আমার বাবা

আমার বাবা

অনেকক্ষণ ধরে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি কোন রিকশা ভ্যান কিচ্ছু নাই। তার উপর ঝুম বৃষ্টি। ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে তোর মায়ের এখন তখন অবস্থা। আমি এক মনে দোয়া ইউনুস পড়ছি।”

এটুকু বলে বাবা দম ফেললেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। এই দৃষ্টির অর্থ- আজকের মত মাফ করা যায়না বাবা?

জন্ম থেকে সহস্রবার নিজের জন্মকাহিনী শুনে শুনে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। কিভাবে মায়ের জন্য রক্ত যোগাড় হল, আমি কত ওজনের ছিলাম, জন্মের সময় আমার গায়ের রঙ কেমন ছিল…… এসব গল্প বলতে বাবা কখনও ক্লান্ত হয়না। একদিন এই বিরক্তিকর কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। বাবা ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমাকে বললেন,

“সে কিরে চিনু! জন্মের পর কিভাবে তোকে কোলে নিলাম সেই কাহিনী না শুনেই ঘুমিয়ে পড়লি যে?”

বাবার মুখে এই চিনু ডাক আমার অসহ্য লাগে। আমার নাম চিত্রা। পুরো নাম চিত্রা মৌমিতা। এত সুন্দর কাব্যিক নামকে বাবা ডাকেন চিনু। কোন মানে হয়?

চিনু ডাকটা শুনলেই মনে হয় কেউ তার পোষা বিড়াল অথবা খরগোশকে ডাকছে। এমনকি আমাদের বাড়ির নামটাও চূড়ান্ত হাস্যকর-“চিনু মহল”। বাবাকে একবার খুব কায়দা করে বলেছিলাম বাড়ির নামটা বদলে দিতে। বাবা বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বললেন, “চিনু মঞ্জিল করে দেই তাহলে,কি বলিস?”

আমার বাবা পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার বেশ কয়েকটা কারখানা আছে। বাবার সেসব কারখানায় জুতার সোল, খুজলির মলম, হাজমোলা এমনকি চিরুনি পেন্সিল এগুলোও বানানো হয়। এবং এসব ব্যবসা করেই আমার বাবা এখন কোটিপতি।

যদিও তার পোশাক আশাক এবং আচরণ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তিনি খদ্দরের জামা পড়ে বাইরে বেরোন। তার প্রিয় খাবার কচুর লতি এবং চ্যাঁপা শুঁটকি ভর্তা। প্রতিদিন দুপুরে বাবা লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে বারান্দায় শুয়ে রোদ পোহান। এই সময় তিনি একটার পর একটা পান খেতে থাকেন এবং সেই পানের রস তার মুখের দুই পাশ থেকে গড়িয়ে পড়ে। মোটামুটি বীভৎস দৃশ্য। আমার বাবা মানুষ হিসেবে মোটামুটি পর্যায়ের বিরক্তিকর হলেও বাবা হিসেবে বোধহয় খুব একটা খারাপ না। ছোটবেলা থেকে আমি কোন কিছু আবদার করেছি, অথচ পাইনি, এমন ঘটনা আজ অব্দি ঘটেনি। আমার বাবা আমার ব্যাপারে খুব আবেগী মানুষ।

ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ঠাণ্ডার সমস্যা। একটু ঠাণ্ডা পানি খেলেই টনসিল ফুলে ভয়ানক অবস্থা। ডাক্তার একসময় আমার ঠাণ্ডা পানি, আইসক্রিম সব কিছু খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। আমার সে কি কান্না এই কথা শুনে… আইসক্রিম আর ঠাণ্ডা পানি খাওয়া না গেলে এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কি লাভ? আমার বাবাও কিন্তু সেই থেকে আজ পর্যন্ত কখনও ঠাণ্ডা পানি অথবা আইসক্রিম খাননি। এমনকি প্রচণ্ড গরমেও না। এসএসসি পরীক্ষার সময় বাবা পুরো তিন ঘণ্টা আমার জন্য হলের বাইরে অপেক্ষা করতেন। আমি বের হলেই পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে আসতেন। আমার বান্ধবীরা সব হাঁ করে তাকিয়ে থাকত আর মুখ টিপে হাসত। আমার ভীষণ বিব্রত লাগত। এত বড় মেয়েকে নিয়ে বাবার এত আদিখ্যেতা দেখলে লোকে তো হাসবেই। যদিও বাবার এসব দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

