ভ্যালেন্টাইন্স ডে

ভ্যালেন্টাইন্স ডে

ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে সেজে উঠেছে গোটা শহর।রিয়া আর সুমনের এটা প্রেমের সপ্তম বর্ষ।সাত বছর আগে এই দিনেই ভালোবাসা জানিয়েছিল সুমন রিয়াকে।প্রতি বছরের মত এবারও ওরা দুজন বেরিয়েছে ঘুরতে।ঝলমলে শহরের প্রত্যেকটা দোকান লাল হার্ট শেপ বেলুনে সেজে উঠেছে।প্রত্যেকটা রেস্তোঁরায় রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।রিয়া আজ খুব সুন্দর একটা লাল শাড়িতে সেজেছে।আর সুমন লাল পাঞ্জাবীতে।বছরের এই বিশেষ দিনটায় ওরা শাড়ি আর পাঞ্জাবীতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।রিয়া সুমনের হাত ধরে এক ঝাঁ চকচকে রেস্তোঁরায় ঢুকলো।সুমন রিয়া কে নিয়ে গেল একদম ধারের এক টেবিলে,যেখান থেকে কাঁচের আড়ালে ঝলমলে শহরটাকে দেখা যাচ্ছে।সুমনের চোখের ইশারায় এক বেয়ারা এসে টেবিলের উপর একটা স্ট্রবেরি কেক রাখলো।কেকের উপর লেখা হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে মাই লাভ।একটা মিষ্টি মিউজিক আর মায়াবি নীলচে আলোয় চারিদিকটা মায়াময় হয়ে রয়েছে।রিয়ার মনে পড়ে যাচ্ছে স্কুলবেলার দিন গুলো।কয়েকমুহুর্তের জন্য তারা আজ আর কেউ মাল্টিন্যাশানাল

কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারী নয়, তারা খুব সাধারণ এক প্রেমিক ও প্রেমিকা।একে অপরের চোখের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে, সুমনের গাঢ় পুরুষ্ঠ ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে রিয়ার ঠোঁটের গভীরে।কাঁচের বাইরের শহরটা এগিয়ে চলেছে তার নিজের নিয়মে।

তিতলি তার বাবা মায়ের আদুরে মেয়ে।এইবছর সবে সে ক্লাস ইলেভেনে উঠেছে।ক্লাস টুয়েল্ভের অগ্নীভকে তার বেশ লাগে।সকাল থেকেই তার প্রিয় গোলাপি টেডিটাকে জড়িয়ে ধরে অপেক্ষা করছে কখন অগ্নীভের মেসেজ আসবে।অপেক্ষার অবসান হল বেলা বারোটায়।ফোনে টুং করে মেসেজ ঢুকলো।
“বিকেল পাঁচটায় বুড়ি মা তলার মন্দিরের পিছনে চলে আয়,কথা আছে।আর হ্যাঁ ওই হলুদ চুড়িদারটা পড়ে আসবি কিন্তু।”

তারপর থেকে ঘড়ির কাঁটা আর সরতেই চায় না যেন।বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই তিতলি হলুদ চুড়িদার পড়ে আয়নার সামনে হাজির।চোখে কাজলটা ইচ্ছে করে একটু স্মাজ করে নিলো।এতে নাকি ওকে অনেক মোহময়ী লাগে।ঠিক বিকেল পাঁচটায় মন্দিরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো তিতলি।অগ্নীভ তো এখনও আসেনি!কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফিরে যাবে ঠিক এমন সময় পিছন থেকে কে যেন এক থোকা গোলাপ বাড়িয়ে দিলো।পিছন ফিরে অগ্নীভকে দেখেই লজ্জায় গালদুটো লাল হয়ে গেল তিতলির।অগ্নীভ তিতলির হাতে ফুলগুলো গুঁজে দিয়ে বলল

“উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন ফর এভার?”
তিতলি দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বলল, “ইয়া আই উইল্”।
অগ্নীভ তিতলি চোখ থেকে হাত দুটো নামিয়ে নিলো।দুটো চোখ তখন স্বপ্ন দেখছে এক নতুন ভবিষ্যতের।

রাহুলের সাথে সম্পর্কের পর আজ প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে অর্ণার।আজ সন্ধ্যে ছটায় রাহুলের সাথে তার ফ্ল্যাটে মিট করার কথা অর্ণার।সেখানেই রাহুল বলেছে সেলিব্রেট করবে।অর্ণা বিকেল চারটের আগেই পৌঁছে গেলো রাহুলের ফ্ল্যাটে।রাহুল তখনও ফেরেনি।গত কয়েকদিন ধরেই অর্ণার শরীর টা ভালো যাচ্ছেনা।একটা প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট কিনে এনেছে সে।রাহুলের এখানকার ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি অর্ণার কাছে সবসময় থাকে।অর্ণার কলিগরা তো সবসময় বলে যে অর্ণা খুব লাকি।নইলে মাত্র এই কদিনের সম্পর্কেই কেউ এত দামি দামি গিফ্ট আর ফ্ল্যাটের চাবি পেয়ে যায়!অর্ণার অবশ্য এব্যাপারে একটু প্রাউড ফিলিং ই হয়।সে বুদ্ধিমতি আর সুন্দরী বলেই না এত তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নিতে পেরেছে!ব্যাগ থেকে রাহুলের দেওয়া আই ফোনটা বার করে রাহুলকে ফোন করলো অর্ণা।
-হ্যালো।
-হ্যাঁ অর্ণা বলো।
-কখন আসছো?
-আই অ্যাম অন দ্য ওয়ে বেবি।
-ওকে।
ফোনটা রেখে বাথরুমে ঢুকলো অর্ণা। টেস্ট কিট টা ইউজ করে দেখলো রেজাল্ট পজিটিভ।
“ওহ্ শিট্” বলে মাটিতে বসে পড়ল অর্ণা।যেটা ভয় পাচ্ছিল সেটাই।রাহুল বারবার বলেছিল ডাবল প্রোটেক্শন নিতে।কিন্তু ও ই চায়নি।

কলিং বেল বেজে উঠলো।অর্ণা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে সুইট হার্ট বলে অর্ণার কোমরটা ধরে কাছে টেনে নিলো রাহুল।তারপর গভীর একটা চুমু।অর্ণা বারবার এই মাদকতাতেই হারিয়ে যেতে চায়।অর্ণার হাতে ডায়মন্ড রিং পড়িয়ে দিল রাহুল।ডিনার শেষে রাহুলের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে অর্ণা।দুজনেই সম্পূর্ণ অনাবৃত।অর্ণা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো।
-রাহুল , আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।
-বলো।
-আই অ্যাম প্রেগনেন্ট রাহুল।
-হোয়াট্!! আর ইউ ম্যাড অর্ণা?হাউ ক্যান ইউ বি সো ই-রেসপন্সেবেল!!
-আমি ইরেসপন্সেবেল রাহুল?যা ঘটেছে তাতে কি আমার একার দায়?
অর্ণার চোখে তখন জল।

-আমি কিচ্ছু জানি না অর্ণা।তুমি ইমিডিয়েটলি ডক্টরের কাছে যাবে আর অ্যাবর্ট করাবে।
কথা শেষ করা মাত্রই রাহুল উঠে জামাকাপড় পড়ে বেরিয়ে গেল।যাবার আগে নিজের মানি ব্যাগটা অর্ণার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গেলো।অর্ণা কোনোভাবেই আটকাতে পারলোনা রাহুলকে।রাহুলের দেওয়া হিরের আংটি, আইফোন, দামি পোশাক, জুতো, ব্যাগ, নরম বিছানা সব যেন ব্যাঙ্গ করে হাসছে অর্ণার দিকে তাকিয়ে।সমস্ত আকাশটা যেন ভেঙে পড়ছে অর্ণার মাথার উপর।হাউস কোটটা জড়িয়ে কোনোমতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো অর্ণা।ঠিক পাশেই একটা ছোটো বাড়ির ছাদে টিমটিম করে আলো জ্বলছে।এক সদ্য বিবাহিত স্বামী স্ত্রী একে অপরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সময় কাটাচ্ছে।ছোট একতলা বাড়ি,মেয়েটির পরনের সস্তার শাড়িটা যেন ব্যাঙ্গ করে অর্ণা কে দেখেই হাসছে।অর্ণা তখন কাঁদছে, ডাকতে চাইছে কাউকে।তার ডাক আর কান্নার আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে গভীর আকাশের মাঝে।

শহর থেকে অনেক দূরে পাহারে ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম।দুর্গা সেখানকারই এক মেয়ে।মায়ের সাথে চা বাগানে কাজ করে। কাজের ফাঁকেই সে মাঝে মাঝে চলে যায় পোস্ট অফিসে।খোঁজ নেয় তার নামে কোনো চিঠি এসেছে নাকি।প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে একটা চিঠি পাঠায় লক্ষণ।লক্ষণ তাদের গ্রামের সবচেয়ে ভালো ছেলে।তাদের গ্রামের মধ্যে সে ই একা শহরের কলেজে পড়েছে।দুর্গার অক্ষর পরিচয় আছে।কিন্তু তাকে চিঠি লিখতে শিখিয়েছে লক্ষণ।কলেজ পাশের পর আর্মিতে যোগ দিয়েছিলো লক্ষণ।বছরে একবার বাড়ি আসতো লক্ষণ।তখন দুর্গার সাথে কথা হত।গুলি , বন্দুক, রাইফেল সবকিছুর গল্প শুনে খুব অবাক হত দুর্গা।সারাবছর প্রার্থনা করতো লক্ষণের জন্য।সে আর লক্ষণ ছোটোবেলার খেলার সাথী।লক্ষণের মা এবার ঠিক করে রেখেছেন এবার লক্ষণ ফিরলে তাকে দুর্গার সাথে বিয়েটা দিয়েই দেবেন। দুর্গাও অপেক্ষা করে রয়েছে কবে আসবে লক্ষণ।গতবার যাবার আগে সে বলে গিয়েছিল এবার নাকি তাকে যুদ্ধে যেতে হবে।যুদ্ধ থেকে ফিরে ছুটি পেলে সে বাড়ি আসবে।সারা সপ্তাহ কেটে গেল কোনো চিঠি এলো না।
পরের দিন সকালে যথারীতি চা বাগানে মায়ের সাথে কাজ করছে দুর্গা।হঠাৎ করে দেখতে পেল যে পাহাড়ের ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে আসছে কয়েকটা বড় বড় গাড়ি।এত বড় গাড়ি দুর্গা আগে দেখেনি গ্রামে।গাড়ি গুলো লক্ষণের বাড়ির দিকে যাচ্ছে।তবে কি লক্ষণ এলো? দুর্গার মনে তখন খুশির হাওয়া।চা বাগান থেকে ছুটতে শুরু করলো লক্ষণের বাড়ির দিকে।

পুরো উঠোনে দশ বারো জন মিলিটারি পোশাক পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে।সামনে একটা কফিনের ঢাকনা খুলে দিচ্ছেন একজন আর্মি অফিসার।লক্ষণ শুয়ে আছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়।দুর্গার সমস্ত পৃথিবীটা ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।লক্ষণ যে আর নেই সেটা সে মেনে নিতে পারছেনা।সারা পৃথিবী মেতে উঠেছে ভ্যালেন্টাইন্স উৎসবে আর পাহাড়ের কোলে সেই ছোট্ট এক গ্রামে অন্ধকার ঘরে জানলার ধারে বসে দুর্গা আজও অপেক্ষা করে যে লক্ষণ যুদ্ধে শেষ করেই তার কাছে ফিরে আসবে।

অফিস থেকে ফিরতে আজ একটু বেশিই দেরী হয়ে গেল অনিতার।রাস্তায় বেশ জ্যাম।রাস্তায় সিগন্যালে গাড়িটা আটকাতেই দরজায় টোকা পড়ল।কাঁচ নামিয়ে দেখে একটা বাচ্ছা ছেলে হাতে একগোছা গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে।”নাওনা দিদি, দশটা গোলাপ কুড়ি টাকায় দিয়ে দিচ্ছি”।

অনিতা দেখলো ছেলেটির শতচ্ছিন্ন পোশাক।বোধহয় কিছু খায়ও নি।অনিতা ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে ছেলেটাকে দিয়ে গোলাপ গুলো নিয়ে নিলো।সিগন্যাল পড়তেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে গেল।তার এই সাতাশ বছরের জীবনে সে সিঙ্গল।মা কে নিয়ে সে একাই থাকে।

ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়িটা পার্ক করে গোলাপের থোকাটা নিয়ে সোজা উপরে চলে এলো অনিতা।চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে একগ্লাস জল খেল আগে।তারপর মায়ের জন্য আনা মায়ের প্রিয় কাজু বরফি আর চকোলেটটা প্লেটের উপর সাজিয়ে , অন্যহাতে ফুলগুলো নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকলো অনিতা।খাটের উপর শুয়ে আছেন অনিতার মা সুপ্রিয়া দেবী।বাম দিক প্যারালাইসড্, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না।একমাত্র মেয়ে অনিতাই মায়ের দেখভাল করে।বলা ভালো মা কে নিয়েই তার জগৎ।

“হ্যাপি ভ্যালেনটাইন্স ডে মা” বলে জড়িয়ে ধরলো অনিতা মা কে।দিনের শেষের মায়ের গায়ের এই মায়াবি গন্ধটাই ওকে সব ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়।ফুল গুলো বেডসাইড টেবিলে সাজিয়ে রাখলো অনিতা।চামচ দিয়ে কাজু বরফিটা একটু কেটে খাইয়ে দিলো মা কে।অনিতার জীবনের একমাত্র ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে এখনও অনেক পথ চলতে হবে তাকে।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত