অধরা আবেগগুলো কবেই যেন জঠরে লুকিয়ে গেছে মানবিক ক্রিয়াপ্রক্রিয়া আর বিচলিত করেনা আত্মাকে অনেক বছর কোনো আপনজনার আঙ্গুলের স্পর্শ থেকে বিরত কতদিন কেউ স্নেহের চুম্বনে বাঁধেনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায় নি
ছাল উঠে যাওয়া ত্বকে ঝুলকালি মাখা কালসিটে গুলো খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে নখের আঁচড় খেতে খেতে ক্ষতগুলো অসাড় উস্কোখুস্কো চুলগুলো যত্নের অভাবে প্রায় শক্ত নারকেলের দড়ির মত কাঁধে ঝুলে পড়েছে চোখ দুটো মৃত কোটর থেকে উকি মারছে
ফাটা গোড়ালি ঘষে ঘষে সারাটা চত্ত্বর ঘুরে বেড়াচ্ছে এই আশায় কোনো দোকান থেকে যদি একটুকরো পাউরুটি এসে পড়ে তার সামনে
কেউ কি জানে তার নাম কি?
তার বাড়ি কোথায়?
তার পরিবারের কেউ কি বেঁচে আছে! থাকলে তারা কোথায়?
এই ব্যস্তবহুল স্টেশনচত্বরে সে এলোই বা কি করে?
সে এরকম কি করে হলো?
না! কেউ জানে না আর কারোর জানবার প্রয়োজনও নেই
সে “পাগলী”, এই নামই তার পরিচয়
সে নিজেও জানেনা সে কে? কোথা থেকে এসেছে, তার পরিবার কোথায়? কে জানে কবে থেকে রাস্তায়- রাস্তায় আস্তাকুড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে জুটেছে, একটা সিমেন্ট বাঁধানো ছাদ পেয়েছে মাথার ওপর আর তারপর থেকে এখানেই পড়ে পড়ে মরার দিন গুনছে
কত তো থাকে এরকম অনাছিষ্টির মানুষজন, ফুটপাতে, বাসস্টপে, স্টেশনে, রেস্তোরাঁর পেছনের গলিতে ডাস্টবিনের পাশে
খাবার খোঁজে তারা
মানুষের পা ধরে ২ টা ট্যাকা চাইতে গেলে বুট এর লাথি খায় পেটে।
তাও চায়
এদের দেখলে মা রা বাচ্চাদের আড়ালে সরিয়ে আনে
এদের কাছাকাছি ঘেঁষতে চায়না খুব একটা কেউ, তথাকথিত মানুষেরা
ওই কিছু কিছু মানবিকতাধারী মানুষকে তাদের দোকান থেকে চা – বিস্কুট ,রুটির টুকরো দিয়ে আসতে দেখেছি,
তারা বোঝে পেটের জ্বালা কি?
অনেক রাত তারাও তো একপেটা খেয়ে শুতে গেছে
অথচ এই পাগল গুলোকেই নিজের রুটির টুকরো ওই শীর্ণ কুকুরটার সাথে ভাগ করে খেতে দেখেছি
এইভাবেই বাঁচতে বাঁচতে একদিন মরে যায় এরা
কেউ মনে রাখেনা ওই কুকুরগুলো ছাড়া।
স্টেশন , বাসস্টপ ,ফুটপাত,আবার কয়েকঘন্টার মধ্যে জনবহুল হয়ে ওঠে।
ট্রেন ৫ ঘণ্টা লেট আছে
স্টেশনে ক্রমে ভিড় বাড়ছে
সবকটা চেয়ার প্রায় ভর্তি
যারা জায়গা পায়নি কাগজ পেতে বা ব্যাগের ওপর বসার জায়গা করে নিয়েছে
কেউ আবার পায়চারি করে যাচ্ছে এখানে-ওখানে
চা – কফির স্টলগুলো ভিড়ে ভিড়াচ্ছন্ন
পাগলী শুয়ে আছে মধ্যিখানে মাটিতে অগোছালোভাবে পায়ের পাতা দুটো মাটিতে রেখে হাঁটু সিলিং এর দিকে
অসংখ্য ছেঁড়া একটা ময়লা শাড়ি কোনরকমে তাকে লোকলজ্জা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে
যার পেটে খাবার নেই তার আবার চক্ষুলজ্জা!
ইতস্তত পা সরাতে গিয়ে কখন শাড়ি টা উঠে এসেছে হাঁটুর ওপরে
তার উন্মুক্ত যোনিদেশ দেখা যাচ্ছে
এতক্ষণ যে পুরুষরা তাকে লক্ষ্য ও করেনি, বা পাশ কাটিয়ে চলে গেছিলো তাদের দৃষ্টি ওদিকেই থেমে গেছে
একদৃষ্টে তাকাতে পারছেনা যদিও, ভদ্র বলে কথা তাও লুকিয়ে চুড়িয়ে চোখ উঠছে নামছে
থামের প্লাগ পয়েন্ট এ মোবাইলে চার্জ দিতে দিতে একটা ১৯-২০ বয়সি ছোকরা বার বার চোখ তুলছে আবার নামিয়ে নিচ্ছে
বসে থাকা মধবয়সি কাকুগুলো এদিকওদিক তাকাচ্ছেন
সামনে সিট এ সবাই বেশ ইতস্তত বোধ করছে
বিশেষ করে সেইসব ভদ্র লোকেরা যারা তাদের পরিবারের সাথে বসে আছেন
এই সেই মানুষগুলো যারা কিছুক্ষন আগে অবধিও ভিক্ষায় সাড়া দেননি
পা ধরতে এলে হ্যাট-হ্যাট করে সরিয়ে দিয়েছেন ঘেন্নায়
এখন তাদেরই এই নোংরা মানুষটাকে দেখে এত উদ্বিগ্নতা!!
তখনই একজন জাঁদরেল বৌমানুষ পাগলিকে একধমক দিল
“ঠিক করে বসো,দেখতে পাচ্ছ না এখানে ভদ্র লোকজন আছে, কি অসভ্য!”
যেন সব দোষ পাগলিই করেছে
গোটা কাপড় না পাওয়া তো তারই দোষ
আচ্ছা এই মানুষগুলো সিনেমাহলে অর্ধনগ্ন নায়িকাদের নাচ দেখে এরকম উক্তি করেন তো!
সবাই হকচকিয়ে উঠলো যেন ধরা পড়ে গেছে এই ভাবে পাগলীর থেকে চোখ সরিয়েছে
পাগলী তার কথা বুঝতে পারলনা
সে উঠে বসলো
এবার তার বুক থেকে একটু কাপড় সরে গেলো
সে ভদ্র-অভদ্র মানুষের তফাৎ জানেনা
কি হয়েছে সে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো
মহিলাটি আবার আঙ্গুল উচিয়ে ইশারা করে চেঁচিয়ে উঠলো “বসো ঠিক করে,শাড়ি নামাও”
পাগলী শাড়ির তফাৎ বোঝে, ওদের টা গোটা, আর তারটা আধখাওয়া ময়লা কোনরকমে টেনেটুনে নামিয়ে বসলো কিছুক্ষন তারপর উঠে গেলো।
সবাই যেন সস্তির নিঃশ্বাস নিল।
৫ ঘণ্টা পর ট্রেন অ্যানাউন্সমেন্ট হলে আস্তে আসতে রাতের স্টেশন খালি হতে থাকলো
দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হলো একে একে
কুকুরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলোর ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে ডাকতে ডাকতে
দূরে ভাসছে সাইরেনের শব্দ
হয়তো এরকম কোনো রাতে পাগলীর যোনি কুড়ে খাবে কোনো মানুষরূপী নেকড়ে
ভ্রুক্ষেপ করবেনা তার ময়লা শরীর,
কোটরের চোখ,চুলের জট
তার আর্তনাদ,
অন্ধকারে তখন সবই সাদা
“পাগলী”রাও মা হয়
৯ মাস গর্ভে বয়ে বেড়ায় আরও এক “পাগলী” কে
কিন্তু তাও তারা পাগলী, মানুষ নয়
সাক্ষী সেইসব গভীর রাতের
থাকবে শুধু পাগলীরা
একফালি ছাদ
আর শহরের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা কিছু অভুক্ত পেট