তাহলে অামি বেচেঁ যাই রেখে দাও। তানিয়া বললো, তাহলে তো ভালই হয়। এত মিস্টি একটা মেয়ে পাবো, সাথে বোনাস ব্র্যান্ড নিউ হান্ডসাম একটা হাজবেন্ড। সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আড্ডা শেষে এবার ঘুমাবার পালা। মেহের বায়না ধরলো সে তানিয়ার সাথে ঘুমাবে। ফাইজান অনেক মানা করা সত্বেও তানিয়া ও কবির তাকে তাদের রুমে নিয়ে গেল। মেহেরকে ছাড়া কখনো ঘুমায়নি ফাইজান। এপাশ-ওপাশ করে কিছুতেই ঘুম আসছিলো নাহ। ঠিক ১ ঘন্টা পর ফাইজান অনুভব করলো কম্বল নড়াচড়া করছে। একি ভূমিকম্প এলো নাতো। টেবিল লাইট জ্বালাতেই দেখলো বিছানার পাশেই দুই পাটি পোকাখাওয়া দাঁত বের করে দাড়িয়ে অাছে মেহের।
ফাইজান কম্বল উচিয়ে রাস্তা করে দিলো ভিতরে অাসার। মেহের একদম পোষা বিড়ালের মত সেটা অনুসরণ করে শুয়ে পড়লো। সকালে নাস্তা সেড়ে বিদায় নিলো কবির ও তানিয়া।যথারীতি তুলির সাথে ড্রয়িং করতে বসে পড়েছেমেহের। ফাইজানও তার কাজে বের হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিনই বিকেলে একই রকমের পোশাক পড়ে বাবা-মেয়ে মিলে হাটতে বের হয়। পাড়ার ভেতরই ঘন্টা দু’য়েক হাটাহাটি করে ওরা দুজন। অনেকেই এগিয়ে অাসে,মেহেরের গাল টিপে অাদর করে দেয়। প্রথম প্রথম কেউগাল টিপলে অনেক রাগ করতো মেহের।তারপর ফাইজান একদিন বুঝালো যে গাল টিপা মানে হচ্ছে “তুমি অনেক কিউট”! সেদিনের পর থেকে কেউ গাল টিপে দিলে অার রাগ করেনা না বরং খুশিই হয় মেহের। পাড়ার মুরুব্বি কমিশনার সাহেব ডাক দিলেন,
: মেহের কোথায় যাও?
– এইতো দাদু হাটতে যাই।
খানিকটা দূর যেতেই মানিক সাহেব ডাক দিলেন,বাপ কা বেটি, সিপাহী কা ঘোড়া। “এটার মানে কি চাচ্চু?” প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেহের।মানে হচ্ছে যেমন বাবা তেমন মেয়ে।উত্তর শুনে খুশিতে বাবার দিকে তাকায় মেহের।দোকানদার বাছিত মিয়াও তাদের অাসতে দেখেক্যাশ ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ায়,”মামুণি, তোমার চিপস।”মেহের বাবাইর দিকে তাকায়, বাবাই চোখের পলক ফেলে ঈশারা দিলে সে চিপসের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানায়। যদিও ফাইজান পরে চিপসের দাম দিয়ে দেয়।অার অানিস সাহেবের কথা তো বলেই লাভ নেই উনিপারলে মেহেরকে কোলে করে নিয়ে পালান। দেখাহলে তার মুখে একটাই কথা,ভাই অাপনার মেয়েটাকে দিয়ে দেন। পাড়ার সবাই অনেক অাদর করে মেহেরকে। তারা মনে করে মেহেরকে দেখলেই বুঝি তাদের মন ভাল হয়ে যায়। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই ঘরে ফিরে দুজন। পড়তে বসে,মেহেরও পড়ালেখা অনেক অাগ্রহী।
অাজকাল অনেক কাজ জমা হয়ে যাচ্ছে। পাশের বাসার ভাবিরা বাড়িতে গিয়েছে বেড়াতে। মেহেরকে বাসায় একা রেখে বের হতে পারছে না ফাইজান। কিন্তু দুপুর১২টার দিকে জরুরী ১টা কাজের জন্য বের হতেই হলো। ১ঘন্টার মধ্য বাসায় ফিরবে বলে এসেছে।কাজ প্রায় শেষ। বাসায় রওনা দিবে ঠিক এমন সময় ঠিক এমন সময় চাচী ফোন দিলেন। চাচা হার্ট এটাক করেছেন, উনাকে নিয়ে সিলেট যেতে হবে।
ফাইজান সাথে সাথে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে চাচাকে নিয়েসিলেট চলে গেল। দুপুর তিনটায় সিলেট পৌছে চাচাকেডাক্তার দেখানো হলো। এদিকে মেয়ের চিন্তায়অস্থির হয়ে অাছে ফাইজান। সে সিলেটে তারকাজিনদের হাসপাতালে রেখে গাড়ি নিয়ে বাসায়রওনা দিল। ৫ টার দিকে বাসায় এসে পৌছালো।কাদঁতে কাদঁতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। সোফায় শুয়ে অাছে মেহের। মুখ একদম শুকিয়ে অাছে। কান্না করেছে বুঝাই যাচ্ছে তার উপর সারাদিন ধরে কিছুই খায়নি। এতটা কষ্ট লাগছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য বাবা বলে মনে হচ্ছে তার। এতটুকুন মেয়ের সাথে কিভাবে এমন করতে পারলো। ফাইজান বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল। মেহেরকে ডেকে তুললো। “বাবা তুমি এসে পড়েছো” ফাইজান মেয়েকে বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো, মারে অামারে তুই মাফ করে দে। অাজ তোর মা বেচেঁ থাকলে তোকে না খাইয়ে রাখতো না। অামি বাবা নামের কলংক রে মা, অামাকে মাফ করে দে। তোর অনেক কষ্টে হয়েছে রে মা? অনেক খিদা লেগেছে?
: না বাবাই অামি ফ্রিজ থেকে জুস খেয়েছি,
বিস্কিটের টিনটা অনেক উপরে ছিল নাগাল পাইনি। এগুলো শুনে কষ্টে ফাইজানের বুক ফেটে যায়। চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। মেহের বলে, বাবা কান্না থামাও অামার খিদে লাগেনি। এইটুকু মেয়ে কি সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যে বলা শিখে গেছে। একদম শায়লার মত। শায়লাও কখনো ফাইজানের দ্বারা কষ্ট পেলে বুঝতে দিতোনা।
তাড়াতাড়ি খাবার বেড়ে দিলো ফাইজান। মেহের এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে নরম পরোটাটা পর্যন্ত ছিড়ে খেতে পারছেনা। ফাইজান পরোটা ছিড়ে মাংস দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে মেহেরকে। চোখের জল যে অাসার পর থেকে ঝরছে তো থামছেই নাহ। এই মাসুম বাচ্চাকে কষ্ট দেয়া অাল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। সে প্রতিজ্ঞা করে অার কখনো সে মেহেরকে একা রেখে কোথাও যাবেনা। যেখানে যাবে সাথে করে নিয়ে যাবে। একজনকে হারানোর শোক ৫ বছরেও ভূলতে পারেনি অারেকজনকে হারালে বেচেঁ থাকাটাই অসম্ভব। নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্য একটানা ৪ দিন না খেয়ে ছিলো ফাইজান। মেহেরের বয়স ছয় পেরিয়ে গেছে অনেক অাগেই। অাজ তার স্কুলের প্রথম দিন। নতুন ড্রেস, ব্যাগ সবকিছু রেডি করে বসে অাছে দুজন। ফাইজান মেহেরকে বুঝাচ্ছে,
: কারো সাথে ঝগড়া করবা নাহ, অার অনেক অনেক বন্ধু বানাবে।
– এটা চারবার বলেছো।
: অনেক টিফিন বানিয়ে দিয়েছি, সবার সাথে শেয়ার করে খাবে।
– এটা তিনবার।
: চুপ পাঁজি মেয়ে।
– হেহে না, অামি বাবাইর লক্ষী মেয়ে।
: হয়েছে পাকনি বুড়ি চলো।
ফাইজান মেহেরকে স্কুলের ভিতরে পৌছে দেয়। মেহের একদম ক্লাসে ঢুকা পর্যন্ত দাড়িয়েই ছিল ফাইজান। নতুন জীবন। মেয়েটাকে মানুষের মত মানুষ বানাতে পারলেই মৃত্যুর পর শায়লার সামনে মুখ তুলে দাড়াতে পারব। একটা শীতল বাতাস ছুয়ে যায় ফাইজানের সারা শরীর। বাতাসে শায়লার শরীরের সুঘ্রাণ পায় ফাইজান।