“এই আপনি রোজ রোজ ছাদে আসবেন না তো”
কথাটি বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দূরে সরে আসলাম। রাগ লাগে প্রচুর। রাগ লাগারই কথা। কারন আমার নিত্য প্রতিদিনের কাজের মধ্যে সবচাইতে প্রিয় কাজ হলো রোজ সন্ধ্যায় ছাদে এসে অস্ত যাওয়া লাল সূর্যটা প্রান আর চোখ ভরে দেখা। পড়ন্ত বিকেল। সূর্যটা অস্তি যাচ্ছে। চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আর ঘরে ফেরার তাড়নায় পাখিদের যে ব্যস্ত হট্টগোল বাধে তা দেখতে বেশ লাগে। তাই প্রতিদিন ছাদে আমি সন্ধ্যা হবো হবো সময়টাতে আসবোই। কিন্তু এই ছেলেটার জন্য ঠিক মন ভরে এসব উপভোগ করতে পারছি না।
– ছাদে আসলে কি ছাদ ভেঙে পড়ে যাবে? (ছেলেটি)
– জ্বি না। তবে ছাদের পরিবেশ নষ্ট হবে। (আমি)
– ওমা তাই? তো আপনি আসাতে নষ্ট হয় না বুঝি?
– চুপ থাকেন, আর এখান থেকে কেটে পড়েন।
– পারবো না,আর দরকার পড়লে আপনি কাটুন।
– এহ আমাদের ছাদ আমি যতক্ষন ইচ্ছে থাকবো। পারলে আপনি যান।
– আমি তো আপনাদের ছাদে উঠিনি। আমি উঠেছি আশরাফ আংকেলের ছাদে।
– আপনার আশরাফ আংকেলকে মেরে নাকে কালো দাগ বসিয়ে দেবো।
কথাটি শুনে ছেলেটা হো হো করে হাসছে। কিন্তু হাসির কারনটা কি? তখনি মনে পড়ল আশরাফ আমার আব্বুর নাম। ছেলেটার দিকে রাগি চোখে তাকালাম। মাথা ভর্তি একগাদা চুল,চোখে মোটা কাঁচের চশমা। হাসছে সাদা দাঁত বের করে। বিরক্তিতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।
আমার রাগত দৃষ্টিতে ছেলেটাকে ভস্ব করে দেয়ার বেকার চেষ্টা করছি। কিন্তু ছেলেটা হো হো করে হাসছেই। মন চাচ্ছে কষে একটা চড় দিই। কিন্তু আব্বু জানতে পারলে আমাকে ফোন, আর ওয়াইফাই থেকে বঞ্চিত করে দেবে। ছেলেটা হাসি থামিয়ে বললো..
– এই যে মিস নিয়াশ,আর একবার রাগেন তো। রাগলে না আপনাকে বেশ সুন্দর লাগে। ইশশ এ কদিন যে কেনো আপনাকে রাগায়নি।
– ঐ ঐ হুতুম পেঁচা মি. প্রলয়, আমার নাম নিয়াশা। একদম নিয়াশ বলে ডাকবেন না বলে দিলাম। আর একদম চুপ থাকবেন। আমার সাথে ফ্লাট করা হচ্ছে তাই না? আমার দিকে একদমই তাকাবেন না।
– হি.হি..হি আবারো রাগিয়ে দিলাম। আর আমার নাম প্রলয় না, নিলয় বুঝছেন? যান যান এখন এখান থেকে ভাগেন। আমি একাই একটু সন্ধ্যাটা উপভোগ করি। ছাগলের ছ নাম্বান বাচ্চার মত প্যা প্যা কইরেন না।
কথাটি বলেই ছেলেটা ছাদের অন্য কর্ণারে চলে গেল। রাগে আমার চোখ মুখ যেন জ্বলছে। মন চাচ্ছে কান ধরে এখন ছেলেটাকে উঠবস করতে পারলে শান্তি লাগত। অসহ্য ছেলে একটা। একবার তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। ধ্যাত, ছাদ থেকেই চলে যাবো। বান্দর ছেলের সাথে একদমই কথা বলবো না।
সেদিন ভার্সিটি থেকে বাড়িতে আসতেই দেখি বাড়িতে বেশ উৎসব উৎসব ভাব। ঘটানাটা কি তা জানার জন্য চারিদিকে দেখছি তখনি কোথা থেকে এই অচেনা ছেলেটি এসে বলতে থাকে..
