এই যে আম্মু যাও তো তাড়াতাড়ি তোমার সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ীটা পরে আসো তো। সে বেশ অবাক হলো। কিছুক্ষণ আগে ঝগড়া করে গিয়েছি বলেই অবাক হচ্ছে। আমার কথা না শোনার ভান করে সে টেবিল মুছতে শুরু করল। মানে সহজে সে যাবে না। আমি চেয়ারে বসে বললাম- এই যে মিসেস নীরা বেগম ওরফে ইকলির আম্মু কথা শুনছেন না আপনি? আম্মা এরপরও কোন কথা বলল না তবে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। টেবিল মুছতে মুছতে অভিমানী হয়ে আম্মা জিজ্ঞাস করল- কেন কি হইছে?
— কিছু হয়নি। যা বলেছি তাই করেন। যান তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসেন।
— কেন সেটা বলবি তো?
এই মুহূর্তে সুন্দর করে একটা মিথ্যা বলতে হবে নইলে তিনি যাবেন না। ইকলির ইউনিভার্সিটি আজ বন্ধ। সে তার বন্ধুদের সাথে নিউমার্কেটে গেছে। একমাত্র ইকলির ইউনিভার্সিটির কথাই বলা যায়।
— ইকলির ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। আপনাকে নাকি ইকলির ডিপার্টমেন্ট হেড দেখা করতে বলছে। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন।
— আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল- কৈ লিসা তো আমাকে কিছু বলল না।
— হঠাৎ আমাকে ডাকলেন কেন?
— সব গার্ডিয়ানদের ডেকেছে।
— ঐ শাড়ীটাই কেন? অন্য কোন টা পড়ি?
— নাহ, ওটাই পরে আসো।
আম্মা কিছুক্ষণের মধ্যে রেডি হয়ে এলো। চুলো থেকে পানির পাতিল নামিয়ে, আমাকে বের হবার জন্য তাড়া দিতে শুরু করল। কিন্তু একটা সমস্যা আছে, আম্মা তাড়াহুড়ো করে রেডি হতে গিয়ে কানের দুল পরতে ভুলে গেছে। আম্মাকে দাঁড়াতে বলে ড্রেসিন-টেবিল থেকে বেগুনি রঙের দুল-জোড়া নিয়ে আসলাম। আম্মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার সামনে গিয়ে বললাম- এই যে দুলজোড়া যে পড়নি সেই খেয়াল আছে? আম্মা হাসতে হাসতে বলল, পাগল ছেলে। দে পড়িয়ে দে। আমি দুল পড়িয়ে দিলাম। দরজা তালা মেরে মা-ছেলে মিলে বের হয়ে পরলাম।
ইকলি আমার ছোট-বোন। পুরো নাম ইশরাত কবির লিসা। আমি আদর করে ইকলি বলে ডাকি। অনেক দিন হলো তিনজন মিলে ঘোরা হয় না না। গতকাল রাত থেকেই ইচ্ছা হচ্ছিলো তিনজন মিলে কোথাও বের হই। ব্যবসায়ের কর্ম-ব্যস্ততায় কোথাও সময় করে বের হওয়া হয় না। সকাল সকাল দোকানের হিসাব-নিকাশ কর্মচারীদের বুঝিয়ে দিয়ে আম্মাকে নিয়ে বের হয়েছি। তিনি এখনও জানেন না আমরা ইকলির ইউনিভার্সিটিতে না, যাচ্ছি বলাকা সিনেমা হলে।
আম্মাকে দাঁড় করিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করলাম। আম্মাকে রিক্সায় বসিয়ে একটু দূরে গিয়ে ইকলিকে ফোন করে বললাম- দুপুর আড়াইটার মধ্যে বলাকা সিনেমা হলের সামনে চলে আসতে।
কথা শেষ করে রিক্সায় উঠে বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করল। আম্মা সচরাচর বাসা থেকে বের হন না। আব্বা বেঁচে থাকতে আমাদেরকে নিয়ে প্রায়ই রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াতেন। আমি থাকতাম রিক্সার উপরের সীটে, ইকলি আব্বার কোলে। ইকলির হয়তো সেসব কিছু মনে নেই। মনে থাকার কথাও না, তখন ওর বয়স খুবই কম। আব্বা আমাদেরকে নিয়ে বলাকায় যেতেন, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক আরও কত যায়গায় ঘুরে বেড়াতেন সেসব এখন কেবলই স্মৃতি।
বলাকার সামনে এসে রিক্সা থেকে নামতেই দেখা গেল ইকলি দাঁড়িয়ে আছে। আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিরে ইকলির ইউনিভার্সিটিতে না যাওয়ার কথা! আমি হাসতে হাসতে বললাম মিথ্যা বলেছি ম্যাডাম। আইস্ক্রিম খাবেন? আম্মা কিছুটা রাগ হয়ে বলল, নাহ বাচ্চা-ছেলেদের খাবার খাই না। তুই আমাকে মিথ্যা বললি কেন?
— সত্যি বললে তো আসতে না তাই মিথ্যা বলেছি। ইকলি তুই আম্মার সাথে থাক আমি টিকিট কেটে আনি।
— আচ্ছা। ভাইয়া পপকর্ন এনো।
টিকিট কেটে পপকর্ন নিয়ে তিনজন মিলে হলে ঢুকে গেলাম। কতদিন পর সিনেমা দেখতে এলাম। সিনেমা হলে না এলে বোঝাই যায় না, সিনেমা কি জিনিস। সিনেমা দেখে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আমরা তিনজন মিলে গেলাম রবীন্দ্র সরোবরে। এখানে প্রায়ই কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকে। আজও হচ্ছে। মঞ্চ নাটক হচ্ছে। নাটকের প্রতি বিশেষ নজর আমাদের তিনজনের একজনেরও নেই। কিছুক্ষণ আগেই সিনেমা দেখে এলাম সেজন্যেই বোধহয় ভাল লাগছে না।
আমরা গিয়ে বসলাম ফুচকার দোকানে। তিনপ্লেট ফুচকার অর্ডার দিলাম। আম্মা বলছে সে খাবে না। এইসব বাচ্চা-ছেলেদের খাবার তার ভাল লাগে না। মূল কথা আসলে সেটা না, সে বাইরের খাবার বিশেষ পছন্দ করে না।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট ছেলে ফুচকা দিয়ে গেল। আমাদের দেখা দেখি আম্মাও খেতে শুরু করল। ফুচকা শেষ করে তিনজনের জন্য আইস্ক্রিম কিনে ব্যাচেলর পয়েন্টের দিকে হাটতে শুরু করলাম। ইকলিটা ভীষণ পাজি হয়েছে। পাশ দিয়ে কোন সুন্দরী মেয়েকে হেটে যেতে দেখলেই আম্মাকে বলছে- আম্মু দেখো তো তোমার ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ হয় কি না। শুধু আম্মাকেই বলছে না, আমাকেউ গুতো দিচ্ছে। ইকলিটা কি যে দুষ্ট হয়েছে। আম্মাও তাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। দুজন মিলে মুচকি মুচকি হাসছে।
ব্যাচেলর পয়েন্ট থেকে রিক্সা নিয়ে স্টার হোটেলে এসে নামলাম। বাসায় গিয়ে এতো রাতে রান্না বারার ঝামেলার কি দরকার। এই অভ্যাস আমি হয়তো আব্বার কাছ থেকে পেয়েছি। আব্বা যেদিনই আমাদের নিয়ে বের হতো, ফিরতে রাত হলে বাইরে থেকে খাইয়ে নিয়ে যেত। হোটেল থেকে বিরিয়ানি খেয়ে ওয়ারী পর্যন্ত রিক্সা ঠিক করলাম। আমি উঠলাম রিক্সার উপরের সিটে, আম্মা আমার নিচে। সবকিছু আগেরই মতন শুধু একজন মানুষ কম, আব্বা।
রিক্সা চলতে শুরু করেছে। আম্মা কোন কথা বলছে না। ইকলি বার বার বলছে ভাইয়া দেখ তো ঐ মেয়েটাকে পছন্দ হয় কিনা? দেখ তো? সুন্দর কিন্তু! ইকলির কথায় আম্মা কোন কর্ণপাত করছে না। আমি আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম- আব্বাকে খুব মনে পরছে তাই না? আম্মা সম্ভবত নিজের অজান্তেই কাঁদছিলেন, আমি জিজ্ঞাস করতেই আমার দু-হাত ধরে বললেন- ইকলি কিন্তু ঠিকই বলছে, তোর কিন্তু এবার একটা বিয়ে করা দরকার। আম্মা যে কিছু লুকোনোর চেষ্টা করলেন, আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না। হয়তো বাড়ি ফিরে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত থেমে থেমে সে আব্বাকে স্মরণ করবে। তার দুচোখ ভিজে যাবে জলে। কিছু স্মৃতির জল, কিছু ভালোবাসার জলে মাখামাখি হয়ে একাকার হয়ে যাবে।
— ইকলির সাথে তুমিও লেগেছ?
— বয়স তো আর কম হলো না। বিয়ে-শাদী কিছু করতে হবে না? নাতি-পুতি দেখতে দিবি না? ইকলি আম্মার সাথে সাথেই বলে উঠল- ভাতিজা-ভাতিজী দেখতে দিবে না? মারা-মারি করব না আমরা?
— খুব মারা-মারি করার সখ না?
— হ্যাঁ ভাইয়া, সত্যি বলছ। বিয়েটা করবা কবে?
আমার কেমন যেন লজ্জা লাগে। বিয়ের কথা উঠলেই ভীষণ লজ্জা লাগে, বিয়ে জিনিস টাকি লজ্জার কোন বিষয়?
আম্মা আবারও বলল- সহজ-সরল একটা বৌ আনতে হবে। ইকলি বলল- ঠিক ঠিক, আমার সহজ-সরল মনের ভাইয়ার জন্যে সহজ-সরল একটা ভাবী লাগবে।
— তুই যে চালাক। তোর সাথে থেকে থেকে তোর সহজ-সরল ভাবীও চালাক হয়ে যাবে।
ইকলি অভিমানের সুরে বলল- হলে হবে। আমার ভাবী আমার সাথে থেকে থেকে চালাক হবে, তাতে তোমার কি? আম্মা হাসল। অনেকক্ষণ হাসল। কি মধুর সেই হাসি। অকৃত্রিম সুখে মনটা ভরে গেল বিয়েটা মনে হচ্ছে এবার করেই ফেলতে হবে। বাড়ি ফিরে ইকলি এসে আবারও জ্বালাতে শুরু করল। আম্মা বাসায় এসেই নিজের ঘরে চলে গেছে। জামা-কাপড় বদলে আম্মাকে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। ইকলিকে বলে এসেছি চা বানিয়ে নিয়ে আসতে। আম্মার কাধে হাত রেখে হাটছি। আম্মা কোন কথা বলছে না। ছাদে না এলে হয়তো এতোক্ষণে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে ফেলত। আম্মাকে রাগাতে শুরু করলাম-
— আম্মা তোমাদের এখন একটা কাজের মেয়ে লাগবে তাইনা?
— সেকি কথা রে?
— মা-মেয়ে মিলে যা শুরু করেছ, তা কি বুঝি না আমি?
— তুই বেশি বেশি বুঝিস।
— বুঝি বুঝি! রান্না করতে কষ্ট হয় তোমার।
— আমি কি তাই বলেছি?
— বল নি বোঝাচ্ছ।
আম্মা কাঁধ থেকে আমার হাত সড়িয়ে দিল। আমি আবারও হাত রাখলাম। আম্মা বিরক্ত হলো, বিরক্ত হয়ে হাত সড়িয়ে দিয়ে বলল- থাক থাক ঢং দেখাতে হবে না। আমি আবারও হাত রেখে বললাম- আহ রাগ কর কেন? দুষ্টুমি করছিলাম। মেয়ে দেখ। আম্মার বিশ্বাস হলো না। অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করল- সত্যি বলছিস?
–জ্বী সত্যিই বলছি।
ইকলি চা নিয়ে ছাদে এসে প্রথমেই বলল- কি ব্যাপার মা-ছেলে মিলে বিয়ের কথা-বার্তা চলছে নাকি? আমার কেন যেন রাগ লাগে। আমি রেগে বললাম- তুই আছিস এক বিয়ে নিয়ে। বিয়ে ছাড়া কি আর কিছু দেখিস না? ঐ দেখ আকাশে কি সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। কতগুলা তারা উঠেছে ওসব দেখ। ইকলি আমার কথা শুনে মনে হলো খুব আনন্দ পেয়েছে। সে হাসতে হাসতে বলল- ‘চাঁদ-তারা তো সবসময়ই দেখি, এইবার ভাবীকে দেখব।’ আমার কেমন যেন লজ্জা লাগে। চায়ের কাপ হাতে ছাদের এক কোণে গিয়ে বসলাম। ইকলি আম্মার কাছে কিছু শুনে লাফাতে শুরু করল। আমার কেন যেন খুব লজ্জা লাগতে শুরু করল।