তিনি এখনও ভাবেন আমি সেই ছোট্টই আছি। আমি একজন খুব ভাল অভিনেত্রীও। আলাদা করে না বললেও চলত অবশ্য, কারণ অভিনয় করার সহজাত ক্ষমতা নিয়েই নারীজাতি এই পৃথিবীতে এসেছে। তারা এই ক্ষমতা দিয়েই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। কখনও নিজের মা বাবা, কখনও স্বামী, কখনও সন্তান আবার কখনও নিজেকে সুখী করার জন্য অভিনয়। আবার কখনও অভিনয় করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায় বলে অভিনয় করে। আমি অবশ্য কখনও কাউকে খুশি করার জন্য অভিনয় করিনা, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অভিনয় করি। যেমন নিজের বাবাকেই কি সুন্দর বিভ্রান্ত করে রেখেছি।

বাবা কখনও বুঝতেই পারেনি তার জন্য কত তীব্র ঘৃণা মনে নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। সবাই বলে আমার বয়স যখন ছয় মাস, তখনই আমার মাকে খুন করে তিনি ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশের কোন মামলা হয়নি, পত্রিকায় কোন খবর আসেনি। আমার নানা বাড়ির লোকেরা হালকা উচ্চবাচ্য করেছিল অবশ্য, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। কতখানি ক্ষমতা আর বুদ্ধি থাকলে এত বড় ব্যাপার এত সহজে সামাল দেয়া সম্ভব? আমার মায়ের মৃত্যু দিবসে বাসায় বিরাট কাঙালিভোজ হয়। আমার বাবা সারাদিন দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। আর আমি সারাদিন পটাশিয়াম সায়ানাইড নিয়ে ঘুরে বেড়াই। যে কোন একদিন এটা খাইয়ে আমি বাবাকে মেরে ফেলবো।

যদিও সাহসের অভাবে আজ পর্যন্ত বাবার খাবারে এই বস্তু মিশিয়ে দিতে পারিনি।

কিন্তু আজকে বাবাকে এই জিনিস খাওয়ানো হবে। আজ আমার আঠারো তম জন্মদিন। আঠারো বছর নাকি ভয় না পাওয়ার, বাধা না মানার বয়স। কোন এক কবি জানি বলেছেন এটা। ধুর ছাই, কবির নাম ভুলে গেছি। যা হোক, কবি তো আর পালিয়ে যাচ্ছেন না। তার নাম পরে দেখে নিলেও চলবে।

“বাবা আসবো?”

“আরে চিনু যে! শুভ জন্মদিন মা! আয় ভেতরে আয়।”
“বাবা, ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আজ আমরা বাইরে খাবো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। ২০ মিনিট অপেক্ষা কর তুই।”

আমার বুক উত্তেজনায় কাঁপছে। আমার হ্যান্ডব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইডের বোতল। খাওয়ার এক পর্যায়ে বাবার খাবারে মিশিয়ে দেয়া হবে। এই প্ল্যান বাসায় করা বিপদজনক। পুলিশের জেরা, হ্যানা ত্যানা কত কি …… কিন্তু কোন রেস্টুরেন্টে করলে ঝামেলা নাই।

যা বোঝার রেস্টুরেন্ট মালিক বুঝুক।

বাবা যেন কিসব কাগজ দেখছিলেন। খুব সম্ভব কোন চিঠি। আমি অন্য কারো চিঠি পেলেই পড়ে ফেলি। কি মারাত্মক বদভ্যাস তাইনা? কিন্তু কেন জানি আমার খুব কৌতূহল হয় এসব ব্যাপারে। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে চিঠিটা হাতে নিলাম।

জাহিদ,

আমাকে মাফ করে দিও। আমি খুব স্বার্থপর তাইনা? সব সময় শুধু নিয়েই গেছি

তোমার কাছ থেকে। বিনিময়ে কিছুই দেইনি কখনও। আর তুমিও বা কেমন মানুষ?

তুমি কি আদৌ মানুষ বল তো? কোন অভিযোগ নেই, প্রত্যাশা নেই… মনে হয় শুধু

আমার জন্যই বেঁচে আছো তুমি। ভার্সিটির প্রথম থেকেই জানতাম তুমি আমাকে

ভালবাসো। শুধু আমি কেন, সবাই জানত। পুরো ক্লাস যেভাবে হাঁ করে তাকিয়ে

থাকতে আমার দিকে! কিন্তু এত গাধা ছিলে কেন? কখনও নিজের মুখে ভালবাসার

কথাটাও বলতে পারলে না। তোমাকে ছেড়ে আনিসের সাথে যখন সম্পর্ক হল আমার,

কিছুই বলোনি কখনও। শুধু তোমার বিষণ্ণ চোখ দুটোর গভীরে তাকালে বোঝা যেত,

সেখানে কি তীব্র বেদনা! কি প্রচণ্ড অভিমান সেখানে!

আনিস যখন চরম প্রতারণা করে আমাকে ছেড়ে চলে গেল, তীব্র ভালবাসায় সর্বস্ব

খোয়ানো একটা মেয়েকে আগলে ছিলে তুমি! ২ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আমাকে

পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করলে, নিজের মা বাবাও তোমার সাথে

সম্পর্ক ত্যাগ করল। কিভাবে পারলে এতোটা করতে আমার জন্য? এ কেমন অদ্ভুত

ভালবাসার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছো তুমি? আর আমিই বা কেমন অদ্ভুত স্বার্থপরতা

নিয়ে জন্মেছি বলোতো? আজ আরেকবার তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। একেবারে না ফেরার

দেশে। জীবনের এত গ্লানি আর বইতে পারছি না আমি। চিত্রার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে না মোটেও।

তোমার মত মানুষকে বাবা হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য যখন ওর হয়েছে, তখন ও

মায়ের অভাব কখনও অনুভব করবে না… একথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

আমি আর পড়তে পারছি না। মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন আমার পুরো পৃথিবী দুলে উঠেছে। মনে হচ্ছে পায়ের নীচ থেকে সব মাটি সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এতোটা বছর আমাকে মমতার মঙ্গলময় ছায়ায় বড় করেছেন এই মানুষটা, নিজের সুখ খুঁজেছেন আমার একটু খানি হাসির মধ্যেমায়ের মত আমারও জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, এ কেমন অদ্ভুত ভালবাসার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছো তুমি বাবা?

আমার আর বাবার বাইরে খাওয়া শেষ হয়েছে।আমরা সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছি। ছোটবেলায় আমি আমার পাঁচ আঙুল একসাথে নিয়ে বাবার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটতাম।আজকেও ঠিক সেভাবেই হাঁটছি-বাবার কড়ে আঙুল

ধরে।বাবা বরাবরের মতই তুমুল আগ্রহে তার প্রিয় গল্প বলা শুরু করেছেন-“তারপর নার্স তোকে একটা তোয়ালেতে পেঁচিয়ে আমার কোলে এনে দিলো বুঝলি? আমি তো বুঝতেই পারছি না কি করব।আমার হাতের মধ্যে এইটুকুন গোলাপি একটা ইঁদুরছানার মত বাচ্চা। ঠিক মত কাঁদতেও পারেনা। কেমন যেন বিড়ালের মত মিউ মিউ করে। কি তুলতুলে! মনে হয় গায়ে কোন হাড্ডি নেই। হাত দুটো মুঠো করা।”

বাবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মুখে অদ্ভুত হাসি। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় কেমন যেন অতিপ্রাকৃত লাগছে দৃশ্যটা।কি মায়াবী মুহূর্ত! আমি ধরা গলায় বললাম,”বাবা, তুমি কি জানো আমি তোমাকে কত ভালবাসি?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত