আমরা হয়তো এই শহরে দেখা করতে পারতাম। কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা মল অথবা সিনেমায়। আমরা পরিচিত হতে পারতাম অন্য যে কোনো দিন, যে কোনো সময়। কিন্তু পাগল মেয়েটা বৈশাখের প্রথম দিনটাই বেছে নিল। সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘরের মেলার মাঝখানে আমাকে আসতে হবে। ওর বাড়িটার কাছাকাছি, তাই। কী অদ্ভুত!
গ্রামীণ বৈশাখের মেলা আমি দেখিনি কোনো দিন। কাগজে আর চোখের ঘষাঘষিতে চশমার লেন্সের পাওয়ার বেড়েছে শুধু। দেশটা আর দেখা হলো না। মেলায় ঢুকতেই মনটা ভরে গেল। গ্রামীণ জিনিসপত্র, জামদানি, মণ্ডা-মিঠাই, নাগরদোলা, সাপ খেলা, পুতুলনাচ, দেশি বাদ্যযন্ত্রের গান, কী নেই! হঠাৎ একটা ফোন এল।
‘তোমাকে তো মেরুন পাঞ্জাবিতে খুব পচা লাগছে। একটা খেলা খেলবে?’
‘কী?’
‘আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। তোমার আশপাশেই আছি।’
‘পাগল নাকি? এত বড় মেলায় কোথায় খুঁজব তোমাকে?’
বললাম বটে। কিন্তু খেলাটায় একটা মজার গন্ধ আছে। মন্দ কী?
‘আমি নাগরদোলার কাছাকাছি থাকব। ওপরে উঠলেই আমাকে দেখতে পাবে।’ ফোনটা কেটে গেল। চার্জ শেষ। ভালো বিপদে পড়া গেল। আসলে বোকা এই আমার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েটার ‘অ্যারেঞ্জ’ বিয়ের কথা চলছে।
ফোনে কথা হচ্ছে কয়েক দিন। আজ দেখা করার কথা। শুধু ফেসবুকের ছবি দেখা আছে। এখন এই ভয়ংকর পাগলামি দেখে আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।
নাগরদোলায় বসে আমি চারদিকে তাকাচ্ছি। ওকে দেখা যাচ্ছে না। আমার হাত-পা কাঁপছে। দুটি সমস্যা আছে আমার।
উচ্চতাভীতি আর মাথা ঘোরানোর সমস্যা। নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করল। দোল খাচ্ছে আর আমি চোখে অন্ধকার দেখছি।
আমি যখন সবচেয়ে উঁচুতে উঠে গেছি, আর কাছেই একটা ফুলের দোকানে একটা মেয়ে আমার দিকে হাত নাড়ছে, শাড়িটা লালই হবে হয়তো, আমার তখন বমি পাচ্ছে।
এরপর আর কিছু মনে নেই। যখন চোখ মেলে তাকাই, দেখি আমি ঘাসের ওপর। মাথাটা একটা খুব নরম কোলে হেলে আছে। একটা নরম হাত আমার হাত ধরে আছে। আমার মুখে জলের ছিটা লেগে আছে। চারদিকে উৎসুক চোখের হাট বসেছে। আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটার মুখের দিকে। দুষ্টু চোখের মিষ্টি হাসির মেয়েটা যেন আরও কিছু পাগলামি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে।
‘কী বীরপুরুষ, আমাকে দেখে একেবারে চিতপটাং? উঠবে আরেকবার নাগরদোলায়, আমার সঙ্গে? আমি হাত ধরে রাখব এইবার।’
‘আমাকে বিয়ে করবে?’
বৈশাখী মেলার চারদিকে হাততালি আর শিষের শব্দে ফেটে পড়ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আমি প্রথম ব্যক্তি, যে অজ্ঞান হওয়া থেকে ফিরে এসে হবু বউয়ের কোলে মাথা রেখে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারলাম।