পূজা আমার ঘড়িটা কোথায়?
— টেবিলের ওপর আছে ( রান্নাঘর থেকে বলছে)
—- কই পাচ্ছি না তো।
—- আমার হাতে অনেক কাজ। আর ভাল করে দেখ পাবা।
— উফফ্ বাবা আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, এদিকে আসো না প্লিজ ।
— আচ্ছা আসছি।
— পাগলীটার আগমন হলো। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, কপালে লেগে আছে ময়দার আচড় আর কাপড়ের এক প্রান্ত গুজে রেখেছে কোমড়ের সাথে। বোঝায় যাচ্ছে তিনি এখন ভেরি ব্যস্ত আছেন। তবে এই বেশে তাকে বেশ গিন্নি গিন্নি লাগছে।
—এই নাও তোমার ঘড়ি (পূজা)
—ধন্যবাদ।
— একটা কিছুও তো তুমি খুজে পাওনা, চোখ কী হাঁটুতে নিয়ে ঘুরো?
— না তো, চোখ তো আমি মাথার পিছনে নিয়ে ঘুরি।
—- হুমম তাই হবে। আমি একটা জিনিস বুঝিনা।
—- কী বোঝনা!!!
—- তোমার মতন একটা আকর্মাকে কেন কোম্পানি রেখেছে আর মাসের পর মাস ফাও বেতন দেয়।
—- কী বললে তুমি, আমি অকর্মা!! আমার আপন বউ হয়ে তুমি এটা বলতে পারলে? ভাল, আমি অফিস যাচ্ছি, বাই।
—- ওইই কই যাও? আমি এত কষ্ট করে তোমার জন্য টিফিন তৈরি করলাম আর তুমি না নিয়েই চলে যাবা, না?
—- হুহ আমার টিফিন লাগবেনা। আর আমি তো অকর্মা তাই কাল থেকে আমার জন্য তোমার আর টিফিন তৈরি করা লাগবেনা।
— ওলে বাবা লে, আমাল বাবুটা রাগ করেছে বুঝি?
—- কিসের বাবু হুমম? আমি কারো বাবু টাবু হই না, বাই।
—- ওকে ফাইন, তুমি টিফিন না নিয়ে যাও, আমিও আজকে খাচ্ছি না।
—- (কি মসিবত, ভালবেসে বিয়ে করার মজাটা টের পাচ্ছি এখন) ওকে দাও।
— হুমম নাও, নাও, নাও না।
— উফফ এভাবে হাত ঘুরিয়ে ওপর নিচে করলে কীভাবে নেব?
—– তুমি তো জানো কি করলে নিতে পারবা।
—- হুমম, আর কথা না বাড়িয়ে পূজার কপালে একটা উম্মাহ দিয়ে টিফিনটা নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পাগলী মেয়ে একটা, আমার রাগী মুখটা নাকি ওর খুব পছন্দের।তাই বলে সময় অসময় না ভেবে আমাকে রাগতে হবে? তবে আমাকে কতটা ভালবাসে সেটা তো আপনারাই বুঝতে পারছেন।
— এই যে মামা চায়না বাংলার সামনে যাবা? (আমি)
—- হ যামু, তয় ভাড়াটা কিন্তুুু একটু বেশি দেওন লাগবো মামা (রিক্সাওয়ালা)
—- কেন?
—- প্রেস কিলাবের সামনে কিসের যেন আন্দোলন হচ্ছে তাই অন্য পাশ দিয়ে ঘুরে যেতে হবে।
— একে তো দেরি হয়ে গেছে, তার পরে আবার ঝামেলা। আচ্ছা চলো।
রিকশা চলছে তার আপন গতিতে। ও আপনাদের তো এখনও আমার পরিচয় দেওয়া হয়নি। আমি শুভ। সাতক্ষীরায় একটা কোম্পানীতে জব করি। বেতন ভালোই। বাবা মা আর ভাই গ্রামেই থাকে। আমি আর আমার স্ত্রী পূজা সাতক্ষীরার মুন্সিপাড়ায় একটা ফ্লাট নিয়েই থাকি।
— মামু আইসা পড়ছি।
—- ও আচ্ছা এই নেও ভাড়াটা।
—- মামু আর পাঁচটা টাকা ধইরা দেন।
—- যেটা চেয়েছিলে সেটাই তো দিয়েছি, তাহলে আবার পাঁচ টাকা কেন?
—- মামু পোলাটা স্কুলে গেছে। অনেকেদিন ধইরা কয়, আব্বা মাংস ভাত খাইমু, প্রতিদিন এই ডাইল ভাত ভালা লাগেনা তাই ভাবলাম আজকে একটু মাংস ভাত কিইনা টিফিন দিলে পোলাডারে নিজে হাতে গালে তুইলা মাংস ভাত খাওয়াইয়া দিয়া আসমু।তাই বেশি ভাড়া চাইলাম। থাক মামু দেওন লাগবো না।
—-( ছেলের প্রতি বাবার এই অকৃত্রিম ভালবাসার কথা শুনে খুশিতে দু’চোখ ভিজে গেল) মামা আমার টিফিনে খাশির মাংস আছে। নিয়ে যাও শুধু তোমার পোলা না, তোমরা দুজনেই খেতে পারবা, আর এই নাও ১০০ টাকা, যাওয়ার সময় ভাবীর জন্য কিনে নিয়ে যাবা।
— না মামা এইডা আপনার খাওন, এইডা আমি নিতে পারুম না।
—- আরে ব্যাটা নাও তো ( জোর করে ধরিয়ে দিয়ে আসলাম)।
—- মামা আপনি কত ভালা, আল্লাহ আপনার ভালা করবে মামা। &আর দেরী না করে অফিসে প্রবেশ করলাম।
—- কী শুভ সাহেব আজ এত দেরীতে আসলেন যে। বস এসেছিল, আপনাকে দেখেনি, আর আপনাকে বস দেখা করে আসতে বলেছে। ( কলিগ)
—- ধন্যবাদ, শফিক ভাই। আর কথা না বাড়িয়ে বসের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
— মে আই কাম ইন স্যার?
—- ইয়েস কাম
—- কেমন আছেন স্যার?
—- ভাল, তুমি?
— ভাল।
—- আজ এত দেরী করে আসলে, কোন সমস্যা?
—- না স্যার, আসলে রাস্তায় একটু জ্যাম ছিল তাই…
—- ও আচ্ছা, এই ফাইল গুলো নিয়ে যাও আর কালকের মধ্যে কম্পিলিট করে দেবে। ওকে
— ওকে স্যার।
স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসলাম। কালকের মধ্যে ফাইল কম্পিলিট করতে হবে তাই, ফাইলের কাজে মন দিলাম। কিম্তুু কেন জানিনা কাজে মন বসছে না। মন বারবার ফিরে যাচ্ছে অতীতের স্মৃতির গহীনে। %পূজার সাথে আমার চার বছরের রিলেশন, তারপর বিয়ে। যদিও ওর পরিবার থেকে আমার সাথে ওর বিয়েটা দিতে চাচ্ছিল না,কারনটা নাকি আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ও কোম্পানির চাকরি করি বলে। আর কেনই বা দিতে চাইবে? ওর মতন সুন্দরী মেয়ে আমার চেয়ে ভাল ছেলে ডিজার্ভ করে।
তবে অবশেষে ওর পাগলামির কারণে বাধ্য হয়ে ওর সাথে আমার বিয়েটা দেয়। ওর সাথে আমার পরিচয় যখন আমি অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। যখন আমি ফরম ফিল আপের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতাম ও চুরি করে আমার ফরম ফিলাপের টাকা আমার পকেটে দিয়ে দিত। আজকাল বয়ফ্রেন্ড গফকে গিফট না দিতে পরলে ব্রেকআপ ও হয়ে যায়। মেয়েটা কখনও আমর কাছে কোন গিফট চায়নি বরং আমি দিতে গেলে বলত ঃ এখন কেন শুধু শুধু এসব কিনে টাকা নষ্ট করলে,তোমার সামনে কত টাকার প্রয়োজন। আমি না বললে আর গিফট কিনবা না। সময় হলে আমিই তোমার থেকে গিফট চেয়ে নেব। আর হ্যা, তখন কিন্তুু না বললে হবেনা হুমম। পাগলী মেয়েটা সময়ের ব্যবধানে আমার থেকে ঠিকই গিফট চেয়ে নিয়েছিল। গিফট হিসেবে নাকি তার আমাকেই চায়। হা হা হা আপনারাই বলেন আমি কি কোন পন্য? ধ্যান মগ্ন হয়ে যখন স্মৃতির পাতার প্রতিটি বর্নাক্ষরে আবদ্ধ ছিলাম,ঠিক তখনই ফোনের কম্পনে স্মৃতির ঘোর কাটলো। পূজা ফোন দিয়েছে ঃ
— হ্যালো(পূজা)
—- হুমম বলো
—- এখানে কি শুভ সাহেব আছে?
—- না, এখানে শুভ নামের কেউ নেই, আমি পূজা আপুর husband বলছি।
—- হি হি হি আপুর husband? এলিয়েন নাকি আপনি?
—- যদি তাই মনে হয় তাহলে তাই। এখন কি বলবেন বলেন।
—- হুহ, লাঞ্চের যে টাইম হয়েছে সে খেয়াল কী আছে?
—- হুম, করেছি। তুমি করেছো?
— আজ এত তারাতারি লাঞ্চ করলে যে, আর তুমি না খেলে বা তোমার আগে আমি কখনও খেয়েছি?
— না তো, আচ্ছা খেয়ে নাও।
—- ওকে ভাইয়া অফিস শেষ হলে তারাতারি বাসায় আইসেন।
—- ওকে আপু।
অফিসের কাজ শেষে তারাতারি বাসায় ফিরলাম। শরীরটা বেশ ক্লান্ত। রাতের খাবারের পর পূজা বায়না ধরল ছাদে যাবে। কি আর করা বাধ্য হয় ছাদে নিয়ে গেলাম। মেয়েটাকে সব সময় হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করি। কারণ ও যে কতটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে সেটা আমি জানি। একটা মেয়ে কখনও মা হতে পারবে না , কেউ তাকে মা বলে ডাকবে না, কাউকে সে বাবু বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেনা, আপনারাই বলেন এটা কী কোন মেয়ের জন্য কম কষ্টের? যেদিন ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছিল ও শুনেই সেন্স লেস হয়ে গিয়েছিল। পরে কয়েকবার আত্নহত্যা করতেও গিয়েছিল কিন্তুু ভাগ্য আমার সাথে ছিল বলে হয়ত পারিনি। তা না হলে হয়ত আমিই নিঃস্ব হয়ে যেতাম। এখন আমার ভালবাসায় ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পূজাকে পাশে নিয়ে ছাদে বসে আছি। দুজনেরি চোখ ঐ উজ্জ্বল চঁাদটির দিকে। হটাৎ পূজা প্রশ্ন করলঃ
—- দুপুরে খাওনি তুমি?
—- (হটাৎ এমন প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলাম) হ্যা খেয়েছি (মিথ্যে বললাম)
—- তাহলে টিফিন বক্স কোথায়?
—- (আর মিথ্যে বললাম না। পূজাকে রিকশাওয়ালার ছেলের গল্পটা বললাম)
—-( পূজা আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে) বাচ্চার কথা শুনলেই সে কান্না শুরু করে দেয় কারণ মা না হওয়ার বেদনা যে তাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।চাপা স্বরে বলল, আমি অনেক পাপী, তুমি আমাকে শেষ করে ফেল।
—- (পূজাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন ভাষায় আমার জানা নেই, কারন আমিও তো দিনের পর দিন একই যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি। তারপরও বললাম) তুমি কী আমাকে নিয়ে হ্যাপী না?
—- এমন কেন বলছো?
—- তাহলে এটা নিয়ে আর কখনও কাঁদবা না, আর কাঁদলে আমি নিজেকে৷ শেষ করে দেবো।
—- তোমার পায়ে ধরি এমনটা বলো না।
—- ভালোবাসা মানে কারোর দূর্বলতাকে ইস্যু বানিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া নয়, ভালবাসা মানে কাছের মানুষটির দূর্বলতা জেনেও তার চোখে চোখ রেখে, তার মুখে হাসি ফুটিয়ে সারাটা জীবন পার করা। শর্ত কখনও ভালবাসার অংশ হতে পারেনা, শর্ত হলো ব্যবসায়িক চুক্তির অংশ। ভাল তো সকলেই বাসতে পারে কিন্তুু ভালবেসে কতজনই বা তাকে ধরে রাখতে পারে? অামি তোমাকে হারাতে চায় না। তুমি এভাবে আমার পাশে থাকলে আমার আর কিচ্ছু চাই না। এবার হাসো
—- (নিশ্চুপ)
—- হাসো, হাসো,হাসো না
—- হি হি হি, আহ্ শুভ হচ্ছেটা কি, এভাবে কেউ সুরসুরি দেয় নাকি।
—- কেউ দেয়না বলেই তো আমি দিলাম।
— ওই
— হুমম
— শোননা
— শুনছি তো বলো
— এদিকে তাকাও
—- হ্যা বাবা বলো
—- কিহ্ বাবা?
—- সরি, আপি বলেন
—- তুমিও না
—- কি আমি
—- একেবারে ফাজিল একটা
—- এটা নতুন কী?
—- হুমম বেশি বোঝে, এবার একটা কবিতা শোনাও
—- এখন??
— এখন না এক্ষুনি।
—- ওকে,জো হুকুম মহারানি তুমি নামক গাছের গায়ে আমি জড়িয়ে থাকতে চায় হয়ে বুনো লতা, সারাটা জীবন থাকবো পাশে বলব মনের কথা। তোমার সুখে সুখী আমি দুঃখী তোমার দুঃখে, বিপদ যত আসুক না কেন দাড়াবো আমি রুখে। তুমি আমার আঁধার রাতের আলোয় ভরা তারা, তোমার রঙে রঙিন হয়ে হয়েছি পাগল পারা।