এক
আমার স্ত্রীর বিয়ের আগে অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল। যেদিন আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম সেদিন অনেকক্ষন বসে ছিলাম সোফায় কোন এক প্রতিবন্ধির মত। সবাই যখন এই কথা সেই কথা নিয়ে হাসাহাসিতে ব্যস্ত আমি তখন অপেক্ষা করছিলাম জেনিয়া কখন আসবে। ত্রিশ মিনিট পর ও সবার সামনে এসে সালাম দিয়ে ঠিক আমার সামনা সামনি বসে। যেই আমি ওর আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সেই আমি মুহুর্তের মধ্যে অস্বস্থিবোধ করছিলাম। বিষয়টা অস্বস্থি না ও বলা যেতে পারে। কেমন যেন সমস্ত নার্ভাস আমাকে আচ্ছোন্ন করে তার করে নিয়েছিল। সবাই যখন ওকে টুকটাক কিছু আস্ক করতে লাগলো আমি তখন আড় চোখে ওকে বার বার দেখছিলাম। খানিক বাদে আমার মামা কৌশলে আমাদের দুজনকে কথা বলার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়। ছাদে এসে দুজনে কিছুক্ষন নিরবতা পালন করলাম। আমি কি বলে ওর সাথে কথা বলবো বুঝতে পারছিলাম না। সে মাথায় ঘুমটা দিয়ে জড়োসড়ো চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ইতস্তত হয়ে তাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “আপনার নাম কি?” সে আমার দিকে একটু তাকায়। এই তাকানোর মাঝে একটা অর্থ বুঝা যাচ্ছিল সেট হলো “ঢং ধরেন? নাম তো ঠিকই জানেন।” সে আস্তে করে জানায় জেনিয়া।” আমি বললাম “নামটা সুন্দর, আপনার মত “সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। এরপর চারপাশটায় আবার নিরবতা ভর করে। কিন্তু এই নিরবতা আমাকে বেশিক্ষন পর্যন্ত গ্রাস করতে পারেনি। ফের ইতস্তত হয়ে বললাম “আমার নাম জিজ্ঞেস করবেন না?” তারপর সে ইতস্তত হয়ে বললো “আমি জানি আপনার নাম জাহেদ।” আমি একটা মৃদু হাসি দিলাম। বিকেল বেলার রোদ্দুর ছায়াটা আস্তে আস্তে করে হারিয়ে যাচ্ছিল আর আকাশের মেঘ গুলো আমাদের মাথার উপর দিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিল। এই ছায়া আর আকাশের মেঘের সংমিশ্রনে পড়ন্ত বিকেলের উন্মাদ করা সৌন্দর্যের প্রফুল্লতা আভা আমি দেখতে পেয়েছিলাম। আমি ভাবছিলাম ওকে আর কি বলা যায়। যেই আমি বলতে যাবো পাত্র হিসেবে আমাকে আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারি? কিন্তু এই কথা বলার আগেই জেনিয়া গম্ভীর হয়ে আমাকে বললো “আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।” আমি মাথা দিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিয়ে বললাম “বলুন।” সে আরও একটু সময় নিল। তারপর আামার দিকে তাকিয়ে বললো “আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে কথাটা কিভাবে বলবো বা আামার বলার উচিৎ কিনা। আসলে আমার একজনের সাথে রিলেশন আছে।” ওর মুখে এমন কথা শুনে আমি কিছুক্ষন চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে বিষয়টা আমি মারত্নক ভাবে নেইনি। কারণ এ সময়টায় এসব বিষয় হরহামেশা হয়। আমি বললাম “পরিবারকে জানাননি কেন?” সে বললো “বলার মত একটা পরিস্থিতি থাকতে হয়। সে পরিস্থিতিটা আমার জন্য আসেনি। আবিদ চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। ভেবেছিলাম চাকরিটা পাওয়ার পরই বিষয়টা নিয়ে বাসায় কথা বলবো। কিন্তু তা আর হলো কই?” আমি কিছু না বলে ছাদে গম্ভীর হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলাম তারপর পায়চারি করছিলাম। সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল যে এই আমি এমন ভাবে পায়চারি করছি কেন। অনেকক্ষন পর আমি পায়চারি বন্ধ করে বললাম “আপনাদের সম্পর্কটা কি খুব গভীর?” সে কি প্রত্যুত্তর দিবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু আমার এই কথার ধরনটা ঠিকি বুঝতে পেরেছিল। তারপর সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জানালো “আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন কোন সম্পর্কই হয়নি। সম্পর্কটা শুধু ভালোবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই প্রান্ত থেক অপর প্রান্তের মানুষটাকে মিস করার মত শত শত অনুভূতিটাই হচ্ছে আমাদের সম্পর্ক।” আমি একটু মাথা চুলকিয়ে বললাম “ঠিকাছে আপনাকে আমি সাহয্য করতে পারি” সে আমার সাহায্যের কথা শুনে ভ্যাবাচিকা খেয়ে বললো “কি রকম?” আমি বললাম “আবিদের সাথেই যেন আপনার বিয়েটা হয় এই ব্যাপারে একটু হেল্প না হয় করলাম তবে একটা শর্ত আছে। শর্তটা পরে বলছি। প্রথমে আমি আপনার বাবা মায়ের কাছ থেকে সময় নিব এই যে আপনি আর আমি দুজন দুজনকে ভালোভাবে চেনা, জানার একটু প্রয়োজন আছে। দুজনে একটু বুঝে তারপর ডিসিশন জানাবো। আর শর্তটা হচ্ছে আবিদকে আমি চাকরি দিব তবে আবিদের চাকরি হওয়ার পরও এই বিষয়টা বাসায় জানাবেন না। এই জন্য জানাবেন না, কারণ মানুষ পরিবর্তনশীল। টাকা, পয়সা মানুষকে পরিবর্তন করে দেয়। আমার সাথে আবিদকেও বুঝার দরকার আছে। বুঝার পর তার পরিবর্তন আপনার কাছে যদি পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে বিয়ে করতে হবে, রাজি? এটাই শর্ত।” সে আমার শর্ত শুনে ভ্রু কুচকে অবাক হয়ে বললো “আমার আবিদ কখনো এমন হবে না” তারপর জেনিয়া আমার শর্তে রাজি হয়েছিল। এই শর্তটা আমি না দিয়ে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিতে পারতাম। কিন্তু এই শহরের পড়ন্ত বিকেলের উন্মাদ করা সৌন্দর্যের মাঝে তার শরীরের স্নিগ্ধ গন্ধটা আমার ভিতরটাকে যখন নাড়িয়ে দিল তখন আমি আমার মাঝে ছিলাম না। যেন আমি সূর্যের উত্তাপ রোদ্দুর থেকে বাঁচার জন্য জেনিয়া নামক ছায়ার আচলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কথা বলার ত্রিশ মিনিট পর পবিবারের সবাইকে বিষয়টা বললাম আমাদের দুজনের একটু ভালোভাবে চেনা জানার প্রয়োজন আছে। তারা আমাদের কথায় সম্মতি জানায়।
দুই
অফিস শেষে বাসায় এসেছি ত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে। এই ত্রিশ মিনিটে আমার বাসার দেয়ালের চারপাশে ছায়ার উদাসীনতা লক্ষ্য করছি। একটু পর জেনিয়া আমার কাছে এসে খুব ইতস্তত হয়ে বললো “আপনাকে চা দিব?” আমি বললাম ”না থাক। এখন চা খাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই।” তারপর সে ভিতরের রুমে চলে যায়। গত পরশু রাত থেকে জেনিয়া আমাকে খুব ভয় করে। আমার সাথে কথা বলার সময় তার কথা গুলো যেন গলার ভিতরই আটকে থাকে। গত দুই দিন আগে রাতে আমি যখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ঠিক ত্রিশ মিনিট পর হঠাৎ আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। তারপর দেখলাম ও বারান্দায় ফোনে কথা বলছে। জিজ্ঞেস করাতে বলে আবিদ ফোন করেছে। আমি তার উপর ভীষন রেগে গিয়েছিলাম। আজকাল মানুষের অনুভূতি গুলো নিয়ে খেলতে আমার ভিতরে অদ্ভুত ইচ্ছে কাজ করে। আমি জেনিয়াকে ডাকলাম। ও চুপ করে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি ওকে বললাম “অস্বস্থিবোধ করছো কেন মেয়ে? আমি তোমার স্বামী। বিয়ের পর একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীই সবচেয়ে আপন বন্ধু। এই বন্ধুর সাথে হেসে কথা বলতে হয় আর বিষন্নতাটা লুকিয়ে রাখতে হয়।” তারপর ওর হাত ধরে আমার পাশে বসিয়ে বললাম “আসার সময় মেহেদী নিয়ে আসছি। দেখি হাত দাও তোমাকে মেহেদী দিয়ে দেই। যদিও আমি মেহেদী দিতে পারি না। আচ্ছা আমি মেহেদী যেমনই দিয়ে দেই যদি হাতটা বিচ্ছিরি দেখায় তাহলে কি মন খারাপ করবে?” সে মাথা নাড়িয়ে বুঝায়, না। আমি মেহেদীর টিউভটা খুলে ওর হাতে এলোমেলো করে এঁকে দিচ্ছি। আমি একদম মেহেদী দিতে পারি না। আর ও এই দৃশ্যটা চুপ করে তার চোখে এঁকে নিচ্ছে। আমি বললাম “সুন্দর হচ্ছে না?” সে বলে “খুব সুন্দর” আমি ওর চোখে তাঁকালাম তারপর একটু রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললাম “মিথ্যে বলো কেন? এটাকে সুন্দর বলে? তুমি দেখছি সত্যটাই বলতে পারো না। খুব খারাপ জেনিয়া খুব খারাপ। আর কখনো মিথ্যে বলবে না কেমন?” আমার কথার কি প্রত্যুত্তর দিবে সে বুঝতে পারে না। আমি মেহেদী দিতেই দিতেই বললাম “আমার কাছে কথাটা লুকিয়ে রেখেছো কেন বলোতো?” সে বলে “কোন কথা?” আমি একটু হেসে বললাম “গতকাল আমি বাসায় ত্রিশ মিনিট আগে এসেছি। কিন্তু তোমায় বাসায় দেখতে পাইনি। বাসায় তুমি আসার পর যখন তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম তখন তুমি বললে বান্ধবীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে। আমি আর কিছু বলিনি। এতোটা সময় পার হয়ে গেলো অথচ তুমি আমার কাছে এখনো সত্যটা বলোনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমার সত্যটা শোনার জন্য। অফিস থেকে ফেরার পথে আমি কিন্তু ঠিকি তোমাকে দেখেছি তোমার পুরানো বয় ফ্রেন্ডের সাথে।” সে চুপ করে থাকলো। এই চুপ থাকার অর্থ আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি বললাম “উত্তর দাও মেয়ে।” সে তারপরও চুপ করে থাকলো। আমি বললাম “কি ভুল হয়ে গেছে?” সে মাথা নেড়ে বুঝায় ভুল হয়ে গেছে। আমি একটু হেসে বললাম “আর এমন করবে না কেমন? আমার খুব রাগ হয়। আমি মানুষটা অনেক ভালো। কিন্তু এই ভালো মানুষটার রাগ যখন বেড়ে যায় তখন কি করে ফেলি নিজেই ভেবে পাইনা। পরে আমি খুব অনুশোচনা করি এই কাজটা কি আমিই করেছি? আমাকে এমন অনুশোচনায় ফেলবে না ঠিকাছে?” সে ভয় পেয়ে যায়। আমি বললাম “এই দেখো মেয়ে ভয় পেয়েছে। আমার কি দোষ বলো। আমি তো তোমার বয় ফ্রেন্ডকে একটা চাকরি দিয়েছিলাম। তোমাদের সম্পর্কের একটা নাম দিতে চেয়েছিলাম। তোমার বয় ফ্রেন্ডের প্রতি তোমার অগাড় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু তোমার এই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে ও। আচ্ছা এই কথা বাদ। তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ত্রিশ দিন হয়েছে আজ। এই ত্রিশ দিনে আমার প্রতি তোমার চোখে ভালোবাসাটা দেখতে পাইনি আমি। জানো আমার খুব ইচ্ছে হয় তোমাক নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে। রাতরে রুপালি চাঁদের আলো দেখতে। তোমাকে ভালোবাসতে। আমাকে তুমি না ভালোবাসো। শুধু আমার ইচ্ছে গুলোকে একটা প্রাণ দিয়ে কেমন?” জেনিয়া চুপ করে রইলো। আমি তার চোখের কোনে জল দেখছি। সে জল হাত দিয়ে মুছে বললাম “এতো নড়ছো কেন? মেহেদী দিচ্ছি তো।”
তিন
এই সন্ধ্যার সময়টায় আমি আবিদের সাথে দেখা করতে এসেছি রেস্টুরেন্টে। তার চেহারাটায় কেমন যেন বিষন্নতার ছোয়া লেগে আছে। এই বিষন্নতার মাঝে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ভালোবাসার মর্যাদা না রাখার এক মানুষকে। আমি খুব শান্ত ভাবে বললাম “কি খাবেন?” সে মাথা নেড়ে বুঝায় কিছু খাবে না। আমি বললাম “আপনাকে এখানে ডাকার কারণ নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?” সে আমার দিকে অদ্ভুত মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকায়। আমি সেই অদ্ভুত মায়া মায়া দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম “যে মানুষটা আপনার ছিল সেই মানুষটা এখন আপনার না। সে মানুষটা এখন অন্যকারো। অন্যজন এই মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন আঁকে। আর এই স্বপ্নের মাঝে আপনি ঢুকে যাচ্ছেন। এটাকে কি ভদ্রতা বলে বলুন?” সে কি প্রত্যুত্তর দিবে ভেবে পায় না। আমি তার চুপ থাকা দেখে বললাম “আর কখনো ওকে ডিস্টার্ব করবেন না ঠিকাছে? ফের যদি ডিস্টার্ব করেন আপনার সাথে খুব খারাপ হবে মি. আবিদ সাহেব।” এটা বলে আমি চেয়ার থেকে উঠে আবার বললাম “মানুষটাকেও হারিয়েছেন আর চাকরিটাকেও হারিয়েছেন। এই কার্ডটা রাখেন। এটা আমার বন্ধুর কার্ড। জীবনটাকে আবার নতুন করে সাঁজান পরিবারের কথা চিন্তা করে। চাকরি করার ইচ্ছা হলে ওর সাথে দেখা করবেন। ওকে আমি বলে রেখেছি সব। চললাম। বেস্ট অব লাক।
মাঝে মাঝে আমি অনুধাবন করি এই আমি মানুষটা এমন কেন? নিজের ভিতরের অনুভূতিকে একটা রুপ দিতে চেতনায় অন্যের অনুভূতির মাঝে প্রবেশ করে নিজের করে নেই। আমার খুব ইচ্ছে করে অনেক অনেক দুরে গিয়ে আমার ভাবনা গুলোকে নিয়ে একটু ভাবতে। এই ভাবনার মাঝে আলো আর আঁধারটাকে খঁজে বের করতাম। খঁজে বের করতাম এই আলো আঁধারের মাঝে আমি কোথায় আছি?
ত্রিশ মিনিট পরে আমি বাসায় আসতেই জেনিয়ার মুখটা দেখে আমার ভিতরটা ধক করে উঠে। তার মুখে লেগে থাকা বিষন্ন ছাপ্টা আমি যখন দেখি আমাকে একটা ক্লান্তির ছায়া ঘিরে ধরে। এই ক্লান্তিটা আমার সমস্থ দেহকে অবশ অনুভূতির দেয়ালে আচ্ছোন্ন করে ফেলে। আমি তাকে বললাম “এখন থেকে আবিদ তোমাকে আর ডিস্টার্ব করবে না।” সে চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থাকি। এই চুপ থাকার মাঝে আমি বুঝতে পারছিলাম আমাদের দুজনের দুরুত্বটা।
পোশাক চেঞ্জ আর ফ্রেশ হওয়ার ত্রিশ মিনিট পর ও আমার সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বললাম “কিছু বলবে?” সে শাড়ির আচল আঙ্গুলের মাঝে পেচিয়ে আমাকে খুব ইতস্তত করে বললো “জীবনটা এমন কেন বলতে পারেন? যাকে এতো এতো ভালোবাসলাম সেই আমার সাথে এমন করলো। কেন করলো এমন আমার সাথে?” আমি চুপ করে থাকি। এই কথার কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারি না। আমার মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে উদ্ভট পাগল মনে হয়। আমার চুপ থাকা দেখে জেনিয়া আবার বললো “ঐদিন আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন আবিদ ফোন করে খুব কান্না করেছিল। আমার ভিতরটার মাঝে বিষাদের ছায়া বাসা বেধে গিয়েছে। আমি ওকে বুঝালাম এখন আমার একটা সংসার আছে। তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখিও না। তারপর শেষবারের মত আমার সাথে একবার দেখা করতে চেয়েছে। আপনাকে আমি বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আপনি কি ভাবছেন আমি জানি না। আমাকে মাফ করবেন। আপনি তো আমার স্বামী। স্বামীর কাছে এই বিষয়টা আড়াল করা আমার একদম উচিৎ হয়নি।” এইটা বলেই ও থামলো। ওর চোখের কোনে জল আসে। এতো ঝড়ের মাঝে সময়ের বিষন্নতায় তার সব অনুভূতি ত্যাগ করে আমার অনুভূতির দরজায় সে। জেনিয়া চোখের জল মুছে বললো “খেতে আসেন। আপনার পছন্দের খিচুড়ি রান্না করেছি।” এই কথার উত্তরে কি বলা যায় আমি ভাবছিলাম। তার এই কথার মাঝে নিশব্দ কান্না গুলোকে আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার দেয়ালের চারপাশে বিষন্নতা গ্রাস করে। কিন্ত এই বিষন্নতা তৈরি করতে আমার তো কোন দোষ নেই। শর্ত অনুযায়ী সে আমার।
পরিশিষ্ট।
সারা রাত বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে শহরটা ভিজে গিয়ে এই সকাল বেলা একটা স্নিগ্ধ শিতল আভা ছড়ালো তখন আমি মগ্ন হয়ে বারান্দার চেয়ারটায় বসে চুপসে যাওয়া শহরটা দেখি। ইদানিং প্রায় আমার ইচ্ছে করে এই রকম ভিজা শহরের বুকে জেনিয়ার সাথে নীল রঙ্গা অনুভূতিতে জড়াতে। তার চোখে চোখ রেখে আমার অন্তরালের কথা তার অন্তরালে সমর্পন করতে। কিন্তু আমি কেন যেন পারি না। আমার ভিতরটায় একটা জড়াতা এসে ভর করে। এই জড়তা আমাকে জব্দ করে আমার সমস্থ দেহকে ক্লান্তিময় করে তুলে। এই চুপসে যাওয়া শহরটা দেখার ত্রিশ মিনিট পর জেনিয়া এসে ইতস্তত হয়ে বললো “অফিসে যাবেন না?” আমি তাকে বলি “না। আজ আর যেতে ইচ্ছে করছে না।” সে আচ্ছা বলে আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে বললাম “শুনো।” সে আমার দিকে ফিরে তাকায়। আমি বললাম “তোমাকে আজকে সব বলা দরকার। তুমি এখনো বিষয়টার মূল কারণ জানো না। আবিদকে আমার অফিসের ম্যানেজারকে