রমজান আলী খালি গায়ে খাটে বসে আছে। গরমে তার শরীর ঘেমে গেছে। কারেন্ট নেই। অবশ্য গ্রামে কারেন্ট না থাকাটা খুব সাধারণ ঘটনা। একটা হাতপাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে সে। তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।
-রিনা, এট্টা গামছা দিয়া যাও তো।
রিনা রমজানের জন্য শরবত তৈরি করছিল। শরবত বানানো শেষ করে একটা গামছা নিয়ে সে ঘরে ঢুকল। শরবত আর গামছা রমজানের দিকে এগিয়ে দিল।
রমজান এক ঢোকে পুরো গ্লাস শরবত শেষ করে গ্লাসটা রিনার দিকে এগিয়ে দিল। রিনা গ্লাস নিয়ে চলে যাচ্ছিল, রমজান পিছন থেকে ডাক দিল। -কই যাও? বস এট্টু এইহানে।
-রান্নাবান্না করতে হইব। দুপুরে খাইবেন না!
-হে পরে কইরো। এহন এট্টু বস। আওয়ার পর তে তো খালি পাকঘরেই বইসা রইছ। এতদিন পর আইলাম, এট্টু কথাও তো কইতাছোনা!
-বেলা হইয়া গেছে। এহন পাক না করলে দেরি হইয়া যাইব।
-হক দেরি। তুমি এইহানে আইসা এট্টু বস।
রিনা চুপচাপ এসে খাটে বসল। রমজান একটু রিনার দিকে সরে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। -ভাল আছ?
রিনা উপরে নিচে মাথা নাড়ল।
-রাজু, সেলিম কই গেছে? এদ্দিন পর আইলাম, এট্টা পোলাপানরেও দেখতাছিনা!
-সেলিম ইস্কুলে গেছে। অর পরীক্ষা। রাজু গেছে বাজারে। আপনে আইবেন বইলা মাংস আনতে গেছে।
-অ। সুমি ভাল আছে? ও খবর পাইছে যে আমি আইছি?
-হুনছে আপনি আইজকা আসবেন। আইসা যে পড়ছেন এইটা হুনছে কিনা জানি না। রাজু ফোন করছে কিনা জানি না।
-সুমির শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন?
-হেরা লোক ভাল। সুমির আল্লাহ্র রহমতে ভাল জায়গায় বিয়া হইছে।
-সুমির বাচ্চাডা কেমুন আছে? কি জানি নামডা?
-সাগর।
-খুব সুন্দর নাম। কত বছর হইল?
-এই দুই বছর হইব সামনের মাসে।
-মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। সুমির জামাই কি খালি চাষবাসই করব? ব্যবসাপাতি কিছু করব না?
-ব্যবসা করব কেমনে? টেকা কই ব্যবসা করার?
-হ, তা অবইশ্য ঠিক। সুমির জামাই বড় পোলা না?
-হ।
-ছোড ভাই দুইডা করে কি?
-একটায় সেলিমের লগে ইস্কুলে পড়ে। আরেকটা জামাইয়ের লগে চাষবাস করে।
-হম। সুমির শ্বশুরটা দুই বছর আগে আৎকা মইরা গিয়া সংসারটারে ভেজালে ফালাইয়া দিয়া গেল। শহরে তাও এট্টা চাকরি করত, হেইডা দিয়া সংসারটা মোটামুটি চলত। এহন তো জামাইয়েরি সব দেহা লাগে।
-হ। আইচ্ছা আমি এহন যাই। আপনে বাইরে গিয়া গাছের তলে বহেন। ঘরে গরম। বাইরে বাতাস লাগব।
-কারেন্ট গেছে কহন?
-দুই ঘন্টা হইছে। কহন আহে ঠিক নাই।
-মোবাইল কই? মোবাইলডা দাও। সুমির লগে কথা কমু।
-মোবাইল বন্ধ হইয়া গেছে। ব্যটারির চার্য শ্যাষ।
-অ।
রিনা রান্না করতে চলে যায়। রমজান ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকের আম কাঁঠাল গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে।
//২//
রমজান আলী মজনু মিয়ার দোকানের সামনে দাঁড়াল। সে সুমির শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। সুমির ছেলের জন্য কিছু চিপস আর বিস্কুট কিনল। সুমির সাথে দেখা করার জন্য তার মনটা ছটফট করছে। মেয়েটা তার খুব নেওটা ছিল। রমজান যেদিন বিদেশে চলে যায়, সেদিন কি কাঁদাটাই না কেঁদেছিল সুমি!
-কি রমজান ভাই, এদ্দিন পর দেশে আইলা!
রমজান দেখল দোকানে জামাল বসে আছে। জামালের সাথে রইস আর আবেদও বসে আছে। রমজান দোকানে ঢুকল।
-একবারে চইলা আইছি। আর যামু না।
-আর যাইবা না?
-না। এবার রাজুরে পাডামু। আমার জায়গায় অয় যাইব।
-কি কও মিয়া। রাজু তো পোলাপাইন!
-কিয়ের পোলাপাইন! বিশ বছর হইল। পোলাপাইন কিয়ের!
-কে, রমজান নি? ভালা আছো বাবা?
রমজান ঘুরে দেখল জব্বার চাচা দোকানে ঢুকছেন। -স্লামালাইকুম চাচা। ভাল আছেন?
জব্বার চাচা বসতে বসতে বললেন- এইতো আল্লায় রাকছে। তুমি আছো কেমুন?
-আছি চাচা আলহামদুলিল্লাহ্।
-তা বাবা,এদ্দিন বিদেশ আছিলা কে? মাঝখানে এট্টু ঘুইরা টুইরা যাইবা না! তোমার মাইয়ার বিয়াডায় পইরযন্ত আইলা না! কয় বছর পর আইলা?
রমজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- দশ বছর হইছে। কি করুম চাচা কন! জানেন তো বহুত ধারদেনা কইরা, জমিটমি বন্ধক দিয়া বিদেশ গেছি। আইতে গেলে খরচ আছে। বাড়ির অবস্থাও তো বেশি ভালা আছিল না। হের লাইগা আইতে পারি নাই। একবারে চইলা আইছি। রাজুরে পাডামু এহন।
-তোমার বউডার যে কি কষ্ট হইছে। একলা একলা পোলাপাইনগুলারে বড় করছে। তোমার বাপ-মা বাইচা থাকলেও একটা কথা ছিল।
রমজান চুপচাপ মাথা নাড়ে।
-তোমার বইনটইনরা আইত। তোমার শ্বশুরও আইত মাঝে মইদ্যে। খুব কষ্টে বড় করছে পোলাপানগুলারে রিনা। তা যাও কই?
-সুমির লগে দেখা কইরা আহি। অর শ্বশুরবাড়ি যাই।
-অ। আইচ্ছা। যাও। ঐ মজনু, এক্কাপ চা দে দেহি। আর বিড়ি দিস এক প্যাকেট।
রমজান চিপস আর বিস্কুট নিয়ে দোকান থেকে বেড়িয়ে পড়ল।
//৩//
-সাগর, এইটা কে জানো নি? এইটা হইল তোমার নানা। কি হয় তোমার? সুমি রামজানকে দেখিয়ে সাগরকে প্রশ্ন করে।
-নানা।
রমজান মিয়া হাততালি দিয়ে বলে- এইত নানাভাই পারছে। দেহি আমার কোলে আসতো। দেহো তোমার লাইগা কি আনছি! এই যে চিপস, বিস্কুট। কোনটা খাইবা?
চিপসের লোভে মায়ের কোল থেকে রমজানের দিকে এগিয়ে যায় সাগর। রমজান চিপসের প্যাকেট খুলে সাগরকে চিপস খাইয়ে দিতে থাকে। নানা নাতির ভাব জমতে খুব বেশি সময় লাগে না।
কিছুক্ষণ পর আকরাম আসে। রমজান সরে বসে বিছানায় জামাইকে বসতে দেয়। -বস বাবা বস। আছো কেমুন?
আকরাম রমজানের পাশে বসে। -আছি আব্বা ভালই। আপনে ভাল আছেন? শরীলডা ভাল?
-আছি বাবা আল্লাহ্র রহমতে। তোমার লগে তো আইজি পরথম দেখা।
আকরাম হাসল। -হ। আপনে তো মেলাদিন পর দেশে আইছেন। বিয়ার সময়ও ছিলেন না।
-কি করুম কও। দেশে আইতে খরচ আছে মেলা। বহুত ধারদেনা কইরা গেছিলাম।
-হুনছি সুমির কাছে। তা আবার যাইবেন কবে?
-আমি আর যামু না। এবার রাজুরে পাডামু।
সুমি রমজানের কথা শুনে বলল- কি কও আব্বা তুমি! ভাইজানরে পাডাইবা মানে! ভাইজানের বয়স হইছে বিদেশ যাওনের?