– হাই…আমি নিলয়। আপনার নাম তো নিয়াশা। আচ্ছা এত বড় নাম কেনো আপনার? নিয়াশ টাই ছোট নাম। আমি কিন্ত্র নিয়াশা বলে ডাকতে পারবো না।
কথাগুলো বলেই হনহন করে উপরের ঘরের দিকে চলে গেল। আমি হাবার মত বড় বড় চোখে ছেলেটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। রাগে মনে হচ্ছে বাড়ির সব কাঁচের গ্লাস একসাথে করে ছেলেটার মাথায় উইকেট খেলি। কিন্তু তার আগে জানতে হবে ছেলেটা কে?
– এই নিয়াশা,আজ থেকে তোর রুমে নিলয় থাকবে। আর তুই অন্য একটা রুম নিস।
আম্মু আমার মাথায় বাজ ফেলানোর মত কথা বলে গেল। দৌড়ে আমি আমার রুমে আসি। দেখি ছেলেটা পায়ের উপর পা দিয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। সাথে আমার প্রিয় টেডিবিয়ার কে জড়িয়ে ধরে আছে। আমাকে দেখার সাথে সাথে আমার দিকে শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে বললো..
– আরে নিয়াশ যে। তা আপনার কি কোনো জ্ঞান নেই নাকি? একটা ছেলের রুমে ঢোকার আগে তো নক করে ঢুকতে হয় তা জানেন না?
– এইই..আপনার কি কোনো লাজ লজ্বা নেই? সিংগেল একটা মেয়ের রুম অনুমতি ছাড়ায় নিয়ে নিছেন। বেরিয়ে যান বলছি। বিরক্তিকর।
– হিহিহি…. পারবো না। আর লজ্বাগুলো সব আমেরিকাতে রেখে আসছি। এখন আপনি ভাগেন। বিরক্তিকর।
রাগে দুঃখে টিভির রিমোর্ট আঁছাড় মেরে টেডিবিয়ার কেড়ে নিয়ে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছি। আমার রুম আমাকেই বের করে দিয়েছে।
ছেলেটা আব্বুর বন্ধুর ছেলে। খুবিই ক্লোজ ফ্রেন্ড ওনারা। আমেরিকা থেকে কি একটা কাজের জন্য এসেছে আমাদের বাড়ি। আসছে ভালো কথা। কিন্তু আমার রুমটাই দলিল ছাড়া দখল করছে। ধ্যাত বিরক্তিকর।
– এই কফি খাবেন?
ছেলেটা আমার সেকেন্ড রুমে এসে আমাকে কফির মগ বাড়িয়ে কফি খেতে বলছে। কি বিরক্তিকর ছেলেটা। সাতদিন হল আসছে আর আমাকেই জ্বালিয়ে মারছে। বিরক্তিমাখা চাহনি নিয়ে বললাম..
– জ্বি না আপনি খান।
– কেনো খাবেন না?
– এই আপনি যান তো। আমার এ্যাসাইনমেন্ট আছে কাল।
– তাহলে তো জ্বালাতেই হয়।।
– আপনি না একটা..আমি কিন্তু আম্মুকে ডাক দেবো।
– দেন।
– আম্মুউউ….