বলে চাকরি দিয়েছিলাম ঠিকই। চাকরি দেওয়ার পর আমার চিন্তা ভাবনায় অন্য কিছু ছিল। আবিদের ভালোবাসার পরীক্ষা করার। অফিসের কলিগ নাদিয়াকে যখন বিষয়টা খুলে বলেছিলাম তার ঠিক দু দিন পর নাদিয়া আমার কথা মত কাজ করতে রাজি হয়। এরপর শুরু হয় নাদিয়ার কাজ। আবিদের সাথে ন্যাকামো করে কথা বলা, লাঞ্চ আওয়ারে তার সাথে লাঞ্চ করা। যদিও আবিদ প্রথমে রাজি হতো না। এরপর বাহিরে ঘুরতে যাওয়া, রিকশায় চড়া। এক পর্যায়ে তাদের ভাব আদান প্রদান করা ভেরে যাচ্ছিল। তবে আমি নাদিয়াকে খুব শতর্ক থাকতে বলেছিলাম যাই করো খুব সাবধানে করবে। এইভাবে এক মাস অতিক্রম হয়। এই এক মাস মানে ত্রিশ দিন পর তুমি আমাকে ফোন করলে। বললে তোমার মন ভালো না। আবিদ তোমার সাথে এখন কথা কম বলে। যখনই ফোন করো তখনই নাকি আবিদ বলে ব্যস্ত আছি। আমি তোমাকে শান্তনা দিয়েছিলাম। ঐদিকে আমি নাদিয়াকে কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে বললাম তোমার কাজ চালিয়ে যাও মেয়ে। এরপর আরও একটা মাস কাটার পর কাঙ্ক্ষিত সময় আসলো। আবিদ নাদিয়াকে প্রপোজ করলো। বিষয়টা যে এতো দ্রুত কার্যকর হবে আমি ভাবিনি। বেশির ভাগ পুরুষই নারীর প্রতি দুর্বল বুঝলে। নাদিয়া যখন আবিদকে বললো তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে তার কি হবে? আবিদ কি বলেছিল জানো? তুমি নাকি একদম সাধাসিদে একটা মেয়ে। তুমি নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে তার সাথে ফোনে কথা বলতে, লুকিয়ে দেখা করতে। ঠিকমত সময় দিতে পারতে না। কোথাও যেতে বললে যেতে পারতে না। নাদিয়ার সাথে মিশে যে অনুভূতিটা পেয়েছে সে অনুভূতিটা তোমার কাছ থেকে পায়নি। এরপর আবিদ তোমাকে ইগনর করতে লাগলো। ফিরিয়ে দিল তোমাকে। তারপর আমি আর একটুও দেরি করিনি। নাদিয়াকে ফাইনাল চালটা দিতে বললাম। নাদিয়াও ফাইনাল চালটা ঠিকঠাক মত দিল। আবিদ কে বলে দিয়েছিল একজন ভালো বন্ধু, ভালো কলিগ হয়ে তার সাথে মিশতে চেয়েছে লাভার হয়ে নয়।”
এইটুকু বলে আমি থামলাম। জেনিয়া চুপ করে থাকলো। আমি চেয়ার থেকে উঠে আবার বললাম “বিশ্বাস করো আবিদ যদি এই পরীক্ষায় জিতে যেত আমি সত্যি সত্যি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থাটা করে দিতাম। যার জন্য এতো কিছু করতে যাবো তাকে তো একটু পরীক্ষা করতেই পারি তাই নয়কি?। নাদিয়া যখন আবিদকে ফিরিয়ে দিল সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। অফিসে তার অনুপস্থিত বাড়তে লাগলো। আর এই অনুপস্থিতির জন্য তাকে চাকরি থেকে নক আউট করলো। ” আমার এতো গুলা কথা শুনার পর জেনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। তারপর বললো “সে আমাকে ভালোবেসেছে ঠিক আছে। কিন্তু আমার প্রতি তার ভালোবাসাটা মজবুত ছিল না।” আমি তাকে বললাম “চাইলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। আবিদের কাছে চলে যেতে পারো। আমি চাইনা আমাদের জীবনটা এভাবে ধূসর ভাবে কাটুক। যে জীবনে আমি আলপনা খুঁজে পাই না।” সে বললো “এমন কথা আর কখনো মুখে আনবেন না। আমি সাদাসিধে একটা মেয়ে ঠিকাছে। কিন্তু আমার জীবনটা এতো সস্তা না। নাস্তা খেতে আসুন।” এইটা বলেই ও ভিতরে চলে যায়। আর আমি ভাবছি জেনিয়ার ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠতে পারবো কি আমি?
“কি ব্যাপার হ্যা? জনাবের লেখা কি শেষ হয়নি? একটু পর আসছি। পাঁচ মিনিট পর আসছি। এই তো আর একটু করে করেই ত্রিশ মিনিট হয়ে গিয়েছে। খাবে না নাকি? আমি আর কতক্ষন বসে থাকবো? আমি আর খাবার গরম করতে পারবো না।”
আমি পিসি থেকে মুখ সরিয়ে জেনিয়ার দিকে তাকালাম তারপর বললাম “ম্যাডাম আর একটু বাকি।” জেনিয়া আমার হাত ধরে বললো “আর একটুও না। উঠো তুমি। তোমার এই “ত্রিশ মিনিট” এর গল্পের বাকি অংশ পরে লিখিও। আর আমি বুঝি না, তোমার গল্পের চরিত্রে আমার নাম কেন দাও তুমি?” আমি ওর কথা শুনে হাসলাম। আসলে আমি গল্প লিখছিলাম। অফিস থেকে এসেই কিছুক্ষন সময় কাটানোর পর ভাল্লাগছিল না। ভাবলাম কিছু একটা লিখি। আর লিখার শুরুতে জেনিয়া আমার পাশে বসেছিল। গল্পে ওর নাম দেখে ও আমাকে বকে চলে গিয়েছিল। আমার হাসি দেখে ও আবার বললো “কি উঠবে না তুমি? আমার কিন্তু ক্ষিধে লেগেছে। তুমি না খেলে আমারও যে খেতে ইচ্ছে করে না, এইটা কি জনাব বুঝে নাহ।” আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম “আজ নিজ হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাইয়ে দিও।” সে বলে “ঠিকাছে জনাব এবার চলেন।” আমি ওর সাথে খেতে গেলাম। ও আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর নিজেও খাচ্ছে। ও গল্পের কাহিনী জানতে চাইলে আমি খেতে খেতে শোনাতে থাকি। জেনিয়া আমাকে বললো “তাহলে বেচারা আবিদের কি হবে?” আমি বললাম “চাকরিতে জয়েন করে আবার নতুন করে জীবনকে নিয়ে ভাববে। আমাদের জীবনটাই না এমন।” জেনিয়া চুপ করে আমাকে লোকমা দিয়ে খাইয়ে দিতে থাকে। আর আমি ওর চোখের মাঝে তাকিয়ে খেতে থাকি। সে বলে “এমন করে কি দেখো হ্যাঁ?” আমি কিছু বলিনা। আমি সেই চোখের মাঝে আমাকে নিয়ে তার ভয়ংকর সুন্দর ভালোবাসাকে দেখতে পাই। এমন ভয়ংকর সুন্দর ভালোবাসা গুলোর মাঝে আমার জড়িয়ে থাকতে খুব ইচ্ছে করে। এমন মায়া মায়া ভালোবাসাকে আমার হারাতে একটুও ইচ্ছে করে না…