বিজয়ের হাসি

বিজয়ের হাসি

-মিস অন্বেষা ,আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

–জ্বী? আমাকে!

–হ্যা, এই যে আপনার কাগজপত্র।

–কে করেছে?

–ছোট স্যার।

–রেহান স্যার!

–হ্যা।

অন্বেষার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কি বলছে এই লোকটা! রেহান স্যার ওকে দেখতে পারে না ঠিকই,তাই বলে চাকরি থেকে একেবারে বরখাস্তই করে দিবে! বরখাস্ত করা কি এতই সোজা?

অন্বেষার মনে পড়ছে, প্রথম যেদিন সে এই চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল, তখন একটা বয়স্ক লোক এই কোম্পানির বস ছিলেন, নাম শরীফ আহমেদ। তিনিই তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। এই এক বছর অন্বেষা তাঁর অধীনেই কাজ করেছে। খুব প্রশংসা করতেন তিনি অন্বেষার কাজের। সবসময় নিজের মেয়ের মত দেখতেন কাজে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি অসুস্থ হওয়ায় কোম্পানির বস হিসেবে আসেন তারই ছেলে রেহান আহমেদ। আর তাতেই অন্বেষার ভাগ্যের এই দুর্গতি ঘটে। রেহান স্যার বয়সে তরুণ, অন্বেষার বয়সী। হয়ত এই কারণে তার রাগও বেশি। প্রথম থেকেই তিনি অন্বেষাকে দেখতে পারতেন না। আর যখন কোম্পানির সবার মুখে তার কাজের, আচার ব্যবহারের প্রশংসা শুনলেন, তখন তো একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। অন্বেষা একেবারে তার দুই চোখের বিষ হয়ে গেল। তাই বলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিবেন! আর ভাবতে পারে না সে। তার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে এখন হঠাৎ চাকরি কোথা থেকে পাবে? অন্বেষার ভাবনায় ছেদ পড়ল রেহানকে একটা সুন্দরী ওয়েস্টার্ন ড্রেস আপ করা মেয়ের সাথে হাসতে হাসতে চলে যেতে দেখে। লোকটার প্রতি তার মন ঘৃণায় বিষিয়ে গেল।

তিন বছর পর।

–আর কত জ্বালাবি আমাদেরকে বল তো! একটা ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে চাচ্ছি, তাও তো করতে চাচ্ছিস না।

–আমি তো তোমাদেরকে বলেইছি যে আমি সামিয়াকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।

–দেখ রেহান, তোর বাবা আর আমি দুজনেই সামিয়াকে পছন্দ করি না। সামিয়া তোর যোগ্য না। আর ও সংসারের কি বুঝবে? সারাদিন ছেলেদের সাথে ঘুরেফিরে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে। এর চেয়ে তুই বরং একটা সংসারী মেয়ে বিয়ে কর। দেখবি তোরা খুব সুখী হবি। আমরা তো সবসময় তোর ভালই চাই।

–তোমাদের যা ইচ্ছে কর।

–কালকে তোর বাবা তোর জন্য মেয়ে দেখতে যাবে ঠিক করেছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে থাকবি। তোকে নিয়েই আমরা রওনা হব।

বলেই মা রেহানের রুম থেকে চলে গেলেন। রেহান আর কিছুই বলতে পারল না। বাবা যা ঠিক করেছে, এখন সেটাই তাকে করতে হবে, বাবার অবাধ্য হওয়া রেহানের পক্ষে সম্ভব না।

–দেখি মা, ঘোমটাটা একটু তোলো তো।

মায়ের কথায় বাস্তবে ফিরে এল রেহান, এতক্ষণ সে সামিয়ার কথা ভাবছিল। কিভাবে তার সামনে বসে থাকা মেয়ে, যাকে এখনো সে দেখেনি, তাকে সামিয়ার কথা বলে বিয়েটা ভাঙবে তাই ভাবছিল।

কিন্তু ঘোমটা খুলতেই চমকে উঠল রেহান। এ কাকে দেখছে সে? তিন বছর আগে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা সেই অন্বেষা না? ওকে দেখাতেই বাবা রেহানকে এখানে নিয়ে এসেছে? মেয়েটাও তো রেহানকে দেখে একইভাবে চমকে গেছে! বাবা অন্বেষাকে দেখিয়ে বললেন,

–রেহান, পরিচয় করিয়ে দেই। এ হচ্ছে অন্বেষা, যাকে তুমি তিন বছর আগে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছিলে। অবশ্য ওর জন্য ভালই করেছিলে। ও এখন অনেক উঁচু পদে চাকরি করে, নিজের যোগ্যতায়। খুব তাড়াতাড়িই সে তার অবস্থার পরিবর্তন করেছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করবে। আমি এই মহামূল্যবান হিরাকে হারাতে চাইছি না। তাই তোমার সাথে আমি অন্বেষাকে বিয়ে দিতে চাই। রেহান কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলল,

–আমি একটু অন্বেষার সাথে একা কথা বলতে চাই।

–আচ্ছা যাও।

–আপনি ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছেন!

রেহানের কথা শুনে অন্বেষার রাগ করার কথা। কিন্তু সে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনি যেমন আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন, আমিও তেমনি হয়েছি। আপনি যেমন কিছুই জানতেন না, আমিও এর কিছুই জানতাম না।

–আচ্ছা যাই হোক, আপনি তো জানেন আমার আর সামিয়ার কথা, আপনি তারপরেও আমাকে বিয়ে করবেন?

–সেটা আমি সবার সামনেই বলব। আপনার আর কিছু বলার আছে?

–না।

অন্বেষা উভয়সংকটে পড়ল। শরীফ আহমেদ অন্বেষার আদর্শ ছিলেন। উনার অনুপ্রেরণায় সে এতটা পথ অতিক্রম করতে পেরেছে। তাঁর কথা অন্বেষা ফেলবে কিভাবে? আবার এও জানে যে রেহানকে বিয়ে করলে সে কখনোই সুখী হতে পারবে না। ভাবতে ভাবতেই রেহানের দিকে তাকাল সে। ছেলেটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর তার ঠোঁটের কোণে দেখা যাচ্ছে বিজয়ের হাসি। আর সহ্য করতে পারল না অন্বেষা। সিদ্ধান্ত নিল, বিয়ে সে রেহানকেই করবে। কোনোভাবেই আর তার কাছে পরাজয় স্বীকার করবে না সে।

….

বিয়ের রাত।

অন্বেষা জানে, শুধু এই রাত কেন, ওর বৈবাহিক জীবনের আর কোন রাত বা দিনই হয়তবা সুন্দর কাটবে না। সবকিছু জেনেশুনেই তো সে বিয়ে করেছিল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অন্বেষা। সে এখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন রেহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুমন্ত রেহানকে কত শান্ত, নিষ্পাপ লাগছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুঝতে পারল অন্বেষা, এই ছেলেটাকে নিজের করে নিতে শুধু তাকে ভালবেসেই যেতে হবে, ঘৃণা এক্ষেত্রে কোন কাজ করবে না।

…..

রাত ১২ টা।

এখনো ফেরেনি রেহান। হয়ত আরো দেরি করবে ফিরতে। প্রায় প্রতিদিনই এরকম দেরি করে সে। আর প্রতিদিনই রেহানের জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকে অন্বেষা। যদিও জানে, রেহান বাইরে থেকে খেয়ে আসবে। তারপরেও প্রতিদিনই মনে হয়, হয়ত আজকে এসে বলবে ,চল একসাথে ডিনার করি। কিন্তু অন্বেষার এই আশাটা কখনোই বাস্তবে পরিণত হয় না। হয়ত রেহানকে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করার জন্য প্রতিশোধ নিচ্ছে তার উপর। ভাবতে ভাবতেই ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল অন্বেষা। ঘুম ভাঙল কারো হাতের স্পর্শে। উঠে দেখল,রেহানের মা দাঁড়িয়ে আছে।

–মা, আপনি এখনো ঘুমাননি?

–ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু জেগে উঠে দেখি তুমি এখনো রেহানের জন্য অপেক্ষা করছ। আসলে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম, রেহান ১২ টায় ফোন করে বলেছিল ও বাসায় আসতে পারবে না।

–ওহ।

–আর কতদিন এভাবে তুমি ওর জন্য অপেক্ষা করবে, মা। আমার ছেলেটা তো তোমার মত লক্ষী একটা মেয়েকে চিনতেই পারল না। ওর কপালে যে কি দুঃখ আছে কে জানে! যাও মা, রুমে গিয়ে ঘুমাও। অন্যদিন তো তাও রাতে অন্তত দেখা হয়। আজকে তাও হল না। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে নিজের রুমে চলে গেল অন্বেষা। জানে সে, আজও হয়ত সামিয়া আর তার বন্ধুদের সাথে আছে রেহান। প্রতিরাতের মত আজকেও কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলল। এভাবে আর কতদিন টিকতে পারবে, তাই ভাবছে এখন! শরীফ আহমেদ অন্বেষাকে আবার তাদের কোম্পানিতে জয়েন করতে বলেছেন। অন্বেষাও খুশি মনে এই চাকরি করছে। কারণ এখন প্রায় প্রতিদিনই রেহানের সাথে তার দেখা হয়, যদিও এতে রেহান মনে হয় বিরক্তই হয়, তাতে অন্বেষার কিছু যায় আসে না। আর শরীফ আহমেদের এ কোম্পানিতে অন্বেষাকে চাকরি দিতে চাওয়ার একমাত্র কারণ রেহানকে চোখে চোখে রাখা। কারণ রেহান সামিয়াকে তার সহকারী হিসেবে এই কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছে।

অন্বেষার জন্য হয়তবা রেহান আর আগের মত সামিয়ার সাথে মিশতে পারে না। তাই ইদানীং তার সাথে অন্বেষার সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও খারাপের দিকে গিয়েছে। যেকোন কাজের জন্য অন্বেষাকে দোষারোপ করে রেহান। আর ছুটির দিনে তো অত্যাচারের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। সে চায় যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, অন্বেষা তার বাবার বাড়ি চলে যায়। কিন্তু অন্বেষা যায় না। সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে। রেহান অবাক হয়। মেয়েটা এত সহ্যশক্তি পায় কোথা থেকে!

কয়েকদিন হল রেহানের বাবা মা ঢাকার বাইরে গেছেন। ফিরবেন এক মাস পর। রেহান ঠিক করেছে, এটাই হয়ত তার পাওয়া শেষ সুযোগ। এর মধ্যেই অন্বেষাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে। তাই তার সাথে রেহান যাচ্ছেতাই ব্যবহার শুরু করল।

–এহ,এটা কি রেঁধেছ?

–তোমার পছন্দের ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস।

–ধ্যাত, এটা কি খিচুড়ি হয়েছে নাকি? রাঁধতে পারো না রাঁধতে যাও কেন?

বলে রেহান খাবার রেখেই উঠে যাচ্ছিল। অন্বেষা বাধা দিল।

–খাবার ছেড়ে উঠে যেওনা। এটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।

–তোমার কাছ থেকে আমি ভদ্রতা শিখব নাকি? আর তোমার যদি মনে হয় আমি অভদ্র, তাহলে আমি তাইই। আমাকে বিয়ে করার সময় তোমার এ কথা মনে ছিল না? নাকি তোমার বাবা মা যখন দেখল যে এমন ধনী ছেলেকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না, তখন তোমাকে আমার কাঁধে চাপিয়ে দিল কিছু না দেখেই?

–দেখ,আর যাই করো, আমার বাবা মাকে নিয়ে কথা বলবে না।

–বাহ, তোমার মুখ দিয়ে তো আগের চেয়ে আরো বেশি বুলি ফুটেছে। কার সাথে মিশছ ইদানীং? আমি যখন বাসায় থাকি না, তখন তো তোমার ভালই হয়, অন্যের সাথে মিশতে পার…

অন্বেষা এবার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল।

–কি, এখন আর কথা বলছ না কেন?

–তোমার যা ইচ্ছে আমাকে বল। কিন্তু আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।

–থাকো তুমি এখানে,আমি গেলাম।

–কোথায় যাও?

–বাইরে থেকে খেয়ে আসব..

অন্বেষা জানে, রেহান আসলে সামিয়ার কাছে যাচ্ছে।

সে জানে না, আর কতদিন তাকে এভাবে থাকতে হবে। কষ্ট জমতে জমতে মহাসমুদ্র হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও রেহানের মাঝে কোন পরিবর্তন নেই।

হঠাৎ করে জ্বর আসল অন্বেষার। হয়ত তার মন আর বেদনার ভার সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু জ্বর আসার পর যেন রেহানের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল। অন্বেষাকে তো বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছেই না, বরং হঠাৎ বলে উঠল,

–অনেকদিন বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হয় না। আজকে ওরা আসবে। আর,ওরা বাইরের খাবার খেতে চাচ্ছে না। তাই তোমাকেই রাঁধতে হবে।

–কতজন আসবে?

–২১ জন!

অন্বেষা অবাক হল, এত ফ্রেন্ড রেহানের কবে ছিল? তারপরেও মুখে কিছু বলল না। বুঝল, এটাই হয়ত রেহানের শেষ চাল।

এই জ্বর নিয়ে এতগুলো মানুষের রান্নাবান্না করতে যে অন্বেষার কত কষ্ট হয়েছে, তা শুধু সেই জানে। তারপরেও সবাইকে তৃপ্তির সাথে খেতে দেখে অন্বেষার মন ভরে গেল। আর এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে, এখানে শুধু রেহানের বন্ধু না, সামিয়ার বন্ধুদেরকেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তাই এত মানুষ!

একটু পর দেখল, রেহান সামিয়াকে হাত ধরে নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে সে আজ অনেক খুশি।

রেহান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–ফ্রেন্ডস, আমি এই মাসেই সামিয়াকে বিয়ে করছি। আর তার জন্যই এই পার্টির আয়োজন করেছি।

অন্বেষার হঠাৎ মনে হল, সমস্ত পৃথিবীটা দুলে উঠেছে। এমনিতেই তার শরীর দুর্বল, তার উপর রেহানের এই কথা শোনার পর আর সহ্য করতে পারল না, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।

অন্বেষাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখেও রেহানের কোন ভ্রুক্ষেপ হল না। সে সামিয়াকে নিয়ে চলে গেল।

রেহানের বেস্ট ফ্রেন্ড সিয়াম, ওদের কোম্পানিতেই কাজ করে, তাই অন্বেষার সাথেও ভাল খাতির আছে। সেই অন্বেষাকে সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

এক সপ্তাহ পর।

অন্বেষা খানিকটা সুস্থ হয়েছে, কিন্তু শরীর এখনো দুর্বল। হাসপাতাল থেকে আজ বাড়ি ফিরবে সে। শ্বশুরবাড়ি নয়, নিজের বাড়ি। হ্যা, হার মেনেছে অন্বেষা। রেহানের কাছে হার মেনেছে। কোনোভাবেই রেহানের মনে জায়গা করে নিতে পারেনি সে। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু শুন্য হৃদয় নিয়ে নয়, রেহানপূর্ণ মন নিয়ে। রেহানের কাছে জিততে গিয়ে কখন যে তাকে ভালবেসে ফেলেছে, টেরই পায়নি অন্বেষা। কিন্তু এই একসপ্তাহ রেহানকে না দেখে বুঝতে পেরেছে সে কতটা ভালবাসে তাকে। যদিও এই একসপ্তাহে একদিনও রেহান অন্বেষাকে দেখতে আসেনি, কোন খোঁজও নেয়নি সে। তাই অন্বেষা ধরেই নিয়েছে রেহানকে আর কখনওই পাবে না সে। অন্বেষা রেহানদের বাসা ছেড়ে নিজের বাসায় চলে আসলেও এখনো চাকরি ছাড়েনি। কারণ যার অনুরোধে চাকরিটা করছিল, তিনিই এতদিন ঢাকায় আসেননি। তাই শরীফ আহমেদ ঢাকায় এসেছেন শুনেই অন্বেষা রিজাইন লেটার দেওয়ার জন্য অফিসে এসেছে। শরীফ আহমেদকে যখন সে রিজাইন লেটার দিল, তখন তিনি অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন অন্বেষাকে চাকরিটা করতে, কিন্তু রেহানের সাথে প্রতিদিন দেখা হওয়ার ভয়েই সে চাকরিটা আর করতে চায়নি।

অফিস থেকে বের হয়েই অন্বেষা দেখল, রেহান আর সামিয়া কোথাও যাচ্ছে। ওরা প্রেমে এতই মগ্ন ছিল যে একটা গাড়ি যে ঠিক ওদের দিকেই আসছে তা দেখতেই পেল না। সামিয়া যখন গাড়িটাকে দেখল,রেহানকে রেখেই সে সরে গেল। অন্বেষা ঠিক কি করবে, বুঝতে পারল না। সে রেহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ঠিকই, কিন্তু নিজেই গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করল। রাস্তা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। রেহান অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই রইল।

আজ রেহান অন্বেষাকে খুব মিস করছে। ওর হাতের রান্না, রেহানের জন্য ওর অপেক্ষা, অশ্রুসজল মায়াভরা টানা দুইচোখ, শান্ত স্নিগ্ধ মুখ, সবকিছু যেন রেহানের হৃদয়ে ঢেউ তুলছে। কেন সে আগেই অন্বেষাকে চিনল না, কেন সে আগেই বুঝতে পারল না যে, সামিয়া নয়, অন্বেষাই ওকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসত? সেদিন, সেই বিপদের সময় তো অন্বেষাই নিজের জীবন বাজি রেখে রেহানকে বাঁচিয়েছিল। আর সামিয়া তাকে রেখেই সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে যদিও সামিয়া অনেকবার এই ঘটনার কৈফিয়ত দিতে এসেছিল। কিন্তু রেহান শুনেনি। কারণ যা জানার সব জানা হয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু এটা জানতে তার বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে! এখন কি আর রেহান অন্বেষাকে পাবে?

মাথার সব চিন্তা দূর করে রেহান সিদ্ধান্ত নিল, অন্বেষা যেদিন আবার আগের মত হাটতে পারবে ,সেদিন তাকে রেহানের মনের কথা খুলে বলতে যাবে, এর আগে পর্যন্ত তার সেবা করে যাবে দিনরাত জেগে। কারণ অন্বেষাই তো এখন রেহানের দিনরাত, সব! হ্যা, অন্বেষা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল! গাড়ির চালক হার্ড ব্রেক করায় আর রেহান অন্বেষাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছিল অন্বেষা।পায়ে যদিও চোট পেয়েছিল, হাটতে পারে না এখন। কিন্তু সেদিন দ্রুত চিকিৎসা করায় অন্বেষা পঙ্গু হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে।

৩ মাস পর।

অন্বেষার সুস্থ হওয়া উপলক্ষে শরীফ আহমেদ রেহানদের বাসায় পার্টি দিয়েছেন। রেহানের অনুরোধেই পার্টি দেওয়া হয়েছে। কারণ সে পার্টি দিয়েছে জানলে হয়ত অন্বেষা আসত না। শরীফ আহমেদকে এখনো অন্বেষা অনেক শ্রদ্ধা করে। তাই তাঁর কথা সে ফেলতে পারবে না। অবশ্য পার্টিটা দেওয়ার অন্য কারণও আছে। আজ রেহান আর অন্বেষার বিবাহবার্ষিকী। তাই আজকেই রেহান অন্বেষাকে তার মনের কথা বলতে চায়। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন অন্বেষা এল না, রেহান তখন হতাশ হয়ে গেল। ভাবতে লাগল,অন্বেষা কি তাকে অন্তত ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দিবে না?

ঠিক এই সময় অন্বেষাকে দেখা গেল রেহানের পছন্দের আকাশী রঙয়ের শাড়ি পড়ে এগিয়ে আসতে। এই রঙয়ে অন্বেষাকে অপরূপ লাগছে! এতদিন রেহান এই সৌন্দর্যকে মিস করেছে বলে রেহানের নিজের উপরই নিজের রাগ হচ্ছে। সবাই যখন কথা বলায় ব্যস্ত, তখন রেহান অন্বেষাকে হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে এল। অন্বেষা যখন হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, রেহান বলল,

–তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ?

অন্বেষা চুপ করে রইল।

–তোমার মৌনতাকে কি আমি সম্মতির লক্ষণ ধরে নিব? আচ্ছা,কিছু বলতে হবে না। আমিই বলছি। তোমাকে এই পর্যন্ত আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি, না বুঝে অনেক কথা শুনিয়েছি। আমি জানি, অনেক রাত তুমি আমার জন্য না ঘুমিয়ে কেঁদেছ। অনেক কষ্ট তোমার মনে চেপে রেখেছ। কাউকে বুঝতে দাওনি, এমনকি কোনদিন তোমার বাবা মার কাছে, আমার বাবা মার কাছে একটা অভিযোগও করনি তুমি। শুধু আমাকে দিন দিন তোমার ভালবাসার ঋণী করে রেখেছ। তোমার এ ঋণ কি কোনদিন পরিশোধ করতে দিবে না? তুমি চলে যাওয়ার পর তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত শুধু তোমার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। এমনকি তোমার রান্না খিচুড়ি আর গরু মাংসও আমি অনেক মিস করি। তুমি আবার আমার কাছে ফিরে এস। আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না প্লিজ।

–তুমি কি এখনো শুধু নিজেই কথা বলে যাবে? আমাকে কিছু বলতে দেবে না? এতক্ষণে অন্বেষার মুখে কথা শুনতে পেয়ে রেহান আনন্দে বলে উঠল,

–বল,এতকাল তোমার কথা শুনব বলেই তো প্রতীক্ষা করছিলাম!

–আমি তোমার কাছে ফিরে আসব এক শর্তে!

–কি শর্ত?

–আমার ভালবাসার ঋণ কিন্তু সুদে আসলে জমে অনেক হয়েছে।তোমাকে সবকিছু পরিশোধ করতে হবে। আর সবসময় আমার পাশে থাকতে হবে। কোনদিন যেন না দেখি আর কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছ। তোমাকে অন্য কোন মেয়ের সাথে দেখলে যে আমার কি পরিমাণ কষ্ট হয় তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আবার যদি আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়েছ দেখি, তাহলে আমি কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করব। আর, খিচুড়ি আর গরুর মাংস খাওয়ানোর ঋণটা না হয় আমিই শোধ করে দিব! অন্বেষার মুখে সেই চিরচেনা মিষ্টি হাসি, যেই হাসির খোঁজ পেতে রেহানের এতদিনের প্রতীক্ষা! রেহান কাছে এসে অন্বেষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

–আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি, আর আজীবন ভালবেসে যাব। কখনো তোমাকে কষ্ট পেতে দেব না। সব কষ্ট থেকে তোমাকে আমি আগলে রাখব। অন্বেষাও পরম নির্ভরতায় রেহানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে দেখা গেল প্রশান্তির অশ্রুকণা, মুখে বিজয়ের হাসি।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত