— বিয়ে করবেন আমাকে?
আনিকার মুখ থেকে কথা টা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো উদয়। আনিকা তাঁর বস। সে যে কোম্পানির কুকার। সাবলীল বাংলায় বলতে গেলে বাবুর্চি। আনিকা সে কোম্পানির মালিক। উদয় সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কারণ আনিকা মেয়ে টা ভীষণ গল্পপ্রিয়। হয়তো গল্পের প্রথম লাইন বলেছে।
— থেমে গেলেন কেনো? গল্পের বাঁকি অংশ বলবেন না?
আনিকা চেয়ার টা সোজা করে বসে— আমি সবসময় গল্প পড়তে ভালবাসি। ভীষণ বইপ্রিয় একটা মেয়ে। মাঝে মাঝে দারোয়ানকে ডেকেও তাঁর সাথে গল্প করি। কেউ ভালো পায় কেউ পাগলামু বলে। কিন্তু আমি আজকে কোনো গল্প করছি না। আমি মন থেকেই বলছি।
উদয় বিপদে পড়ে গেলো। আনিকা আবার তাঁর চরিত্রের পরীক্ষা নিচ্ছে না তো? না কী সে লোভী কী না তা ঘেঁটে দেখছে? কোনোরকম জবাব দিলো— আমি অল্প শিক্ষিত একটা ছেলে। গ্রাম থেকে এসেছি। বড় ছেলে বিধায় পুরো পরিবারটাকে আমাকেই দেখতে হয়। বাবা অসুস্থ। যে টাকা বেতন দেন। তা দিয়ে কোনোরকম বাবার ঔষধপত্র কিনে টেনেটুনে চলে যায়। কিন্তু আমি লোভী নই বস।
আনিকা কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বললো— আপনি কত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আপনার এই ব্যাপার টা আমাকে খুব হিংসে ধরায়। তাছাড়া আপনি যা ভাবছেন আসলে আমি তা করছি না সত্যি। আমি আপনার ব্যাপারে সব জানি। আপনি লোভী নন। তা আমি অনেক আগেই বুঝেছি। লোভী নন সে কারণেই তো আপনাকে আমার আরো বেশি ভালো লাগে। কথাগুলো সরাসরি বলছি বলে ভাববেন না আবার মেয়ের লজ্জাশরম কম।
উদয় আনিকার চোখে এবার লুব্ধক দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে যায়৷ এবার সে নিশ্চিত। আনিকা সত্যি সত্যিই বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, কিন্তু কেনো? সে তো দেখতেও খুব সুদর্শন নয় যে শুধু চেহারা দেখে সব ভুলে যাবে। উত্তর দিলো— বিদেশী গল্প পড়তে পড়তে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে বস৷
আনিকা হাসলো।
তবে শব্দ করে নয়৷ বললো— জানি আমি দেখতে সুন্দরী না। প্রতিটা সাধারণ মেয়ের মতো রান্না করতে পারি না। শাড়ি পড়তে পারি না। আরো অনেক কিছু। এসব আপনার অপছন্দ হতে পারে। কিন্তু আমার আপনাকে ভালো লেগেছে। বিয়ের প্রস্তাবও দিলাম। বাকীটা আপনার হাতে। আমি কাউকে জোর করতে পছন্দ করি না, জানেনই তো।
উদয় চলে আসলো পাকঘরে।
উদয়।
পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারেনি। ছোটবেলা থেকে হোটেলে কাজ করেছে। তাঁর রান্নার হাত ভালো। গ্রামে সুনাম আছে। সে সুবাদে এই কোম্পানির কুকার হিসেবে যোগ দিয়েছে। অন্য জায়গার থেকে এখানে খুব ভালো বেতন পায় সে।
মিথ্যে বলে না সচারচর। কিন্তু একটা বড় মিথ্যে সে অনেক আগে আনিকার কোম্পানির কাছে বলেছে। সে অবিবাহিত!
একটি মাত্র মিথ্যা!
বিবাহিত থাকার পরেও একটু ভালো মাইনের চাকুরী পাবে বিধায় বলেছিলো সে অবিবাহিত। এই কুকার পদে কোম্পানির লোকেরা বিবাহিত লোক নিবে না। বিবাহিতদের না কী পিছুটান বেশি। কাজ করে না মন দিয়ে। সারাদিন বৌয়ের সাথে ফুসুরফুসুর করে।
উদয় কাজে ফাঁকি দেয়নি।
সায়েরা৷
উদয়ের বৌয়ের নাম। গ্রামের সহজ সরল সাধারণ একটি মেয়ে। সাত বছর প্রেম করে তাঁকে বিয়ে করেছে উদয়। আবার বিয়ের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে কদিন আগে। একটা ছেলে আছে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাবে ভাবছে।
উদয়ের রাতে ঘুম হচ্ছে না।
সে কী অনেক বড় অপরাধই করে ফেললো না কী এখানে নিজেকে অবিবাহিত বলে? সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু এই মিথ্যে টা খুব প্রয়োজন পড়ে গিয়েছিলো তাঁর পরিবারের জন্য! সায়েরাকে আজকের কথা না বলে শান্তি পাচ্ছে না উদয়। ফোন দেয়ার সাথে সাথে সায়েরা ধরে বললো— আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো?
উদয় সালামের জবাব দিয়ে— ভাল নেই। আজকে এক কাহিনী ঘটেছে।
তারপর পুরো ব্যাপার টা খুলে বললো উদয়। সব শুনে সায়েরা খুব শক্ত ভাবে বললো— চলে আসো তুমি। কাজের অভাব হবে না। কিন্তু আমি তোমার বুকে অন্য কেউ শুয়ে আছে তা কল্পনা করতে পারবো না।
— দেখছি কী করা যায়।
নিচক এক যন্ত্রণায় পড়ে গেলো উদয়। তাঁর বৌকে সে খুব ভালবাসে। সায়েরা হয়তো আরো বেশি ভালবাসে। তাঁদের একটা সন্তানও আছে। অসুস্থ বাবা বাড়িতে। সব কিছু মিলিয়ে চাকুরীটাও দরকার। আনিকা তাঁর বিবাহিত জীবনের কথা জেনে গেলে চাকরীচ্যুত করবে। আনিকা হাজার টা ভুল সহ্য করতে পারে। কিন্তু একটিও মিথ্যে নয়।
আবার এরকম ভালো বেতনের চাকুরী সে আর কোথাও পাবে না তাও নিশ্চিত। এসব ভাবতে ভাবতে যখন মাথা টা হাল্কা ধরলো তখন আনিকার ফোন! মাঝ রাত্তিরে আনিকার ফোন পেয়ে নড়েচড়ে বসলো। এর আগে কোনোদিন আনিকা রাত্তিরে ফোন দেয়নি।
উদয় ফোন তুললো— বস, আপনি এতো রাত্তিরে?
— হ্যাঁ। বিরক্ত করলাম না তো?
— তা না ঠিক।
— অনেকক্ষণ ফোন ব্যস্ত পেয়েছি। কার সাথে কথা বলছিলেন জানতে পারি?
— বাবা ফোন করেছিলো।
— আপনার গলার আওয়াজ বলে দিচ্ছে মিথ্যে বলছেন। দেখুন আমি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না। কিন্তু আমার জানা দরকার। কেনো তা আপনি ভালো করে জানেন। তা আপনি বলবেন কী?
— মাফ করবেন বস। আমিও এক কথা দুইবার বলি না।
আনিকা ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে বললো— যদি আপনার প্রেমিকা না থাকে তো দরজা টা খুলুন। আর থাকলে দরকার নেই। আমি আপনার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি!
উদয় তড়িঘড়ি করে উঠে রুমের বাতিগুলো জ্বালালো। অফিসের রান্না করার রুমের এক কোণে থাকে সে। এভাবে এখানে আনিকা এসে পড়বে সে কল্পনা ও করতে পারেনি। দরজা খুলে দেখলো আনিকা শাড়ি পড়ে এসেছে! হাতে চুড়ি, চোখে কাজল, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক! সব কিছু মিলিয়ে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। যে কেউ একবার তাকালে চোখ ফেরাতে চাইবে না।
তবে উদয় চোখ ফেরালো। কোনো অপরূপার দিকে চোখ গেলে তাঁর সায়েরার কথা মনে পড়ে যায়। আনিকা নীরবতা ভেঙে বললো— ভিতরে ঢুকতে বলবেন না?
— আপনার অফিস, আপনার কর্মচারী। আমি বলার কে?
আনিকা লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে রুমে ঢুকে বললো— আমি আজকে আপনার সাথে থাকবো।
উদয় চমকে উঠে— জ্বী? মানে?
— ভয় পাবেন না। আপনার সাথে নয় ঠিক, আপনার রুমে। আপনি আমার রুমে একটি রাত কাটাবেন আর আমি আপনার রুমে। আপনি আমার বিয়ের প্রস্তাব মানেন আর না মানেন এটা মানতেই হবে।
উদয়ের এ সি রুমে ঘুমানোর কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু সায়েরা ছাড়া অন্য কোনো নারীর সাথে বিছানায় যাওয়ার কথা ভাবার আগেই মরণ চায় আল্লাহ্’র কাছে। উদয় রাজি হয়ে গেলো। আনিকা মুচকি হেসে বললো— আপনি তো আমার দিকে তাকাচ্ছেনই না।
— তা না। আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে।
— প্রথমবার কারো জন্য সেজেছি। শাড়ি পড়েছি, কাজল দিয়েছি।
উদয় না শোনার মতো করে রইলো। আনিকা আবার গলা বাড়ালো— আপনি বিরক্ত হচ্ছেন৷ যান বাইরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
উদয় আচ্ছা বলে গাড়িতে এসে উঠে বসলো। গাড়িচালক তাঁকে এমন সম্মান করছে মনে হচ্ছে সে ইতিমধ্যেই আনিকার স্বামী হয়ে গিয়েছে। সহ্য হচ্ছে না উদয়ের। নিজেকে সামলিয়ে নিলো। বেশিদূর নয় আনিকার বাড়ি। গাড়িচালকই আনিকার শুবারঘর দেখিয়ে দিলো।
উদয় আনিকার নীদ্রাকক্ষে ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। পুরো রুমের জুড়ে উদয়ের ছবি টানানো। দেখে বুঝা যায় স্পষ্ট কেউ লুকিয়ে তুলেছে। বিছানায় বড় করে উদয় লেখা। কোলবালিশ সহ চায়ের কাপটাতেও! সায়েরা আজকের রাতের কথা জানতে পারলে কষ্টে মরেই যাবে। ভালো লাগছে না।
সায়েরাকে আবার ফোন দিলো। সায়েরাকে উদয় জাগিয়ে রাখে না। বেশি রাত পর্যন্ত সায়েরা চাইলেও কথা বলে না। তবে আজকে উদয়ের আবদার সারা রাত কথা বলতে হবে। সায়েরাও খুশি হলো। তেরো বছর পিছনে ফিরে গিয়েছে দুজন। ভোরবেলা পর্যন্ত কথা বলেছে।
সকালে আনিকা নিজের বাড়ি ফিরে এলো। উদয় ও অফিসে। দিন দিন আনিকা যেভাবে উদয়ের নেশায় মেতে উঠছে তা ভালো লক্ষ্মণ না। ভয় পাচ্ছে সামনাসামনি সায়েরার কথা বলে দিতে আনিকাকে। সায়েরাও বারবার ফোন করছে। এরকম স্বস্তি অস্বস্তিতে একটা সপ্তাহ কেটে গেলো।
কয়েকদিন ধরেই আনিকাকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। সে চাইলেই ব্যক্তিগত ডাক্তার রাখতে পারে তবুও রাখে না। আজকে এক নিঠুর বাণী শুনে আসলো ডাক্তারের মুখে। একটা মেয়ের জন্য এর থেকে বেশি দুঃখ কষ্ট আর হয় না। যখন ডাক্তার বলে— আপনি কোনোদিন মা হতে পারবেন না!
বাড়িতে ফিরে রুম বন্ধ করে একটানা কয়েক ঘণ্টা কান্না করেছে। মা বাবাও বেঁচে নেই যে তাঁদের কুলে মাথা রেখে কাঁদবে। আঠারো বছর থাকাকালীন তাঁরা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মা বাবার একমাত্র সন্তান ছিলো আনিকা। উদয়ের সব ছবি তুলে ফেলেছে দেয়াল থেকে। কোলবালিশ, চায়ের কাপ ও ফেলে দিয়েছে। আর যাবে না উদয়ের কাছে সে ভালবাসা চাইতে। সে ভেবে পাচ্ছে না তাঁর এতো টাকা পয়সা দিয়ে কী আসবে যাবে? যদি না কেউ আম্মু আম্মু বলে গলায় জড়িয়ে ধরে? ঠিক করে নিয়েছে উদয় ছুটি কাটিয়ে আসলেই সব কিছুর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবে।
উদয় সকালে ছুটি নিয়েছে।
আনিকার কাছে ছুটি হলেও উদয় আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। বাড়িতে গিয়ে ফোনে আনিকার কাছে মিথ্যে কথা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবে। সায়েরাকে আসার কথা জানায়নি। হঠাৎ উদয়কে দেখে সায়েরার মুখের অবস্থা কেমন জানি হয়ে যায়। উদয়ের এই দৃশ্য’টা খুব প্রিয় সেজন্যই জানায়নি।
বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহর হয়ে যায়। দরজার তালার একটা চাবি উদয়ের কাছে থাকে। সেজন্য সায়েরাকে ডাকেনি।
সকালে উঠে যখন দেখবে সায়েরা তাঁর বুকে। সায়েরা চমকে উঠবে। সায়েরা জেগে যাবে ভেবে আস্তে আস্তে দরজা ঢেলে ভিতরে ঢুকলো উদয়।
রুমে ঢুকার পর খাট নাড়াচাড়ার করার শব্দ শুনে উদয় বাতি জ্বালালো। দেখলো ছেলে টা ঘুমিয়ে আছে। আর সায়েরা কোনো পুরুষের সাথে প্রেমলীলায় মক্ত আছে! রুমের বাতি জ্বালানোর পরেও তাঁদের হুঁশ হলো না! উদয় এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না।
বুকে যেন কেউ চাকু মেরে কলিজা বের করে নিয়েছে। সায়েরা বলে জোরে একটা চিৎকার দিলো। পাশের রুমের অসুস্থ বাবা সজাগ হয়ে গেলো। ছেলে টা সজাগ হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সায়েরা আর তাঁর খাটের সঙ্গীও।
সঙ্গীটাকে পালানোর সুবর্ণ সুযোগ করে দেয় উদয়। তাঁর দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। এই সঙ্গী আর কেউ না, যে তাঁকে এতো ভালো বেতনের একটা চাকুরীর খোঁজ দিয়েছিলো। তাঁর টাকা পয়সার অভাব নেই। এম পি এর ছেলে। ছেলে টা বাবাকে দেখে খুশি হয়েছে বেজায়। এতো কিছু বুঝেনি।
ছেলে টা আবার ঘুমিয়ে গেলে সায়েরাকে কান্নাসিক্ত নরম গলায় উদয় একটি কথাই জিজ্ঞেস করে— কথা ছিলো আমরা সারাজীবন গাছ তলায় থাকবো তবুও আলাদা হবো না। আর না জানি কবেই তুমি আমার থেকে আলাদা হয়ে গেছো। বলো না কেনো? ছেলেটার কথা একবার ও ভাবলে না?
সায়েরা মুখের উপর বলে দেয়— আমার কথা কে ভাববে? বছরে একটা শাড়ি ছাড়া কী দিতে পারিস তুই?
উদয় নিরুত্তর।
এরকম এক টা দিন উদয়ের জীবনে আসবে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে বুঝতে পারছে সায়েরা আর তাঁর সাত বছরের প্রেমিকা সায়েরা বা সাত বছরের স্ত্রী সায়েরা, দুটোর একটাও নেই। এক কাপড়ে চলে যায় বাইরে। সেখানে তাঁর প্রেমিক বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকালে উঠে ছেলে ফারায মাকে খুঁজছে। মা যে নেই। ছেড়ে চলে গিয়েছে।
উদয় লুকায়নি৷ স্পষ্ট বলে দিয়েছে মা তোমাকে, আমাদের ছেড়ে ভালো থাকতে চলে গিয়েছে। তারপর থেকে ফারায নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকছে। বাবার অসুস্থতা একটু না অনেক বেশিই বেড়ে গিয়েছে। এতোটাই বেড়ে গিয়েছে যে সায়েরা চলে যাওয়ার তিন দিনের মাথায়’ই মারা যান!
এর ভিতরে উদয়ের ফোন বন্ধ ছিলো একটানা এক সপ্তাহ।
সে কারণে আনিকার ফোন ধরতে পারেনি সে।
আজকে ছেলেকে নিয়ে আবার আনিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে উদয়। দরকার পড়লে আনিকার পায়ে পড়ে মাফ চাইবে। চাকুরী ছেড়ে দিবে। ছেলেটাকে নিয়ে গ্রামেই থাকবে।
আনিকার সামনে উদয় আর তাঁর ছেলে। আনিকা উদয়ের ছেলেটাকে খেয়াল করছে ভালো করে। ঠিক নাকের বাম পাশে একটা তিল ফারাযের, আর আনিকার ও সেখানেই সেরকম একটা তিল! ছেলেটাকে কাছে ডাকতে ইচ্ছে হলেও ডাকেনি। মনের অবস্থা মৃত্যু শয্যাশায়ী তাঁর।
আনিকা কষ্ট হলেও উদয়ের কাছে সবকিছু খুলে বলে ক্ষমা চেয়ে নিলো। আনিকার এরকম অবস্থাতে কীভাবে সে বলবে যে ছেলে টা দাঁড়িয়ে আছে পাশে সে তাঁরই সন্তান? উদয় বলেনি। ভেবেছিলো চলে যাবে। আনিকা শেষে বললো— পিচ্চি টা কে?
— ভাতিজা।
এ কথা শুনে ফারায কান্না করে দিয়ে বললো— আমি তোমার ভাতিজা আব্বু? তুমিও মায়ের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তাহলে? আমাকে বিক্রি করে দিতে এসেছো এখানে না? আমি কী এতোই খাই পড়ি?
আনিকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক হয়েই বললো— আপনার ছেলে? আপনার মতোই হয়েছে। কথার কড়া জবাব দিয়ে দেয়।
আনিকার এরকম স্বাভাবিক আচরণে উদয় অবাক হয়। আনিকার যে আর কিছু আসে যায় না উদয় বিবাহিত না কী অবিবাহিত তা নিয়ে৷ বরং উদয়ের ছেলেটাকে দেখে ভালোই লেগেছে। নাকের বাম পাশের তিলটার জন্য ভুলতেও পারবে না কোনোদিন। উদয় চলে যায়নি, বা আনিকাও চাকরীচ্যুত করেনি মিথ্যে বলার জন্য।
অবশ্যই করতো, শুধু ছেলেটার জন্য। নাহয় আনিকা মিথ্যে সহ্য করার বেটি নয়। শত যাই হোক। অফিসের পাশেই ছোট্ট বাসা নিয়েছে উদয়। বাপ ছেলে ভালোই থাকে। একটা স্কুলে ভর্তি করিয়েছে ফারাযকে। আনিকা রোজ লুকিয়ে একবার দেখা করে আসে। উদয়কে জানয়ে দেয় না।
ফারাযকে মানা করে দেওয়াতে সে ও বলে না। বাঘের গল্প শুনাচ্ছিলো ফারাযকে উদয়। ঘুমাচ্ছে না সে। হটাৎ বলে উঠলো— আচ্ছা আব্বু, আম্মু ডাক টা কী খুব খারাপ? আম্মু ডাকলে কেউ কষ্ট পায়? তোমার অফিসের আন্টিকে আজকে আম্মু ডেকেছিলাম আর উনি সমানে কান্না করলো কেনো?
উদয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো— কখন?
— কখন আবার, দুপুরে। রোজই তো আমার জন্য টিফিনে এটা ওটা আনে। তুমি নাকি পাঠাও। আবার তোমাকে বলতেও নিষেধ করে। কিন্তু আজকে উনি অনেক কান্না করেছে। আমার ভালো লাগছে না। ফোন দাও না স্যরি বলি।
উদয় আবার বিড়ম্বনায় পড়ে গেলো। ফোন দিতে বাধ্য হলো প্রায়। নাহলে ঘুমুচ্ছেই না। আনিকা ফোন ধরতেই ফারায বললো— স্যরি আন্টি। আমি আপনাকে কাঁদিয়েছি আজ।
আনিকার নীরব কান্নার শব্দ শুনতে পারছে উদয়। জবাব দিলো— রোজ কাঁদাবে এভাবে আম্মু বলে?
— আচ্ছা।
এভাবে ওরা কথা বলতেই আছে। পিচ্চি ছেলে টা কতো কথা বলতে পারে। উদয় ভাবছে কে জন্ম দিলো আর কে মা হলো!
এভাবেই একটু একটু ফারাযকে নিয়েই ফেলেছে আনিকা। ছেলে টা তাঁর কাছে আসতেই চায় না। এক চাঁদনী রাতে আনিকাকে ফোন দিয়ে বললো— পৃথিবীর চাঁদ আকাশে। আর আমার চাঁদ টা আপনার কাছে। তাঁকে ছাড়া আমার ঘুম হয় না।
— নিয়ে যান এসে। আমি কী আটকে রেখেছি?
— না, কিন্তু চাইলে আমাকে আটকে রাখতে পারেন।
— আমার এত সাহস নেই।
ফোন টা কেটে আনিকা ঠিকই খুশিতে আত্মহারা। নয় তারিখ তাঁদের বিয়ে হয়। হানিমুন করতে যায় গ্রামের বাড়ি। এখন উদয় অফিসের না হলেও ঘরের কুকার। শ্বশুরবাড়িতে সে থাকে না।
সেই ছোট্ট বাসাতেই থাকে। আনিকারও সেখানে থাকতে কোনো আপত্তি নেই। লোকেরা কতকিছু বলে। আনিকা সেদিকে কান দেয় না।
কিছু বছর পরের কথা।
সূর্যি মামা এখনো উঁকি দেয়নি।
আনিকা উদয়কে ডেকে বললো— আচ্ছা তোমার রক্তের গ্রুপ কী?
— ও পজেটিভ।
— তাহলে জলদি উঠো। একজনকে রক্ত দিতে হবে। সঠিক সময়ে না দিতে পারলে উনি ও মারা যাবেন। উনার পেটের সন্তান ও মারা যাবে।
— তোমার ও তো ও পজেটিভ। তুমি ফারাযকে নিয়ে যাও। একেবারে স্কুলে দিয়ে এসো। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।
— খালি ঘুম আর ঘুম। এই ঘুমই আমার এক নাম্বার সতিন। কবে এই সতিনটাকে ছাড়বে বলো?
— কালকে ছাড়বো। আজকে যাও।
— মনে থাকে যেন।
রোজই এক কথা বলে উদয়। আনিকারও উদয়কে এ নিয়ে বকতে ভালো লাগে।
ফারাযকে নিয়ে আনিকা রক্ত দিতে চলে গেলো। এর পর আরো দুই ঘণ্টা ঘুমানোর পর উঠলো উদয়। ভুলে ফারাযের স্কুল ব্যাগটাই রেখে গেছে তাড়াহুড়োয়। ফোন দিবে বলে ফোন তুলতেই আনিকার ফোন— ঘুম থেকে উঠা হয়েছে মহারাজের? তাহলে ফারাযের ব্যাগ টা স্কুলে দিয়ে আসা হোক। আমি অফিসে যাচ্ছি।
— আচ্ছা, তারপর কী রক্ত দিলে?
— হুম। কিন্তু একটা ব্যাপার কী জানো? মহিলা টা কীভাবে যেন ফারাযের দিকে তাকাচ্ছিলো!
— মহিলা? কী বলো? ফারাযের দিকে কীভাবে তাকাবে কেনো? আচ্ছা নাম কী উনার?
— সায়েরা আক্তার। উনার স্বামীটাও কী খচ্চর। একবার ও না কী দেখতে আসে না! সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে কী জানো? জীবনের প্রথম কাউকে রক্ত দিলাম আর সে তারপর এক ঘণ্টাও বাঁচলো না! বাচ্চা সহ মারা গেলো!
উদয় চুপ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বললো— ডিজিল্যাব হাসপাতালেই তো? কত নাম্বার কেভিনে?
— ৭৭, কেনো? আচ্ছা আমার সময় নেই। পরে কথা হবে। তুমি ফারাযের ব্যাগ টা জলদি দিয়ে যাও।
— আচ্ছা লক্ষ্মীটা।
— ঢং, রাখছি।
উদয় তাড়াহুড়ো করে ফারাযকে ব্যাগ দিয়ে হাসপাতে যায়। ৭৭ নাম্বার কেভিনে গিয়ে দেখে। এই সায়েরা আক্তার আর কেউ নয়। তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা, স্ত্রী এবং ছেলের আম্মু’ই!
সায়েরাকে দেখে নিজের অজান্তেই উদয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো— দুর্ভাগ্য তোমার সায়েরা। এতো ভালো একটা মেয়ের রক্ত নিয়েও বাঁচতে পারলে না। পরপারে আল্লাহ্ তোমাকে ভালো রাখুক।