-রাজুর বয়স বিশ বছর পার হইয়া গেছে। আমার আর বিদেশ থাকতে ভাল্লাগে না। আমার জায়গায় রাজুরে পাডামু। মালিকের লগে হেরুমি কথা হইছে।
আকরাম বলল- রাজু তো পোলাপান মানুষ। বিদেশ যাইয়া কি করতে না কি কইরা শেষে এট্টা ঝামেলা বাধাইয়া দে। পাডাইলে আর কয়েক বছর পরে পাডান।
রমজান আকরামের কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। -আরে ধুর! কি ঝামেলা হইব! এহন জোয়ান বয়স। এহনি তো কাম করার সময়। আমার মত বুড়া বয়সে বিদেশ যাওনের দরকার নাই। আর বাবা, তুমিও বিদেশ যাওনের চেষ্টা কর। দেশে এই চাষবাস কইরা আর কয়দিন চলবা?
-বিদেশ যাইতে যে টেকা লাগে, টেকা পামু কই?
-জমিটমি বেইচা, বন্ধক দিয়া দরকার হইলে যাও। তুমি রাজি হইলে আমি চেষ্টা কইরা দেখতে পারি। আমাগো কোম্পনিতে আরো লোকটোক নিবো শুনছি। তুমি রাজি হইলে আমি দেখমু চেষ্টা কইরা।
সুমি বাইরে থেকে গামছা এনে আকরামের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে- হইছে, বিদেশ যাওনের আলাপ পরে কইরো। এহন তাড়াতাড়ি গোসল কইরা আসো। আব্বা তোমার লগে খাওয়ার লাইগা বইসা আছে।
আকরাম বসা থেকে উঠতে উঠতে বলে- আব্বা বসেন এট্টু। আমি গোসল কইরা আইতাছি।
-যাও বাবা।
//৪//
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রমজান আর রিনা শুয়ে আছে। কারেন্ট নেই। রিনা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। টেবিলের উপর একটা চাইনিজ চার্জার রাখা। তাতে রুমের অন্ধকার খুব একটা দূর হচ্ছে না।
-হোন, এবার আমি আর যামু না বিদেশ। রাজুরে পাডামু।
-হুনছি। আপনে কইছেন।
-অ। তোমারেও কইছি তাইলে! রাজুরে কইছ?
-আমি কই নাই। আপনে কইয়েন।
-ঠিকাছে……………….চিন্তা করতাছি এবার আকরামরেও বিদেশ পাডাইয়া দেওনের ব্যবস্থা করুম। আমাগো কোম্পানিতে হুনছি লোক নিবো। ভালই হইব তাইলে। রাজু আর আকরাম একলগে থাকতে পারব।
-আপনারে এট্টা কথা কই?
-কও।
রিনা মুখটা সামান্য অন্যদিকে সরিয়ে বলল- আপনে আকরামরে বিদেশ পাডাইয়েন না।
-কে?
-আমি যেই কষ্ট পাইছি, আমার মাইয়াও হেই কষ্ট পাক সেইটা আমি চাই না।
রমজান আলী অবাক হয়ে রিনার দিকে তাকাল। রিনার দৃষ্ট ঘরের সিলিঙের দিকে। রমজানের হঠাৎ করে মনে হল রিনাকে সে অনেক কষ্ট দিয়েছে। একা একা দশটা বছর সে তাদের সন্তানদের মানুষ করেছে, ঘর সংসার সামলেছে। এই আধো আলো আধো অন্ধকারেও রিনার মুখে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অথচ বয়স আর কত হয়েছে! এখনো তো চল্লিশও পেরোয়নি। বিদেশ যাওয়ার আগে রমজানের সাথে রিনার যেই ঘনিষ্টতা ছিল তা দেশে আসার পর গত কয়েকদিনে রমজান দেখেনি। প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিল। পরে মনে করেছে অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে হয়ত এমন হয়েছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন রমজান বুঝতে পেরেছে সুদীর্ঘ দশ বছরের অনুপস্থিতি রিনার মনের সব সৌন্দর্য শুষে নিয়েছে। রিনা আর আগের সেই রিনা নেই। সে বদলে গেছে। রমজান টেবিলের চার্য লাইটা নিভিয়ে ধীরে ধীরে রিনাকে নিজের দিকে টেনে নিল।
উৎসর্গঃ বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের। যাদেরকে অনেকেই মানুষ মনে করে না- এদেশেও করে না, বিদেশেও করে না।