মায়ের হাতে বেডরুমের দক্ষিণের জানলার পর্দাটা সরে যেতেই সকালের স্নিগ্ধ উষ্ণতা এসে স্পর্শ করে স্বপ্নাকে। ও মাকে আদুরে সম্বোধন করে আড়মোড়া ভাঙে অরুণের আলোর অনুভবে। মাও এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। যেন এখনো ছোট্টটি আছে স্বপ্না। এবার ক্লাস টুএলভে উঠবে সে। ফাইনাল চলছে। সকালের জল খাবার খেয়ে সমস্ত স্টাডি মেটেরিয়াল নিয়ে বসতে হবে স্বপ্নাকে। তারপর সারাটা দিন সেগুলোকে এক মনে আঙুল বুলিয়ে ছুঁয়ে চলবে স্বপ্না, ওর মেরিট আর মেমরিকে ভালোভাবে ঝালাতে। ছোটো থেকেই পড়াশুনা বড্ড প্রিয় স্বপ্নার। আরেকটাও প্রিয় কাজ ছিল এক সময় ওর জীবনে। আর সেটাই ছিল ওর মনের ঘরের ভালোবাসার জগৎ। আজ আর তা নেই। তবে মনিদা আশ্বাস দিয়েছে, ওর সেই প্রিয় কাজটি শীঘ্র স্বপ্না আবার করতে পারবে।
ভালোবাসার নাম মনে করতেই, আজকের ডেটটা মনে পড়ল স্বপ্নার। ফেব্রুয়ারি মাসের এইদিনটা যে ভালোবাসাকে নতুন করে রাঙানোর দিন, প্রতিশ্রুতির বিশ্বস্ত বাঁধনে দৃঢ় করে বাঁধার দিন, তাকে শ্রদ্ধাসহ সম্মান জানানোর দিন, নিষ্ঠার সাথে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ভালোরাখার দিন। ভাবতেই একরাশ ভালোবাসার ঘ্রাণ যেন ধূপের গন্ধের মতো ভেসে এলো স্বপ্নার চারিধারের বাতাসে। কানে বাজতে লাগল পিয়ানোর টুংটাং শব্দে প্রেমের গানের কলি। কী অদ্ভুত এক মাদকতা আছে এই সমস্ত অনুভূতি জুড়ে। যেন কল্পনায় স্বর্গীয় সুখে ডুবে যাচ্ছে স্বপ্নার পঞ্চইন্দ্রিয়। আগে এভাবে বুঝতে পারত না স্বপ্না। অবশ্য ওর পক্ষে পারাটাও হয়তো বাকিদের মতো সহজ ছিল না। প্রথম ওর প্রিয় বান্ধবী পৃথার কাছে ওর প্রেমকাহিনী শুনে ও অনুভব করেছিল ‘প্রেম’ শব্দটার গভীরতাকে। শীতের শেষে বসন্তের হাল্কা নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায় ওর মন অনুভব করে সেই শব্দের উপস্থিতিকে। যখন কোকিলের মধুর ডাকে ভরে ওঠে ওদের ফলের বাগানটা, স্বপ্নার মনে হয় প্রকৃতিও ডুবে যেতে চাইছে এই অব্যক্ত সুখে। ওর মনে হয় যেকোনো গভীর ভালোলাগা বা কারোর গভীরভাবে ভালো চাওয়ার স্বার্থবিহীন ইচ্ছার অন্য নামই হল ভালোবাসা। বেশ কয়েকদিন আগে যখন মনিদার কাছে স্বপ্না জেনেছিল এক বৃদ্ধ দম্পতির গল্প, ও তখন একটা কবিতার ছন্দ বলেছিল দাদাকে। মনিদা সেটি শুনে তখন সুদূর বিদেশে বসে সস্নেহে বলছিল, জানিস তো বোন আমি আজ এতো বড় হয়েও যে গভীরতায় পৌঁছতে পারিনি, তোর অনুভূতি সেখানে অবলীলায় সহজ অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
স্বপ্না কৌতুহলে জিজ্ঞেস করেছিল, কোন গভীরতায় দাদা?
