মাঝ দুপুরের করা রৌদ্রে দাঁড়িয়ে আছি ফ্লাইওভারের মধ্য খানে।শো শো করো তীব্র গতিতে ছুটে চলছে গাড়ি গুলো।কর্ম ব্যস্ততার মানুষ গুলোও নিশান হারিয়ে পারি দিচ্ছে যার যার কর্মে।পুরো শহর থেমে নেই।কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর।অসংখ্য লোকের ভিড়ে আমি এক অদম এই শহরের ফ্লাইওভারে দাঁড়ানো।আমার সাথে আজকে খাদিজার থাকার কথা ছিল।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস,খাদিজা আজ হাসপাতালের বেডে।গতকাল খাদিজা যখন সন্ধার সময় বাসায় ফিরতে যাচ্ছে,ঠিক তখনই খাদিজার গাড়ি এক্সিডেন্ট করে।যার ফলে খাদিজা আজ সদর হাসপাতালে। নিজেকে অনেক একা মনে হচ্ছে।অনেক করুণ অবস্থা খাদিজার। বাঁচার সম্ভাবনা অনেক কম।
ডাক্তাররা বলেছে, “বাঁচার সম্ভবনা নেই,তবুও বাকিটা অাল্লাহর হাতে।যদি ওনি চান বাঁচাতে পারেন। পাগল হারা হয়ে আমি খাদিজার পাশেছিলাম।খাদিজার জ্ঞান এখনো ফিরে নাই।ডাক্তাররা ১৪ ঘন্টার সময় দিয়েছে। যদি এর ভিতরে জ্ঞান ফিরে তাহলে খাদিজা বেঁচে যাবে।আর না ফিরলে, না ফেরার দেশে পারি জমাবে খাদিজা। ভাবতেই শরীলের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। তা কি করে হয়।খাদিজা যে কথা দিয়েছিল আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না।তাহলে আজ কেন ও আমায় একা ফেলে চলে যাচ্ছে। আমার মতো একটা বোবা ছেলেকে যে ও ভালোবেসেছে এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া।কথা না বলতে পারা আমি এক মানব।সমাজ থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব সকলই আমাকে অবজ্ঞা করে।কেউ আমার সাথে মিশতে চাই না।কথা বলতে চাই না। বন্ধুত্ব করতে চাই না।কারণ আমি যে বোবা,কথা না বলতে পারা একজন ছেলে।
ক্লাসের কোনো এক টেবিলে বসার জায়গা ছিল আমার।সেই টেবিলে শুধু আমি একাই বসতাম।আমার সাথে কেউ আর বসতে আসেও না এবং অাগ্রহও করেও না।নিকৃষ্ট একজন ছেলে আমি।কথা না বলতে পারা সমাজের চোখে ঘৃণিত একজন মানব।সেই দিন খাদিজা সর্বপ্রথম আমার সাথে টেবিলে বসেছিল। খাদিজা কে অনেকে আমারনামে বাজে মন্তব্য করলেও খাদিজা সেগুলোকে তুচ্ছ করে দিয়ে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছিল।একাকিত্ব দূর করারজন্য আমিও খাদিজার সাথে বন্ধুত্ব করে নিয়েছিলাম।এই বন্ধুত্ব থেকে এক সময় ভালোলাগা এবং ভালোবাসায় পরিণত হয়। মনের মাঝে তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।তবুও মুখ ফুটে খাদিজা কে ভালোবাসার কথা বলতে দ্বিধা বোধ করতাম।
খাদিজা কি আমাকে কখনো ভালোবাসবে।কেন বাসবে আমি তো কথা বলতে পারি না।বোবা একজন ছেলে।কেউ আমার সাথে মিশতে চাই না।খাদিজা আমাকে ভালোবাসবে না।এটাও সঠিক।তাই আর কখনো খাদিজা কে ভালোবাসার কথা বলে ওঠতে পারি নাই। নিজের প্রতি সবসময় একটা নিকৃষ্ট আচরণ থাকত।যে আমি কথা বলতে পারি না।কেউই আমার সাথে মিশে না।কেবল খাদিজাই মিশেছে। কখনো খাদিজা কে বলতে পারব কি না,যে আমি তাকে ভালোবাসি।সে দ্বিধায় কেটে দিন পার করে দিচ্ছি। কিন্তু সকল দ্বিধা দূর করে,কোনো এক পরন্ত বিকেলে,সূর্য ডুবে যাওয়ার আগ মুহুর্তে, চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশে,জনমানবহীন এক রাস্তায় আমার সামনে মুখ ফুটিয়ে খাদিজা বলে ফেলল,”আমি তোমাকে ভালোবাসি জুবায়ের” নিস্তব্ধ আমি,নিস্তব্ধ প্রকৃতি,নিস্তব্ধ আমার চোখের পলক। দৃষ্টি দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে ছিলাম কতক্ষন আমার জানা নেই।খাদিজার ডাকে আমার দৃষ্টি গুজলো তার দিকে।
আমি কিছু বলার আগেই খাদিজা ঝাপিয়ে পড়ল বুকে।আমার চোখের পানি পড়তেই মুখ ফিরিয়ে তাকালো আমার দিকে।করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাদিজা আমার এই না বলা উত্তর শুনার জন্য।সকল বাধা দূর করে হাতে কাগজ কলম নিয়ে লিখে ফেললাম “আই লাভ ইউ টু খাদিজা” এটা দেখার সাথে সাথেই আবারও ঝাপিয়ে পড়ল বুকে।সময় যেন শেষ হয় না,বেলা যেন যায় না,জনমানবহীন এই পথে যেন কোনো কিছুর শব্দ হয় না।হাঁটা শুরু করলাম গন্তব্যে। খাদিজাও আমাকে ভালোবাসে এটাও সবচেয়ে বড় পাওয়া। বোবা, কথা না বলা ছেলের প্রতিভালোবাসা আছে এটাই যেন অবাস্তব। তবুও যেন নিয়মের তাগিদে কিছু কিছু মানুষ তা করে থাকে সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর জন্য।বোবা,কথা না বলতেপারা লোক গুলোও মানুষ।এদের অবজ্ঞা করতে নেই।কাছে টেনে ভালোবাসে নিতে হয়।
সেই সময় থেকে শুরু করে এখনো খাদিজা আমাকে অনেক ভালোবাসে।কখনো তার মাঝে ভালোবাসার কমতি দেখি নাই। সবসময় আমার পাশে ছায়ার মতো থেকেছে খাদিজা।আমার সুখ-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় সকল সময় আমার পাশে ছিল।এই তো কালকে যখন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল,তখন খাদিজা একটা শাল নিয়ে এসেছিল।আমার গায়ে শালটা ঝড়িযে দিয়ে খাদিজা বলল,”বাহ্, এখন তো অলরেডি লেখকের মতো মনে হচ্ছে” আমি তখন খাদিজার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়েছিলাম।আর কাগজ কলমে লেখে দেখালাম,”প্রিয় মানুষদের ধন্যবাদ দিতে নেই,তাদের কে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়” সন্ধার আগ মুহুর্তে আমার কাছ থেকে বিদায় নেই খাদিজা।বাসায় যাওয়ার সময় ঘটল এক্সিডেন্ট।যার ফলে খাদিজা এখন হাসপাতালে।
খাদিজা হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায় আর আমি ফ্লাইওভারে।কারণ একটাই খাদিজা যদি এই ধরণীতে বেঁচে না থাকে তাহলে আমি কেন বেঁচে থাকব।দুজন বাঁচলে এক সাথে বাঁচব মরলেও এক সাথে মরব।সময় যখন পেরিয়ে যাচ্ছে খাদিজার জ্ঞান এখনো ফিরে নাই।তখন মনের মাঝে চিনচিন করে একটা ব্যথা অনুভব করতে থাকে।যেটা খাদিজা কে হারানোর ভয়।আমার মতো একটা ছেলেকে যে মেয়ে ভালোবাসতে পারে,সেই মেয়ে আমাকে ছেড়ে আজ চলে যাবে অজানা এক দেশে।তা কখনো হবে না।এক দিকে খাদিজা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করবে আর অন্যদিকে আমি এই বোবা ছেলে ফ্লাইওভার থেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করব।দুজনে এক সাথে পারি জমাব অজনা এক দেশে।যে দেশে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।সেই দেশে চলে যাব।
আমি পুরোপুরি ভাবে প্রস্তুত মারা যাওয়ার জন্য।ফ্লাইওভারের ওপরে আমি দাঁড়ানো। এক ঝাপ দিয়ে চলে যাব মৃত্যুকোলে।মাঝ দুপুরের এই কড়া রৌদ্রে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে।চিৎকার করে বলতে লাগলাম,”আমি আসছি খাদিজা আমি আসছি,দুজনে এক সাথে পারি জমাব না ফেরার দেশে” কিন্তু আমার চিৎকার তো কেউ শুনতে পাই না।বোবা ছেলের কথা তো দূরে যায় না। নিজের মাঝেই অনুভব করা যায়।চারপাশের মানুষতো শুনতে পাই না।শহরটার দিকে তাকিয়ে নিলাম একবার। টং করে একটা শব্দ হতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম।পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখলাম খাদিজার মেসেজ,”এই তুমি কোথাই,জলদি করে আস” আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে ডাক দিয়ে শুকরিয়া জানালাম।যে মহান আল্লাহ পাক আমার খাদিজা কে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।কিছুক্ষনের জন্য যেন সারা শহর নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সকল ভয় দূর করে মনের মাঝে আনন্দ আর উল্লাস নিয়ে দ্রুত ছুটে চললাম খাদিজার কাছে।রাস্তা থেকে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে সদর হাসপাতালে প্রবেশ করলাম।
খাদিজার রুমে প্রবেশ করে চোখ দুটো কে আর থামিয়ে রাখতে পারলাম না।খাদিজা আমাকে দেখা মাত্রই মুখে এক চিতলি হাসি দিয়ে হাতের ইসারায় আমার কাছে যাওয়ার জন্য ডাক দিল।কাছে যেতেই গোলাপ গুলো খাদিজার হাতে দিয়ে পরম সুখে কাঁদতে লাগলাম।এই কান্না হারিয়েও ফিরে পাওয়ার সুখের কান্না। খাদিজার হাতে আমার হাত রেখেই অন্য হাতে খাদিজার মাথা বুলাতে লাগলাম। কতটা কষ্টের পর সুখ পেলাম তা অফুরন্ত।ওপর ওলা যেন বাকি জীবন আমার পাশে খাদিজাকে রাখে সেই কামনা করি। এভাবেই যেন দুজন একে অপরের পাশে থাকতে পারি আর ওপর ওলা যেন আমাদের সব আশা পূরণ করে সেই কামনাই করি।