এমন রক্ত দেওয়া শরীরে রাত জাগতে পারবে না। তুমি বরং বাসায় যাও।’ হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বলে গেলেন কথাগুলো তনু’র মা। সৌজন্যতা না দায়িত্ববোধ? বুঝবার চেষ্টা করলাম না। শুনলাম, মৃদু একটা হাসি দিয়ে বুঝাতে চাইলাম-‘আমি ঠিক আছি’।
ঘুমের ইনজেকশনকে টেক্কা দিয়ে এই মাঝরাতে জাগবার শক্তিটুকু তনুর নেই, তাই আয়েশেই সামান্য দূরত্বে থাকা চেয়ারটায় ঝিমিয়ে নেওয়া যায় নিজেকে। মেয়ের পায়ের দিকটায় সামান্য জায়গাটুকুতে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন তাহমিনা বেগম। মেঝেতে কিছু পড়বার শব্দে জাগলাম, ঘড়িটায় ৪.১০ তখন। মাথার পাশের টেবিলে রাখা গ্লাসটা নিতে গিয়ে ফেলে দিয়েছে তনু। ‘পানি খাবেন?’ মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর জানালো। হাত দুটো একখানে করে নিজের বুকটা ঢাকবার চেষ্টা করলো মূহুর্তেই। চাঁদরটা শরীরের ওপর দিয়ে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলাম। ‘বোতলটা মুখে ধরলে খেতে পারবেন?’ ‘হুম।’নিজে থেকে উঠে বসবার চেষ্টা করলো কিছুটা, পারলো না। ভয় থেকেই মাথার নীচটায় হাত দিয়ে বসানোর চেষ্টা করলাম, বাঁধা দিলো না; হয়তো বাঁধা দেওয়ার শক্তি নেই বলে। দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে তৃষ্ণা নিবারণের জানান ছিল স্পষ্টশব্দে। ‘ঘুম দিন।’
মাথা এদিক-ওদিক ঝাঁকিয়ে না করলো তনু। কথা বাড়ালাম না। বালিশটা পিঠের পেছনে দিতেই হেলান দিলো আয়েশভাবেই। ‘এখানে নিয়ে এসেছে কে?’ অস্ফুট জিজ্ঞাসা তনুর। চোখের নীচটা ফুলে গেছে এক রাতেই, কেমন যেন কালচে বর্ণ হয়েছে। ‘আপনার মা আর আমি।’ ‘অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে বা নামিয়েছে কে?’ প্রশ্নের কারণ বুঝতে অসুবিধা হলো না। উত্তর না দিয়ে মেঝেতে গ্লাসের টুকরোগুলো একত্র করায় মন দিলাম। ‘বললেন না?’ ‘ওমন অবস্থায় কেউ নারী থাকে না, রোগী থাকে; আর ওমন অবস্থায় কেউ পুরুষও থাকে না, সেবক হয়। কথা বন্ধ করে ঘুমান এখন।’
কথা বাড়ালো না তনু, আমিও চাইছিলাম না কথা বাড়ুক। উঠতি মেয়েদের সমস্যাই এমন, সারাদিন হাফ প্যান্ট পড়ে বেড়াবে তাতে সমস্যা নেই, দেখলেই ভাষণ দিবে ‘বাড়িতে মা-বোন নেই’? সেই রাত গত হয়েছে আজ চারদিন হলো। হাতের ব্যান্ডেজগুলো এখনো থাকলেও সুস্থই বলা যায় তনুকে। এ কয়েকদিনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ওর সামনে না দাঁড়াতে। কখনোও সামনে পরলেও জরুরী ফোন কলের বিজ্ঞাপন জানিয়ে ফোনটা কানে দিয়ে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করতে করতে পাশ কেটেছি। ‘আপনি কি আমাকে ঘৃণা করে কথা বলেন না?’ দোতলার সিঁড়িতে পা রাখতেই প্রশ্নটা কানে আসলো। ‘না। কেন এমন মনে হলো?’ ‘আপনার পাশ কাটিয়ে চলাতেই মনে হলো।’ দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালাম, অনেকটা সামনাসামনি।
‘দেখুন, নতুন কোন ক্লাশে উঠলে সেই ক্লাশের পড়াগুলো খুব কঠিন মনেহয়; অথচ ঐ ক্লাশ পেরিয়ে গেলে ছোট কেউ এসে যদি বলে ‘এই অংকটা করে দিবেন?’ তখন আমরা বলি-‘এত সোজা অংক পারো না?’ জীবন এমনটাই।’
‘কি বুঝালেন?’ ‘কিছুই না।’ কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না আর। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি ভাঙতে এগুলাম। ‘সেদিন শরীরে হাত দিছিলেন, এজন্য একবার সরি বলবেন সময় করে। তাহলে সেদিনের উপকারের জন্য একটা ধন্যবাদ দিতে পারি।’পেছন থেকে তনুর কথায় হাসি আটকাতে পারলাম না। ভাড়ায় আছি বাসাটাতে। বাড়ির মালিক বিদেশে, মা-মেয়েই শুধু নীচতলায়। কি ভেবে ভাড়া দিয়েছে আমাকে তা এখনোও ভাবায়, হয়তো পাশের ব্যাংকে চাকরী; তাই। কথা হতো না তেমন, সেদিনের আগে।
সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় মহিলা দেবদাস হওয়ার আশায় হাতে কয়েক জায়গায় ব্লেড চালিয়েছিলো। পরিণতি, কিছু রক্তক্ষরণ আর ক্ষত। যে থাকবার সে থাকবেই, যে যাবার সে কখনোই থাকবে না; এটাই ভুলে যায় মানুষ। সময়ের নিয়মেই সময় অতিবাহিত হলো। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে প্রায় বছর। চাকুরীর নিয়মেই বদলির আদেশটাও হাতে পেলাম। অনেকটা দূর, দূরত্ব বোঝাতে দুই শহর পেরিয়ে। সকালে বেরুবার সময়ই তাহমিনা বেগমকে জানালাম বদলির কথাটা। বাড়ির মালিকদের একটু অতিপ্রাকৃত হতে হয়, হয়তো সেজন্যই কোন পরিবর্তন উনার মাঝে পেলাম না। শেষদিনের অফিস, কাজের চাপ না থাকলেও বিদায়ের মনভাঙ্গার আওয়াজ সামলানোর চাপটা বেশ সামলাতে হলো। শারীরিক ক্লান্তির চেয়েও মানসিক ক্লান্তিই ধ্বস নামালো নিজের মাঝটায়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রুমে আসলাম। পোশাক বদল ঝামেলা মনে হওয়ায় বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। ‘আসবো?’ কন্ঠটায় চমকালাম। তনু। কাপ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে। ‘আসুন।’ বিছানা থেকে সরে গিয়ে বসবার জায়গা করে দিলাম তনুকে। হাতে ধরা কাপটা এগিয়ে দিলো। আপনি আমাকে ভালোবাসেন?’ তনুর কথার আকস্মিকতা সামলাতে সময় নিলাম একটু। কাপটা টেবিলে রেখে সামনের সোফায় বসলাম। ‘না। কেন মনে হলো?’ ‘আমি অনেক খোলামেলা পোশাকে থাকি সবসময়। আপনার সামনে পরলেও আপনার চোখে শারীরিক লোভ দেখিনি।’
‘এতে কীভাবে প্রমাণ হয় ভালোবাসি?’ ‘কেউ কাউকে ভালোবাসলে তার খোলা শরীরেও লোভ আসেনা। ভালো না বাসলে শরীরকে নিয়ে লোভ জাগে।’কথায় জড়ালাম না ইচ্ছে করেই। টেবিলে রাখা কাপটা হাতে নিয়ে চলে গেলো তনু। চলে যাওয়া পথটায় চেয়ে রইলাম কিছুটা সময়, কথাগুলো মনে করে।’আর একটা কথা।’হঠাতই দরজায় তনু। চলে যাওয়া পথটায় তাকিয়ে থাকায় কিছুটা চোখাচোখিই হতে হলো। ‘বলুন।’ ‘আপনি যে আমাকে ভালোবাসেন তা প্রমাণ করলেন আবার।”কীভাবে?”এতক্ষণ বসে থাকলেও আপনি আমার দিকে তাকালেন না, চলে যাওয়ার পর পথের দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা সাহসের অভাব, আর ভালোবাসলে সাহসের অভাব হয়।’
পিক-আপে সামান্য আসবাব তুলে বিদায় নেওয়ার জন্য তাহমিনা বেগমের রুমে আসলাম। ভদ্রতার খাতিরে যতটুকু না বললেই নয়, ওতটুকু দু’জনই বললাম। বাড়ির গেটটাতেই তনুর দেখা। ভাড়াটিয়ার জন্য বেশি দরদ কারো মাঝেই থাকে না, তনুরও নেই। ‘সময় পেলে আসবেন, চা খেতে।’ খাবারের তালিকার সংক্ষিপ্তায়ণ শুনে হাসিই পেলো। ‘নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন, তাহলে পৃথিবীও আপনাকে ভালোবাসবে।’ ‘সারা পৃথিবী ভালো না বাসলেও দুঃখ নেই, ভালোবাসার মতো একজন বাসলেই হবে।’ গেট পেরিয়েও পেছন ফিরলাম না। ফিরলেই নতুন কোন দর্শণ বার্তা আওড়ানো শুরু করবে তনু, এই ভয়ে। নতুন অফিসে খাপ খাওয়াতে সময় লাগলো না একটুও, থাকবার জায়গাটায় ইচ্ছে করেই খাপ খাওয়াতে চাইলাম না।
প্রায় দু’সপ্তাহ পর তনুর নম্বর থেকে ফোন আসলো, দুপুরে বিরতীতে। ‘পার্লারে যাওয়া পছন্দ করেন আপনি?’ প্রথম কথাটা এমন আসবে তা ভাবনাতেই ছিলো না। কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিলাম-‘না’। ‘কেন?’ ‘পার্লারে যে মেয়েরা যায় তারা সারাজীবন মেয়েই থাকতে চায়, মহিলা হতে চায় না; এ জন্যই।’ কল বিচ্ছিন্ন হওয়াটা স্পষ্টই বুঝলাম, শুধু বুঝলাম না খারাপ লাগার মতো কিছু বলেছি কি না? মাঝে মাঝেই এমন ক্ষুদ্র সময়ের কথন হতো তনুর সাথে। এখন শুধু ওর ফোনের আশাতেই থাকিনা, নিজেও ফোন দিতে শিখেছি। ওর ছেলেমানুষী গুলো নিজের মাঝে এখন কিছুটা হলেও মানসী আকার পেতে চাইছে, তা বেশ বুঝতেছি। অনেকটা সময় পেরুলে মনেহয় ‘ফোন দিচ্ছে না কেন’?
মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা পেরিয়েও কাজ গুছিয়ে নিতে পারছি না মোটেই। চেয়ারটায় হেলান দিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করে চলেছি বারংবার। বুকপকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো, বিরক্তি নিয়েই ধরলাম। ‘তনু কি তোমার কাছে গেছে?’ তাহমিনা বেগমের এমন প্রশ্নে চমকালাম। ‘না। কেন?’ ‘খুব সকালে তোমার কথা বলে বেড়িয়েছে, এখনোও নেই। ফোন দিলেও ধরছে না।’ ফোন দিয়েই চললাম, ধরলো না। কাজের অবশিষ্ট বিরক্তি আর ফোন না ধরার বিরক্তি মিলিয়ে মেজাজ হারালাম মূহুর্তেই। অফিস থেকে বেরিয়ে ফোন দিতেই রিসিভ করলো তনু। ‘কোথায় আপনি?’ আশপাশের শব্দগুলো ভেসে আসছে ফোনে। উত্তর দিলো না কথার। ‘কোথায় আপনি এখন?’ ‘ভালোবাসেন আমাকে?’ ‘না। আগে বলুন কোথায় আপনি?’ ‘তাহলে শুনে কোন কাজ নেই।’
কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। ফোন দিলাম আবার, সুইচড অফ।অফিসের সামনের রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে, শরীর থেমে যাচ্ছে ক্রমশই। ফোন এখনোও সুইচড অফ। ‘স্যার যাইবেন?’পাশে দাঁড়ালো রিকশাচালকের আহ্বানও মেজাজ খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে না জানালাম।হাটাপথেই এগুলাম বাসার দিকে, দূরত্বও হাটা পথেরই। গরম না থাকলেও ঘেমেই চলেছি অবিরাম। তাহমিনা বেগমকে ফোন দিয়েও জানিয়েছি সবটুকুই, তনুর ফোন সুইচড অফ বলেই চলেছে অনবরত।
রুমের দরজাটা খুলতে যাওয়ার সময় আচমকা মেয়ে কণ্ঠে চমকালাম। ‘আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। পরিচয় নেই, তাই চিনবেন না।’ ‘ওহ, আচ্ছা। ধন্যবাদ।”আপনি যে বিয়ে করেছেন, তা তো বলেন নি ভাই।’রুমে এক পা দিয়েও আটকালাম কথাটায়। তাকালাম, কিছু বলার আগেই বললেন-‘ভাবী এসেছেন, আমাদের রুমে বসে আছেন। তনু ভাবী।’তনুকে নিয়ে রুমে আসলাম। কথা বলবার সামান্য রুচিও নেই। তাহমিনা বেগমকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম-‘আসতেছি আমরা’।
অফিসের এক সহকর্মীকে জানিয়ে বাসের টিকিট কনফার্ম করলাম। আরোও অনেকটা দেরী হবে বাসের।
‘ভালোবাসেন আমাকে?’ তনুর এমন কথায় নিজেকে সামলাতে কষ্ট হলো অনেক। ‘না।”ভালো না বাসলে আমার জন্য এত অস্থির হলেন কেন?”জানি না।’ ‘জানি না কথাটা সহমতের বহিঃপ্রকাশ।’ আপনি-তুমিতে মিশিয়ে সে রাতে তনুকে বাসায় পৌঁছালাম ভোর রাতে। বলিনি একবারও ‘ভালোবাসি’, তবে বুঝিয়েছি হাজারবার ‘ভালোবাসি’।