কাঁচের চুড়ি

কাঁচের চুড়ি

প্রচন্ড গরমে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলাম পুরো গা ঘামে ভিজে একাকার অবস্থা। চাদরের সাথে গা লেগে গিয়েছে। বেশ গরম পরেছে বলতেই হয়। আকাশটা মেঘলা মনেহয়। আকাশ মুখ গোমরা করে থাকলে প্রকৃতি গরম হয়ে যায়। দুজন যেন একে অপরের পরিপূরক। চৈত্র মাসের শেষের দিকে এমন প্রকৃতি সাধারন ব্যাপার। এইসময় গরমের বদলে ঠান্ডা পরিবেশ আশা করা নেহাত বোকামি। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস অনেক আগে থেকেই। দুপুরের খাবার খেলে বিছানা শরীরকে আকর্ষন করতে শুরু করে। ঠিক যেন চৌম্বকের মত। সেই আকর্ষনে আমাকে সাড়া দিতেই হয়। কিন্তু প্রচুর গরমের কারনে বিকর্ষণ ঘটাতেই হল।

বিছানা ছেড়ে উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম। খুব জল তৃষ্ণা পেয়েছিল। আমার সাথে পরিবেশেরও তৃষ্ণা পেয়েছে। বৃষ্টি হলে বেশ ভাল হত। রুমে কোন ফ্যান নেই। ভাবছি টেবিল ফ্যান কিনে নিব। কিন্তু টাকাই হচ্ছে না। ছাদের এই ঘরের উপরে টিনের চালা। কড়া রোদে গরম হয়ে থাকে। যেন সুর্য আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। হাত পাখা নিয়ে বাতাস নিজেকে বাতাস করতে থাকলাম। এটাকে গরিবের ফ্যান বলা চলে। দশ পনের টাকা হলেই পাওয়া যায়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। চারটা বেজে এসেছে প্রায়! সাড়েটায় আমার টিউশানি। তারমানে এখনো ঘন্টা খানেক বাকি। এদিকে ঘুম আসছে না। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। খুব ছোট্ট সংসার আমার। একজনে সংসার হয়না। তবুও আমি এটাকে সংসার বলি। এই সংসারে আমিই কর্তা, আমিই সদস্য!

অনেক বাধা বিপত্তি পাড় করে এই ঘরটা ভাড়া নিয়েছি। ভদ্রলোককে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরে ঘরটা দিলেন। যখন জানলেন এই শহরে আমার কেউ নেই! ভার্সিটির হলে জায়গা হয়নি! আবার তেমন কোথাও জায়গা পাচ্ছি না। তখন উনি সদয় হলেন। ভার্সিটি কাছেই। রিক্সা করে গেলে দশ টাকা ভাড়া নেয়। আমি হেটেই পৌঁছে যাই। আর কিছুদিন গেলে হয়তো একটা চাকরি পেয়ে যাব। তখন নাহয় রিক্সায় যাব! হাত মুখ ধুয়ে একটা টি-শার্ট পরলাম। গরমে একটাই সমস্যা। ঘন ঘন কাপড় ধুতে হয়। পাঁচদিন আগে কাপড় ধুয়েছি। একদিন গায়ে দিয়েই টি-শার্ট ঘন্ধ হয়েছে! কি আর করা! পারফিউম লাগিয়ে বেড় হলাম। ঘড়িতে চারটা আটাশ মিনিট বাজে। এখনো দুই মিনিট বাকি! টিউশানি খুব দুরে নয়। দোতলার একটা ছেলেকে পড়াই। ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট। ভাল ছাত্র হওয়ায় পড়াতেও কোন সমস্যা হয়না। ভাল টাকাও পাই! সব মিলিয়ে সুখকর একটা টিউশানি বলা চলে।  বেল বাজাতেই আন্টি দরজা খুলে দিলেন। আমি সালাম দিলাম। আন্টি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন

-তোমার ছাত্র অপেক্ষা করছে। ভেতরে এস। ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম আদিল বই সামনে নিয়ে বসে আছে। আমার কাছে পড়ার জন্য তার মধ্যে আকর্ষন কাজ করে। ছাত্রের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক হলে পড়ার মধ্যেই আকর্ষন থাকে। তবে বেশি বন্ধুসুলভ আচরন করলে ঘারে চেপে বসে।

বই খুলে পড়াতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরেই ট্রেতে আমার জন্য নাস্তা চলে আসল। যেদিন পড়ানো থাকে, সেদিন দুপুরের খাবার কম খাই। এতে কিছু টাকা সঞ্চয় হয়। এছাড়া বিকেল বেলা নাস্তা খেলে পুরো পেট ভরে যায়। কখনো কখনো রাতের খাবার খেতে হয়না। প্রথম প্রথম লজ্জা করে খেতাম না। পরে লজ্জা ভুলে খেয়ে নেই। আমার জন্য বেশি করে নাস্তা পাঠানো হয়। যাতে পেট ভরার পরেও কিছু থেকে যায়। একে কালচার বলা যায়! আজকে সাদিয়া ট্রে নিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সে আসে। আর এমনিতে কাজের মেয়েই আসে। সাদিয়া হল আদিলের বড় বোন। এবারে ভার্সিতিতে সেকেন্ড সেমিস্টারে পড়ছে। কোন পাবলিক ভার্সিতিতে পরিক্ষা না দিয়ে বাবার টাকায় প্রাইভেট ভার্সিতিতে ভর্তি হয়েছে। তবে ছাত্রী খারাপ নয়।

-কেমন আছেন? আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। আমি বই এর দিকে তাকিয়ে বললাম
-জ্বি ভাল। আপনি?
-আমিও ভাল। আপনার ছাত্রের পড়ালেখা কেমন চলে?
-ভাল চলছে।
-আচ্ছা আপনি পড়ান। পরে কথা হবে আবার।
-ওকে।

সাদিয়া চলে গেল! এতক্ষণ বই এর দিকে মুখ থাকলেও আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটি হাসলে মুখে টোল পরে। কথা বলার সময় মুচকি হেসে কথা বলে। জীবনানন্দ দাস তাকে দেখলে হয়ত একের অধিক প্রেমের কবিতা লিখে ফেলত! মাঝেমাঝে ইচ্ছা করে বলি

-এইযে এমন করে হাসি মাখা মুখে কথা বলবেন না। দেখলে বুকের মাঝে তুফান শুরু হয়ে যায়। যে তুফানের আগে কোন আবওহাওয়া বার্তা প্রকাশ হয়না। কিন্তু বলতে পারি না! কোন এক বাধা আমাকে আটকে দেয়। এর আগে অনেকবার তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছি। কখনো সে আমার দিকে তাকিয়েছে। বেশিক্ষণ চোখাচোখি হয়নি। তার আগেই চোখ নামিয়ে নিয়েছি।

-স্যার, বৈশাখের জন্য কিছু কিনেছেন?
-হু!
-বৈশাখের কেনাকাটা করেছেন! আদিলের কথায় হুশ ফিরলাম। এতক্ষণ কোন এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। নিজেকে সংযত করে মুচকি হেসে বললাম
-নাহ! তুমি?
-হ্যা। আমি একটা গেঞ্জি আর টি-শার্ট। আপু একটা শাড়ি কিনেছে। দুজনেই পহেলা বৈশাখে নতুন পোশাক পরব।
-বেশ এখন পড়।

পড়ানো শেষ করে রুমে আসলাম। এখন গরম কমেছে। বিকেলের দিকে রৌদ্রের তাপ কম থাকায় কিছুটা ঠান্ডা অনুভব করছি। এবারের টাকাটা পেলে একটা টেবিল ফ্যান কিনতে হবে। নাহলে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। পহেলা বৈশাখের দিন টাকা দেওয়ার কথা আছে। নতুন বছরে নতুন ফ্যান কিনব! আর মাত্র একদিন! ঘুম ভেঙে দেখলাম ঘড়িতে আটটা বাজে। বছরের প্রথম দিনেই ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেললাম। আজ অবশ্য ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। তাই কোন চিন্তা নেই। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। হাতমুখ ধুয়ে বাইরে যাব ভাবছি। হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিব!  শার্ট গায়ে দিয়েই টাকার কথা মনে এল। টিউশানির টাকা পাওয়ার কথা! সোজা আদিলদের দরজার সামনে এসে বেল বাজালাম।  সাদিয়া দরজা খুলে দিল! আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম

-আন্টি নেই!
-না। মা ছোট খালার বাসায় গিয়েছে।
-টাকার দেওয়ার কথা ছিল
-ও! হ্যা। মা আমার কাছে টাকা দিয়ে গিয়েছে।
-ওকে।
-আরেকটা কথা।
-জ্বি!
-আজ বাসায় পায়েস রান্না হয়েছে। খেয়ে যান।

ভেতরে ঢুকে ড্রয়িংরুমে বসলাম। সাদিয়া এখনো শাড়ি পরেনি। অন্য দিনের মত সাধারন পোশাকেই দেখছি তাকে! তাকে একটা কালো শাড়ি কিনে দিতে ইচ্ছা করছে। সে কালো শাড়ি দেখে বলবে

-কালো রং কেন!
-আপনার প্রেমে শহীদ হওয়ায় কালো রং শোকের প্রতিক হিসেবে ব্যাবহার করা যায়!
-আরে ধুর। শহীদ আমিও তো হয়েছি!
-খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে!
এক চামচ মুখে নিয়ে বললাম
-অনেক মজা হয়েছে।
-আমি নিজে হাতে রান্না করেছি। আপনি খান। আমি বরং টাকাটা নিয়ে আসি। সুন্দরি মেয়ের রান্না মজা নাহলেও অমৃত মনেহয়! রুপের কাছে বোধহয় রান্নার স্বাদ তুচ্ছ! খুব বেশি ভাল রান্না নাহলেও সুন্দর বলতে বাধ্য হলাম।

-এই নিন আপনার টাকা।
পায়েস খাওয়া শেষে পানি খাওয়া হয়ে গিয়েছে। টাকাটা হাতে নিয়ে বললাম
-আচ্ছা আসি।
-কোথাও ঘুরতে যাবেন নাকি!
-না। তেমন কোন প্ল্যান নেই। তবুও দেখি কি করা যায়!
-বান্ধবী অথবা প্রেমিকার সাথে ঘুরতে বের হলেই পারেন। তার কথায় মুচকি দিয়ে বললাম
-ওসবের মধ্যে নেই।

বিকেল হয়ে এল প্রায়। তব্দ দুপুরের রোদ্রের একটু তাপ এখনো রয়েছে। সারাদিন সবাই বাইরে হই হুল্লড় করে কাটালেও আমি রুমে ঘুমিয়েছি। নতুন ফ্যান কিনে আনার পরে বেশ আড়ামে ঘুমিয়েছি। সকালবেলা টাকা নিয়েই ফ্যান কিনে এনেছি। তারপরে রুমে এসেই ঘুম।  সকালবেলা সাদিয়ার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় একটা ব্যাপার মনে হচ্ছিল। সাদিয়া আমাকে দেখছে এমন কিছু! তবে সেটা আমার ভাবনার ভুল হতেও পারে। ভেবেছিলাম তাকে একটা শাড়ি কিনে দিব। কিন্তু সেটা হয়ে উঠেনি। পরে অনেকগুলো কাঁচের চুড়ি কিনেছি। কিন্তু সেগুলো এখন টেবিলের উপর পরে আছে। বিকেলবেলা রুম থেকে বের হলাম। এখন দোটানায় ভুগছি। চুড়িগুলো দিব কি-না সেটাই ভাবছি। একবার মনেহয় তাকে দেই! আবার মনেহয় এই সামান্য কাঁচের চুড়ি দিব! তবে ছাদে দাঁড়িয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সন্ধ্যাবেলায় চুড়িগুলো ফেলে দিব!

-বিকেলবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন! পিছনে ঘুরে তাকালাম। সাদিয়াকে দেখেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এতক্ষণ ওর কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ এভাবে চলে আসবে সেটা ভাবিনি। আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম

-না মানে কিছুনা।
-নতুন বছরের প্রথম বিকেলে এভাবে ভাবলে চলে!
-জানিনা। কারন ছাড়াই ভাবছি হয়ত।
-কারন তো কিছু একটা আছেই। আপনার হাতে কি?
-ও কিছু না। কাঁচের চুড়ি।
-কাঁচের চুড়ি দিয়ে আপনি কি করবেন! আপনি তো নিশ্চয় হাতে দিবেন না!

সাদিয়ার মুখে দুষ্টামি মাখা হাসি। সে শাড়ি পড়েছে। সাথে কানের দুল, চুলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া! গালে টোল পরায় আরো বেশি সুন্দর লাগছে!

-কি হল কিছু বলছেন না যে! কাউকে দিবেন?
-তেমন কিছু না। কোন কারন ছাড়াই কিনেছি।
-মানুষ কারন ছাড়া কিছুই করে না। আপনি তো অবশ্যই না।
-জানিনা। তবে ভাবছি চুড়িগুলো কাউকে দিব নাকি!

নিজের আজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল। দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। বৈশাখের বিকেলবেলায় ভাল লাগার মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগছে। দুজন দুদিকে তাকিয়ে আছি। তবে আমি মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকে দেখছি।  হঠাৎ সাদিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-চুড়িগুলো আমায় পড়িয়ে দিবেন? এবারে সাহস করে ওর চোখের দিকে তাকালাম। ওর মাঝে আকাঙ্খা কাজ করছে। কিছু চাওয়া কাজ করছে। যেটা ভালবাসলেই হয়! আমি চুপ করে চুড়িগুলো ওর দুই হাতে পড়িয়ে দিলাম।

-আচ্ছা সোহান। আমাদের সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারেনা! সাদিয়া প্রথম আমার নাম ধরে ডাকল! সে শুধু চুড়ি পেয়েই থেমে থাকতে চায় না। আমার মনের সিংহাসনটাও চায়! যে সিংহাসন ভালবাসা দিয়ে তার জন্যই গড়েছি! সেটা তাকে না দিলে কিভাবে হয়! আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম

-হ্যা পারে।

কথাটা বলেই ওর হাতের দিকে তাকালাম। কাঁচের চুড়িগুলো বেশ লাগছে তার হাতে!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত