সুখের বাড়ি

সুখের বাড়ি

আভার যেদিন বিয়ে হয় নাটক,সিনেমার মত সেদিনও আমার চাকরী হয়নি।দেখা যায় মেয়ে কবুল বলার পরপরই ছেলে চাকরী পেয়ে যায়।তখন সেটা আরও কষ্টদায়ক হয়ে যায়।

কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেনি।আমার চাকরী হয়েছিল আভার বিয়ের আরও দু বছর পর।যেদিন আভার প্রথম বাচ্চা হয়।

সুপ্তির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আভার বিয়ের মাস ছয়েক পর। আমার ফুফাতো বোনের বাসায়।একটা দাওয়াত ছিল।সেদিন গেস্ট হিসেবে সুপ্তিও এসেছিল।ওখান থেকেই ওর সাথে পরিচয়।অবশ্য পরিচয়টা শুরু হয় সুপ্তির বাবার থেকেই।লোকটা বেশ মিশুক।একজন ভাল মানুষের যে গুন থাকা দরকার তার সবগুলা গুনই ওনার মাঝে বিদ্যমান।আমাকে যখন ওনার পাশে বসিয়ে বললো,

-তো ইয়াং ম্যান, কোথায় চাকরী করছো?
তখন আমি লোকটার কথায় একটু চুপ করেই রইলাম।বেকারদের এই প্রশ্নটা করলে মন খারাপ হয় নয়তো রাগ উঠে যায়।কিন্তু আমার এসবের কিছুই হলো না।এই একটা কথায় আমি যে অভ্যস্ত।আমার চুপ থাকা দেখে লোকটা বললো,

-বুঝতে পেরেছি।
ভদ্রলোকের কথায় আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কি বুঝতে পেরেছেন?

-তোমার চুপ থাকাটাই বলে দিচ্ছে তোমার পরিচয়।অবশ্য এরকম পরিস্থিতিতে আমাকেও পড়তে হয়েছিল,কিন্তু সেটা থেকে বের হতে পেরেছিলাম।ইনশাআল্লাহ তুমিও পারবে।

-জ্বী হ্যা,দোয়া করবেন।

আমার কথায় লোকটা মুচকি হেসে ওনার মেয়েকে ডাকলেন।অবশ্য সাথে ওনার স্ত্রী ও ছিলেন।সেদিনই সুপ্তির বাবার সুবাদে সুপ্তির সাথে পরিচয়।

এই শীতে একটা কাজ বেশ আরামেই করা যায়।ইন্টার্ভিউ শেষে যখন খালি পকেট নিয়ে হেটে বাসার দিকে রওনা দেই তখন গরমের মত আর ঘামতে হয় না।বেশ আরামেই হেটে আসা যায়।অবশ্য রাতে পা কিছুটা ব্যথা করে কিন্তু ঘামে তো শার্টটার ভিজতে হয় না।আমার পা ব্যথা করলেও শার্টটা আরামেই থাকে।

কিছুদিন হলো ফোনটার ভাইব্রেট কাজ করছে না।তাই সাইলেন্ট করেই রাখতে হয়।বেশ কয়েকবার ডাক্তারও দেখিয়েছি কিন্তু কিছুদিন পর আবারও একই অবস্থা।আজকাল সেই ডাক্তারের দোকানে রোগি নিয়ে গেলে ডাক্তারও বেশ রেগে যান।সেটা হয়তো মুখে প্রকাশ করে না কিন্তু আমি বুঝতে পারি।ভেবেছি চাকরীটা হয়ে গেলে এটাকে আগে পাল্টাবো।

এর জন্যে অবশ্য মাঝে মাঝে সুপ্তিও বেশ রেগে যায়।যখন কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও সাইলেন্ট থাকার কারনে ধরতে পারি না তখন মেয়েটার রাগ আরও বেড়ে যায়।এই যে এসব বলতে বলতেই মেয়েটার ফোন এসে হাজির।অবশ্য ফোনটা যদি এখন আমার হাতে না থাকতো তাহলে ধরতেও পারতাম না আর ওদিকে মেয়েটা রেগে ভাপা পিঠার মত ফুলে যেতো।

আমি ফোনটা ধরতেই সুপ্তি শান্ত গলায় বললো,

-ইন্টার্ভিউ কেমন হলো?
সুপ্তির কথায় আমি কিছু বললাম না।একটু চুপ করেই রইলাম।কাল রাতে যখন সুপ্তির সাথে কথা হয় তখন আমি ওকে বলেছিলাম সামনের দু সপ্তাহ কোন ইন্টার্ভিউ নেই।অবশ্য এই মিথ্যেটা বলতে চাইনি।কিন্তু কি ই বা করার ছিল,প্রতিবার যখন ইন্টার্ভিউ ভাল হয়েও সুপ্তিকে বলি চাকরীটা হয়নি তখন আমার থেকে খারাপ লাগাটা ওরই বেশি লাগে।তাছাড়া এভাবে কতই বা বলা যায়।আমার চুপ থাকা দেখে সুপ্তি আবারও বললো,

-ইন্টার্ভিউ কেমন হলো?
-বরাবরের মতই ভাল।তবে মনে হচ্ছে এবারও হবে না।
-মনে হওয়ার কারনটা কি?

-আমার আগে যে লোকটা বের হয়েছিল তার মুখে বেশ হাসি দেখেছিলাম।শুনলাম ভেতরে নাকি ওনার পরিচিত কেও আছেন।

-খেয়েছো সকালে?
-হ্যা,ওই রফিক ভাইকে দিয়ে হোটেল থেকে ভাত,মাংস আনিয়েছিলাম।সেটা খেয়েই বের হয়েছি।কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে আজ ইন্টার্ভিউ ছিল?

আমার কথায় সুপ্তি একটু চুপ থেকে বললো,

-সকালে তোমাকে ফোনে না পেয়ে তোমার বাসায় গিয়েছিলাম।কিন্তু রফিক চাচা বললো তুমি নাকি আগেই বের হয়ে গেছো।

-আচ্ছা,আর কিছু বলেছে?

-তুমি যেটা আমার থেকে লুকিয়েছ সেটা উনি বেশ ভালভাবেই বলে দিয়েছেন।রফিক চাচার কাছে টাকা দিয়ে এসেছি নিয়ে নিও,আর দুপুরে খেয়ে নিও।

সুপ্তির কথায় আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।এই রফিক মিয়াটাও হয়েছে,সবকিছু বলে দিতে হবে।এই লোকটার কিচ্ছু পেটে থাকে না,সব গড়গড় করে বলে দেয়।অবশ্য বাসার দারওয়ান হলেও লোকটা বেশ ভাল,আমাকে বেশ ভালবাসে।

আমি সুপ্তিকে একটু চুপ থেকে বললাম,
-আচ্ছা বাসায় গিয়ে ফোন দেই।
-হুম,সাবধানে।

আমি ফোনটা রেখে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।এই মেয়েটা সত্যি ই খুব বোকা।বোকা না হলে কেও আমার মত বেকার ছ্যাকা খাওয়া ছেলের সাথে প্রেম করে।আভা চলে যাবার পর সুপ্তি এমনভাবে আমার জীবনে এসেছিল যে মেয়েটাকে আর ফেরাতে পারিনি।একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে।

আজ সকাল থেকেই কেমন যেন মনটা বেশ ভাল ছিল।মনে হচ্ছিলো আজ কোন ভাল কিছু আমার অপেক্ষায় আছে।তাই এখন আর কিছু খেলাম না।খাওয়ার কিছু কপালে থাকলে তখন আয়েস করেই খাওয়া যাবে।অবশ্য খাওয়ার কিছু ছিল ও না বাসায়।আমি রুম থেকে বের হয়ে হাটা দিলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্য।কাল রাতে এক ফ্রেন্ড বলেছিল রক্ত দিতে হবে,রুগী নাকি ওর পরিচিত।পরিচিত না হলেই বা কি,বেকার মানুষকে যে কেও স্মরণ করেছে এটাই বা কম কিসে।

প্রতিবারের মত এবারও রক্ত দেওয়ার পর রুগীকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠলো।যাকে রক্ত দিলাম তাকে যদি দেখতে না পাই তাহলে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগে।তাই আর দেড়ি করলাম না।

