ভাইয়া

ভাইয়া

মোটরসাইকেলের পেছনে বসে বসে ভার্সিটিতে যেতে ভালই লাগে ত্রিণার । যদিও বান্ধবীরা অনেকভাবে ঠাট্টা করে ওকে পঁচায় । পঁচানোর কারণ অবশ্য ও নিজে একটা বের করে নিয়েছে । কারণটা হল মোটরসাইকেলে ওর সামনে বসা মানুষটা , যাকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ত্রিণার বড়ভাইয়া বলে ডাকতে হয় মায়ের মতে এই মানুষটা পৃথিবীতে বিলুপ্তপ্রায় ভাল মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম কিন্তু ত্রিণার কাছে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত । এর অবশ্য পেছনে যুক্তিযুক্ত কারণও আছে ওর কাছে ।

ভাইয়া সবসময়ই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে । কারণে অকারণে বকাবকি করে । বলতে গেলে ত্রিণার ভাল-লাগার সবকিছুতেই বাধ সাধে । এই যেমন কদিন আগে ত্রিণার বান্ধবীরা সবাই মিলে একটা ট্যুরে গিয়েছিল । ত্রিণার খুব ইচ্ছে ছিল ওদের সাথে যাবার , কিন্তু একমাত্র ভাইয়ার কারণে যাওয়া হল না । কি বলল? বলল , “তোর যদি যেতে এতোই ইচ্ছে হয় তাহলে আমার সাথে যাবি । আমি তুই আর মা , আমরা তিনজন মিলে ঘুরতে যাব ওই একই জায়গায় । ”ভাইয়ার কথা বিশ্বাসযোগ্য । এই একটা ব্যপারে ত্রিণা দ্বিমত পোষণ করতে পারে না যে, এই ভাইয়াটা এক কথার মানুষ । জীবনে কখনও ভাইয়া নিজের কোন কথার বরখেলাপ করেনি , তা যত ছোট ব্যাপারই হোক না কেন । আর ত্রিণার ব্যাপারে ?

পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে , কিন্তু ত্রিণা যদি একটা কিছু চায় সেটা একেবারে সময়মত ওর কাছে পৌঁছে যাবে ।
কিন্তু অতকিছু ওর লাগবে না । ওর দরকার একটু হেসে কথা বলা । একটু ভালবেসে কাছে টেনে কথা বলা । একটা সাধারণ বড়ভাই যেরকম হয় সেরকম হওয়া । যেমন ওর বান্ধবী লিমার বড়ভাই । বাসায় যেমনই হোক বাইরে লিমার সাথে সবসময়ই ভাল ব্যবহার করে , হেসে কথা বলে । অন্তত বান্ধবীদের সামনে ওর মান-সম্মানটুকু রাখে ।
কিন্তু ওর বড়ভাই ? কোনদিন ওর বান্ধবীদের সাথে একটু হেসে কথা বলেছে , এমন কাহিনী ঠাকুরমার ঝুলিতেও পাওয়া যাবে কিনা স্বন্দেহ আছে । এমনকি সালাম দিলে তার উত্তরেও শুধু মাথাটা উপর নিচ করে চলে যায় । যাই হোক, ভাইয়ার কথা বলতে গেলে শুধু বলতেই হবে । আর শেষ হবে না । প্রতিদিনের মত আজও ভাইয়ার সাথে ভার্সিটি গেট পর্যন্ত দিনের সবচেয়ে বোরিং জার্নিটা শেষ করল ত্রিণা । মোটরসাইকেল থেকে নেমে যাওয়ার সময় ভাইয়া হঠাৎ ডাক দিল ,

-“ত্রিণা”
-“জ্বী ভাইয়া”
-“এদিকে আয়”