চিৎকার করে ডাক দিলাম। সাথে সাথেই আব্বু আম্মু দুজনেই হাজির। মনে মনে রাক্ষসরাণী মনি মল্লিকার মত এক ঐতিহাসিক হাসি দিলাম আর বললাম.. এবার কোথায় যাবা চাঁদ? খুব জ্বালিয়েছো বাছাধন। এবার তোমার কান ধরে উঠবস করাবো।
– কি রে ষাঁড়ের বৌ এর মত এভাবে চিল্লানি দিলি ক্যানো? (আম্মু)
– ওহহ আম্মু আমি ষাঁড়ের বউ না,তুমিই ষাঁড়ের বউ।
– ঐ কি বললি? আমি ষাঁড়? (আব্বু)
– সরি..আসলে..হ
– আসলে হয়েছি কি আংকেল আমি ওনাকে বললাম,রাত জেগে পড়বেন যখন কফি খেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ুন ভালো লাগবে। উনি সেটা না শুনে ফোন চাপতে বসে গেল। আমি ফোনটা নিতে যেয়েই আপনাদের ডাক দিল। আমি বলেই ছিলাম পড়ার সময় ফোন কাছে রাখা ঠিক না।
আমি হা হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাগে দুঃখে আমার ইচ্ছে করছে ছেলেটার মাথার সব চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু সেটা করতে পারছি না। সমস্ত রাগ নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম। দেখি আমার দিকে তাকিয়ে রাজ্য জয় করার হাসি হাসছে। উফফ হাসিটা দেখে মনে হচ্ছে দৌড়ে যেয়ে দাঁতের উপরে রোমান রেংকস এর সুপারম্যান পানস দেয়।
– নিয়াশা, তুই না একটা যা তা। দেখে তো শিখতে পারিস। ছেলেটা দেখছিস তো কত ভালো, সবার কত খেয়াল রাখে। (আম্মু)
– এই শেষ চান্স এরপর যদি ফোন সংক্রান্ত কোনো বিষয় দেখেছি বা শুনেছি ফোন কেড়ে নেবো। (আব্বু)
আব্বু কথাগুলো বলে আম্মুকে নিয়ে চলে গেল। আমি কাঁদো কাঁদো চোখে ওনাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। ভেবেছিলাম কি আর হলো টা কি? অসহ্য। সব কিছুর মূলে এই হুতুম পেঁচা ছেলেটা। রাগে সারা শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে।
– হু হু.. কি, মি নিয়াশ ওপপস সরি মিস নিয়াশ কী বুঝলেন? (নিলয়)
– এই আপনি আমার সাথে কথা কথা বলবেন না। ইচ্ছে করছে ধ্যাত যান তো এখান থেকে।
– কাঁদো কাঁদো চোখে আপনাকে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগে। আয়নাতে একবার দেখবেন কিন্তু হুমম?
– আপনাকে খুন করবো।
– পারবেন না, কারন আপনি অনেক খারাপ ভালো একটা মেয়ে।
কথাটি বলেই চোখ মেরে আমার রুম থেকে চলে গেল। আমি হা হয়ে ছেলেটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। রাগের মাত্রা চরমে উঠে গেছে। কফির মগটা জোরে আঁছাড় দিলাম। কি বিরক্তিকর ছেলে।
রাগে কষ্টে আমি আর এ্যসাইনমেন্ট করিনি। পরদিন সকালে ভার্সিটিতে যাবো বলে বের হয়েছি তখনি ছেলেটা আমার সামনে আমার ছোট ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে হাজির। আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এমনিতেই এ্যাসাইনমেন্ট করতে পারিনি। তার উপর কাল রাতের রাগ এখনো কমেনি।
– গুড মর্নিং নিয়াশ।
– আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না বলেছিলাম না? রাগ লাগে খুব।
– আমি তো চাই রাগে আপনি ফুলে উঠুন। যাতে আপনাকে রাগলে সুন্দর লাগে সেটা ভালো করে দেখতে পারি।
– আমাকে দেখলে আপনার চোখ তুলে নেবো।
– কিরে আবার ঝগড়া করছিস? (আব্বু)
– না আংকেল ঝগড়া না। আমি ওনাকে বললাম রিকশাতে না যেয়ে সাইকেল করে চলেন। আমিই পৌছে দিই। কিন্তু উনি বললেন সাইকেলে আমার মত বান্দর ছেলের সাথে যেতে বয়েই গেছে।
– নিয়াশা তুই নিলয়কে এসব বলেছিস? রিকশা পেতে তো রোজই দেরি হয় আর সে যখন বলছে তোকে পৌছে দেবে তো বরং তার সাথেই আজ না হয় যা।
– না আব্বু আমি…
– চুপ, যা বলছি তাই শোন।
কথাটি বলেই আব্বু চলে গেল। উফফ এই ছেলেটা আমাকে জ্বালিয়ে মারবে। এক ট্রাক বিরক্তি আর দুই ট্রেন রাগ নিয়ে ছেলেটার সাইকেলে উঠতে হলো। এত বেয়াদপ মার্কা ছেলে আমি আগে দেখেনি। আর আমার আব্বু আম্মুও হয়েছে এক। এই ছেলেটার সব কথা বিশ্বাস করছে কিন্তু আমার কথা শুনছেই না। অসহ্য।
– এই যে মিস নিয়াশ। (ছেলেটা)
– নিয়াশা। (আমি)
– বড় নাম। নিয়াশই বেষ্ট।
– শয়তান। (আস্তে করে)
– কিছু বললেন?
– জ্বি না।
– আচ্ছা একটা কথা বলেন তো। এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো?
– খুবিই বাজে হতো।
– মোটেও না। আপনার বাধ্যতার মাঝে আটকে থাকা রঙিন হিজাবের ভিতরে থাকা অবাধ্য চুলের ঘ্রাণ আমি সারাটা পথ ফ্রিতে পেতাম। আপনার মাদকতায় ঘেরা অপ্রতিরোধ্য রাগের চাহনি আর শব্দহীন বিস্ফোরিত রাগি রাগি কথাগুলো সারাটা পথ শুনতাম মুগ্ধতায় চুপটি করে। বেশ হতো তাই না?
আমি সাইকেল চালানো নিলয় নামের ছেলেটার কথা শুনে ঠিক কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছি যা রাগ ছিল তা কেন জানি না এক নিমিষেই সব কোথায় উধাও হয়ে গেল। ছেলেটার কথা শুনলে মনেই হয় না বিদেশে থাকত। যত ঝাড়ি দিই ততই চুপ করে শোনে। আস্তে আস্তে ভার্সিটির সামনে চলে আসলাম। ভাবছি বান্ধবিদের বলে ছেলেটাকে বেশ করে কেলাতে হবে।
– এই রাখেন চলে এসেছি। (আমি)
– হুমম।
– ধন্যবাদ।
– ওকে।
– আরে নিয়াশা,আজ এত লেট। (রুমানা)
– হেটে হেটে আসলি নাকি? (নাবিলা)
– নারে এই যে দেখ পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চেপে আসছি। (আমি)
– ওহ তাই? তা ছেলেটা কে? রাজপুত্র নাকি? (নাবিলা)
– হুমম রাজ পুত্রই তো। তবে নাম নিলয়। রাজকুমারীর বর মানে নিয়াশার বর। মানে এখন বয়ফ্রেন্ড পরে বিয়ে করে বর হবো।
কথাটি বলেই ছেলেটা জোরে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। আমি হাদারামের চার নাম্বার বউয়ের মত চুপসে চেয়ে আছি। বান্ধবিদের দিকে তাকাতে পারছি না। জানি সবাই আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে এখন চেয়ে আছে। এই ছেলেটাকে খুন না করা অবদি শান্তি লাগছে না।
– দোস্ত তলে তলে এতদূর? (নাবিলা)
– মানে কী? (আমি)
– মানে আবার জিগাও? তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে আমাদের জানালিও না।
– কিসের বয়ফ্রেন্ড? কার বয়ফ্রেন্ড? (আমি)
– চুপ কর,, তুই এত বড় ভিলেন তা আগে জানতাম না।
– ধ্যাত, কেউ আমার কথা শুনছে না কেনো??
বিরক্তির সীমা পরিসীমা পার করে ভার্সিটিতে আসলাম। একে তো এস্যাইনমেন্ট করিনি তার উপর ছেলেটা এখানে এবং সব জায়গায় গাদ্দারি দেখাচ্ছে।
– এই রুমা তোর এস্যাইনমেন্টা দে একটু কপি করি। (আমি)
– কেনো? (রুমানা)
– রাতে করতে পারিনি। দে তাড়াতাড়ি।
রুমানার থেকে এস্যাইনমেন্ট করার জন্য যখন খাতা খুললাম তখন আমি বেশ চমকে উঠি। কারন যে বিষয়ের উপর এস্যাইনমেন্ট করতে হবে তা অলরেডি করায় আছে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? কাল রাতে তো কেবল এস্যাইনমেন্টের টাইটেল টা উপরে লিখে রাখছিলাম। এটা কে করলো?
– দোস্ত প্রেমে পড়ে সবকিছু ভূলে যেতে বসেছিস? (নাবিলা)
– হুমম হয় হয়,রাত জেগে কথা বললে এস্যাইনমেন্টের কথা তো দুরে থাক নিজের বন্ধুদেরও ভূলে যায়। (রুমানা)
– মানে কি? (আমি)
– দিব্যি এ্যাসাইনমেন্ট করে আনছিস আর এসে কিনা বললি করিস নাই। বাব্বাহ..
কিছুই বললাম না। ক্লাস শেষ করে বাড়িতে আসলাম। আজ আমার এ্যাসাইনমেন্টাই সবচাইতে বেষ্ট হয়েছে। কিন্তু কে করেছে এটা তা জানিনা। ভাবতে ভাবতে সারাটা দিন চলে গেল। তবে মজার ব্যাপার হল সকালের পর ছেলেটাকে আমি আর দেখি নি। চলে গেল নাকি?
বিকেলে যখন ছাদে উঠলাম তখন দেখি নিলয় ছেলেটা গীটার বাজিয়ে গান করছে..
“তুমি আমার অশান্ত বিকেলের নীরব এক চিলতে রোদ।
তুমি আমার প্রথম দেখা ফাগুনের হালকা ঠান্ডা ভোর।
অদেখা রয়েছো তুমি, তবু আছি তোমাতে বিভোর।
আমি হাত বাড়াবো তোমার ছায়াপানে,
তুমি হবে আমার মনের রাজ্যে সোনার মোহর।”
আমি চোখ বড় বড় করে ছেলেটার গান গাওয়ার দিকে চেয়ে আছি। এত সুন্দর করে গীটার বাজিয়ে কেউ গান গায়? আমি অপলক চেয়ে আছি। ছেলেটা আমার দিকে তাকালো। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। ছেলেটা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল..
– সরি।
– কেনো?
– সকালে আপনার বান্ধবিদের সামনে আমার বলা কথাগুলো বলার জন্য।
– ওহ। আপনি তো এমনি। নিজে বেঁচে আমাকে পঁচিয়ে চলেছেন।
– হি হি..তবে চিন্তা নেই আর। আমি কালই চলে যাচ্ছি। আপনাকে আর জ্বালাবো বা পঁচাবো না।
আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলাম খুব। এ ছেলে তবে চলেই যাচ্ছে। যাক বাবা আমি বাঁচলাম হাফ ছেড়ে। অবশ্য একটু ধোলাই না করতে পেরে আফসোস লাগছে। তবুও চলে যাচ্ছে আর নিজে থেকে সরি বলেছে বলে ছেড়ে দিলাম।
– এসাইনমেন্টা নিশ্চয় খারাপ হয়েছে তাই না? তবে চেষ্টা করেছিলাম ভালো ভাবে করার। কিন্তু অনেকদিন আগে সাবজেক্ট শেষ করেছি তো তাই যেমন পারছি তেমন করেই দিয়েছি। আর রাত জেগে করেছিলাম বলে ভূলও হয়েছে হয়ত।
কথাগুলো শোনার পর আমি হা হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম। তার মানে নিলয়ই আমার এসাইনমেন্ট করে রাখছিল। আর সেটাই কিনা সবার থেকে ভালো হয়েছে। আমি সিওর এই ছেলেটা ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। না হলে এভাবে আমাদের মত ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট এরাকম ভাবে পারবে না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম নিলয় চলে যাচ্ছে। আমি কেবল চুপ করেই দেখছি। কেমন যেন লাগছে। তখনি নিলয় থেমে যেয়ে বললো..
– আর একটা কথা, শুধু রাগলে আপনাকে সুন্দরি লাগে না। যখন গভীর ঘুমে আপনি আচ্ছন্ন হয়ে যান তখন আপনার চিকন চুলগুলো আপনার চোখ,মুখ সব ঢেকে দেয় তখন আরো বেশি সুন্দর লাগে। টোল পড়া হাসির দুটো গাল এমনভাবে অন্ধকারকে আলোকিত করছিল যা বলে বোঝাতে পারবো না মিস নিয়াশা। এসাইনমেন্ট এর খাতা আনার সময় দেখেছিলাম আর কি। সরি।
কথাগুলো বলে ছেলেটা হনহন করে চলে গেল। কিন্তু আজব ব্যাপার ওর কথাগুলো শুনে আমার কেনো জানি না রাগ লাগছে না। অনুমতি না নিয়ে একটা মেয়ের রুমে ঢোকা ব্যাপারটা রাগের বটেই কিন্তু রাগ না হয়ে কেমন যেন মনে হচ্ছে। কিন্তু কেনো?
আজ পাঁচদিন হলো ছেলেটা চলে গেছে। প্রথম তিনদিন বেশ মজা পেয়েছি। খুব খুশিই ছিলাম নিজের রুম ফিরে পেয়েছি বলে। কিন্তু শেষের দুইদিন খুব মন খারাপ লাগছে। কয়েকদিনই তো পরিচয় কিন্তু কেনো ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে আমার। বারবার ওর বলে যাওয়া কথাগুলো মনে পড়ছে আমার। অকারনেই ছাদে যেয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটা যে কর্ণারে থাকতো এসে দাঁড়িয়ে সেদিকে চেয়ে থাকছি। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার। আমার এমন পরিবর্তন মানতেই পারছি না। বান্দর একটা ছেলের কথা অকারনেই মনে চলে আসছে। ধ্যাত বিরক্তিকর। চলে যাওয়ার পর কেমর শুন্য শুন্য লাগছে। আর বড় কথা যাওয়ার আগে আমার নামটা সঠিক করে বলে গিয়েছিল।
– এই নিয়াশা,আগামী তিনদিন পর তোর বিয়ে।
সন্ধ্যার পর ছাদে দাঁড়িয়ে শয়তান মার্কা ছেলেটার কথা ভাবছি সেসময় আব্বু এসে কথাটি বললো। আমি চোখ বড় বড় করে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আমার বিয়ের মানে কি?
– আব্বু কি বলছো তুমি এসব? আমার বিয়ে মানে?
– হুমম তোরই তো বিয়ে। ছেলেটা অনেক ভালো। আমাদের বেশ পছন্দ। আর ছেলে নিজেই বলেছে তোকে বিয়ে করতে চাই। সো আমি মনে করি আমাদের মতামত তুমি মেনে নিবে।
কথাগুলো আব্বু কর্কশ গলাতে বলে চলে গেল। আমি ওনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। তারপর রাগের চোটে পাশে থাকা গোলাপ গাছের টবটা আছাড় দিলাম। লাল সূর্যের শেষ ভাগের নির্লিপ্ত সন্ধ্যাঘনের পরিবেশটাকে উদাস হয়ে দেখতে লাগলাম। খুব মন খারাপ লাগছে। কয়েকদিনের অনির্বাচিত পরিচয়ে শয়তান মার্কা ছেলেটার জন্য মন খারাপ লাগছে।
প্রতিদিনের ওর ফাজলামো আমাকে পঁচানো সব ব্যাপারগুলো যেন আমার কাছে এখন ভালো লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু কেনো? ভালোবেসে ফেলেছি নাকি? মানুষের মন আসলেই ছন্নছাড়া। কখন কিভাবে আবেদনময়ী আবেগের স্তুপে চাপা পড়ে কি যে করে বসে কাকে যে ভালোবেসে ফেলে তা মনের মালিকও জানে না। ফাজিল মন একটা। কিন্তু আমি যে এখন কিছুই করতে পারবো না। না আছে ছেলেটার নাম্বার,না আছে ঠিকানা।
কিছু ভালো লাগছে না। কাল আমার বিয়ে। কিন্তু যাকে ভালোবাসছি তার সাথে না। কোন আবুলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে কে জানে? ইচ্ছে করছে সব ভেঙে ফেলি। কিন্তু কিছুই তো করতে পারবো না। একা একা ছাদে এসে এসব ভাবছি তখনি শিহাব আসলো। (আমার ভাই)
– আপু তোকে একটা জিনিস দিতে ভূলে গিয়েছিলাম। নে এটা। নিলয় ভাই তোকে দিতে বলেছিল।
কথাটি বলেই আর দাঁড়ালো না। দৌড়ে চলে গেল। আমি নিলয়ের নামটা শুনে জিনিসটার দিকে তাকালাম। দেখি একটি ছোট্ট কাগজ। ভাজ খুলতেই দেখি সেখানে নাম্বার লেখা। নাম্বার টা দেখার পর চোখ দিয়ে কখন যে পানি পড়ে গেল বুঝতেই পারিনি। সাথে সাথে কল দিলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ। বুকের ভেতরটা কাঁপতে শুরু করেছে। জানি না কি হল আমার কল দিতে দিতে নিচে চলে আসলাম।
এসে দেখি আব্বু আম্মু সহ পরিচিত অনেক লোকজন সোফাতে বসে গল্প করছে। সাথে আরো দুজন বেশ পরিচিত লাগছে। কিছু না ভেবেই কান্না কান্না চোখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম..
“আব্বু আমি এ বিয়ে করতে পারবো না। আমি হুতুম পেঁচা মার্কা শয়তান আর ফাজিল নিলয় ছেলেটাকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে আব্বু। আমি ওকেই চাই আব্বু”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। ভয়ে মাথাটা নিচু করে নিলাম। একটা মেয়ে হয়ে এত বড় সাহসের কাজ করলাম লজ্জার মাথা খেয়ে,ভয় লাগছে এবার। কিন্তু এত সাহস আসলো কোথা থেকে? মনে মনে প্রস্তুত হতে লাগলাম আব্বু আর আম্মুর হাতে থাপ্পড়গুলো খাওয়ার জন্য। ঠিক তখনি সবাই জোরে হেসে উঠল। আমি মুখ তুলে সবার দিকে তাকালাম। দেখি সেই দুজন লোক আর আব্বু বেশি জোরে হাসছে। আমি চোখ বড় বড় করে ওনাদের দিকে তাকালাম। কি হল এটা বোঝার চেষ্টা করছি। আমি কি হাসির কথা বললাম নাকি?
– আরে পাগলি মেয়ে নিলয়ের সাথেই তো তোর বিয়ে হচ্ছে। আর এনারাই তো তোর সাদাফ আংকেল মানে নিলয়ের আব্বু আর আম্মু।
আব্বুর কথা শুনে হা হয়ে গেলাম। সে কারনেই ওনাদেরকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। তারমানে নিলয় সাদাফ আংকেলের ছেলে। যখন গ্রামে থাকতাম একবার নিলয় সহ এনারা বেড়াতে আসছিল। তখন আমি মাত্র বড় ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। নিলয় তখন ফোরে পড়ত। আমার এখনো মনে আছে দুজন আমার দাদুর থেকে জিলাপি খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছিলাম। তখনি নিলয়ের হাতে আমার দাঁত লেগে সামনের দাঁত একটা পড়ে যায়। আমি কি কান্নাটাই না করেছিলাম। কিন্তু নিলয় অনেক হেসেছিল আর বলছিল
“দাঁত বুকড়ি কাঁকড়া খাবি?”
এই সেই নিলয় কত বড় হয়ে গেছে। ওনারা চলে আসে তারপর। এরপর আর কখনই দেখা হয়নি এনাদের সাথে। কি গাধি আমি সবার সামনে এসে ধায় ধায় করে নিলয়কে ভালোবাসি কথাটি বলে দিলাম। ধুররর।
– নিলয় বাইরে আসো এবার। (আম্মু)
আম্মুর কথা শেষ হতেই দেখি নিলয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কেবল হা হয়েই সব দেখছি। লজ্জাতে মনে চাচ্ছে উড়ে চলে যায়। ইসস যদি ডানা থাকতো দুটো। কোন হারামি ছেলেগুলো বলেছিল সুন্দরী মেয়েরা পরিদের মত ডানা থাকে। কিন্তু আমার ডানা যে কই গেল? আমি তো যথেষ্ট সুন্দরি।
আমি বসে আছি বাসর ঘরে। আমারিই রুমটা আজ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঠিক বেডের মাঝখানে বসে আছি। কিন্তু বসে কেনো আছি আমি? শুয়েও তো থাকতে পারি। কিন্তু কোন ফইন্নি মহিলা যে শুয়ে না থাকার নিয়ম বের করছিল কে যানে? শুয়ে শুয়ে ঘুমায় যাবো। আহা কত মজা।
হুতুম পেঁচাটার জন্য বসে থাকতে হচ্ছে। ধুরর ঘুম পাচ্ছে আমার। টেডি বিয়ারটা জড়িয়ে নিয়ে বসে আছি। ছেলেটা আমাদের বাড়িতেই ছিল আর আমি তাকে খুজেই পায়নি। ধুরর সব আব্বুর দোষ এত বড় বাড়ি করেছিল কেন? অবশ্য বিরহের টানে রুম থেকে বেরই হয়নি।
– এই যে নিয়াশ সাহেবান।
হঠাৎ চমকে উঠি। কারন নিলয় আমার পাশে এসে কখন যে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। তবে আমাকে নিয়াশ বলেছে আমার রাগ লাগছে না কেনো? হুরর রাগ লাগবে কেনে? ভালোবাসার উপর রাগ করে নাকি কেও। আচ্ছা উনি কি আমাকে ভালোবাসে? শুনতে হবে। যদি না বলে টেডি বিয়ার ঝড় চালাবো ওর উপর।
– কেমন আছেন? (ও)
– ভালো আপনি?
– ভালো তবে টেনশনে আছি।
– কিসের?
– এখন থেকে আপনাকে রাগালে আমার কি কি অবস্থা হবে সেসব। যে রাগি আপনি ভাবা যায়? অবশ্য রাগলে আপনাকে ফুলকপির মত বেগুন লাগে।
– হি হি হি… রাগবোই না আর।
ছেলেটার কথা শুনে হাসতেই ইচ্ছে করছে। আমি ঘোমটার ফাক দিয়ে বেশ দেখতে পারছি আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও।
– তাই? ভাবছি কাল থেকে আপনাকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাবো। না করলে চুলির মুঠি ধরে পিটাবো কেমন?
– কিহহ,,মেরে আপনার নাক ফাটাবো (কথাটি ঘোমটা তুলে রেগেই বললাম)
– তাই না? দেখি কে কার নাক ফাটায়।
কথাটি বলে ও লাইট অফ করে দিল। আমি ভয়ে বললাম “এই লাইট অফ করলেন কেনো?”
আর কোনো কথা শোনা গেল না। কেবল অনুধাবন করলাম সামনে বসা মানুষটি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিল তার বুকে।
———‘(সমাপ্ত)’——–