আমি যখন রোগীর রুমে গেলাম তখন সবাই সদ্য হওয়া বাচ্চাকে নিয়ে বেশ মাতামাতি শুরু করে দিয়েছেন।আমাকে দেখে একজন এগিয়ে গিয়ে বেডে শুয়ে থাকা রুগীকে আমার দিকে দেখিয়ে বললেন,

-উনিই তোমাকে রক্ত দিয়েছে।
লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে উনিই রোগীর একমাত্র স্বামী।বাবা হওয়াতে হয়তো খুশিটা একটু বেশিই।আমি একটু এগিয়ে রোগীর দিকে তাকালাম।একে মেয়ে বলবো নাকি মহিলা বলবো এসব ভাবতে ভাবতে উনি হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন।হয়তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন বলে।এরকম পরিস্থিতিতে আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার পরেছি।তবে সেই অবস্থায় আমি এগিয়ে গেলেও আজ কেমন যেন যেতে ইচ্ছে করলো না।তাই আর আগানোর চিন্তাটাও মাথায় আসলো না।

আভাকে যে এতদিন পর এভাবে দেখবো আমি ভাবতেও পারিনি।আমি ওর সাথে কথা না বলে চলে আসার সময় ওর চোখের কোনের পানি আমার চোখ এড়ায়নি।কিন্তু আগের মত এখন আর এই পানিটাতে আমি ডুবে যাই না,ডুবে যেতে চাইও না।

এই মুহুর্তে আভাকে ভুলে থাকতে হলে আমার ঘুম দরকার।যেটা চাইলে অসম্ভব কিছু না।বাসায় যাব,ঘুমের ওষুধ খাবো আর ঘুমিয়ে যাব।অবশ্য এর মাঝে সুপ্তি বেশ কয়েকবার ফোন দেবে কিন্তু আমি ধরবো না।বলতে গেলে ধরতে পারবো না।তখন তো আমি ঘুমিয়ে থাকবো।

গেইট দিয়ে ঢুকতেই রফিক চাচা আমার দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে তার চিরচেনা সেই হাসি মাখা মুখে বললেন,

-তুমি বের হয়ে যাওয়ার পরই একজন এসে দিয়ে গেলো।বললো তোমাকে দিতে।

রফিক মিয়ার কথায় আমি কিছু বললাম না।আগে জানা দরকার এই খামটা কিসের।আমি রফিক মিয়ার সামনেই খামটা খুললাম।ভেতরের কাগজটা বের করে আমি একবার চোখ বুলিয়ে রফিক মিয়ার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললাম,

-আজ থেকে আমাকে আর তুমি নয়,স্যার বলে ডাকবেন।এখন আর বেকার নেই,চাকরীটা হয়ে গেছে।বুঝতে পেরেছেন?

আমার কথায় রফিক মিয়া আস্তে করে বললো,

-জ্বী স্যার।
রফিক মিয়ার মুখে জ্বী স্যার শুনে আমার কেমন যেন ভাল লাগলো না।আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
আমি যেরকম ছিলাম সেরকম ই আছি।কোন স্যার নয়,আগের মতই ডাকবেন।
আমার কথায় রফিক মিয়া আবার সেই চিরচেনা হাসি দিয়ে বললেন, জ্বী আচ্ছা।

আমি আর এই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম না।বের হয়ে আসলাম।কেমন যেন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।ঘুরতে ইচ্ছে করছে।আজ সুপ্তিকে নিয়ে ঘুরবো।যাব ওর পছন্দের জায়গায়।এর আগে বেশ কয়েকবার গেলেও আজ যাব নতুন করে।আচ্ছা সুপ্তি কি আমার চাকরীর কথা শুনে খুশি হবে।ও কি আমাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরবে?ধরলে হয়তো মন্দ হবে না।আর মন্দ কাজ সুপ্তি কোনভাবেই করবে না।

আজ আর হাটা দিলাম না।রিক্সা নিলাম।রিক্সা চলছে তার আপন গতিতে।গন্তব্য সুখের বাড়ি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত