মেঘার সাথে আমার প্রথম দেখা আজ থেকে প্রায় ২ বছর আগে। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন প্রায় ডুবতে যাচ্ছে ঠিক এমন সময়ে ক্লাস শেষ করে বাসায় আসছিলাম। এমনিতেই সারাদিনের ক্লাসের চাপে প্রচন্ড টায়ার্ড। বাসে একটি সিট পেতেই বসে পরলাম। পাশে একটি মেয়ে বসেছিল। বাসের হেল্পার যখন ভাড়া নিতে আসল তখন আমি ভাড়া দিয়ে দিলাম। কিন্তু পাশের মেয়েটি বলল ভাড়া পরে নিতে। হেল্পার চলে গেলে মেয়েটি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল।
কথা-বার্তা থেকে বুঝলাম ওর কাছে কোন টাকা নেই। আমি সাধারণত অপরিচিত কারও সাথে যেচে পড়ে কথা কখনই বলি না। কিন্তু ফোন রাখার পর আমি ওকে বললাম যে ভাড়া নিয়ে কোন টেনশন না করতে। আমি দিয়ে দিব। সাথে সাথে ও আমার সাথে ঝগড়া করা শুরু করে দিল। কেন আমি তার ভাড়া দিব, আমার কি ঠেকা পড়েছে এই নিয়ে বিশাল প্যানপ্যানানি শুরু করল।
এমনিতেই খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই আর কোন কথা না বলে ওকে সরি বলে সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বোধ হয় হেল্পার এল এবং বিশাল জোড়ে চিল্লাচিল্লি করা শুরু করল। সামনের সিট থেকে উতসুক কয়েকজন উঠে এল এবং নানাকথা বলতে লাগল। পাশে তাকিয়ে দেখি প্রচন্ড শক্ত মেয়েটা লজ্জায় একেবারে চুপসে গিয়েছে। আমি আর কোন কথা না বলে হেল্পারকে ১০ টাকা দিয়ে দিলাম। সারা রাস্তায় ও আরেকবারও একটি কথাও বলল না। মনে মনে বললাম কি রকম দেমাগ মেয়ের! একটা ধন্যবাদও দিল না। দুনিয়া বড়ই আজীব। পরের স্টপিজে ও যখন নামতে নিল তখন হঠাত করেই বলল- আপনার মোবাইল নম্বরটা দিন। টাকা ফ্লেক্সি করে দিব। আমি তাকে আমার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে দিলাম। সেদিন রাতেই আমার মোবাইলে ১০ টাকা চলে আসল। টাকা পাওয়ার সাথে সাথে মনে মনে হেসে উঠলাম।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমি এক দিন একা হাটতে হাটতে বই মেলায় চলে এসেছি। চারদিকে অনেক তরুন-তরুনী। প্রত্যেকটা সেকেন্ডে আমার অনুভূতি তখন চেঞ্জ হচ্ছিল। একবার মনে হচ্ছিল একা এসে চরম বোরিং লাগছে। ফ্রেন্ডদের নিয়ে আসলে অনেক ভাল হত। আবার মনে হচ্ছিল একা এসে ঠিকই করেছি। আমার আবার পুরা পাগলা রোগ ধরেছে।
যেই দৃশ্যই দেখি কেন যেন মনে হয় এটাই আমি কিছুদিন আগে স্বপ্নে দেখেছি! হঠাত করে পকেটের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক নম্বর। ফোন টোন রিসিভ করতে এক-দম ইচ্ছে করছিল না। তাও করলাম। ওপাশ থেকে এক মেয়ে কন্ঠ প্রথমেই জিজ্ঞাস করল আমি ব্যস্ত কি না!! ফোন করলে মানুষ হাই হ্যালো এসব বলে। কিন্তু ব্যস্ত কি না এটা জিজ্ঞাস করতে এই প্রথম দেখলাম। আমার ইতস্তত দেখে ওপাশ থেকেই বলল যে ও ওই বাসের মেয়েটা। ওই ঘটনা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। যাই হোক, কিছুক্ষণ কথা হল। হঠাত করে ও বলল ও বইমেলায়। পুরাই টাস্কি খেয়ে গেলাম। তারপর ওকে আমার অবস্থানের কথা বললাম। ও সব কিছু জেনে আমাকে ৪ মিনিট বট-বৃক্ষের মত দাড়ায়ে থাকতে বলল। আমি তার আদেশ পালন করতে লাগলাম।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মনে হল আমার এই উসকো চেহারা দেখলে ও তো দৌড়ে পালাবে! তাও কথা যেহেতু দিয়েই ফেলেছি সেহেতু থাকতেই হয়। ও এসে উপস্থিত হয়েই আমার চেহারার করুণ অবস্থা নিয়ে প্রচন্ড বড় বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল। আরে বাপ, একজন আরেকজনের নামই জানি না তাতেই এত কিছু! আরও কথার মাঝখানে তার নাম পরিচয় নেওয়া হল। কথা থেকে বুঝলাম দুইজনই বই পাগল। সেখান থেকেই শুরু। কি এক অজানা বাধনে বাধা পড়লাম। না পারলাম বাধনটাকে কাটতে না পারলাম ভেঙ্গে ফেলতে।
প্রতিদিনই বই মেলায় আসা। মেলার সব বই নিয়েই আমাদের দীর্ঘ গবেষণা। কোন বইয়ে কি ভাল কি লেখলে আরও বেশি ভাল হত এসব নিয়ে আমাদের যুক্তি তর্কের কোন শেষ হত না। আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ আর ও ক্লাসিকেল বই বেশি পড়ত। এসব নিয়ে আমাদের যুক্তি আর ঝগড়া ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। ও যুক্তিতে হেরে গেলে যে কি প্রচন্ড মন খারাপ করত। ওর মন খারাপ করা দেখে আমিও ইচ্ছে করে ওর সাথের যুক্তিতে হেরে যেতাম। ও যে ঠিকই বুঝে নিত ওর কাছে হেরে যেতে আমার ভাল বই খারাপ লাগে না এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই!!
আমরা একই ভার্সিটিতে পড়তাম(ডিপার্টমেন্ট আলাদা)। আমাদের দুজনকে নিয়ে ফ্রেন্ড সার্কেলে প্রায় সব সময়ই আলোচনার ঝড় উঠত। ফ্রেন্ডগুলাও যে কি রকমের! আরেক জনের প্রেম সহ্য করতে পারে না। আড়ালে আবডালে কত কথা। অবশ্য আমরা এসব কথার নিকুচি করতাম। যত্ত সব আতেলগিরি!! আমরা আমাদের মতই সময় কাটাতাম। সময় পেলেই রিকশা করে ঘুরে বেড়ানো। রিকশা দিয়ে ঘুরাও যে চরম রোমান্টিক তা আমি মেঘার কাছে থেকেই প্রথম জেনেছি!
নাম মেঘা দেখেই ও মনে হয় বৃষ্টির জন্য পাগল। আমিও যে ভিজতে খুব অপছন্দ করি তাও না। তবে বৃষ্টি হলে মেঘার আর কোন কথা নেই। বৃষ্টিতে তার ভিজা লাগবেই। আর তার সঙ্গী হওয়া লাগে এই আমাকে। এই বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে কত ঝগড়া হয়েছে তার সাথে। একবার তো প্রায় রিলেশন ভেঙ্গে যাওয়ারই উপক্রম হয়েছিল!! সেবারের মধুর ঝগড়া শুরু হয়েছিল অনেক ছোট্ট একটা কারণে- একদিন সকাল থেকে প্রচন্ড মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিল। আমার সাত সকালের কঠিন ঘুম পাগলীটা। সেদিন আমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে কই কই কিভাবে ভিজবে তার দীর্ঘ বর্ণনা করতে লাগল। আমার প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগেছিল।
কিন্তু, এটা জানতে পারলে পাগলীটা মনে অনেক কষ্ট পাবে তাই আর কিছু না বলে পাগলীর সাথে প্রায় সারাদিনই বৃষ্টিতে ভিজলাম। ফলে যা হওয়ার তাই হল। বাসায় ফিরলাম ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি বাসায় প্রচণ্ড কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখি পাগলী বাসায় এসে হাজির। ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাসায় এসে হাজির। আমি কেন তাকে বলি নি আমার সেদিন ঠান্ডা লেগেছিল সেটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে লাগল। কেমনে কেমনে আমার আম্মুকেও পটিয়ে ফেলল! যদিও সে সেদিন বাসা থেকে অনেক খাবার রান্না করে নিয়ে আসল। খেতে যে কত অসাধারণ হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত আমার আম্মু যখন অন্য রুমে গেল সে তখন আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগল। কেন যেন তখন মনে হল জ্বর হয়ে তো অনেক ভালই হয়েছে।
তার সাথে আমার যত ঝগড়া হয় অন্য জুটির মধ্যে বোধ হয় এত ঝগড়া হয় না। উফফ!! বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা হলে কি নাম হবে, প্রথম বাচ্চা ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা নিয়ে কত ঝগড়া! কে কাকে বেশি ভালবাসে এসব নিয়ে ঝগড়ার কোন শেষ হয় না। ভালই লাগে এসব মধুর ঝগড়া গুলো।
আজকে আবার ভ্যালেন্টাইন ডে। বিশেষ দিন। এই দিনে সেজেগুজে ওই মহারানীর জন্য দশটা লাল গোলাপ কিনে নিয়ে যেতে হবে। একটা জিনিসই বুঝি না ভালবাসার জন্য আবার বিশেষ দিনের কি দরকার!! যত্তসব। তাও মহারাণীর হুকুম যখন মানতে তো হবেই।