দুই ব্যাচ সিনিয়র এক বড় ভাই কিছুদিন ধরে আমার পিছুপিছু ঘুরঘুর করছে।কখনো একতোড়া গোলাপ নিয়ে বা,কখনো রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে।আমি তাকে প্রতিবারই যখনই কিছু বলতে যাবো তার আগেই সে তোতলাতে থাকে,ঘামতে থাকে।অবশেষে ফুল-টুল ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে পালায়।
আমার ভার্সিটির সবাই এই ব্যাপারটা জানে।প্রতিবারই সবাই আমাকে বলে, আমি যেনো নিজ উদ্যোগে তার কাছে যাই,তাকে সাহস দেই।কিন্তু, সে আমাকে দেখলেই কোন চিপাচাপায় যে উধাও হয়ে যায় কে জানে!
আমি বিকেলে বারান্দায় এসে বসে থাকলে দেখি,সে ও আমাদের বাড়ির নিচে ঘুরঘুর করছে।আমাদের বাসায় একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর আছে।ওকে দেখামাত্রই সেটা বিকট চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে।একবার ও কুকুর’টাকে শান্ত করার জন্য এক টুকরো টোস্ট বিস্কুট এনে দিয়েছিলো। কুকুর’টা সিদ্ধ মাংস ছাড়া কিছু খায় না।টোস্ট বিস্কুটে কামড় দিতে গিয়ে কুকুর’টা দাঁতে ব্যাথা পেয়েছে।এরপর থেকে ও কে দেখলে মানে ‘শুভ’ কে দেখলে কুকুরটা চিৎকার করে করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।
আমার বান্ধবী নাদিয়া আমাকে বললো-এভাবে হবে না,শুভ ভাই যেই লেভেলের ভীতু,মনে হয় না জীবনেও তোরে প্রপোজ করতে পারবে।
আমিও গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললাম-না করলে নাই,আমারো ঠেকা পড়ে নাই।
-তবে একটা কাজ করা যায়…
-কি কাজ?
-তুই অন্য একটা ছেলের সাথে প্রেমের এক্টিং শুরু কর,তাতে যদি শুভ ভাই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে সাহসী হয়ে প্রপোজ করে!
আইডিয়া’টা মন্দ না।ভার্সিটির এক বন্ধু রে ঠিক করলাম আমার সাথে প্রেম প্রেম এক্টিং টা করার জন্য।সেই ছেলে আবার মহা ফাজিল,যতটা না অভিনয় করতে বলেছি তার থেকে একটু বেশী বেশীই করা শুরু করেছে।
এদিকে,প্রায়ই দেখি শুভ আমার আর ছেলেটাকে দেখে দুঃখী দুঃখী চোখে তাকিয়ে থাকে।আমার বান্ধবী নাদিয়া’কেও জিজ্ঞেস করেছে ইদানীং আমার সাথে যাকে দেখে সে কে!
নাদিয়া একটু অবজ্ঞার কণ্ঠস্বরে বললো-হবু প্রেমিক হবে হয়তো!
শুভ আঁতকে উঠলো।সর্বনাশ!
সেদিন বিকেলেই দেখি শুভ বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে আছে।আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।বাবা আমার রুমে এসে চাপা গলায় বললেন- ‘ইদানীং একটা ছেলেকে দেখি আমাদের বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে,চোর-ডাকাত নাকি!আমাদের টাকা-পয়সা নিয়ে ভাগার মতলব নেই তো!’
আমি বিরক্ত কণ্ঠে বললাম-উফ!বাবা,এত সন্দেহ করার কিছু নাই,কত মানুষই তো আসে,দাঁড়ায়..
বাবা মাথা নাড়তে নাড়তে চাপা গলায় বললেন- নিশ্চয়ই হারামজাদার কু-মতলব আছে।
শুভ সারা বিকেল দাঁড়িয়ে রইলো।সন্ধ্যা নামতে চলে গেলো।ও যেতেই বাবা আমার রুমে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো- হারামজাদা গেছে এতক্ষণে।
আমি নাদিয়া’কে ফোন দিয়ে বললাম-আর এক্টিং করার দরকার নাই আমার,শুভ এখন ডেইলি বিকেলে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা ওকে চোর ভেবে খুব টেনশন করে।
নাদিয়া হাসতে হাসতে বললো-প্রপোজ তো করে নাই।
-ধুর,করুক আস্তে-ধীরে।আপাতত এক্টিং অফ।
পরদিন বিকেলে শুভ আবার বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে রইলো।বাবা অস্থির ভাবে আমার রুমে এসে চাপা গলায় বললো-রিশা!
-হ্যাঁ বাবা?
-ঐ হারামজাদা আবার আসছে।আমার মনে হয় ও প্ল্যান করছে আমাদের খুন করে জিনিসপত্র নিয়ে ভাগার।
আমি হতাশ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এ মানুষটা এবার টেনশনে টেনশনেই না হার্টএট্যাক করে বসে।
পরদিন শুভ’কে গিয়ে বললাম-এই যে!
উনি আমাকে দেখেই দ্রুত চলে যেতে নিচ্ছিলেন,আমি ধমকে বললাম-থামেন!
উনি থামলো।
-কি সমস্যা আপনার?
শুভ তোতলাতে তোতলাতে বললো- ইয়ে.
মা..মানে……কি!
আমি এক ভ্রুঁ উচিয়ে বললাম- প্রতিদিন বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়া থাকেন কেনো?
শুভ ঢোঁক গিলে বললো- কা…কার বাসা?
-জানেন না?
শুভ ঘামতে লাগলো।আস্তে করে বললো- আমি আসলে…
-কি?
-ইয়ে..মানে আপনাকে একটা কথা বলি?
-বলেন…
শুভ কতক্ষণ ইতস্তত করে, কপালের ঘাম মুছে বললো- আপনার কাছে কি ফিজিক্স এর নোট আছে?
-হোয়াট!!
শুভ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালো।এই ছেলেরে দিয়ে এক্সেক্টলি কোনো কিছুই হবে না।
ক’দিন বিকেলে শুভ আর বাসার নিচে আসে নি।প্রায় ১ সপ্তাহ বাদে সে আবার আসলো।ও আসলেই কুকুর’টা বিকট ডাকাডাকি শুরু করে।বাবা কুকুর’টার এই বিকট ডাকাডাকি শুনে আমার কাছে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো- রিশা!ও আসছে?
-কে?
-আরে ঐ হারামজাদা’টা।মনে হয় আজ বাড়ি এট্যাক করবে।
আমি বারান্দায় এসে দেখি শুভ বাসার নিচে দাঁড়িয়ে।ইশারায় বললাম-এখানে কেনো?
ও নিচ থেকে ইশারায় জবাব দিলো- ও আমাকে ভালোবাসে!
আমি মুচকি হেসে ভেতরে এসে ওনাকে ফোন দিলাম।
-শুভ ভাইয়া,বাসার নিচ থেকে চলে যান।বাবা আপনাকে ডাকাত ভাবছে,একটু পর কুকুর টাকে আপনার পেছনে লেলিয়ে দিতে পারে!
শুভ ছুটে পালালো।
এরপর থেকে,প্রতিদিন বিকেলে ও বাসার নিচে আসে,বাবা টেনশনে ঘরময় পায়চারি করে,কখন না ডাকাত এসে ওনার ঘর লুট করে নিয়ে যাবে।
শুভ আমাকে সামনাসামনি কখনো বলে নি সে আমাকে ভালোবাসে। ইশারায় একবারই বলেছে।পরের দিন যখন ওনার দেখা পেলাম,বললাম- সেদিন যেনো ইশারায় কি বলেছিলেন?
শুভ ঢোঁক গিলে বললো-কো…কোনদি
ন?
-ঢং ছাড়েন।
-ও! আচ্ছা,সেদিন?
-হ্যাঁ, সেদিন…
শুভ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো- ফিজিক্স এর নোট কি তোমার কাছে হবে?
আমি দাঁত খিঁচে বললাম-আছে,বাবার কাছে যাইয়েন,একদম ভালো করে বুঝায়া দিবে।
এরপর ক’দিন ভার্সিটি গেলাম না।শুভ একদিন খুব সাহস করে ফোন দিয়ে বললো-আমি কেমন আছি?
আমি মিথ্যে করে বললাম-খুব জ্বর,বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছি না।
ফোনের ওপাশ থেকেই ও উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো-কবে থেকে?
-ক’দিন থেকেই।
অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর শুভ বললো- তোমাকে অনেকদিন দেখি না।
-দেখে কি হবে?
-ইয়ে মানে,ফিজিক্স এর নোট……
খট করে ফোন টা নামিয়ে রাখলাম।চিরাচরিত এক কথা শুনতে শুনতে থ্যাঁতলা হয়ে গেছি।
একদিন ভার্সিটি গিয়ে শুভ’কে বললাম-আমার বিয়ে,কার্ড দিবো কাল।আসবেন কিন্তু শুভ আঁতকে উঠে বললো-কেনো?
-কেনো মানে কি?
-না মানে,এত তাড়াতাড়ি…..
-হ্যাঁ! ইচ্ছে…
শুভ হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো।
আসলে আমার বিয়ে-টিয়ে কিচ্ছু না।ওকে জাস্ট একটু ভড়কে দিলাম।কিন্তু ও একটু বেশীই ভয় পেয়ে গেলো।
এরকিছুদিন পর রাতে,৩ টার দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ফোন কলের আওয়াজে। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি,শুভ কল দিয়েছে।
-হ্যালো! এত রাতে কি?
শুভ ফিসফিস করে বললো-রিশা,তুমি কই?
-কেনো,বাসা-কেনো,বাসায়,ঘুমাচ্ছি।
– তোমার তো কাল বিয়ে হবার ডেট,প্লিজ করো না।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম-করবো তাতে আপনার কি?
শুভ হতাশ কণ্ঠে বললো-আমি তোমাদের বাসার নিচে?
আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম।ঘুম-টুম সব উবে গেলো।
-আমাদের বাসার নিচে? কেনো?
-ইয়ে…মানে,আসছিলাম তোমাকে একটা কথা বলতে।কিন্তু…
-কিন্তু? কি?
-তোমাদের বাসার কুকুর’টা আমাকে দেখে ফেলেছে,যখন পাইপ বেয়ে উঠছিলাম।আমি ওর মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে রেখেছি।ওর পা দু’টো ধরে রেখেছি।তুমি প্লিজ একটু নিচে আসবা? কুকুর’টা আমাকে কামড়ে ধরবে যদি ছাড়ি..
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম-যেমনে ধরে আছেন,ওমনে ধরে রাখেন।একটু পর আমাদের কাজের মেয়ে ওরে সিদ্ধ মাংস খাওয়াতে যাবে, তখন ছাইড়েন…
শুভ গম্ভীর স্বরে বললো- তুমি কি একটু আসবা? পাশের ক্যাকটাস গাছের সাথে কাঁটার খোঁচা লাগছে…
-আপনি না আমাকে কি যেনো একটা কথা বলবেন, যদি বলেন তবে আসবো…
শুভ তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো-আসলে তোমার কাছে কি ফিজিক্স এর নোট হবে?