ত্রিণা ভাইয়ার সামনে গেল । তারপর ভাইয়া ত্রিণার ডানপাশের ঝুঁটিটা ধরে টেনেটুনে ঠিক করে দিল । আর বলতে লাগল , “ভার্সিটিতে উঠে গেলি এখনও চুলের ঝুঁটিটাও ঠিকমত বাঁধতে শিখলি না” ওহ! বলতে ভুলেই গেছি । ত্রিণাকে একমাত্র ওর বড়ভাইয়ের জন্যই এখনও এই বয়সে চুলে ঝুঁটি বেধে ভার্সিটিতে আসতে হয় । এটাও বলা চলে ভাইয়ার এরেকটা অত্যাচার ওর উপরে । ক্লাসের ছেলে গুলো রীতিমত ওকে “লাল ঝুঁটি কাঁকাতুয়া” নাম দিয়ে দিয়েছে । তাই একটা উপায় বের করে নিয়েছে ও । প্রতিদিন ভাইয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঝুঁটি করে ভার্সিটিতে আসে আর ঠিক তার পর পরই ওয়াশরুমে গিয়ে চুল ছেড়ে দেয় । কিন্তু জমের মত ভয়ঙ্কর ভাইয়াকে কি এসব বলা যায়? তাই মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে । যাই হোক , ঝুঁটি ঠিক করে দিয়ে ভাইয়া একটা একহাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিল । তারপর বলল , “আজকে তো মা দিবস । দুপুরে ভাল কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে মা-মেয়ে ভাল কিছু খেয়ে নিস । আমার অফিসে আজকে অনেক চাপ থাকবে । নাহলে আমিই সময় করে চলে আসতাম । কি ! পারবি তো ?”
“হ্যা পারব।”

ভাইয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু অবাক হল ত্রিণা । ভাইয়া কোন ফেসবুক টেসবুক চালায় না । তেমন কোন সোশাল মিডিয়ার সাথেও যুক্ত না যেখানে ত্রিণা নিজে ফেসবুক টুইটার সব খুলে বসে আছে । কিন্তু আজ যে মা দিবস এই ব্যাপারটা ওর আগে ভাইয়াই বলে দিল ! ব্যাপারটা কিরকম না ! নাহ! এতো নতুন না । বলতে গেলে প্রায় প্রতিবপছর ভাইয়া এইদিনটা পালন করে এভাবেই । এভাবে বলতে , ত্রিণাকে টাকা দিয়ে দেবে অথবা কোন কোন বছর রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনে বাসায় দিয়ে যাবে । কিন্তু সরাসরি মাকে কখনও বলতে দেখা যায় নি “হ্যাপি মাদারস ডে , মা।

এক মিনিট ! এই কাজটা ভাইয়া সবসময়ই করে । সবধরনের অনুষ্ঠানে ও কেমন জানি পেছনে থাকতে চায় । মায়ের জন্মদিন এমনকি ত্রিণার নিজের জন্মদিনগুলোতেও ওর বার্থডে গিফটটা কখনওই ভাইয়া নিজের হাতে ওকে দেয় নি । সবসময় মা দিয়ে এসেছে । সবকিছু নিজে করে , কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না আসলে ও-ই যে করে এসব । কিরকম যেন নিজেকে লুকিয়ে রাখার স্বভাব ওর । কি যে সুবিধা আছে এতে , একমাত্র ভাইয়া নিজেই জানে ! যাই হোক , এক্সাইটেড হয়ে ত্রিণা ওর সব বান্ধবীকে মা দিবসের কথা বলে । সবাই ওর কথা শুনে এক্সাইটেডও হয় । কিন্তু সেই এক্সাইটেডনেস ফেসবুকে মায়ের সাথে ছবি অথবা প্রোফাইল পিকচার আপলোড করা পর্যন্তই থাকে । এরপর “মা দিবস” বছরের বাকী তিনশো চৌষট্টি দিনের মতই হয়ে যায় ।