মনের ঘরের গভীরতায়। উত্তর দিয়েছিল মণিষ। আরো বলেছিল, আমাদের সবার পঞ্চইন্দ্রিয় থাকে। যেগুলো দিয়ে আমরা ভালোবাসার জগতকে বহিরাগতভাবেই আস্বাদন করতে পারি। কিন্তু এই পাঁচটা ইন্দ্রিয় সজাগ থাকায়, কখনোকখনো অজান্তেই আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মানে সাইকোলজিতে যাকে মন বা মানস জগত বলে, তার অনুভূতিকে হারিয়ে ফেলি বা অবজ্ঞা করি। অথবা হয়তো সে অনুভূতিকে অজান্তেই বিভিন্ন চাওয়াপাওয়ার দাঁড়িপাল্লায় বাটখারার মতো ব্যবহার করে ফেলি। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তোর মধ্যে সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের রাজা হয়ে গভীরে অঙ্কুশ ধরে বসে রয়েছে। তাই অচেনা অদেখা সমস্ত ঘটনাকেই তুই তোর মন দিয়ে অনুভব করতে পারিস। আস্বাদন করতে পারিস তার গভীরতম রূপ রস গন্ধকে।
দাদার কথাগুলোকে সেই মুহূর্তে একটু ভারী মনে হয়েছিল স্বপ্নার। তবু ও বুঝতে পারে কোথাও ওর ভেতরে একটা ইচ্ছার চোরাস্রোত বয়। সে স্রোতের তীব্র জলোচ্ছ্বাস ভালোবাসা শব্দটাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য কেমন যেন আনচান করতে থাকে। আর এও বোঝে স্বপ্না যে যেকোনো গভীর ভালোলাগার মধ্যেই ও তার উপস্থিতি টের পায়। যেমন ও যখন কবিতার ছন্দ গড়ে, তাতে পায় সেই প্রেমের সুবাস। যখন ওর পুরানো আঁকার খাতা রঙ পেন্সিলগুলো স্পর্শ করে, তখন মনের ঘরে পায় সেই গভীর অনুভূতির ছোঁয়া।
তাই এবার যখন দিন সাতেক আগে এসে, পৃথা ওকে বলেছিল কার্ড কিনবে ওর প্রেমিকের জন্য। স্বপ্নাও ঠিক করেছিল পৃথার সাথে গিয়ে অনেকগুলো কার্ড কিনবে। আর ওর কেনা কার্ডগুলোকে পাঠাবে বিভিন্ন ভালোবাসার ঠিকানায়। সে ঠিকানার তালিকায় প্রথমেই থাকবে ফ্র্যান্সিস আর্নেস্ট প্ল্যাটেল ও তার স্ত্রী নরমা জুন প্ল্যাটেলের বাড়ি। যে অস্ট্রেলিয়ান দম্পতির কথা বলেছিল মনিদা। বহুবছর ধরে এলজাইমার রোগে ভুগে শয্যা নিয়েছিলেন নরমা জুন। আর অন্যদিকে ওঁর স্বামী আর্নেস্ট ছিলেন মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু স্ত্রীয়ের মৃত্যুর সময়ে তার হাত ধরে চিরকালীন স্বর্গীয় মিলনে চলে যান ওঁর স্বামীও। আর এইভাবেই ওঁদের সত্তর বছরের ভালোবাসার জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল এই বছরের শুরুতে একই দিনে। তাদের সে ঘরের ঠিকানাতে যে এখনো রয়েছে ভালোবাসার সুবাস। যেমন কোনোস্থানে ধূপ জ্বালানোর পরও অনেকক্ষণ তার গন্ধ সেই বাতায়নে থেকে যায়। ঠিক তেমনই সেই সুবাসের উদ্দেশ্যে পাঠাবে স্বপ্না প্রেমের বার্তা।
আর পাঠাবে স্বপ্নার এক বন্ধুর কাকার বাড়িতে। যে কাকা তার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য নিজের একটি কিডনি ডোনেট করেছেন। মৃত্যুকে দুজনে মিলে হারিয়ে দিয়ে প্রেমের উচ্চ শৃঙ্গে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে পেরেছেন। সেখানে পৌঁছাবে স্বপ্নার পাঠানো ভালোবাসার কার্ড।
পাঠাতে হবে মিনু কাকিমার ঘরেও। যেখানে কাকিমা কাকুর হঠাৎ ধরা পড়া যক্ষ্মারোগকে সারিয়ে কাকুকে সুস্থ করে তুলতে বদ্ধ পরিকর হয়েছেন। শূন্য হতে শুরু করে আজ তিনমাস হল কাকিমা উদয়াস্ত আটটা ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিলি করে বেড়ান শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর থেকে কলেজস্ট্রিট অবধি। কাকিমার সেই ক্লান্তির সুবাসকে আরো উৎসাহ দেবে স্বপ্নার পাঠানো রঙিন কার্ডের বার্তা।
স্বপ্না তার স্কুলের স্যার কুশলবাবুর ঘরেও পাঠাবে একটা কার্ড। তারা যে তাদের সন্তানের প্রতি ভালোবাসার উপরে স্থান দিয়েছে তাদের সন্তানের দেশমাতৃকার প্রতি বৃহৎ ভালোবাসাকে। তাইতো তিরঙ্গা পতাকায় মুড়ে যখন ছেলের কফিনবন্দী দেহটা এসেছিল গতবছর, তখন মা বাবা হয়েও নিজেদের চোখের জলকে আটকে রেখেছিলেন ওঁরা। এও এক ভালোবাসার রূপ। ত্যাগ ও শ্রদ্ধামিশ্রিত এই রূপকেও যে এইদিনে বার্তা পাঠানোটা বড় প্রয়োজন।
আর, গোপনে আরেকটা কার্ড স্বপ্নাকে রাখতে হবে নিজের মা বাবার ঘরে। যাদের একত্রিত ভালোবাসার জোর আজও স্বপ্নার অন্ধকার জগতকে আলো করে রেখেছে। নিজেদের ভালোবাসার ফসলকে আবার তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে যখন বাবা উদয়াস্ত খেটে টাকার জোগাড় করছিলেন। মা তখন নির্দ্বিধায় তার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন নিজের সমস্ত গয়নাকে। সেসময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের ভেজা কণ্ঠের সান্ত্বনা শুনেছিল স্বপ্না।
— এগুলো থাক না। আমি ঠিক করে উঠতে পারব সব।
— নাও না। আমার জীবনে এগুলোর দাম কি তোমাদের চেয়ে বেশি?
অনুভবে ভেজা এ কথাগুলোতেও ছিল ভরপুর ভালোবাসার গন্ধ। এ গন্ধগুলো খুব টানে স্বপ্নাকে। ও একান্তে অনুভব করে, সবরকম ভালোবাসার গন্ধকে। ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও, সবাই একই রকম মুগ্ধকর। যেমন ফুলের বাগানে রজনীগন্ধা, গোলাপ, জুঁই, গন্ধরাজের ভিন্ন ভিন্ন সুবাস থাকে। ঠিক তেমনই প্রেমের বাগানও সেজে থাকে ভালোবাসার বিবিধ রঙের ফুলে। ও রাতে শুয়ে স্বপ্ন দেখে ওর আঁকার খাতায় শুয়ে থাকা রঙিন ছবিগুলোকে। ও জানে, ও বিশ্বাস করে, মনিদার কথা। মনিদা বলেছে, ছোটোবেলায় পরপর টাইফয়েড আর ক্যালকাটা ফিবারে যে দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছিল স্বপ্নার, তা আবার ফিরে পাবে ও। আবার ওই স্বপ্নে দেখা ছবিগুলো জেগে উঠবে ওর মৃত দৃষ্টিপটে। ওর মনের ঘর ততোদিন না হয় বাকিদের ভালোবাসার সুবাস ছুঁয়েই প্রাণবন্ত হয়ে থাকুক।