১.
বরই গাছটার পাতার ফাকে ফাকে রোদের নিষ্প্রাণ লুকোচুরি |
দেখতে বড় ভাল লাগে শুভ্রার,কি চমৎকার আলোছায়ার খেলা | হঠাৎ হঠাৎ রোদের ঝলকানি যখন মুখে এসে পড়ে তখন কেমন যেন লাগে |
মায়ের ডাকে ঘোর ভাঙতেই একটু বিরক্তি এলো,চুপচাপ থাকার সময় কোন কথা বলতে ভাল্লাগেনা আসোলে |
– এই শুভ্রা,কিরে এখানে যে?
– তাহলে কোথায় থাকব?
– ফাইজকে একটু দেখতে যা,কাল ঈদ আর আজ দুজন দুমুখি | আরে সংসারে এরকম কত ঝগড়াঝাটি হয়,যা মামণি |
– আমি ওর পাশে থাকলে ওর ঈদ মাটি হবে |
– আহহা মামণি…ওহহো বলতেই ভুলে গেছি,আজ একদম সকালে ওর বড়বোন ফোন করেছিল |
– তাই ! কি বলল?
– ফাইজের ডানহাতের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছিল,তাই এখন পুরাহাত ব্যান্ডেজ | ইস বেচারা ছেলেটার কি হল |
– আম্মু আমার উঠতে ভাল্লাগছেনা,ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দিবে? গোছানোই আছে,টুকিটাকি একটু ভরে দাও |
– দিচ্ছি,মনটা ফ্রেশ কর |
– করছি…
মা বিছানায় লাল ব্যাগটা রেখে গোছগাছে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন | শুভ্রার দৃষ্টি ঐ হালকা মেঘঢাকা আকাশে,বৃষ্টি হবে নাকি?
ফাইজের গম্ভীর চেহারাটা বারবার চোখটাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে |
কি দরকার এত ঝাপসা হওয়ার,কি আছে ঐ চেহারায় রাগ আর নিষ্ঠুরতা ছাড়া?
কিন্তু ঐ চেহারাকেই যে খুব ভালবেসে ফেলেছে,একদম মন থেকে |
ফার্মগেটের বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে এখন শুভ্রা দাড়িয়ে |
নাকের কাছে একফোটা ঘাম গড়ানোর অপেক্ষায় | আশপাশের পরিবেশটা কেমন অন্যরকম | সবার চোখেমুখে একধরনের চাপা উত্তেজনা,চাপা আনন্দ |
কাল ঈদ,আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কাল পরিবারের সবার সাথে ঈদ করবে,একসাথে ঈদগাহে যাবে,ছোটদের নিয়ে যাবে মেলায় | মেলায় কত খেলনা !
একটা বাস এসে থামল,অমনি হুড়াহুড়ি | বাবারে যাত্রিদের বাসে ওঠার যুদ্ধ দেখলেই গলা শুকিয়ে যায় |
ভালমত নেমপ্লেট দেখল শুভ্রা |
নাহ এটা ওর বাস নয় | মিরপুরের বাস তো এতো দেরি করেনা,ইস এই রোদে আর কতক্ষন দাড়াতে ভাল্লাগে? এখানের আকাশটা একদম পরিস্কার |
এতটুকু দাড়াতেই মাথাটা কেমন ঝিম দিয়ে গেছে,তৃষ্ঞা পাচ্ছে যে খুব | মোবাইলে রিং হচ্ছে,প্রথমবার না শুনলেও এবার শুনেছে ও |
ব্যাগের মধ্যে এতকিছুরে বাবা,টাকাপয়সা এত অগোছালো কেন?
কোনরকম ফোনটা বের করে দ্রুত রিসিভ করল,হ্যালো…
– শুভ্রা প্লীজ আসো
ফাইজের কন্ঠস্বর শুনে চোখের পাতা কেমন কেপে উঠল,ছেলেটার কন্ঠ এরকম হল কিভাবে?একদম ভেঙে গেছে,চেনাই যাচ্ছেনা |
– এই শুভ্রা
– হুম আমি আসছি | ফার্মগেটে বাসের জন্য দাড়াইয়া আছি |
– আমি তো তোমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিছি,এতক্ষনে বোধহয় পৌছে গেছে |
– ও…
– যাও তাড়াতাড়ি বাসার দিকে রওনা দেও,আমি ড্রাইভারকে থাকার জন্য বলে দিতেছি কেমন |
– আচ্ছা…তোমার গলা..না কিছুনা |
– কি,বল…
– না,আসতেছি আমি |
ফোনটা ব্যাগে রেখে কাউন্টারের দিকে এগোয়,টিকিটটা ফেরত দিতে হবে | যাক বাসে ওঠার টেনশন শেষ |
শুভ্রার চোখে পানি টলটল করছে,উফ বিরক্তিকর ! পানিটা একটু তড় সইতে পারেনা?
২.
ঝরঝর বৃষ্টির শব্দ আগেথেকেই ভাল লাগে ফাইজের |
এখন একটু বেশি ভাল লাগছে,তবে হঠাৎ করে বুকে একটা ভয় দাপিয়ে যায় প্রবলভাবে | খুব ভয় লাগে ওর,কান্না আসে প্রচন্ড কিন্তু…
কিন্তু পারেনা কাদতে,লজ্জা হয় | আপা এসে কাদতে দেখলেই সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমত ঝেড়ে যাবে | অথচ শুভ্রা কত ভাল,খালি আদর করে |
মেয়েটা কি খুব রাগ করে আছে?
রুমে ঢুকে ফাইমা একটু চমকে গেল,দারুণ খুশি শুভ্রাকে দেখে |
– এত তাড়াতাড়ি এসে পড়েছিস আপু !
– জ্যাম আজ তেমন পড়েনি বলা যায় এদিকটাতে,আমাদের ঐ লাইনে আবার ভীষন জ্যাম |
– হুম | তা ফ্রেশ না বসে আছিস কেন,যা বাথরুমে যা |
– আপা,ওকি ঘুমায়?
– না,বৃষ্টি দেখে | কিছুক্ষন আগে দেখে আসলাম গুনগুন করে গান গাচ্ছে | তুই আসবি,মনে খুশি ধরেনা |
ফাইমার হাসি থামতেই শুভ্রা ওর হাত ধরে বলে,আপা ওর কাছে গিয়ে কি বলব আমি?
– কিছুই বলার দরকার নেই,মাথাটা জড়িয়ে আদর করে দিস |
– আচ্ছা…
– ওকে এতদিন খুব বকাঝকা করেছি,থাপ্পড়ও দিয়েছি কয়েকটা | এতবছর আমাকে জ্বালিয়েছে,এখন আবার তোকে | আরো যদি মারতাম !
– আহা এতবড় ছেলেটাকে মারলে,ও খুব কেদেছে না?
– যা ইচ্ছা করুক,আমি কি করব !
– আচ্ছা থাক,আমি এসেছি তুমি আর মাথা গরম করনা তো |
– যা রুমে যা এখন |
ব্যাগটা নিয়ে ওরুমে পা বাড়াল শুভ্রা,চোখের পাতা এখন অসহ্যরকম কাপছে | আর পানিতো জমে আছে সেই কখনথেকেই |
শুভ্রার হাতের স্পর্শে চোখ মেলল ফাইজ | হালকা হালকা ঘ্রাণ আসতেই বুঝেছে শুভ্রা এসেছে বোধহয় | শুভ্রার ঘ্রাণ যে ওর মুখস্থ |
ঠোটের কোণে একটু হাসি ফুটিয়ে ফাইজ বলল,তোমাকে মারার শাস্তি দেখেছ শুভ্রা? এইযে দেখ,খুব ভাল হয়েছেনা?
ঝরঝর কেদে দিল শুভ্রা |
আস্তে ফাইজের মাথাটা জাপটে ধরে খুব কাদছে | কান্নাজলে ভিজছে ফাইজের ঘন কালোচুল আর কপালের খানিকটা | ফাইজ একদম নিরব |
হঠাৎ শুভ্রা বলল,তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছি |
– কোথায়,দাও এখনি পড়ব |
– ধুর বোকা এখন নাতো,কাল পড়বে | আমি পড়িয়ে দেব |
– তোমার জন্য আপা কিনছে,আমি কিনতে পারিনি তবে রং বলে দিছি | তোমার বোধহয় পছন্দ হবেনা |
– সব পছন্দ হবে,সব…
– শাড়ি কিন্তু |
– আমি কি শাড়ি পড়তে পারি?
– রং কি জানো? আবছা নীল |
– সত্যি?
– হ্যা সত্যি,খুব সুন্দর লাগবে তোমাকে |
– এই তোমার পাঞ্জাবিটার রং কি,শুনবানা?
– বল
– আবছা নীল,তোমাকে ভীষন সুন্দর লাগবে | আমরা নীল রাজারাণী সাজব,খুব মজা হবে |
– শুভ্রা,আমার উপর কি তোমার রাগটা গেছে?
– গেছিল তো,তুমিই আবার মনে করিয়ে দিলা |
ফাইজ চুপ হয়ে যায়,আবার কাদতে ইচ্ছে করছে |
সহ্য না করতে পারলে কেদেই ফেলবে | শুভ্রা তো আর আপার মত বকা দিবে না,নিশ্চয়ই ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে বলবে,কাদেনা সোনা |