দুপুরে কোনভাবেই মাকে ঘর থেকে বের করা গেল না । অনেক জোর-জবদ্দস্তি করেও মাকে বের করতে পারল না ত্রিণা । কারণ একটাই ! তার গুণধর ছেলেকে ছাড়া তিনি বাইরে খাবেন না । শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে ভাইয়াকে কল দিল ত্রিণা । একবার রিং পড়ার সাথে সাথেই কল রিসিভড । এই ব্যাপারটা সম্পর্কেও একটু না বললেই নয় । বাসায় থাকার সময়ও অনেকবার দেখেছে ত্রিণা , অনেক গুরুত্বপূর্ণ কল আসলেও ভাইয়া হেলেদুলে ওগুলো রিসিভ করে । এমনকি বসের কল হলেও এর ব্যাতিক্রম হয় না । অনেকসময় তো রিং হয়ে হয়ে কলগুলো কেটেও যায় । কিন্তু ত্রিণার ব্যাপারটা পুরোই উল্টো । এপর্যন্ত জীবনে কখনওই ভাইয়াকে কল করে এক থেকে দুই রিং এর বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি ওকে । বিদ্যুৎ বেগে কল রিসিভ করে ফেলে ভাইয়া । মাঝেমাঝে বিরক্ত হয় ত্রিণা । কারণ ফোনে ব্যালেন্স না থাকলে অথবা কম থাকলে মিসকলটাও দেয়া যায় না ওকে । পরে যদিও সাথে সাথেই ফোনে ব্যালেন্স চলে আসে । তারপরেও এই একটা “ভাইয়া” নামের পেইনটা ওর জীবন থেকে আর গেল না ।

যাই হোক ভাইয়াকে ফোন করে মায়ের সকল বৃত্তান্ত বলল ত্রিণা । শুনে ভাইয়া এমন একটা সমাধান বের করল যেটা শুনে ত্রিণার রাগের পরিমাণটা আরোও বেড়ে গেল । সমাধানটা হল , ত্রিণা এখন আবার বের হয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসবে । তারপর মা-মেয়ে বসে ঘরেই লাঞ্চ করবে । কিন্তু এরপরের কাহিনী শুনে অবশ্য আবার নিজেকে শান্ত করে রাখল ত্রিণা । কারণ ভাইয়া বলেছে বিকেলে অফিস থেকে এসে ওরা তিনজন মিলে শিশুপার্কে যাবে , রাত পর্যন্ত ঘুরবে তারপর বাইরে খেয়ে একসাথে বাসায় ফিরবে । শিশুপার্ক ! ত্রিণার খুব প্রিয় একটা জায়গা । বয়সটা অনেক বেড়ে গেলেও এখনও এটার প্রতি লোভ সামলাতে পারে না ও । আর ভাইয়াও জানে ব্যাপারটা । তাই মোক্ষম সময়ে এই অস্ত্রটা সবসময় ব্যবহার করে । যাই হোক ভাইয়া যেহেতু এক কথার মানুষ , সুতরাং সেদিন সত্যি সত্যিই যা যা বলেছে সবই করেছে । বলা যায় জীবনের অন্যতম একটা সেরা দিন পার করেছিল ত্রিণা ।

এভাবেই দিনগুলো কাটতে লাগল ভালভাবেই তারপর একসময় রমজান মাস এল । ঈদের অপেক্ষায় অপেক্ষায় প্রায় অর্ধেক মাস চলেও গেল । ঠিক এমন সময় হঠাৎ ভাইয়ার অফিস থেকে অর্ডার এল ভাইয়াকে এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে । অর্ডার যখন এসেছে তখন তো যেতেই হবে । মনে মনে একটু খুশিই হল ত্রিণা । যাক অন্তত এক সপ্তাহের জন্য হলেও ভাইয়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে । কিন্তু এদিকে মা রীতিমত কানাকাটি শুরু করে দিয়েছে । কিছুই বুঝতে পারল না ত্রিণা , জীবনের জন্য তো আর চলে যাচ্ছে না , মাত্র তো একটা সপ্তাহ । কিন্তু কে শোনে কার কথা .যাই হোক , হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে ওঠার আগেই ভাইয়া ফুরুৎ করে চট্টগ্রাম চলে গেছে ত্রিণার খেয়ালই নেই । ভাইয়া অবশ্য এরকমই । কখন কি করে না করে কেউই জানে না একমাত্র মা ছাড়া । আচ্ছা মা ছাড়া জানার মত আর আপন কে আছে ? ত্রিণা নিজেই! কিন্তু সেই সুযোগ কি ভাইয়া দেয় ওকে ? নাকি ত্রিণা নিজেই ইচ্ছে করে দূরে সরে থাকে ! অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্ন । ধুর ! এসব বাদ এখন । এখন শুধুই মুক্তি আর স্বাধীনতা । প্রথম কয়েকটা দিন অনেক মজায় কাটাল ত্রিণা । যখন ইচ্ছে তখন বের হয় , বান্ধবীদের সাথে শপিংএ যায় । কোন বাধাই নেই বলা যায় । মাঝেমধ্যে মা একটু আধটু বলে বৈকী কিন্তু মা তো! মেনেজ করে ফেলা যায় ।

