রানবীর : আচ্ছা, দাদা-দাদুকে আমাদের হার মানাতে হবে, বুঝেছ?
মীম : কিভাবে হার মানাতে হবে? আর হার মানাতে হবে কেন?
রানবীর : আমাদের দুজনের মধ্যে যে ভালোবাসা, সেটা যে দাদা-দাদুর চেয়ে অনেক গুণ বেশি, সেটা বোঝাতে হবে।
মীম: কিভাবে বোঝাব?
রানবীর: দাদা-দাদুর ছেলে-মেয়ে কয়জন?
মীম: ১০ জন।
রানবীর : আমাদের বাবু হবে ২০টা। তাহলে আমাদের মাঝের ভালোবাসা যে দাদা-দাদুর চেয়ে বেশি, সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।
মীম : আমাকে মেরে তোমার ভালোবাসা প্রমাণ করার বুদ্ধি, তাই না?
রানবীর : কী বলো, তোমাকে মারার বুদ্ধি মানে?
মীম : ২০টা বাচ্চা কি তোমার পেটে হবে নাকি আমার? আমি বাবা দুইটার বেশি বাবু নিতে পারব না।
রানবীর : মাত্র দুইটা?
মীম : হ্যাঁ গো, হ্যাঁ। ২০টা বাচ্চা দিয়ে তুমি কী করবা, যদি আমি বেঁচে না থাকি?
রানবীর : তুমি বাঁচবে না কেন?
মীম : ২০টা বাচ্চা হতে তো তোমার কিছু করা লাগবে না। তোমার দরকার খালি ২০টা রাত, ওদিকে আমার তো ২০টা বছর। বাব্বা, আমার চিন্তা করতেও ভয় লাগছে।
রানবীর : দাদু পারলে তুমি পারবা না কেন?
মীম : দাদু পারছে, কারণ দাদুদের সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণের কিছু ছিল না। দাদার সঙ্গে মজার খেলা খেলতে খেলতে ১০ বার মা হয়েছে।
সে আজকের দিন জন্মালে দুইটার বেশি বাবু নিতই না।
রানবীর : আচ্ছা, আমরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কী ব্যবহার করব?
মীম : ছিঃ। এসব কথা বিয়ের পর বলবা, এখন এসব বললে একদম নাক ভেঙে দিব।
রানবীর : তাই, আমার নাক ভেঙে দিলে আমি তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিব কী করে?
মীম : হয়েছে হয়েছে, আর ঢং করতে হবে না। সারা দিন বলে আমি ঢং করি, অথচ নিজে ঢং করার বেলায় কম যায় না। আমি এখন ঘুমাব।
রানবীর : একা একা ঘুমাতে ইচ্ছা করে না আর।
মীম : আবার শুরু করছ? চুপচাপ ঘুমাও। আমি রাখলাম।
ফোনটা সত্যি সত্যি রেখে দিল মীম। কিন্তু মীম জানে, রানবীরের ঘুম আসবে না। প্রতি রাতে মোবাইলে চুমু না দিলে এই বদ ছেলেটার ঘুম আসে না। তাই কিছুক্ষণ পর আবার কল দিল মীম। রিংটা না হতেই ওপাশ থেকে—
রানবীর : হ্যালো মীম, বেবি, আই মিস ইউ।
মীম : শুনো, আমি পুয়ারা করতে ফোন দেই নাই। তোমার ঘুমের ওষুধটা নাও, আর ঘুমাও। মুউউউয়া। বাই, গুড নাইট।
ফোন কেটে দিল মীম। এবার পাগলটা ঘুমাবে। সকালে দিব্যি বিছানায় পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না মীম কল করে জাগাবে। সকালে ক্লাস আছে, এই ভাবতেই ঘুমে চোখ ছোট হয়ে এলো।
ওয়াশরুম থেকে এসেই লাইফ করে ঘুমিয়ে পড়ল। মোবাইলের লাইটটা জ্বলে উঠল। মীম বুঝতে পারছে পাগলটা গুড নাইট আর আই লাভ ইউ লিখে টেক্সট করেছে। এটা পাগলটার অভ্যাস। রিপ্লাই না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল মীম।
মীম আর রানবীর একে অন্যের কাজিন। তাদের বাবারা দুজন আপন ভাই। কিন্তু ভাই হলেও দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ। অথচ মীম আর রানবীর কাউকে ছাড়া কেউ বাঁচতে পারবে না হয়তো। তাদের প্রেমটা শুরু হয় দুজনের বন্ধুত্ব থেকেই। পরিবারের দূরত্বটা কমাতেই মূলত তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করা শুরু হয়। একপর্যায়ে নিজেদের মধ্যে অনেক বোঝাপড়া হয়ে যায় এবং মনের অনেক মিল থেকেই তারা নিজেদের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে। একদিন মীমকে ফেসবুকেই অফার করে রানবীর। মীম প্রথমে রাজি হয়নি।
কিন্তু রানবীরের রিজেক্ট হওয়া চেহারা মীম মানতে পারেনি। শেভ না করে করে মুখভর্তি দাড়ি, চুল না কেটে কেমন জানি এবড়োখেবড়ো চেহারা বানিয়ে ফেলেছে। ভার্সিটি পর্যন্ত মিস করা শুরু করে দিয়েছে। যেখানে দুই পরিবারের সম্পর্ক ভালো করার মিশনে নামছে মীম, সেখানে তাদের দুজনের সম্পর্কই খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে মীম সাড়া দিল। এক দিনে অমানুষ থেকে মানুষ বানিয়ে, কাজিন থেকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে রানবীরকে নিজের করে নিল মীম।
কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, মীমের মনে ততই ভয় জন্মাচ্ছে; কেননা তার বিয়ের জন্য বাসায় কথাবার্তা চলছে। অন্যদিকে মীম আর রানবীর এখনো চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে, যেখানে বিয়ে নিয়ে তাদের কোনো প্ল্যান নেই। কিন্তু মীম আজকাল রানবীরকে বিয়ের ব্যাপারে দুই পরিবারকে রাজি করানোর জন্য খুব প্রেসার দিচ্ছে। রানবীর যেহেতু এখনো ছাত্র, তাই বিয়ে করার মতো সামর্থ্য তার নেই বলে সে কোনো উত্তর দিতে পারছে না।
এ কারণে মীম অনেক রাগ হয়ে থাকে রানবীরের ওপর। কিন্তু রানবীর মীমকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।
অতঃপর একদিন মীমকে দেখার জন্য বাসায় ছেলেপক্ষের লোক এলো। রানবীর মীমের হবু বরের সামনে সোফায় বসে বারবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখছে আর মীম আসার জন্য অপেক্ষা করছে। বাসার যেহেতু কেউই রানবীর-মীমের সম্পর্ক নিয়ে কিছু জানে না, তাই মীমকে দেখতে আসার অনুষ্ঠানে রানবীরের উপস্থিতি কারো চোখে কোনো সমস্যা না।
কিন্তু রানবীর কেবল মীমকে একনজর দেখার জন্যই বেহায়ার মতো চলে আসছে। তা ছাড়া গত এক সপ্তাহে মীমকে দেখতে আসবে বলে মীম রাগ করে রানবীরের সামনে আসেনি।
রানবীরও ‘কাপুরুষ’ শব্দটা মীমের কাছ থেকে ভালোভাবে নিতে পারেনি, তাই রানবীরও রাগ করে দেখা করেনি। কিন্তু আজ আর মন মানছে না।
লাল শাড়ির পরিবর্তে হলুদ একটা শাড়ি পরে মীম সবার সামনে এসেছে। মীমকে বসতে দিয়ে নিজের আসন ছেড়ে হবু বরের পেছনে দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মীম এতক্ষণে বুঝতে পারছে, রানবীর তাকে দেখতে আসছে। মীমকে যতবারই মাথা তুলে মুখটা দেখাতে বলছে তার হবু শাশুড়ি, মীম ততবারই রানবীরকে দেখতে পাচ্ছে। আর বুঝতে পারছে রানবীরের চোখে জল জমে আছে, শুধু চোখের পাতাটা নামালেই জল নেমে আসবে গালে।
মীমের গাল বেয়ে এবার চোখের পানি পড়ছে, এটা দেখে অনেকেই অবাক হলো। মীমের হবু শ্বশুর তো বলেই ফেলল— ‘মা, আজ তো আমরা কেবল দেখতে আসলাম, তুমি কাঁদছ কেন?’
উত্তর না দিয়েই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মীম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং হবু বরের পেছনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো রানবীরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। মীমের এমন কাণ্ড দেখে রানবীর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে মীমের দিকে তাকাল। সবাই হিন্দি সিরিয়ালের মতো এক এক করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দুজনের দিকে তাকাল। মীমও মনে হয় সবাই তাকানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই যখন এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাল, ঠিক তখনই মীম রানবীরের ঘাড়ের পেছনে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে তার দুই ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরল।
গত সপ্তাহেই দুজনের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলো, আজ তারা দুজনে বিয়ের পিঁড়িতে। মীমকে দেখতে আসার ওই দিনে তার সেই সাহসিক কাজ শুধু তাদের দুজনের জীবনে সুখ বয়ে আনেনি, তাদের দুই পরিবারের কোন্দলেরও অবসান ঘটিয়েছে। অন্তত এই কারণে মীমের প্রতি দুই পরিবার কৃতজ্ঞ।
আর রানবীরের কাছে তো মীম আজীবনই রানি আর নিজে মীমের কাছে কাপুরুষ। যদিও মীম এখন আর কাপুরুষ বলে না, কারণ ওই দিন রানবীর মীমের কাছে আসতে পারার সাহসই যে তাকে সাহসী করে তুলেছে, তা কেউ না জানলেও মীম নিজে তো জানে।