আলসে দুপুর। বেলা সাড়ে বারোটা কে দুপুর ই তো বলে মনে হয়। কি জানি নাও বলতে পারে। আমার আবার দুনিয়া দারির সাথে বোঝা পড়া কম। আজ খুব সকালে উঠেছি। অবশ্য সকাল সাতটা খুব একটা সকাল না আর্লি রাইজারদের জন্য। কিন্তু আমার মত ঘুম কাতুরে মানুষের জন্য এটাই ভর সকাল। বিছানায় চিত হয়ে পরে আছি! এখনও বেশ ঘুম পাচ্ছে। প্রায় চোখ বন্ধ করি করি ভাব এমন সময় মা পেছন থেকে আমার কোমড় অবধি বেণী করা চুল উঁচু করে নাক শিটকে উঠলো। আমি প্রচন্ড আহত হলাম মায়ের এমন কান্ডে! এমন ভাব করছে যেন মাছ বাজারের মাছওয়ালা পঁচা মাছ মায়ের হাতে দিয়েছে, সেই গন্ধে মা নাক শিটকাচ্ছে! কটমট করে তাকিয়ে বললো ‘সেই যে রাতে বেণী করে দিয়েছিলাম তোকে, তারপর আর চুলে চিরুনি করিসনি?’।
আমি বেশ প্রসারিত মুখে বলে উঠলাম ‘না মা! দেখেছো তোমার করা বেণী কত শক্ত! ও মজবুত! এখন ঠিকঠাক আছে’। মায়ের হাতে খুন্তিও দেখছি। আমার এমন হেয়ালিপনা জবাবে মা আবার মারতে না শুরু করে। বেশ গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে বললো, ‘সারাদিন মরার মত পরে থাকিস কেন? দুই-চারটা কাজ ও তো করতে পারিস নাকি? ‘ এমন কথা আমার প্রতিদিনই শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই আবার ঘুমে মননিবেশ করতে যাব কি মা আবার চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বাহিরে যে মেঘ করেছে সেটা কি চোখে পড়ে নি?এক্ষুনি যা ছাদে, কাপড় তুলে নিয়ে আয়’
সাধারণত মেয়েরা খুব একটা কেয়ারলেস প্রকৃতির হয় না। কিন্তু আমি সেই লেভেলের কেয়ারলেস। কোন কাজ পারি না, কোন বিশেষ গুণও আমার নেই। সারাদিন পরে পরে ঘুমাই,রাতে একটু আধটু বই নিয়ে বসি, টিভি দেখি, গান শুনি, আবার রাতে ঘুমিয়ে পরি। সারাদিনে এই কয়টা কাজ ই করি। তাই টুকটাক কাজ করতেও আমার প্রচন্ড আলসেমি লাগে। সিঁড়ি গুনে গুনে ছাদে উঠছি। এই বৃ্ষ্টি ও আমার পছন্দ হয় না।এই সময় ছাদে না এসে চা খাওয়া মজাদার কাজ হত! কিংবা কানে ইয়ারফোন গুঁজে চিত হয়ে পরে দুই-তিন ঘন্টা আরামে ঘুম দেওয়া যেত। কিন্তু কপাল আমার ওতটাও ভাল নয়। ছাদে উঠেই মন ভাল হয়ে গেল, সমানুপাতিক হারে মেজাজ খারাপও হল। ছাদে রুপম ভাইয়া আছে। আমাকে দেখেই হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললো, ‘শুভ দুপুর, অনিমা! আজকের ওয়েদার টা দেখেছো কি চমৎকার ‘। মেজাজ টা আরো খারাপ হল। কেউ কি কাউকে দুপুরবেলা উইশ করে! এ নিশ্চয় আমাকে হেয় করে উইশ করেছে। কারণ সে ভাল করেই জানে আমি কি পরিমাণ ঘুমকাতুরে। আমি কোন জবাব না দিয়েই কাপড় গুলা নিয়ে সিঁড়ি না গুনেই বাসায় চলে আসলাম।
রাগে শরীর গজগজ করছে। এই ছেলের জন্যেই আমার ছোট্ট জীবনে বিশাল বড় বড় কষ্ট। আমি যেই পরিমাণে কেয়ারলেস, রুপম ভাইয়া ঠিক সেই পরিমাণের পারফেক্ট। তার চালচলন, কথাবার্তা, কাজকর্ম সব কিছুই পারফেক্ট। মেয়ে হিসেবে আমার রুম যতটা অগোছালো, ছেলে হিসেবে রুপম ভাইয়ার রুম ততটাই গোছালো। এক বার কেমিস্ট্রি এক্সামের আগে আমার বই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মায়ের বকা থেকে বাচার জন্য রুপম ভাইয়ার পুরানো বই নিয়ে এসে ছিলাম।বাসায় এসে আমি অবাক। পুরানো বই একদম নতুনের মত! বইয়ে যে আন্ডারলাইন করা হয়েছে দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্কেল দিয়ে মেপে মেপে লাইন টেনেছে। এই ছেলের সবকিছুই পারফেক্ট! জামাকাপড় কখনও দুমড়ানো-মোচড়ানো দেখি নি। একদম
ইস্ত্রি করা।পড়াশোনাতেও ফার্স্ট ক্লাস। ‘এমন ছেলে আজকাল হয় নাকি!
রুপম হ্যান করেছে, রুপম ত্যান করেছে, রুপম এই তো রুপম সেই ‘ এই সব নিয়ম করে আমার শুনতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার লম্বা লম্বা নখওয়ালা হাত দিয়ে ওনাকে গলা টিপে খুন করি। কিন্তু পারি না।কারণ সে আমার মনের মধ্যে অনেক আগে থেকেই চিরস্থায়ী বসতি গড়েছে। মাঝে মাঝে তাকে সেই পরিমাণে ভাল লাগে, মাঝে মাঝে আবার হত্যা করার সাধ জাগে! এই কারণেই তাকে দেখলে মন সমানুপাতিক হারে ভাল হয় আবার রাগও লাগে।
আজ একটু বেশিই গরম পড়েছে। এই গরমে একটা লাইন মনে পড়ছে বার বার “সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুঁড়ে! “। এই গরমে বেড়িয়েছিলাম বই কিনতে। কোন দুঃখে যে মায়ের সাথে রাগ করে নিজেই এসেছিলাম, এখন গরমে জান যায় যায় অবস্থা। হাত ভর্তি বই। গরমে ঠান্ডা কিছু খেতে মন চাচ্ছে। সোজা বাজারের ভেতর ঢুকে গেলাম আইসক্রিম খাওয়ার জন্যে। এই গরমে একটা ছাতার ও অভাব বোধ করছি। কেউ যদি এখন ছাতা মেলে ধরতো। আহারে! গরমে আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। একটু সামনে এগুতেই রুপম ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। আহা! অতিব চমৎকার!
তাহলে ইনি আজকাল বাজার ও করে। আমার কপালে ভাঁজ পড়ল।এই মুহূর্তে আমার এই ছেলের প্রতি প্রেম-মহব্বত কিছুই আসছে না। বরং গরমে শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। আরেকটু তাকে দেখলেই আমি রাস্তায় ধপাস করে পড়ে যাব। তাই আইসক্রিম কিনতে দোকানে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু সমস্যা হল আইসক্রিম কিনি কিভাবে, আর কিনলেও খাব কিভাবে? বই একগাদা। আমার এই মুহূর্তে খুবই রাগ হচ্ছে। রিক্সা ডেকে বাসায় যাওয়া দরকার।
– আরে অনিমা, বাজারে কি করছো?
– লুকোচুরি খেলছি, খেলবেন?
আমি আজকাল তাকে সোজাসাপ্টা উত্তর না দিয়ে, ত্যানা পেঁচিয়ে উত্তর দেই।এতেই শান্তি।
– তোমার বেশ গরম লাগছে। বুঝেছি।
– বেশ করেছেন।
– আইসক্রিম খাবে? চল খাওয়াই।
হঠাৎ ই প্রেম-মহব্বত ফিরে আসতে শুরু করল। এই গরমে আমার সত্যিই আইসক্রিম চাই। অবশ্য তাকেও চাই! হায়া-লজ্জা সব ভুলে বলে উঠলাম,
– তো বই গুলো ধরেন।নাহলে খাবো কি করে?
– আচ্ছা, আগে কিনে আনি।
বেকারি তে বসে আছি। ফ্যানের নিচে। ঠান্ডা বাতাস, আইসক্রিম। কলিজা জুড়ানো শান্তি। বেকারিতে বসে আইসক্রিম খাওয়ার চিন্তাটা মাথায় আগে আসলেই এখন রুপম ভাইয়ার সাথে বসতে হতো না। কিন্তু গরমে মাথা বোধহয় আমার কাজ করছিল না। রুপম ভাইয়া একটু পরপর ই আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে! অদ্ভুত ব্যাপার। কিছু কি বলতে চায়? আমি কি জিজ্ঞেস করে দেখবো? না থাক কি দরকার। এই ছেলেকে ভাল লাগে বললে বড় পাপ হবে! একে আমি ভালবাসি! সিরিয়াস টাইপের ভালবাসা। একদম ‘তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই! আর কিছু জীবনে পাই বা না পাই! ‘ এই টাইপের ভালবাসা। মাঝে মাঝে খুব হতাশ হই, আমি জানি যে আমাকে উনি কখনই ভালবাসবে না।তার আর আমার আকাশপাতাল তফাৎ। কিছুতেই কিছু মেলে না। ঠিক কবে থেকে ভালবাসি! আমি জানি না।জানার চেষ্টাও করি নি, এবং তাকে জানানোর চেষ্টাও করি নি। এই ছেলে ফিজিক্সের সব ল মুখস্থ রাখতে জানে, কেমিস্ট্রির বিক্রিয়া মুখে মুখেই করে দিতে জানে! শুধু আমার বেলায় নাবুঝ। আমি প্রেম-ভালবাসাতেও জিরো! এই ছোট্ট জীবনে আমার দ্বারা কিছুই হবে বলে
মনে হয় না।
– বুঝলে অনিমা, এই গরমে নিয়ম করে আইসক্রিম খাওয়া দরকার।
– তাই নাকি? তো খান।
– একা খেয়ে মজা নেই।
– তাহলে খাবেন না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, গেলাম।
এই ছেলের সাথে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।আমার জন্যেই বিপদজনক। কোন সময় যেন টপ করে ভালবাসি বলে ফেলি! আমার আবার হায়া-লজ্জাও কম। বলতে কতক্ষণ!
– তুমি চাইলে আমরা এক রিক্সায় বাসায় যেতে পারি!
– আমি তো তা চাই না।
– আমার তো মনে হচ্ছে চাও।
– না
– বেশ! আমি চাই, তাই এখন এক রিক্সায় যাব।
এই ছেলে দেখছি বেশ পাকনা! আমি আসলেই কি চাই? কত কিছুই তো চাই! কিন্তু এই মুহূর্তে এইখান থেকে পালাতে চাই। আজ রুপম ভাইয়ার মতিগতি ঠিক লাগছে না।কোন সময় যেন চট করে ধরে ফেলবে আমার মনের কথা। তাই উল্টা পায়ে হাটা দেওয়াই শ্রেয়।
– এই অনিমা, কই যাও?
উত্তর দেওয়া যাবে না! পালাতে হবে।খুব দ্রুত হাটছিলাম, হঠাৎ পেছন থেকে রুপম ভাইয়া সামনে এসে খট করে আমার হাত ধরে ফেললো! কি বেহায়া ছেলে! রাস্তাঘাটে কেউ হাত ধরে নাকি? হাতের বই গুলিও পরে গেল। শরীর আমার কাঁপছে।
– কি সমস্যা? একসাথে যাব বললাম না? আমি রিক্সা ডাকতে গিয়েছিলাম। তুমি কই পালাচ্ছো?
– পালাচ্ছি না।আমি আমার মত যাব। আপনি একা যান।
বেশ একটা হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকাল।যেন সব বুঝে গেছে। হাত টা ছেঁড়ে দিয়ে সব বই তুলে নিল।
– আমি কিন্তু বইয়ের বাইরেও অনেক ভাষা বুঝি।
– হুঁ, ভাল।
– তুমি আসলেই লুকোচুরি খেলছো, নিজের সাথেও এবং আমার সাথেও।
ছেলে এসব কি বলছে! আমার বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যাচ্ছে। এতো দেখছি অনেক কিছুই বোঝে!
– ভালবাসতে পারো অথচ স্বীকার করবে না! তা কি হয়? আমার কারণে
তোমার বকা শুনতে হয় তাই স্বীকার করতে চাও না? শুনো তুমি যেমন আমি তেমন টাই তোমাকে ভালবাসি, চুল বাঁধতে ইচ্ছা করে না? আমি আজীবন বেঁধে দিব! এই গরমে ছাতা হয়ে পাশে থাকব,শুধু গরমে কেন? আজীবন নাম্বার ওয়ান ছাতা হয়ে পাশে থাকব, কি নিবে না পাশে?
– রিক্সা ডাকেন রুপম সাহেব! রাস্তাঘাটে প্রেম করতে নেই। উত্তর না হয় পরেই শুনলেন!
সুন্দর একটা হাসি দিয়ে আমার নাম্বার ওয়ান ছাতা রিক্সা খুঁজতে গেল।রোদ যেন আরো বাড়ছে। বাড়লে বাড়ুক! প্রটেকশন পেয়ে গেছি। আজীবনের প্রটেকশন।