সীমাবদ্ধ

সীমাবদ্ধ

বসন্তের শীতল বাতাস চারদিকে। আজকে আমার মনে বেশ আনন্দ লাগছে। আনন্দের বিষয়টা অবশ্য বসন্তের বাতাস না। কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসলাম। প্রথম বিয়ে বলে কথা, তাই আনন্দ লাগছে। বউ ঘরের ভিতরে আর আমি বাইরে। ফ্রেন্ডরা অনেক নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিচ্ছে। যেগুলো অতিরিক্ত নিয়ম কানুন শেখাচ্ছে; হালারা একটাও বিবাহিত না। কোত্থেকে যে এসব জ্ঞান আহরণ করে, যাইহোক। কিছুক্ষণ পর ভেতরে ঢুকবো। সবকটাকে কিছু বকশিস দিয়ে বিদায় করলাম। রুমে ঢুকে পাঞ্জাবী খুলে ফ্রেশ হলাম। বউয়ের দিকে মুচকি একটা হাসি দিয়ে এগুতেই পিপুল বলে উঠলো; এই খবরদার একদম কাছে আসবেন না।

বেলুন চুপসে গেলে যেরকমটা হয় আচমকা সেভাবেই আমার মুচকি হাসি চুপসে গেলো। উনার নাম পিপুল, অদ্ভুত নাম না? প্রথম দিন থেকেই এই নামের মানে কেমন জানি ঘটকা লাগতো। আজকে তো একদম ঝটকা লেগে গেলাম। বললাম, এই তুমি এসব কি বলছো? আসবোনা কেনো? পিপুল বলে উঠলো; ভদ্র ভাষায় কথা বলুন। তুমি তুমি করছেন কেন? বিয়ে করে কিনে ফেলেছেন? এবার আর কিছু বললাম না। সিনেমাতে দেখেছি বউরা এরকম করলে একটা বালিশ নিয়ে বরকে হয়তো সোফায় নয়তো ফ্লোরে শুতে হয়। আমিও তাই করতে যাবো এমন সময় পিপুল বললো, আমার কিছু কথা ছিলো আপনাকে শুনতে হবে। এখানে বসেন। কাছেই বসে পরলাম;

– জ্বি বলেন কি বলবেন।
– আমি একজনকে ভালোবাসি। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। আমাকে জোর করে বিয়েটা দেয়া হয়েছে। আমি মানা করলে বাবা মারা যাবে। উনি অসুস্থ, তাই আমি রাজী হয়েছি। রবিনের চাকুরীটা হয়ে গেলে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো। এর আগে আমাকে ছুঁতে আসলে আমি সুইসাইড করে ফেলবো।

একদমে পিপুল এসব বলে ফেললো। ব্যাপারটা সিনেমাটিক ঘটে যাবে ভাবতেই পারিনি। বললাম;
– আচ্ছা যাইহোক, আমি আপনাকে ছুঁবো না। কিন্তু আপনি আপনার বাবা মাকে ব্যাপারটা বুঝাতে পারতেন ভালো করে। অহেতুক আমার জীবনটা এরকম বিভীষিকায় ঠেলে দিলেন ক্যানো? তার চাকুরী ছিলো না এটাই মুখ্য? আমিও তো বেকার ছিলাম। আমিও একজনকে ভালোবাসতাম। আমার পরিবারের কোন আপত্তি ছিলো না তাকে তুলে নিতে ঘরে। বরং আমার বাবা বলেছিলেন বিয়েতে রহমত আছে। তাও যদি তর কপাল খুলে বাপ। বিয়েটা কর, আমরা রাজী।

এই কথা শুনে পিপুল হেসে ফেললো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো;

– দেখেন আমার কিছুই করার নেই। আমি কঠিন মূহুর্তটা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। আর ছেলে জাতি এতো ছ্যাবলা মার্কা হয় এটা প্রেম না করলে জানতাম না। একটা অকর্মণ্যকে আমি ভালোবেসেছিলাম। এতো অলস আমি জীবনে দেখিনি। ভালোবাসার জন্য মানুষ জীবন দেয়। আর ও আমার কাছে আইসা খালি বলতো; পিপুল ডু সামথিং প্লিজ। আই কান্ট লিভ উইথআউট ইউ। অসহ্য লাগতো এসব শুনে। কই নিজে একটা চাকুরী খুঁজে আমার বাপের সামনে দাঁড়াবে, তা না। এমনিতেই আমার বাপ প্রেম ভালোবাসা এসবে বিশ্বাসী না। একশোবার বলছি, কিন্তু দেখেন আর কি করবো আমি বলেন? আর কি করার ছিলো?

-কেমন যেন নিজের গায়ে লাগছিলো কথাগুলো। আমিও একসময় এমনটা ছিলাম। আই মিন এখনো আছি। তাও আমার এখন চাকুরী, টাকা পয়সা সবটার উপস্থিতি আছে। আমি বললাম;

– দেখেন পিপুল, খামোখাই আপনি রবিন সাহেবকে দোষারোপ করছেন। এই আমাকেই দেখেন আমি লাইফে অনেক ফাইট করে এই জায়গায় এসেছি। আমি যাকে ভালোবাসি তার বাপ, মুরুব্বীকে কিছু বললাম না। আরে ভাই মানুষকে সুযোগ দিতে হয়। নিজের সম্পত্তির অভাব নেই। একমাত্র মেয়ে। এসব কি কবরে নিয়ে যাবে? আমি দেখাশুনা করতাম এসব। নাহ্ ভালোবাসা, বেকার এই জাতীয় ছেলের মুখই উনি দেখবেন না। কি হ্যাডম! আসলে মুখ না দেখেই ভালো হয়েছে। আমার চাকুরী হয়েছে। দেখলে হয়তো হতো না। আর আপনি এখন আমার চাকুরীর সাথে সংসার করেন। আপনাকে নিশ্চয়ই আমার চাকুরীটাই দেখে বিয়ে দেয়া হয়েছে? আর আমার ভালোবাসা আপনি চাইলেও কোনদিন পাবেন না। এই দুনিয়ায় ভালোবাসার মূল্য নেই।

এই আপনার মতো মেয়েদের কারণেই আজকে হাজার ভালোবাসার কবর দেয়া হচ্ছে। ছেলেরা একদিন প্রতিষ্ঠিত হয় মনে রাখবেন। আর যারা চাকুরী দেখে লাফিয়ে ভালোবাসার মানুষকে ফেলে অন্যকে বিয়ে করে তারা কোনদিন সুখি হয়না। কেনো জানেন? কারন আজকে যার চাকুরী আছে তার জীবনেও ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে থাকতে পারে এই চাকুরীটা যখন ছিলোনা তখন। আর হারানোর যন্ত্রণা থেকে অনেকেই আর অন্য কাউকে আপন করে নিতে পারে না। টাকায় কতদিন সুখ দিবে বলেন? একসময় সুখ আর সহ্য হবেনা। তখন ভালোবাসা দরকার পরবে। মরিয়া হয়ে ভালোবাসা খুঁজলেও আর সেটা পাওয়া যাবে না। আর আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন মানে? মুখের কথা? ঠ্যাং একেবারে…

পিপুল কখন উঠে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ উপরে তাকিয়ে দেখি পিপুল অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমাকে বললো;
– তুই উঠে দাঁড়া।
– এই! আপনি তুই তুকাড়ি ক্যান করছেন?
– তকে বলছি উঠে দাঁড়া।
– আহা বেডে উঠে দাঁড়ালে মাথায় ফ্যান লেগে যাবে তো। আমি লম্বা আছি।
– তুই নিচেই দাঁড়া।
– আচ্ছা দাঁড়ালাম।

– এতক্ষণ অনেক সহ্য করছি। আর না। দুই দিন আগে এসব বুলি কোথায় ছিলো তর? আমার বাপকে এখন বকতেছিস? আমি যখন বলছিলাম, রবিন কিছু একটা করো আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। তখন তুই কি বলছিলি? আমাকে ভুলে যাও পিপুল। আমি কিছুই করতে পারবো না। এই জীবনে এভাবেই একা থেকে মরবো। তুমি তোমার বাবার পছন্দকে বিয়ে করে সুখি হইয়ো। এসব বলছিলি না? কাঁইদা ভাসায় ফেলছিলি। একটা চাকুরীর জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক রেফারেন্স বের করে দিছি। তুই নিজে চেষ্টা করছিলি? আজকে অন্য কারো হলে আমার দোষ হতো তাইনা? আমি যদি শ্যামল ঘটককে টাকা খাইয়ে বুদ্ধি করে না পাঠাতাম বাবার কাছে তাহলে কি হতো বল? আর চাকুরীটা কপালের জোরে পাইছো বলে এখন ভাব ঝড়তেছে?

– আমি কি এসব বলছি সোনা? তুমি চেতো ক্যান? আমি কিন্তু বলছি চাকুরীটা আমি পেয়ে যাবো পিপুল। তোমার বাপ, আই মিন শ্বশুর আব্বা তো উঠে পরে লেগেছিলেন তোমায় বিয়ে দিয়ে দিতে। আচ্ছা ওসব বাদ আসো এখন আদর করে দেই।

– খবরদার ছুঁবি না।
– তুমি তো কেঁদে ফেলছো একদম। আমিও কেঁদে ফেলবো কিন্তু। দেখো আজকে তুমি পাশে ছিলা বলেই তো আজকে আমরা এই মূহুর্তটা অর্জন করতে পারছি। আর আজকে তুমি এতটুকু না করলে উপরের অভিনীত ঘটনাটাই ঘটতো। বেটা যদি ঘাউড়া টাইপ হতো? পারতে ওকে ছেড়ে আসতে। আর অন্যকে কেনই বা খেসারত দিতে হতো। সম্পর্কটা তোমার আমার ছিলো। এখানে আমাদের মধ্যেই বাউন্ড করে রাখা উচিত। না হলে তিনটা জীবন নষ্ট হতো পিপুল। আমি তোমাকে পাওয়ার জন্যই মন দিয়ে চেষ্টা করে চাকুরীটাও পেয়েছি। তোমার ভরসাটা ছিলো বলেই এটা সম্ভব হয়েছে আমি জানি। দুজনের প্রচেষ্টার অর্জন এটা। আচ্ছা যাও তুমি বেশিটাই করছো। এখন তো কাছে আসো? আমি সরি, অভিনয় করতে গিয়ে একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম আসলে। বিরাট অর্জন বুঝোনা? চাকুরী আর মনের মানুষ দুটো একসাথে পাইছিতো তাই বলে ফেলছি অনেক কিছু।
যদিও মিথ্যা বলিনি (এই কথাটা মনে মনে বলছি)
তারপর পিপুল বললো;

– এই কানে ধরো। তাহলে কাছে আসবো। আর একশোবার বলো আই লাভ ইউ।

হাহাহা বাসর রাতেও কানে ধরতে হয়েছে। আসলে পিপুল আর আমার সম্পর্কটা পাঁচ বছরের। এটাকে পাঁচ জনমের বলতে পারি আমি। পিপুল আমাকে একটা মূহুর্তের জন্য দূরে ঠেলে দেয়নি। অন্তিম মূহুর্তে যখন আমার চাকুরী হচ্ছিল না। পিপুলের বাবা’ও যখন ওকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো, তখনো’ও পিপুল আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলো; রবিন আমি আছি এবং আমি থাকবো। তুমি শুধু একটা কিছু করার চেষ্টা করো। ভেঙ্গে পরো না। পিপুল আমাকে ম্যাথ সলোয়িশান কষে দিতো বসে বসে। মেয়েটার নাম যেমন অদ্ভুত তেমন তার ভালোবাসাটাও ছিলো অদ্ভুত মজবুত। ভাগ্যের সহায় চাকুরীটা বিয়ের পাঁচ দিন আগে হয়ে যায় আর বাকিটা পিপুলের শ্যামল ঘটকের তেলবাজিতে। আসলে ভালোবাসাটাকে শুধু ভালোবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখা উচিত না। তাহলে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। ভালোবাসাটাকে সারাজীবনের জন্য অর্জন করে নেয়ার প্রচেষ্টাটা থাকা দরকার। দুজনের’ই। পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসাগুলো পূর্ণতা পাক। বাসর রাতে বউ ফেলে আর জ্ঞান দিতে পারবো না। গেলাম, বউ বসে আছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত