মুঠোফোনটার স্কিনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এই ফোনে কিছুক্ষণ আগে এক নাগাড়ে অনেক গুলো কল আসছিল। রিসিভ করতেই সেই বহুচেনা, মনের মাঝে স্থায়ী বসত গড়ে তোলা সেই কণ্ঠস্বর।
— আমি চলে এসেছি বলে আমার উপড়ে এতো রাগ করে থাকবে? আমি কিছু না বলে চুপচাপ ফোন কানে ধরে আছি। জুঁই ওপাশ থেকে আবার বলল।
— মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কি বিয়ের পর কয়েকদিনের জন্য বাবা মায়ের সাথে থাকতে পারবো না? সারা মাস তো তোমার সাথেই থাকি, দুতিন মাস পরপর কেবল কিছু দিনের জন্য বাবা-মায়ের কাছে আসি।
— সেটা কি একবারও বলেছি যে আমি রাগ করে আছি?
— বলতে হবে কেন? আসার সময় তোমাকে বললাম আমাকে লাল শাড়ীতে কেমন লাগছে, আর তুমি তখন আমাকে উল্টো ঝাড়ি দিলে বললে চোখের সামনে থেকে দূর হতে।
— তুমি যাবে শুনে মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছিলো।
— হুঁ, রাত্রে খেয়েছ?
— না,
— শুনো ফ্রিজে খাবার রাখা আছে একটু কষ্ট করে গরম করে খাও। আর আমাকে কাল নিতে এসো বুজলে? এখন রাখছি।
জুঁই মেয়েটা একটু অদ্ভুত ধরণের যেদিন সে বাবার বাড়ি যাবে। সেদিন জুঁই এর মাঝে একধরণের চঞ্চলতা বিরাজ করে। কথায় কথায় হাসবে। সকাল থেকে খুঁটিনাটি ব্যাগে ঢুকাবে, যেন সে কয়েক দিনের জন্য নয় কয়েক বছরের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বারবার আমাকে বলবে একটা সিএনজি ঠিক করে দিতে। কয়েকটা শাড়ী এনে আমাকে বলবে কোনটা পরবো বলো তো? আমি কিছু না বলে চুপচাপ শুধু মুখ ভারী করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। যাতে আমার এই অসহায় মুখটা দেখে আর না যেতে চায়। সাজগোছ করে আমাকে যাওয়ার সময় হাসি হাসি মুখে বলবে। নিজের যত্ন নিবে আর আমাকে কয়েক দিন পর আনতে যাবে বুঝছ? আমি শুধু ছোট করে হুঁ বলি। আজ যাওয়ার সময় আমাকে শাড়ী দেখাতে এসেছিল লাল শাড়ীতে আমাকে কেমন লাগছে আর আমি রাগে বলে দিয়েছি চোখের সামনে থেকে দূর হতে। জুঁই নামের চঞ্চল মেয়েটাকে যখন আমি আনতে যাবো শ্বশুর বাড়ি থেকে তখন সে কেঁদে কেঁদে চোখ ভাসিয়ে দিবে। খাট ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকবে, জানালার কার্নিশ গুলো হাতিয়ে হাতিয়ে দেখবে। একটা নেকড়া এনে টিভির পর্দা পরিষ্কার করবে আর চোখের জল মুছবে। তার ভাব খানা এমন যে বিয়ের আগে এই টিভি তার সব ছিলো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দরজা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। বাবার বাড়ির স্মৃতি মনে করে চোখ মুছতে মুছতে আমার সাথে ফিরে আসবে। বাসায় ফিরে আমাকে বলবে।
_ তুমি আস্ত একটা শয়তান। আর কয়েকটা পরে আসলে কি এমন হতো।
আমি জুঁই এর কথা শুনে শুধু হাসি। আর জুঁই রাগে শুধু খিটখিট করে। ফ্রিজ থেকে খাবার বেড় করে গরম করার সময় হাতে সেই লেভেল এর গরম খুন্তির ছ্যাঁকা খেলাম। হাত অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ফিরে এসে দেখি খাবার দীর্ঘ সময় চুলায় থাকায় অতি গরমে পুড়ে গেছে। খালি পেটে বিছানায় শুয়ে পরলাম। কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা বাজে। এখান থেকে জুঁইদের বাসায় যেতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট। কোনকিছু না ভেবে একটা সিএনজি করে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম।
জুঁইদের বাসার সামনে নেমে। গেট দিয়ে ঢুকার সময় গেট খোলা দেখে অবাক হলাম। এক মাত্র কেউ আসার কথা থাকলে গেট খোলো থাকে। আমি যে আসবো সে কথা তো কারও জানার কথা না। ফোনে ব্যালেন্স না থাকার কারণে জুঁই কে কল দিতে পারলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার কলিংবেল বাজাতেই ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিলো। তাকিয়ে দেখি জুঁই হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। মনে হয় দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
— আমি যে আসবো তুমি কিভাবে জানলে?
জুঁই আমার কথার উত্তর না দিয়ে কেবল একটা মুচকি হাসি দিলো। তার হাসির উত্তর এমন আমি যে আসবো তা সে অনেক আগেই জানে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে না দিয়ে বলল।
— ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে আসো।
ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে এসে দেখি আমার সব পছন্দের খাবার রান্না করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে। জুঁই আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে হাসলো। জুঁই নিজে খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে অপল দৃষ্টিতে আমার তিপ্তি করে খাওয়া দেখছে। মেয়েদের এইটা মনে হয় সব চাইতে আনন্দের মুহূর্ত। প্রিয় মানুষটাকে তার পছন্দের খাবার নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারছে। জুঁই খাওয়ার মাঝে আমাকে ডাক দিয়ে বলল।
— শুনছো?
— হুঁ,
— আসার সময় টেবিলের উপড়ে একটা চিরকুট রেখে এসেছিলাম পড়ে দেখেছ? আমি খাওয়া থামিয়ে জুঁই এর দিকে অবাক চোখে তাকালাম।
— কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছ না যে, পড়েছ?
— না তো, কি লেখা ছিল? আমার কথা শুনে জুঁই এর মুখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ দেখতে পেলাম।
— না কিছু লেখা ছিলনা। বাজারের লিস্টি করে রেখে আসছিলাম।
— হুঁ,
আমি জানি জুঁই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছে। সেই কিছু একটা কি হতে পারে ভাবছি। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। কিন্তু জুঁই বিছানার আসার নাম গন্ধ নেই। সেই তখন থেকে সারা রুমে হাটছে আর হাটছে।
— তুমি সেই তখন থেকে পাগলের মতো এই মাঝ রাতে রুমের ভিতরে হাটছো, ব্যাপার টা কি বলতো? জুঁই আমার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল।
— আমি ঘুমাতে চাইলে কি আর হবে? আরেক জন তো ঘুমাতে চাইছে না। তার নাকি হাটতে ইচ্ছা করছে।
— তুমি সেই তখন থেকে এই একটা কথা বারবার বলছ। সেই আরেক জনটা কে বলতো? জুঁই পরাজিত সৈনিক এর মতো আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
— তুমি সত্যি বুঝতে পারছ না?
— না, জুঁই আমার কাছে এসে আমার হাতটা নিজের পেটের চেপে ধরে লাজুক মুখে বলল।
— কিছু অনুভব করতে পারছ? এটাই চিরকুটে লেখা ছিল।
আমি দেরী করে হলেও কথাটার মানে বুঝতে পারলাম। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। জুঁই হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিলাম। খুশিতে আমার চোখের জল ছলছল করছে। সবার মতো বলতে পারছিনা আজ তুমি যা চাইবে তাই দিবো।
হাত দুটো শক্ত করে আরও কাছে টেনে নিলাম। পাগলীটার চোখেও জল ছলছল করছে। নিজের চোখের জল আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না টুপ করে একফোঁটা জল হাতের উপড়ে পড়ল। জুঁই আস্তে করে আমার বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। যোগ হলো আরেকটা নতুন স্বপ্নের জীবন।