কিন্তু ধীরে ধীরে আনন্দের পরিমাণ কেমন যেন কমে যেতে লাগল ! ত্রিণা নিজেই বুঝতে পারল না এর কারণটা কি ! কেমন যেন ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করল । বাবা মারা যাবার পর ভাইয়াই একমাত্র পুরো ঘর সামলে রাখত । কোনদিন বাবার অভাব বুঝতে দেয় নি ত্রিণাকে । সবসময় সব ধরনের সমস্যা থেকে ওকে এমনকি মাকেও দূরে রেখে নিজে নিজে সেটা সমাধান করার চেষ্টা করত । বাইরে অনেক কঠিন একটা মানুষ হলেও , সবার সাথে একটা দূরত্ব রেখে চললেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু ভাইয়া একটা ছোট্ট শিশুর মতন । এই একটা ব্যাপার ত্রিণা বুঝতে পারে । এজন্যই মাঝেমাঝে এই অসহ্য মানুষটাকে মিস করে প্রচুর , যেমন এখন করছে হাঁটতে হাঁটতে একসময় ভাইয়ার রুমে ঢুকে পড়ল ত্রিণা । কখনও কোন ব্যাপারে ভাইয়া ওকে সীমাবদ্ধতা দেয় নি । এমনকি ওর কম্পিউটারের পাসওয়ার্ডও ত্রিণার জানা । সামান্য অগোছালো রুমটায় তেমন কিছুই নেই বলা যায় । দেয়ালে একটা ছবি আছে , তাও মা-বাবার ।

হাঁটতে হাঁটতে কম্পিউটারের কাছাকাছি গেল ত্রিণা । কোনকিছু চিন্তা না করেই ওপেন করে বসল সেটা । ডেক্সটপে ওয়ালপেপারে একটা চৌদ্দ-পনের বছর বয়সের মেয়ের ছবি । এই মেয়েটাকে ত্রিণা চেনে । কারণ ও নিজেই এই মেয়েটা । “পিকচার” নামের ফোল্ডারটায় সব ত্রিণার ছবি নয়ত মায়ের ছবি অথবা কয়েকটা বাবার ছবি । কিন্তু ভাইয়ার নিজের কোন ছবি নেই । হঠাৎ ওকে অনেক দেখতে ইচ্ছে হল ত্রিণার । পুরো কম্পিউটার ঘেঁটে একটা ছবি বের করা যাবে , এই চিন্তা প্রথমেই বাদ দেয়ার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু তারপরেও একবার চেষ্টা করে দেখল , একটা হলেও যদি পাওয়া যায় নাহ! শেষ পর্যন্ত একটা ছবিও পেল না । মাথায় একবার চিন্তা আসল ভাইয়াকে একটা ভিডিও কল করার ।
কিন্তু কি বলবে কল দিয়ে ?

আর ব্যাপারটা কেমন যেন ! অথবা এই মুহূর্তে ভাইয়া ব্যস্তও থাকতে পারে , কে জানে ! তাই এই চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল ত্রিণা । তারপর একটা দারুন বুদ্ধি আসল মাথায় । মায়ের থেকে এলবামটা নিয়ে আসল ও । এটাতে অনেক ছবি আছে ভাইয়ার । ছোটকালের , বড়কালের সব ছবি আছে । অনেক হাস্যকর আর মজার কিছু মুহূর্তের ছবি আছে । এলবামটা দেখতে দেখতে বুকের উপর নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল ত্রিণা আগামীকাল ঈদ । আজকে ভাইয়া আসবে । কোন ঝামেলা না হলে দুপুর নাগাদ চলে আসার কথা । তারপর ইফতার করবে সবাই মিলে । মনের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে ত্রিণার । কেউ না বলে দিলেও ও জানে ভাইয়া কখনও খালি হাতে আসবে না । কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই । কি হতে পারে ! কি হতে পারে ! চিন্তা করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল খবরই নেই । টনক নড়ল যখন মা এসে বলল ভাইয়াকে একটা ফোন দিতে কোন আপদ-বিপদ হল কিনা , ইফতারের সময় তো প্রায় হয়ে এল ।

আপদ-বিপদ ! কি যে বলে মা মাঝেমাঝে । ভাইয়াকে এখনই একটা ফোন দিলে দুবার রিং পড়ার আগেই রিসিভ করবে সেই মানুষ । এখনই একটা কল দিয়ে মাকে চিন্তা মুক্ত করার জন্য ত্রিণা মোবাইলটা হাতে নিল । তারপর ভাইয়াকে কল দিল । একবার , দুবার , তিনবার , চারবার , এভাবে অনেকবার রিং হল , কিন্তু কেউই রিসিভ করল না । শেষ পর্যন্ত কলটা কেটেই গেল । নিজের কানকে যেন বিশ্বাসই করতে পারল না ত্রিণা । আরেকবার কল করল ভাইয়াকে । আবার বারবার রিং পড়ে কল কেটে গেল , কোন উত্তর এল না একটা শীতল রক্তের স্রোত যেন ত্রিণার শিরদাঁড়া বেয়ে চলে গেল । সারাদিনের রোজায় নাকি অন্যকারণে কে জানে ! গলাটা শুকিয়ে গেল যেন ওর। জীবনে এই প্রথমবারের মত ভাইয়া কল রিসিভ করল না ।

কিন্তু কেন? রাগ করেছে কোন কারণে ? হতে পারে ও চলে যাবার সময় ওকে বিদায় দেয় নি , সেজন্য রাগ করেছে । মা বলেছিল , রাতে ভাইয়া নাকি ওর বিছানার পাশে অনেক্ষণ বসে ছিল । তারপর যাবার আগে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে একটা ছোট চুমু দিয়ে চলে গিয়েছিল । চুমু দিলে ত্রিণা অনেক রাগ করে সেই ছোটকাল থেকেই । একবার নাকি ভাইয়া ওকে জোর করে চুমু দেয়াতে ভাইয়াকে এমনভাবে কামড় দিয়েছিল যে , পুরো রক্তই বের করে ফেলেছিল । যাই হোক , সেদিন ভাইয়ার উপর রাগ হচ্ছিল , কিন্তু এখন কেমন যেন লাগছে । না! ভাইয়ার কিছু হয়নি , এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ত্রিণা । কিছু হতেই পারে না । কিভাবে হবে? কোনভাবেই সম্ভব না ! কোন যুক্তি নেই কিন্তু ভাইয়া ঠিক আছে , এটা অন্তত ত্রিণা নিশ্চিৎ কিছুক্ষণ পর ভাইয়ার নাম্বার থেকেই কল আসল ত্রিণার মোবাইলে । পড়িমরি করে কলটা রিসিভ করেই বলল ,“ভাইয়া”

-“না আমি মিস্টার অমিত না । আপনি কি উনার বোন বলছেন?”
-“জ্বী বলছি”
-“কাইন্ডলি একটু তাড়াতাড়ি মেট্রোপলিটন হসপিটালে আসুন ।”
-“মেট্রোপলিটন হসপিটাল? কেন? ওখানে কেন? আর আমার ভাইয়ার মোবাইল আপনার কাছে কেন?”

কিন্তু ততক্ষণে ওপাশ থেকে কল কেটে দেয়া হয়েছে । কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল ত্রিণা । তারপর এই অবস্থাতেই মাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিল ও । ঠিক কিসের উপর এসেছে জানে না । আসতে খুব বেশি হলে দশ মিনিট লেগেছে । কিন্তু ত্রিণার কাছে এই দশ মিনিট যেন মনে হয়েছে দশ ঘন্টা। যাই হোক , হাসপাতালে গিয়ে মাত্রই লোকটাকে খুঁজে বের করে নিল ত্রিণা । তারপর লোকটা ওকে আর মাকে সাথে করে নিয়ে একটা বিশাল রুমে ঢুকল।

রুমটায় অনেকগুলো মানুষ শুয়ে আছে যাদের উপরে সাদা কাফনের কাপড় দেয়া । ত্রিণা আর মা ওই লোকটার পিছন পিছন হাঁটতে লাগল লাশগুলোর মাঝে । হঠাৎ এক জায়গায় এসে লোকটা থেমে গেল । একটা লাশের সামনে। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবেই উপরের কাপড়টা সরিয়ে নিল । তারপর ত্রিণা আর ওর মাকে ওখানে রেখেই ওখানে থেকে চলে গেল খুব শান্ত অবস্থায় ভাইয়া শুয়ে আছে । একদম একটা ছোট্ট শিশুর মতন । চেহারায় কেমন যেন একধরনের প্রশান্তি । সেখানে নেই কোন চিন্তা , নেই কোন রাগ , নেই কোন ধমক । ভাইয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুব কমই দেখেছে ত্রিণা । বাবা মারা যাবার পর তো ঘুমাতেই দেখে নি ভাইয়াকে বলা যায় । হয়ত ওর আর মায়ের চিন্তায় চিন্তায় ঘুমাতো না ।
কিন্তু এখন কেন এভাবে ঘুমাচ্ছে ? সব চিন্তা শেষ?

হঠাৎ করে চিৎকার করে “ভাইয়া , ভাইয়া” করে ডাকা শুরু করল ত্রিণা । শরীরে যত শক্তি আছে সবটুকু দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে ডাকতে লাগল । কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না । তারপর হঠাৎ মায়ের দিকে চোখ পড়ল ওর । একটা মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে যেন । তারপর পাগলের মত মাকে বলল , “মা, ওমা , ভাইয়াকে একটু ডাকো না , আমার উপর রাগ করে আছে । কথা বলছে না । আমি সরি তো । আর কোনদিন ঘুমাব না । প্রতিদিন জেগে থাকব । ওমা , ডাকো না ভাইয়াকে ”মা নিরব আবার ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করল , “ও ভাইয়া , একবার তাকাও না । সরি বললাম তো । আর করব না । এবারের মত মাফ করে দাও । এই দেখো আমি চুলে ঝুঁটি করেছি । বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাব না । তোমার সব কথা শুনব , একবার তাকাও না ভাইয়া , ভাইয়া , ও ভাইয়া ” অনবরত ডেকে যেতেই থাকল ত্রিণা । কিন্তু ভাইয়ার ঘুম আর ভাঙে না । তারপর দুটো মহিলা এসে ত্রিণা আর ওর মাকে নিয়ে যেতে লাগল । ওরা যেতে চাইল না , তাই জোর করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল ওদের । কিন্তু তারপরেও ত্রিণা ভাইয়াকে ডাকা থামালো না । ডাকতে ডাকতে একসময় গলাটা যেন ধরে এল । চোখদুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসতে থাকল । আবছা চোখে খালি ভাইয়ার প্রাণহীন নিথর দেহটা পড়ে থাকতে দেখল ।

“কিরে দিনের বারটা বাজে , এখনও ঘুমোচ্ছিস , উঠ উঠ , এতোদিন পর ছেলেটা ঘরে আসবে । আর তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস ?” লাফ দিয়ে উঠল ত্রিণা । সাথে সাথেই বুকের উপর থাকা ছবির এলবামটা বিছানার উপর পড়ে গেল । সেখানে একটা ছবি দেখা যাচ্ছে যেখানে ভাইয়া ত্রিণাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুখে একটা অমূল্য হাসি নিয়ে। খুব ঘেমে গেছে ত্রিণা । এরকম উলটোপালটা স্বপ্ন গুলো যে কোথথেকে আসে কে জানে ! যাই হোক , নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল ,“মা ভাইয়া কয়টা নাগাদ পৌঁছবে?”

-“কোন ঝামেলা না হলে একটা নাগাদ”
-“ঝামেলা মানে?”
-“আরে কত ধরনের ঝামেলা আছে না ? ওইসব আরকি !”
-“কিসের ঝামেলা ?”
-“আরেহ পাগলি ! ট্রেন লেট করতে পারে , রাস্তায় জ্যাম পড়তে পারে । এসব ঝামেলা আরকি”
-“ওহ!”

কিছু না বলেই ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেল ত্রিণা ।ত্রিণার হঠাৎ এরকম আচরণে একটু অবাকই হলেন মা । তারপরেও কিছু বললেন না । দুপুর দুটো বেজে পাঁচমিনিট ঘরের একোণা থেকে ওইকোণায় পায়চারী করছে ত্রিণা । সেই একটা থেকে শুরু করে এতোক্ষণ পর্যন্ত প্রায় একশো বারের মত জিজ্ঞেস করেছে মাকে , ভাইয়া কেন আসছে না । উত্তরে মা ভাইয়াকে ফোন দিতে বলে । আর তখনই আবার লাফিয়ে উঠে বলে , না ! ফোন দেয়া যাবে না ।

এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় আড়াইটা বেজে গেল । এখনও ভাইয়ার কোন খোঁজ নেই । এবার মা নিজেই ফোনটা হাতে নিলেন , ভাইয়াকে কল করার জন্য । ত্রিণা আবার লাফিয়ে উঠে মায়ের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল , “আমি করছি” । তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ভাইয়াকে ডায়াল করল রিং পড়তে হয়ত দশ সেকেন্ডের মত সময় লেগেছে , এতোটুকু সময়ের মধ্যেই ত্রিণার হার্টবিট যেন দশগুণ বেড়ে গেছে। একবার রিং পড়ল ,ত্রিণার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেছে ,দ্বিতীয়বার রিং পড়ল ,ত্রিণা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । তৃতীয়বার আর রিং এর অপেক্ষা করল না , মায়ের দিকে তাকিয়ে , “ওমা” বলে আবার ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে মা “কি হয়েছে কি হয়েছে” বলতে পাগল হবার দশা , কিন্তু ত্রিণার মুখে আওয়াজ নেই ।

ঠিক এমন সময়ে দরজা দিয়ে ঢুকলো ভাইয়া । ঢুকেই ত্রিণার দিকে এগিয়ে এসে বলল , “কিরে ফোন দিয়েছিলি ? আমি বাড়ির সামনেই ছিলাম । তাই রিসিভ করিনি , ভাবলাম এখনই তো দেখা হবে ভাইয়া কথা শেষ করার আগেই ত্রিণা যেন লাফ দিয়ে ভাইয়ার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হুহু করে কান্না জুড়ে দিল । একেবারে ছোট বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে ঠিক সেভাবেই যেন কান্না করতে লাগল। ত্রিণার এমন আচরণে ভাইয়া একটু অবাক হলই বটে তারপরেও কিছু বলল না। যেন ভাইয়াও বুঝতে পারল , কলিজাটাকে সাতদিন দূরে রেখে যাওয়াটা ওর মোটেও ভাল কাজ হয়নি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত